টিকিট

Category: Sports Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 8886

বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে টিকিট শব্দটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ট্রেনে, সিনেমা হলে টিকেটের প্রচলন ছিল। শহরে গিয়ে সিনেমা দেখার সাহস ছিল না। সিনেমা দেখলে শহরে থাকতে হবে। রাজশাহী শহরে কোথায় থাকবো। ১৯৬৫টির পাক-ভারত যুদ্ধের আগে গোদাগাড়ীতে একটা রেল স্টেশন ছিল। স্টেশনটা আজও আছে। শুধু নাই রেলগাড়ীর আসা-যাওয়া। তাই ট্রেনের টিকিট দেখা হয়নি। গোদাগাড়ী রাজশাহীর পথে মুড়ির টিনের মত একটা বাস সকাল বিকাল চলতো। টিকিটের কোন বালাই ছিল না। বাস কনট্রাক্টর কোথায় কে উঠেছেন জেনে নিয়ে ভাড়া আদায় করতেন। কাগজের নোটগুলো হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে; পয়সাগুলোকে একটা চামড়ার ব্যাগে রেখে এক হাত বাসের বড়টা চেপে ধরে চমৎকারভাবে কাজগুলো শেষ করতেন। ছাত্র হিসাবে আমরা অর্ধেক ভাড়া দিতাম। কোন টিকিট দেয়া না হলেও কনট্রাক্টর আমাদের দেখেই বলতেন,
‘ও, আপনারাতো হাফ টিকিট!’
জবাবে বলতাম, ‘টিকিটতো দেন না। হাফ টিকিট বলেন কেন? আমরা তো হাফ ভাড়ায় যাই’।
কনট্রাক্টরকে চটাতে চাইতাম না। হাঁসতে হাঁসতে অর্ধেক ভাড়া বাহির করে দিতাম।
অনেকদিন ধরেই জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ‘ল’ চলছে হাপিয়ে উঠেছে মানুষ। আরোপ করা হয়েছে নানা রকম বিধি-নিষেধ। বড় চুল রাখা যাবে না। ধরা পড়লেই বাটি ছাঁট, তা না হলে ন্যাঁড়া মাথা। চোস্ত প্যান্ট পড়া যাবে না; বেল বটমও নয়। ছাত্রই এ সব করে। জেনারেল সাহেবের বাড়াবাড়ি তাঁদের ভালো লাগছিলো না। প্রতিবাদ হিসেবে ছিটে-ফোটা মিছিল শুরু হলো। ছিটে-ফোটা আস্তে আস্তে বিশাল আকার ধারণ করতে লাগলো। হঠাৎ সামরিক এলান জারী হলো, ছাত্ররা হাফ টিকেটে সিনেমা দেখতে পারবে। তবে এজন্য আইডি কার্ড লাগবে। মিছিল মিটিং বাদ দিয়ে ছবি তোলা, প্রিন্সিপ্যালের দস্তখত, কেরানী সাহেবের কাছে ধর্ণা দিয়ে সিল নিয়ে সবাই কার্ড তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ছাত্র নয় তারাও জাল কার্ড তৈরী করলো। তারা পুরো টাকা দিয়ে টিকিট কিনবে কেন?

জেনারেল সাহেব আশ্বস্থ হলেন। মিটিং মিছিল বন্ধ হলো। ৩টা মাত্র সিনেমা হল। প্রতিদিনতো নতুন ছবি রিলিজ হয় না। হলের মালিক মাসে একটার বেশী ছবি চালায় না। মাসে ৩ ঘন্টার ৩টা শো দেখে তারপর কি করবে। কবরীর এক কান্না, ববিতার পেয়ারা নিয়ে দুষ্টামি আর ক’বার দেখা যায়। আবার শুরু হলো, মিছিল, মিটিং, স্লোগান।
“মার্শাল ল! মানি না, মানি না”।
“আইয়ুব তুমি বিদায় হও”।

