স্বাধীনতার ৪৪ বছর উদযাপন করছি। কয়েক বছর পর আমরা সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবো। স্বাধীনতা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। স্বাধীনতা আমাদেরকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী, সচিব করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক করলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। কে চায় নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে। স্বাধীনতা নিয়ে কোন বিতর্ক না থাকলেও স্বাধীনতার নানা অনুসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক চলছে। একদল বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ বলে চলছেন, “ মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে।” অন্য দল রিরি করছেন বিতর্কের কথা শুনে। পালটা আক্রমন করছেন। কিন্তু কোন সমাধান কেউ দিচ্ছেন না।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, রাজাকারের আলবদর আলশামস, শান্তি বাহিনীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। এদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নাই। আমরা গোড়াতেই ভুল করেছি। কোন সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করিনি। কেন করিনি আজ তা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
পরিসংখ্যান তৈরী করতে হলে শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, আলবদর-আলসামস, শান্তি বাহিনীর সংগা ঠিক করা প্রয়োজন ছিল। কে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ? একদল বলছেন;
‘-যারা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে মারা গেছেন তারাই মুক্তিযুদ্ধের শহীদ’।
অন্যদল বলছেন;
‘-এরা বলেকি? এরা তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনী, তাদের সহযোগী হায়েনা রাজাকার, আলবদররা শতশত মানুষ, বুদ্ধিজীবিকে মেরে ফেলেছে – তারা কি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ নয়?’
বিতর্ক চলছে।
- কত জনকে পাক বাহিনী মেরে ফেলেছে? রাজাকার কতজনকে মেরেছে? ইত্যাদি-ইত্যাদি।
মেরেছে তার প্রমাণ শতশত বধ্যভূমি, গণকবর- সেখানকার লাশের স্তুপ, হাড়গোড় কংকাল। বধ্যভূমি, গণকবর ছাড়াও শতশত লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সারাদেশে। কিন্তু সংখ্যাটা কত? এতা কি ৩০ লক্ষ না কম বা তার চেয়েও বেশী। সত্যিকারের পরিসংখ্যান নাই, তাই আমরা এ নিয়ে বিতর্ক করতে পারি, কোন সমাধানে পৌছাতে পারি না। তাই বিতর্ক চলছে।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার একটা গ্রাম হাটপাড়া। হাটপাড়ার দিলদার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁর স্মরণে প্রতিবছর আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। কয়েকটি আলোচনা সভায় আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। আলোচকদের দাবী,
“দিলদার গোদাগাড়ী ইঊনিয়নের একমাত্র স্বাধীনতা শহীদ। তাঁর স্মরণে সরকার আজও তেমন কিছু করেনি”। মহসিন পাড়ার এক মজুর গোছের লোক, অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো;
-“অ্যারা কি বুলছে রে বাবা। মুক্তিযুদ্ধে এ ইঊনিয়নের শুধু দিলদার মারা গেছে। ঘোষের বেটি শান্তিকে যখন ধইরা ক্যাম্পে মিলিটারিরা লিয়া যাচ্ছিল তখন ওর ভাই বাধা দিলো। মিলিটারি – ভগবান না কি নাম ঐ ছুড়াটাকে রাস্তার উপর গুলি কইর্যা ম্যার্যা ফেললো। ছুড়াটা স্বাধীনতা যুদ্ধের ল্যাগা মারা যায়নি?”
জবাবে বললাম,
-মহসিন ভাই। পাকিস্তানি মিলিটারি ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ গোদাগাড়ী ছাড়লো। সে দিনই শান্তি ছাড়া পেল। পাগল হয়ে গেছে। কয়েকদিন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। একদিন কোথায় হারিয়ে গেল। কতদিন পরে ঘোষ কাকাও মারা গেলেন। তাদের কথা কে বলবে?
