৩১শে জানুয়ারী, আমি আজ থেকে পূর্ণ অবসরে। সচিব হিসাবে পিআরএল এ সরকারী গাড়ি ছিল। গাড়িটা সরকারী পুলে জমা দিলাম।পেনশন পেপার জমা দেয়ার জন্য পরিবহন পুল থেকে একটা অনাপত্তি পত্র লাগবে। পরিবহন পুলের কমিশনারের সাথে দেখা করলাম। তিনি সদয় হয়ে একদিনেই অনাপত্তি পত্রটি দিলেন। পেনশন পেপার তৈরি করা ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় থেকে সরকারি আদেশ জারির জন্য পাঠানো হয়েছে।১৫ দিন পার হয়ে গেছে। কোন খবর নাই। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব এর সঙ্গে দেখা করলাম। পেনশন পেপারটা তার দপ্তরেই আছে। তিনি খুব ভাল ব্যবহার করলেন। কথা দিলেন;
“স্যার এ জন্য আপনার আসা লাগবেনা। ১৫ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যান। আমি আপনাকে জানাবো”।
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। পিআরএল এ থাকা অবস্থা থেকেই ঘরে বসে বসে সময় কাটে। মাঝে মধ্যে সচিবালয়ে পরিচিত জনের কাছে যাই। সবাই ব্যস্ত। তার মাঝে কথা বার্তা বলে সময় কাটাচ্ছিলাম। বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আওলাদ হোসেন এর রুমে গিয়ে বসি। শান্তি একটাই এখনও এখানকার সবাই ইজ্জত করে। তারা সবাই কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাজা উজির মারি। ভালোই লাগে। তাই বলেতো প্রতিদিন যাওয়া যায় না। একদিন না একদিন তারাও বিরক্ত হবে। তাদের বিরক্তির কারন হয়ে কি লাভ। আর চাইলেও প্রতিদিন সিএনজি করে কলাবাগান থেকে সচিবালয় যেতে মন চায় না। জীবনের বিশাল একটা সময় সরকারী সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করেছি। শরীরটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যাওয়া আসার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিএনজি এর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না।তার উপরে সিএনজিতে উঠলে জানুয়ারির শীতের বাতাস ধুলাবালি সহ্য করতে পারি না। ঠাণ্ডা,সর্দি কাশি লেগে যায়। সরকারের সর্বোচ্চ পদে থেকে ঢাকায় বাড়ি গাড়ী না থাকা অভিশাপ। অবসর জীবন আমার অভিশপ্ত সময়।
পরিচিত লোকজন কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করে;
-“স্যার অবসরে সবাইতো কিছু করে। আপনি কেন কিছু করেন না। কিছু করেন স্যার। না করলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন”।
কোন জবাব দিতে পারি না। কোন জবাব আমার জানা নাই। মনে মনে নিজেকে বলি;
‘আমি অপদার্থ, তাই কোন কিছু জোটাতে পারি না’
কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকি। তাদের কথা গুলো তো ঠিক। বাসায় বসে থাকি। পিআরএল এর প্রথম দিকে রাস্তায় বাহির হতাম। রাস্তা দিয়ে ছোট বড় নানান জাতের গাড়ি ঘোড়া চলছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলোতে মানুষ বাঁদুর ঝোলা ঝুলছে। রাস্তা পার হচ্ছে। আমার সাহসে কুলায় না। ঠাই দাড়িয়ে থাকি। এ ভাবে কতক্ষন, এক সময় ঘরে ফিরে আসি। টিভিটা অন করে একটার পর একটা চ্যানেল বদলাতে থাকি।
মাঝে মাঝে ছেলে বউ জিজ্ঞাসা করে,
-“ কি করছো ?”
-“ টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছি”।
জবাব দিয়ে পুনরায় চ্যানেল বদলাতে থাকি। এ কাজ করতে করতে চ্যানেল বদলানোর একটা নব নষ্ট করে ফেলেছি। এখন চ্যানেল গুলোতে কখনো উপরে কখনো নিচে করতে পারি না। শুধু কমাতে পারি। তাই করতে থাকি। বিরক্তি ধরে যায়। টিভি বন্ধ করে আইপ্যাডটা নিয়ে বসি। নেটে ব্রাউজ করি। কখনো ফেসবুক, কখনো অনলাইন পত্রিকা, নেটের আর্টিকেল একটাও ভাল লাগে না।
অবসর জীবনের প্রতিদিনের গুমোট, আস্তে আস্তে একটা বিরাট পাথর হয়ে বুকে চেপে বসলো। এলপিআর এর মাঝ পথে, শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। বউ বলছে,
-ডাক্তারের কাছে যাও। দেখাও, চেক আপ কর। তা না হলে কবে একেবারে বিছানায় পড়ে যাবে। যাবো যাচ্ছি করেও যাওয়া হয় না। একদিন কলাবাগানের ভাড়া বাসার সামনের মুদি দোকানের মালিক বললেন;
-“স্যার আপনার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে,ডাক্তার দেখান”।
আর অবহেলা করতে পারলাম না। স্কয়ার হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে শুয়ে পড়তে হলো। সাবেক সচিব ওয়ার্ড এ থাকি কি করে। কেবিনে উঠলাম দু’দিন থেকে বিলের পরিমান শুনে স্বেচ্ছায় বিদায় নিলাম। ও কথা আপনাদের বলেছি ‘জীবন’ প্রসঙ্গে। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিবের দেয়া কথা, ১৫ দিন অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা সিরাজকে টেলিফোন করলাম। সিরাজ জানালেন;
-“অনেক দিন তো হয়ে গেল স্যার। আজও কিছু পাইনি। আপনি নিজে একটু খবর নিবেন স্যার”।
২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি থেকে বিরোধী দলের ডাকে অবরোধ চলছে। এর মাঝে হরতাল।এখানে সেখানে ককটেল ফুটছে,পেট্রোল বোমায় গাড়ী জ্বলছে, পুড়ে মরছে মানুষ। রাস্তায় বাহির হতে সাহস হয় না। তারপরও বাহির হলাম। ঢাকার রাস্তায় গাড়ী ঘোড়ার অভাব নাই। এর মাঝে সব কিছুই চলছে। একটা সিএনজি নিয়ে জনপ্রশাশনে হুমায়ুনের দপ্তরে হাজির হলাম। সে জানালো;
-“ স্যার আপনার পেনশন পেপারের সাথে আবাসন পরিদপ্তরের অনাপত্তি পত্র নাই। ওটা ছাড়া পেনশন পেপার প্রসেস করতে পারছি না”।