স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাই সিনেমার মূল দর্শক। হাফ টিকিটে সিনেমা দেখতে গিয়ে সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার দশা। তাঁরাও দাবী তুলতে লাগলো। দাবীর মুখে বন্ধ হলো সিনেমা হলের হাফ টিকেট। এছাড়াও সিনেমার হাফ টিকিট আন্দোলন থামাতে তো পারেনি বরং সিনেমা হলে একত্র হয়ে মিছিলগুলো বড় হচ্ছিলো।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমনুরা হয়ে রাজশাহী পর্যন্ত রেলপথটা আজও চালু আছে। সত্তরের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ছিল নাজুক। আমরা ২ বন্ধু কি কাজে মনে নাই চাপাইনবাবগঞ্জ এসেছিলাম। বাসের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে ট্রেন ধরবো স্থির করলাম। স্টেশনে এসে দেখি কাউন্টারে কেউ নেই। ম্যানেজারের রূমে গিয়ে দেখলাম তিনি একজনের সংগে গল্প করছেন। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম,
- ‘রাজশাহীর ২টা টিকেট দেন’।
জবাবে স্টেশন মাস্টার জানালো,
- ‘টিকেটবাবু এখনও আসেননি’।
আমরা এখন কি করবো জানতে চাইলে, মাস্টার জানালো,
- ‘টিকিট ছাড়াই যান। আপনারাতো ছাত্র। আপনাদের টিকিট লাগবে না কি?’
- ‘টিকিট চেকার উঠলে কি হবে’ জানতে চাইলাম।
- ‘কিছু হবে না’। জবাবে মাস্টার জানালেন।
- ‘কি বলছেন? বুঝলাম না’। অবাক হয়ে বললাম।
- ‘না বুঝার কিছুই নাই। আমনুরা থেকে টিকিট চেকার উঠে না। আমি জানি টিকিট বাবুর মত চেকার বাবুও নাই। উঠলে উঠতে পারে রাজশাহী কোর্ট স্টেশনে। ওখানে নেমে যাবেন’। ছোট-খাটো বক্তৃতা শুনে অবাক হলাম। বাবুদের ঠিক সময়ে স্টেশনে উপস্থিত করা, টিকিট বিক্রি, টিকিট ছাড়া ভ্রমণ বন্ধ করার দায়িত্ব যার; তিনিই বিনা টিকিটে যেতে উপদেশ দিচ্ছেন। ‘সেলুকাস, অদ্ভুত এই দেশ’।

টিকিট ছাড়াই ট্রেনে চাপলাম। এবারও টিকিট-এর দেখা মিললো না। মনের ভিতর একটা ভয় ছিল। রাজশাহী শহর পর্যন্ত না গিয়ে কোর্ট স্টেশনে নেমে গেলাম। নামতে নামতে বন্ধুকে বললাম এই রেল ব্যবস্থা লাটে উঠবে।

লোকাল বা সিটি বাসে টিকিট অর্থনৈতিক করনেই আজও চালু হয়নি। চালু করলে টিকিট ছাপা, বিক্রি, চেকিং এর ব্যবস্থা এ সব করতে বাড়তি পয়সা গুণতে হবে। যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিবে না। বাস ভাংচুর জ্বালাও পোড়াও হবে। বাস মালিক বা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী করতে চায় না। তাই আজও সনাতন পদ্ধতি চালু আছে।

ঢাকা শহরের সিটি সার্ভিসে একদিকে খরচ, অন্যদিকে চুরির পরিমাণ বেড়ে গেলো। নতুন ধারণা জন্ম নিলো্ বাস কোম্পানী করা। এটিসিএল ব্যক্তি মালিকানায় অনেকগুলো বাস একত্রে করে একটা কোম্পানীর জন্ম দিল। কোম্পানী টিকিট ছেপে কমিশনে প্রতিটি স্টপেজে একজন বিক্রেতা কাম চেকার নিয়োগ করেছে। ব্যবস্থাটা মন্দ নয়। যাত্রী মালিক দু’জনেরই লাভ। কিছু লোক চাকুরী পেয়েছে। অন্যদিকে চুরির পরিমাণ কমেছে। এটিসিএল-এর আরো অনেকগুলো কোম্পানী এখন সার্ভিস দিচ্ছে। ‘উঠে পড়ুন, তারপর ভাড়া দিন’। এ ব্যবস্থাটা একেবোরে বিদেয় নিয়েছে। ঢাকার বাহিরে লোকাল বাস থেকে সনাতন পদ্ধতি কবে বিদায় নিবে সেই দিনের অপেক্ষায় আছি।

আন্তঃজেলা দুরপাল্লার বাস সার্ভিসগুলোতে টিকিট ছাড়া চলাচল করা যায় না। কাউন্টারে টিকিট কিনে বাসে উঠা যায়। কোন কোন সার্ভিসে অগ্রীম টিকেট কেনার সুযোগও আছে। যাত্রার উপর নির্ভর করে কবে টিকিট কাটতে হবে এর কোন ধরা-বাধা নিয়ম নাই। তবে ব্যতিক্রমও আছে।