শুনে মহসিন ভাই বললো;
-“ সবাই নিজের লাইগ্যা, যুদ্ধের কথা বলে- নিজের কথা কয়”।
বলেই হাঁটা শুরু করলো। আমিও বাড়ির পথ ধরেছি, হাঁটছি আর ভাবছি;
-“ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার দাবী করছে, দিলদার এ ইঊনিয়নের একমাত্র স্বাধীনতার শহীদ। যদি তাই হয় তা হলে স্বাধীনতার শহীদ ৩০লক্ষ সংখ্যাটা বেশী হয়ে যাবে”।
দিলদারের পরিবারের কথা ঠিক হলে ভগবান, শান্তি এরা স্বাধীনতার শহীদ নন।
এসব চিন্তা করলে মাথাটা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৭১ এর এক একটা দিন। কেল্লাবারইপাড়া গোদাগাড়ীর পদ্মা পাড়ের একটা গ্রাম। গ্রামের ৫-৭ জন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নদী পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের লালগোলা গেছে। লোকজন কানাঘুষা শুরু করেছে কেল্লাবারইপাড়ায় মুক্তিবাহিনী এসেছে। কখন এসেছে কখন বিদায় নিয়েছে কেউ জানেনা। পরের দিন গভীর রাতে পাকবাহিনী কেল্লাবারইপাড়া ঘিরে ফেললো। খবর শুনে পাড়ার এরফান শেখ, আর ফজলু মিয়া হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। ভোরের আলোয় মুক্তিবাহিনীর খোঁজে মিলিটারি গ্রামটাকে তচনচ করে ফেললো। কোথাও তাঁদের চিহ্ন নেই। রাতেই গাঁয়ের জোয়ান পোলাপান ফাকফোঁকর খুজে পদ্মায় ঝাপ দিয়ে পালিয়েছে। গাঁয়ে পড়ে রয়েছে বুড়া, মহিলা আর বাচ্চাকাচ্চা। মুক্তিদের না পেয়ে পাকহানাদাররা দুজন বুড়ো মানুষকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাখুচি করে মোসলেমের আট বছরের ছোট ভাইটাকে বাড়ির বাহিরে কান্টায় গুলি করে মেরে ফেললো। অপরাধ মোসলেম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে গেছে।
বেলা গড়িয়ে দুপুর। শুক্রবার জুম্মার দিন। আলতাব পালোয়ান আলবদর নেতা। পাকিস্তানি আর্মিকে খবর দিলো মুক্তিরা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে। যেই শোনা সেই কাজ। নামাজ শুরু হয়ে গেছে। সাধারন বুড়োগুলো ভয়ে বাড়িতে। মসজিদে আসেনি। ইমাম সাহেব তিনজন মুসল্লি নিয়ে নামাজ পড়াচ্ছেন। একজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া ব্রাশফায়ার করলো। ইমাম সহ তিনজন মুসল্লি মসজিদে লুটিয়ে পড়লেন। রক্তে মসজিদের ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে।
সপ্তাহ খানেক পর জানলাম,কেল্লাবারইপাড়ার বেয়নেট খোঁচানো বুড়ো দু’জন মারা গেছেন। দেশ স্বাধীন হলো, শরণার্থীরা ফিরে আসছে। সেই রাতে পদ্মায় ঝাপ দেয়া লোকজনও ফিরে এলেন। ১২ জন ফিরলেন না। তাদের পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার, আলবদর কেউ মারেনি। হয়তো তাঁদের লাশ মাছের পেটে গেছে।
অস্ত্র হাতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চায়ের দোকানে আড্ডা চলছে। পালোয়ান তার দলবল নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। হঠাৎ খবর এলো পালোয়ান ধরা পড়েছে। এ কদিন একটা বাড়ির কোঠায় লুকিয়ে ছিলো। মোসলেম কোন কথা না বলে স্টেনগানটা চায়ের টেবিল থেকে তুলে ভাল করে দেখে নিলো। দাঁড়িয়ে কাঁধে স্টেনগানটা ঝুলিয়ে বলল, “আসি রে বাড়িতে কাজ আছে”।
বিকালে চায়ের আড্ডায় খবর পেলাম, মোসলেম পালোয়ানের বুক ঝাঁজরা করে দিয়েছে।
এলোপাথাড়ি ভাবতে ভাবতে বাড়ির পাশে এসে পরেছি। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, “হার্ট অ্যাটাক এ মারা যাওয়া এরফান শেখ, বজলু মিয়া, বেয়নেট খোঁচানো ২ জন, সেই রাতে পদ্মায় ঝাপ দেয়া না ফেরা ১২ জন - এরা কি স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ নন?”
