বাঁশ ফুল

Category: Environment Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 38291

বাঁশ গাছে ফুল ফুটেছে। না গাছে নয়, ঘাসে ফুল ফুটেছে। বাঁশ গাছ নয়, ঘাস। সব চেয়ে উঁচু ঘাস। ঘাসে প্রতিদিন ফুল ফোটে। পদ দলিত করি, এ আর এমন কি কথা!  তবে হ্যাঁ, নজর কাড়ার কারণ আছে। বাঁশফুল কোনদিন নজরে আসেনি। আগ্রহটা তাই এত বেশী। বাঁশ বলে কথা। প্রতিদিন আমরা একে অপরকে বাঁশ দিচ্ছি। পদ দলিত করার কোন প্রশ্নই আসে না। এছাড়াও বাঁশের নানান ব্যবহার, ছনের ঘর তৈরী, জোয়াল, বাঁশের লাঠি, বেড়া দেয়া, জন্ম থেকেই দেখছি। তাই এত আগ্রহ। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের উত্তর অংশের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে জন্ম। প্রতিটি বাড়ির পাশে একটা বাঁশ ঝাড়। বলতে গেলে বাঁশ ঝাড়ের মাঝে জন্ম ও বেড়ে উঠা। বাঁশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে, মাঝ দিয়ে প্রতিদিনের যাতায়াত। বাঁশ ফুল কোনদিন নজরে পড়েনি। কারণ এ বাঁশগুলোতে কোনদিন বাঁশ ফুল ফোটেনি। বাঁশের কোন দোষ নেই, দোষ আমাদের, বাঁশে  ফুল ফোটার সুযোগ আমরা দেইনি। তার আগেই ছনের চালে খুঁটি বা ঘরের চালে বাতী হয়ে গেছে। বাঁশ ঝাড়ে জম্ম নিলেও বাঁশ ফুল দেখা হয়নি। বাঁশ ফুল আর ডুমুরের ফুল একই রকম বস' ছিল আমার কাছে। খবরটা পড়ে ভীষণ ইচ্ছা হলো বাঁশ ফুল দেখার। বয়স, যোগাযোগ, অথর্, স্বাধীনতা কোনটাই ছিল না। পাহাড়ে গিয়ে বাঁশ ফুল দেখা হয়নি। আজকে হলে, রঙ্গিন ছবি পত্রিকার পাতায় শোভা পেত। ইন্টারনেটে নতুন ব্লগ তৈরী ; বেসরকারী  চ্যানেলগুলো  বাঁশ, বাঁশ ফুল নিয়ে টক শো করতো। এরই মাঝে আমার বাঁশ ফুল দেখা হয়ে যেত। সেটাও ঐ সময় হওয়ার কোন উপায় ছিল না। তাই বাঁশ ফুল না দেখার বেদনা নিয়েই থাকলাম। কয়েক দিন বাঁশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়া আসার সময় মাথা উঁচু করে তাকালাম। বাঁশে ফুল এসেছে কি না। কদিন পর মনের অজানে- তাকানোও  বন্ধ হলো। বাঁশ গাছের পাশ দিয়ে আসি যাই। কোনদিন মনে পড়েনি বাঁশ ফুলের কথা। বাঁশে ফুল ধরতে পারে এটা বিশ্বাসের মধ্যে ছিলো না। স্কুলে নাটক করবো, স্ট্রেজ তৈরী করতে বাঁশ কেটেছি, ব্যাডমিন্টন খেলবো বাঁশের খুটি পুতেছি। এভাবে জীবনের বেশীর ভাগ সময় পার করে ফেললাম। বাঁশফুল তো দূরের কথা বাঁশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়েও কোনদিন ভাবিনি।