ঢাকা আজও মেট্রোপলিটন ক্যারেকটার পাইনি। মানুষগুলোর শিকড় গ্রামের মাটিতেই আটকে আছে। ঈদে পর্বনে দুই তৃতীয়াংশ লোক শহর ছেড়ে গ্রামে যায়। বাস, ট্রেন, প্লেন, যাই হোক না কেন একটা যানবাহন লাগে। দুরপাল্লার বাসে টিকিট লাগে। ঈদ পর্বনে এ টিকিট অগ্রীম কিনতে হয়। আমিও মেট্রোপলিটান হতে পারিনি। গোদাগাড়ীর গ্রাম থেকে অনেকটা বলতে গেলে পাসপোর্ট ভিসায় ঢাকা মেট্রোপলিটানে চাকুরী করি। ঢাকা শহরে পরগাছা হিসেবে বেড়ে উঠছি। শিকড় গাড়তে পারিনি। গ্রামে আছে মা, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব। তাঁদের সাথে দেখা করতে হবে। বাড়ী ফিরতে হয়। বেশ কয়েকজন পরগাছা একসংগে থাকতাম। বয়সে একটু বড় হওয়ায় কোন বাসের টিকিটি কবে ছাড়বে, কে টিকিট কিনে আনবে ভাবতে হতো না। টিকিটের টাকা আর তাঁদের হাতে চা-নাস্তার কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েই আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম। টিকিট আমার হবেই। তাহের একদিন হঠাৎ এসে বললো,
- ‘দাদা, আগামী সপ্তাহে হানিফ টিকিট ছাড়বে। টিকিট কিনতে হবে। হাতে টাকা নাই। একটা কিছু করুন’।
- ‘ঠিক আছে। দেখা যাবে। কে দাড়াবে টিকিটের জন্য?’ জানতে চাইলাম।
- ‘আমরা ঠিক করে নিবো। কে কবে কোন কাউন্টারে দাঁড়াবে। আপনি টাকাটার ব্যবস্থা করলেই চলবে’, তাহের জবাব দিলো।
- ‘ঠিক আছে’, তাকে আশ্বস্থ করলাম।
মলিন মুখে মিনু এসে বললো,
- ‘রাত ৩টা থেকে হানিফের দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর চার-পাঁচজন বাকি ছিল। এ সময় কাউন্টার থেকে জানানো হলো টিকিট শেষ’।
- ‘তাহলে টিকিট পাওয়া যায় নি’। জানতে চাইলাম।
হতাশ হয়ে মিনু জানালো,
- ‘না দাদা। কাল ন্যাশনাল টিকিট দিবে। সন্ধ্যায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াবো’।
কোন জবাব ছিলো না। কৈফিয়ৎ; বাড়ি ফেরার তাগিদ, শিকড়ের টান; সবকিছু বরবাদ হয়ে যাবে যদি টিকিট না জোটে।
তাহের, মিনু, কহিনুর একসংগে সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে ন্যাশনাল এর টিকিট। একসাথে,
- ‘দাদা টিকিট পাওয়া গেছে’।
- ‘চলো নাস্তা করে আসি। অনেক ধকল গেছে তোমাদের’। কোন জবাব দিলো না। মুখে প্রশান্তির হাসি।
গাবতলী গিয়ে দেখি প্রতিটি সিটের টিকিট দুইতিনবার বিক্রি হয়েছে। আমাদের টিকিটেরও একই দশা। এক সিটের ৩ জন দাবীদার। ঝগড়া, হাতাহাতি, তারপর ভাগাভাগি সমঝোতা। কারণ আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।
একবার এমনও হয়েছে, ওরা সব কয়জন এসে জানালো,
- ‘দাদা সব কয়টা সার্ভিস চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না’।
- ‘এবার বাড়ী যাওয়া বাদ দাও। ঢাকায় ঈদ করি’। আমার প্রতিক্রিয়া জানালাম। তাঁদের মুখ চোখ কালো হাড়ির মতো হয়ে গেলো। বললো, ‘বাড়ী যাওয়া হবে না, কি বলছেন দাদা’। ব্ল্যাকে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি টিকিটে একশত টাকা বেশী দিতে হবে’। আপনি একটু দয়া করলেই বাড়ী যাওয়া হয়’।
বললাম, ‘ঠিক আছে ব্যবস্থা করো’। মনে মনে ভাবছি, তবুও ঈদে বাড়ী যেতে হবে, না গেলে শিকড়টা যে ছিড়ে যাবে। শিকড় ছাড়া আমাদের অস্তিত্বের কি হবে?’