বুকের ভেতর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসলো। এরা সবাই স্বাধীনতার শহীদ। এদের রক্ততে আমাদের স্বাধীনতা । ভাবছি কেল্লাবারইপাড়া আটষট্টি হাজার গ্রামের একটা। অন্য গ্রাম গুলোর অবস্থাও কেল্লাবারইপাড়ার চেয়ে ভাল ছিল না। কেল্লাবারইপাড়াকে দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে দেখলে, স্বাধীনটার শহীদ ৩০ লক্ষ, সংখ্যাটা কেন জানি কম মনে হয়। ২০০২ সালের দিকের কথা।
চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকি। মা গ্রামে থাকেন। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখতে গ্রামে যাই। গ্রামে গেলে চায়ের আড্ডায় না যেয়ে পারিনা।
বিকালে আড্ডায় বসে আছি। বাদরু ভাই নাম করা মুক্তিযোদ্ধা, আড্ডায় যোগ দিলেন। চা খাচ্ছি, বাদরু ভাই বললো, “জানিস গোদাগাড়ী পৌরসভার মেয়র জামাত থেকে হয়েছে”। হাসতে হাসতে বললাম, “জানি। খোঁজখবর রাখি। তোরাই তো ভোট দিয়ে বানিয়েছিস”। আমার জবাবে বাদরু ভাই প্রসঙ্গ পালটালো। কিন্তু বুকের কষ্টটা চেপে রাখতে পারলেন না। আবার শুরু করলেন, “জানিস আজকাল জামাতও বিজয় দিবস পালন করে - আলোচনা সভা করে। আলোচনা সভায় বলে” – তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জানতে চাইলাম, “ কি বলে?” জবাবে যা বললেন তাতে কান গরম হওয়ার অবস্থা। “শুক্রবার আলোচনা সভায় পালোয়ানের ছেলে দাবি করেছে তার বাবা স্বাধীনতার শহীদ”।
কি জবাব দিবো বুঝতে পারছি না। বলে ফেললাম, “স্বাধীনতার শহীদ সংখ্যা ৩০ লক্ষ থেকে বাড়াতে হবে, কম হয়ে গেছে”।
বাদরু ভাই বুঝে উঠতে পারেননি আমি কি বলতে চেয়েছি। অবাক হয়ে মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
অনেকদিন গ্রামে থাকি না। অনেক মুখ অচেনা। আড্ডার একজন অচেনা মুখ আলোচনায় ঢুকে পড়লেন।
“ইমাম সাহেব তো পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। তিনি লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের লোক। তিনি স্বাধীনতার শহীদ হলে পালোয়ান চাচাকে স্বাধীনতার শহীদ বললে অসুবিধা কোথায়?”
প্রচণ্ড ক্ষোভ আর বেদনা নিয়ে বললাম, “বাবা, পালোয়ান স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার অপকর্মের জন্য ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হয়েছেন। মানছি তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া আইনানুগ হয়নি। তবে এ শাস্তি তার প্রাপ্য ছিল। সে স্বাধীনতার শহীদ হয় কিভাবে?” অচেনা মুখটি এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করলেন না। স্বাধীনতার যোদ্ধাদের কথা বার্তা ভালো লাগছিলো না। উঠে চলে গেলেন। ভাবছি এ ছেলেটা এভাবে চিন্তা করছে কেন? ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তে কখন ৭১ এ ফিরে গেছি জানি না। গোদাগাড়ী ইস্ট-পাকিস্তান রাইফেল(ইপিআর) ক্যাম্পের বেশির ভাগ জোয়ান পশ্চিম পাকিস্তানের। ২৭শে মার্চ’৭১ থেকেই ধরপাকড় শুরু করেছে। জোয়ান স্কুলকলেজে পড়া কোন ছেলে বাদ যাচ্ছেনা। গোদাগাড়ীতে থাকা নিরাপদ মনে হলো না। ২৭শে মার্চ’৭১ পদ্মা পাড়ি দিয়ে লালগোলায় পৌঁছলাম।