বাংলাদেশ পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারে সিনিয়র স্টাফ কোর্স করছি। অংশগ্রহণকারী ট্রেনিদের একটা করে টার্ম পেপার লিখতে হবে। কি বিষয়ে টার্ম পেপার লেখা যায় এ নিয়ে সকলে মহাব্যস-। লেখতে হবে তাই লেখা। এটা কেউ পড়বেন আমি বিশ্বাস করি না। তাই এই নিয়ে কোন ভাবনা আমার কোনদিন ছিল না। হেঁসে খেলে বেড়াতাম। এছাড়াও নামের শেষে একটা পিএইচডি ডিগ্রী থাকায় সবাই ভাবতো আমার কোন অসুবিধা হবে না। মাঝে মধ্যে দু’একজন এসে আলাপ, আলোচনা জিজ্ঞাসা করতেন;
-‘‘ কি বিষয় নেয়া যায়।’’
মাঝে মধ্যে বিজ্ঞের মত কাউকে দু,একটা বিষয় বাতলে দিয়েছি।’
আমার বন্ধু সহপাঠী বদিউল আলম, আমি তাঁকে ‘বদ’ বলেই ডাকতাম। জিজ্ঞাসা করলো ;
-‘‘ বাঁশে অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে পেপারটা লিখলে কেমন হয়?’’ জবাবে বললাম,
-‘‘ কথায় কথায় লোকজনকে বাঁশ দেয়া তোঁর অভ্যেস। এখন মুখে বাঁশ দিস। টার্ম পেপারে দিবি, মন্দ কি?’’ আমার সম্মতি আর উৎসাহে ‘বদ’ চীন, থাইল্যান্ড এর নানা জাতের বাঁশ, বাঁশ প্রক্রিয়াজাতকরন প্রক্রিয়া, বাঁশের নতুন নতুন ব্যবহার সংক্রান- তথ্য, চিত্র সংগ্রহ করতে লাগলো। বাঁশ ফুলও বাদ গেল না। ক'দিন পর বদ একটা শেকড়সহ বাঁশ এনে ঘরে তুললো। জ্যান- বাঁশ। কোর্সের শেষ দিন বিপিএটিসিকে বাঁশ দিয়ে তারপর যাবে। বদের ইন্টারনেট  ডাউনলোড করা তথ্য ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ করেই আবিস্কার করলাম বাঁশ ফুল। অনেক দিনের অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ হলো। বাঁশফুল দেখলাম। আহামরি কিছু নয়। সাদামাটা মেটে রং এর এবং অনেক গুলো থোকা থোকা ফুল। ফল সবুজ নীলাভ। বোটার দিক কমলার মত পিছনে সরু হয়ে লতার মত লম্বা।

৪৮ বছর পর বাঁশ গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে তারপর বাঁশগুলো মারা যায়। আমার দেখা বাঁশ ঝাড়গুলোর কোন বাঁশকে ৪৮ বছর বাঁচতে দেয়া হয়নি। তাই বাঁশ ফুল দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। পাহাড়ে জংগলে বাঁশগুলো ৪৮ বছর ফুল ফল দিয়ে চলে যায় সবার অগোচরে। বাঁশ ফল ইঁদুরের সব চেয়ে প্রিয় খাবার। সাপের প্রিয় খাবার ইঁদুর। পাহাড়ে বাঁশ ফল ধরলে সবার অগোচরে নিরবে নিভৃতে ইঁদুর তার প্রিয় খাবার হিসেবে মহাআনন্দে বাঁশ ফল খেয়েছে। ইঁদুর খেতে সাপের  প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। মানুষের কিছু আসে যায় নি। দিন পাল্টাচ্ছে নানা কারণে মানুষ বনে বাসা বাঁধছে। নিজের প্রয়োজনে বনের মাঝে চাষাবাদ করছে। যথানিয়মে বাঁশ গাছে ফুল ফুটছে, ব্যাস। দলে দলে ইদুর আসছে। ইঁদুরের সংগে সাপ। ইঁদুর ফসলের ক্ষেত নষ্ট করছে। সাপের কামরে মানুষ মরছে। পত্রিকা টিভি চ্যানেল নিয়মিত ছবি ফিচার ছেপে চলছে। বাঁশ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চলছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নানা আয়োজন। সব জায়গায় এক কথা;

-‘‘ বাঁশ ফুল অশনি সংকেত। দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। সাপের কামড়ে মানুষ মরবে।”

বিপিএটিসিতে বদ বাঁশ গাড়লো। পরদিন বিপিএটিসির বাসে করে ঢাকা ফিরলাম। গাবতলির ট্রাফিক জ্যামে বাসটা আটকা। বদির বাঁশফুল ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো। ভাবছি আমার ছোট বেলায় বাঁশফুল ফুটলে কি ভয়ংকর পরিসি'তিতে পড়তাম। চিন্তা করতেই গা শিওরে উঠলো। ভালোই হয়েছে বাঁশফুল দেখতে হয়নি। বাসের হেলপারের ডাকে নিজেকে ফিরে পেলাম,
‘‘ বাস ফার্মগেট হয়ে যাবে। যাঁরা শুক্রাবাদ, কলাবাগান যাবেন নামতে পারেন।’’
ব্যাগটা নিয়ে নেমে হাঁটা দিলাম। কয়েকজন তখনও বৎসায় লিপ্ত। কে যেন বলছে, যাবে তো শাহবাগ। তা হলে কেন ফার্মগেট , কলাবাগান হয়ে গেলে আপনাদের অসুবিধা কোথায়! মনে মনে বললাম অসুবিধা আছে তোমাদের হাঁটা হবে না।

হাঁটছি আর কামনা করছি বদির বাঁশ যেন ৪৮ পার না হয়। দরকার নেই আমার পরবর্তী প্রজন্মের বাঁশফুল দেখার। তাঁদের জন্য হরেক রকম বাঁশ, বাঁশফল, ফুল, আমরা ইন্টারনেটে, বইপত্রে রেখে যাচ্ছি। তাঁরা সেগুলো দেখেই সন্তুষ্ট থাকুক। আমার তো তাও জোটেনি। ভাবতে ভাবতেই বাসায় এসে পৌঁছলাম। বাঁশ মাথা থেকে বিদায় নিল।

২০০৮ সাল। বাঁশ আবার পত্রিকার শিরোনাম হলো। চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঁশে ফুল ফুটেছে। সংবাদটা পড়েই ভাবলাম আর কাগজে নয়। বাঁশ ফুল বাঁশেই দেখবো। পাহাড়ে যাবো। সারাদেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরীর কাজ চলছে। তথ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ, তথ্য সংগ্রহের কাজ তদারকির জন্য বাংলাদেশের এক প্রান- হতে অন্য প্রান- ছুটে বেড়াচ্ছি। ঠিক করলাম চট্টগ্রামের পাহাড়ে যাবো। ছবিসহ ভোটার তালিকার কাজ, বাঁশফুল দেখা এক সংগে করে আসবো। পাহাড়ে গেলাম। বাঁশফুল দেখার জন্য গাড়ী থেকে নেমে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হলো।

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সরু রাস-া দিয়ে হাঁটছি। সামনে পিছনে অনেক লোক। সবার হাতে দামী দামী জুমলেন্সসহ ক্যামেরা। বাঁশের ডগার ফুল ফলকে জুম করবেন। সাপের কামড় থেকে বাঁচার জন্য গামবুট। অবশেষে বাঁশ ফুলের কাছে পৌঁছলাম। কয়েকটা সবুজ বাঁশ ফল নীচে পড়ে আছে। ক্যামেরা গুলোর ফ্লাশ জ্বলছে। ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ করছে। আহা মরি কিছু মনে হলো না। এছাড়া আমার পায়ে গামবুট তো দুরের কথা কেটসও ছিলনা। ছোটবেলায় সাপের কামড়ে বাবাকে হারিয়েছি। এখনও মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যে সাপ দেখি। ভাল লাগছিল না।