আমার বন্ধু সাদিক, তাঁর বাবা ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর একটা হিন্দু পরিবারের সাথে বিনিময় করে গোদাগাড়ীতে বসত শুরু করেছে। তার চাচা ডাক্তার ভারতেই আছেন। সাদিকরা আগেই চলে এসে চাচার বাসায় উঠেছে। লালগোলায় তাঁদের সাথে তাঁর চাচার বাসায় উঠলাম।
বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে শরণার্থীরা লালগোলায় আম বাগানে খোলা আকাশের নিচে ঠাই নিয়েছে। অবর্ণনীয় অবস্থা। খাবার, কাপড়, পানি কোন কিছুই নেই। তবুও গ্রামে দেখে আসা মানুষগুলোর মত তাদের মুখে কোন আতঙ্কের ছাপ নাই।
ক’দিন পর শরণার্থী শিবির এর জন্য ভারত সরকার তাবু, খাবার, পানির ব্যবস্থা করলো। শরণার্থীরাই ভলেনটিয়ার হিসাবে শরণার্থীদের রেজিস্ট্রেশান, তাবু, খাবার বিতরনের দেখ- ভাল করছে। আমিও যোগ দিলাম। এক মাসের মধেই লালগোলায় কোন ফাঁকা জায়গা নেই। মানুষ গিজগিজ করছে। তবুও থেমে নাই শরণার্থীর স্রোত।
একটা পরিবার ৭৫কি.মি.পায়ে হেঁটে নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে লালগোলা ক্যাম্পে এসেছে। সাথে এক ভাই আর এক জোয়ান বোন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা-বাবা আসেননি? তাঁরা গ্রামে রয়ে গেছেন?”
ছেলেটির চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। ঠোঁটগুলো নড়ছিল। কিছু বলতে পারছে না। আমি নামধাম রেকর্ড করছি। ছেলেটা বলছে, “বাবা অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাকে নিয়ে হাঁটা দিয়েছিলাম। জ্বরে পথে মাকে রেখে আসতে হলো”।
মুখ তুলেই দেখলাম, চোখের পানিতে তার গাল ভিজে গেছে। দু’হাতের তালু দিয়ে মুছছে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। শান্তনা দেওয়ার মত কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। ইতোমধ্যে আমি লালগোলা ছেড়েছি। মাঝেমাঝে ডাক্তার কাকুর বাসায় আসি। সাদিকের কাছ থেকে বাড়ির খবর নিয়ে যাই। তখন ৭১ এর আগস্ট মাস। বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। শরণার্থী শিবিরে রোগ-শোক কলেরা ডাইরিয়া বেড়ে গেল। প্রতিদিন লাশের মিছিল। কবরস্থান, শ্মশান ঘাট ২৪ ঘণ্টা ব্যতিব্যস্ত। রাতে খাবার সময় সাদিক জানাল, “তোদের গ্রামের আমেনা কলেরায় মারা গেছে”। অবাক হয়ে সাদিককে বললাম,
-“আমেনার বয়স তো মাত্র ২২ বছর। ও মারা গেছে”। ডাক্তার কাকু বললেন,
-“আমেনার মত আরও অনেকে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। ঠিক মত স্যালাইন দিতে পারছি না। শুনেছি তোমার সাথে এম,এন,এ সাহেবের ভাল খাতির। চেষ্টা করে দেখনা বাবা কিছু স্যালাইন সংগ্রহ করা যায় কিনা?”
বললাম;
-“কাকু আমি ছোট মানুষ। আমি বলবো। কিছু হবে কিনা জানি না”।
তিনি বললেন,
-“আমরাও চেষ্টা করছি। তুমিও দেখ। যদি জোগাড় করা যায় তবে কিছু মানুষকে বাঁচানো যাবে”।
অনেক সময় পার হয়ে গেছে। বাদরু ভাই আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছেন। চায়ের দোকানের পিচ্চির ডাকে নিজেকে ফিরে পেলাম,
-“স্যার! আর এককাপ চা দিব?”