আমি অর্থনীতির ছাত্র। ফুল ফল আমাকে ততোবেশী টানে না, যেমন টানে মানুষ। তাড়াতাড়ি ফিরতি পথ ধরলাম। হাঁটছি, কয়েকটি ছনের ঘর চোখে পড়লো। যাবার সময় বাঁশফুল দেখার আনন্দ উত্তেজনায় বাড়ীঘর লোকজন চোখে পড়েনি। বাড়ী বললে ভুল হবে। উপজাতিদের মাটির দেয়াল, উপরে ছনের চালা। যেন ছোট বেলায় দেখা উত্তর বঙ্গের মাটির দেয়াল ঘর। পাশে বাঁশ ঝাড়।

একজন হাড্ডিসার বৃদ্ধ একটা গামছা ঘাড়ে, দু হাত গালে দিয়ে বসে আছেন। ঘোলাটে উদাস দৃষ্ঠি। জিজ্ঞেস করলাম ,
‘- কেমন আছেন ?’’ বৃদ্ধ পাহাড়ি ভাষায় যা জানালো বাংলায় তা হলো;
‘- বাঁশফুল ফুটেছে । ফল ধরলেই ইঁদুর আসবে, ইঁদুর খেতে সাপ আসবে, ইঁদুরগুলো জুমের সব ফসল নষ্ট করবে। সাপের কামড়ে কত মানুষ মারা যাবে কে জানে! দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। চুপচাপ বৃদ্ধের কথা শুনছিলাম। কোন জবাব দেয়ার শক্তি ছিলনা। বৃদ্ধ জোরে জোরে বলতে লাগলো।

‘- বাবা বাঁশফুল দেখে তোমরা আনন্দ করছো। ছবি তুলছো। আমরা কি খাবো বলতে পারো।'
বৃদ্ধের কথার কোন জবাব আমার জানা ছিল না। মাথা নিচু করে হাঁটা দিলাম। আমি পরাজিত। বৃদ্ধ বিদ্রুপ করছে। আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। পথ শেষ হচ্ছে না। অবশেষে গাড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম। গাড়ী ষ্টার্ট দিল।

বাঁশফুল দেখেছি, দারিদ্র পীড়িত বৃদ্ধকে দেখেছি, উপজাতীয়দের মধ্যে দুর্ভিক্ষের আশংকা দেখেছি। দারিদ্রক্লিষ্ঠ বৃদ্ধের মুখ দেখার পর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো। নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম,
‘- বাঁশফুল কেন দেখতে আসলাম ? ’’

ঢাকা ফিরলাম। সাভারে ভোটার তালিকা প্রনয়ণ সংক্রান- প্রশিক্ষণ  চলছে। সাভার হয়ে বিপিএটিসিতে গেলাম। বদির বাঁশটা দেখবো। বাঁশের পাশে  মাটিতে পানি জমে আছে। বাঁশটা মরে গেছে। হাঁফ ছাড়লাম। এ বাঁশে আর কোন দিন ফুল ফুটবে না।

মরা বাঁশটা দেখেই মনে পড়লো, বাঁশ তলায় কোন গাছ জন্মে না। এমন কি অন্য কোন ঘাসও না। আমাদের বাড়ীর সামনের দুটো বাঁশ ঝাড়ের মাটিটা পরিষ্কার আর ঠক ঠকে শুকনো ছিল। শুকনো বাঁশ তলাটা ছিল ডাংগুলি আর মার্বেল খেলার প্রিয় জায়গা। বাঁশফুল ফুটলে আমাদের কি হতো ভাবতেই ভিতরে আঁৎকে উঠলাম। সামান্য একটা ঘাসফুল এর মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের কত আনন্দ, কত বেদনা, উৎসাহ উদ্দীপনা। অন্য দিক আর একদল মানুষের কাছে এটা অশনি সংকেত। তাঁর কাছে বাঁশ ফুল হতাশা আর দুভিক্ষের পদধ্বনী।