-“ দে”
স্বাধীনতার শহীদের সংখ্যা নিয়ে আজকের বিতর্ক নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
- পথে রেখে আসা ছেলেটির মা কি স্বাধীনতার শহীদ? শরণার্থী শিবিরে মারা যাওয়া ২২ বছরের আমেনা।
আড্ডার সেই অচেনা ছেলেটা বলবে, “ওরা স্বাধীনতার শহীদ হয় কি করে। ওরা তো জ্বরে, ডায়রিয়ায় মারা গেছে”। স্বাধীনটার যুদ্ধ না হলেও তো তাঁরা মারা যেতে পারতো। যুদ্ধের আগে কি কেউ জ্বরে, ডায়রিয়ায় মারা যায়নি? তার কথায় যুক্তি আছে। আজকের বাস্তবতায় তার সঙ্গে তর্ক করা ঠিক হবে না। ৭১এর বাস্তবতায় দাড়িয়ে আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি তাকে অস্বীকার করবো কি ভাবে। আমার কাছে এরা সবাই স্বাধীনতার শহীদ। এতে স্বাধীনতার শহীদের ৩০লক্ষের বেশী হউক বা কম,কিছু আসে যায় না। লালগোলা ক্যাম্পের ছেলেটার মা,আমেনা, শান্তি, ভগবান- এদের কাউকে আজ আমাদের মনে নাই। মনের স্মৃতিতে রাখতে পারিনা, কাগজে রাখতে পারতাম। রাখলে নতুন প্রজন্মের আড্ডার সেই ছেলেটার কাছে অন্তত তুলে ধরতে পারতাম।
জনাব রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ, গোদাগাড়ী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৭১এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত এম,এন,এ। তাঁকে বললাম;
-“স্যার স্বাধীনতা শহীদদের একটা তালিকা করা দরকার”।
তিনি বললেন,
-“করতে পারলে ভালো হতো। অনেক বড় কাজ। করবো কি করে। কোন টাকা নাই। তোমরা কয়েকজন গোদাগাড়ী ইউনিয়নের তালিকাটা কর। তারপর দেখবো”।
রাতদিন পরিশ্রম করে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত তালিকা একটা তৈরী করলাম। স্যার তাঁর বড় ছেলেকে দেখতে দিলেন। তালিকায় মসজিদের শহীদ ইমাম সাহেবের নাম দেখে রেগে গেলেন;
-“উনিতো পাকিস্তান পন্থী। আব্বার বিরুদ্ধে ভোটে কাজ করেছে। উনি স্বাধীনতার শহীদ হন কি করে”।
জবাবে বললাম;
-“উনি ভোটের সময় কি করেছেন তা বিষয় নয়। পাকিস্তানীরা তাঁকে গুলি করে মেরেছে। তিনি স্বাধীনতার শহীদ”।
কে শোনে কার কথা। তিনি ঘ্যাঁচ করে ইমাম সাহেবের নামটা কেটে দিলেন। বললেন;
-“ উনার নাম বাদ দে”।
তালিকায় আমেনার নাম দেখে বললেন;
- “তুই একটা পাগল। আমেনা তো শরণার্থী শিবিরে কলেরায় মারা গেছে। তালিকায় ওর নাম দেখলে লোকে হাসাহাসি করবে”।
বলেই একটানে আমেনার নামটাও কেটে দিলেন। বললেন;
-“আমার প্রতিটা নাম এভাবে দেখার সময় নাই। তালিকাটা নিয়ে যা, যেভাবে বললাম সেভাবে তৈরী কর”।
ক্ষোভে দুঃখে কিছুই বলতে পারলাম না। তালিকাটা এনে বাড়ীর কোণায় রুমের মেঝেতে রেখে দিলাম। তালিকাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বললেন। ৩০লক্ষ জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। নিজিকে প্রশ্ন করলাম;
-“আমার তালিকার নামগুলো এই ৩০লক্ষের মধ্যে আছে কি? এটা কি পরিসংখ্যানগত কোন সংখ্যা। না প্রতীকী, যেখানে ইমাম সাহেব, আমেনা, ডাইরিয়ায় কলেরায় মারা যাওয়া সব এখানে লুকিয়ে আছে”।
১৯৭৪সাল, আমি স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনার জন্য বুলগেরিয়া চলে যাচ্ছি। নিজের জিনিষ-পত্র গুছাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়লো ঘরের কোনায় পড়ে থাকা গোদাগাড়ী ইউনিয়নের স্বাধীনতার শহীদদের তালিকাটার দিকে। হাত দিয়ে তুলতে গেলাম, ঝুরঝুর করে খুলে পড়লো। উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিলাম।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও স্বাধীনতার শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
মোঃ রফিকুল ইসলাম, পিএইচডি
সাবেক সচিব
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||