শিকড়হীন পরগাছাগুলোর শিকড় গজিয়েছে। বিয়ে করেছি। আজ মেয়ের স্কুল, কাল ছেলের পরীক্ষা। নানা অজুহাতে গত কয়েকবার বাড়ী যাওয়া হয়নি। তবুও দুই শিকড়ের সেতু বন্ধনটা আজও রয়ে গেছে।

বাসের টিকিট-এর কথা লিখছি। ভাবছেন প্লেনের টিকিটের অবস্থা এমন নয়। এখানেও টিকিটের বিড়ম্বনাও কম নয়। ইউএনডিপির একটা প্রোগ্রাম। কাল ফ্লাইট। আজ পর্যন্ত টিকিট নাই। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। টিমের সদস্যরা মুখ কালো করে বসে আছে। বিভোর জানতে চাইলো,
- ‘তাহলে যাওয়া হবে না’।
- ‘অপেক্ষা করুন দেখা যাক’।
তাঁকে শান্তনা দিলাম। সন্ধ্যা ৬:০০ টায় ইউএনডিপি থেকে কামাল টেলিফোনে জানালো,
- ‘স্যার! শেষ পর্যন্ত টিকিট পাওয়া গেছে’। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে টিমের সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বললাম।

গোদাগাড়ী সুলতানগঞ্জের মেলা, প্রেমতোলী ক্ষেতুর মেলায় গরুরগাড়ীতে হাঁটতে হাঁটতে অনেকবার গেছি। কোন টিকিটের প্রয়োজন হয়নি। ঢাকাতেও অনেক মেলা হয়, একুশের বই মেলা, বাণিজ্য মেলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা, তাঁত শাড়ী মেলা, হস্তশিল্প মেলা, বৈশাখী মেলা। ঢাকা শহরে সারা বছর কোন না কোন মেলা আছেই। এখানে মেলায় ঢুকতে টিকিট লাগে। মানুষ টিকিট কিনছে, মেলায় যাচ্ছে। মেলায় উপচে পড়া ভিড়। তিল-ধারণের স্থান নাই। তবুও মেলামুখি মানুষের স্রোত থামে না। সরকারের মাঝাড়ি ধরণের একজন কর্মকর্তা হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মেলার কয়েকবার ঢুকার জন্য প্রতিবার কিছু টিকিট পাই। মেলা শেষ হয়, যাওয়া হয় না।। টিকিটগুলো অফিসের ড্রয়ারে থেকে যায়।

সুলতানগঞ্জের মেলায় প্রাণের টানে যেতাম। টিকিট লাগলে যেতাম না এটা ঠিক নয়। টিকিট লাগলেও হয়তো যেতাম। এখন ঠিক উল্টো ড্রয়ারে টিকিট পড়ে থাকলেও যাওয়া হয় না। আগে মেলায় গেছি, পাপড় ভাজা খেয়েছি, পুতুল নাচ, সার্কাস দেখেছি। ত্রিফলা আকাশ থেকে শুয়ে পড়া লোকটার উপর পড়বে। দম বন্ধ অবস্থা। না কোন কিছু হয়নি। লোকটার দুই পায়ের ফাঁকে গাড়ের উপরে মাটিতে ফলাটা গেঁথে গেছে। সবার মুখে হাসি। হাততালি। প্রতিটা মুহুর্ত ছিল আনন্দ, উচ্ছাস আর শিহরনের। তাই টিকিট লাগলেও যাওয়া যায়।

বাণিজ্য মেলার গেইটের সামনে দিয়ে প্রতিদিন অফিস আসি-যাই। টিকিটও ফি তারপরও যাওয়া হয়নি। মেলা আমাকে টানে না। অথচ এই মেলায় আসার জন্য মানুষের কত আকুতি। আসা-যাওয়ার পথে প্রতিদিন একটা বিজ্ঞাপন দেখতাম, ‘বড় পর্দায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১ দেখুন। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিশেষ ছাড়। এখন মাত্র এক লক্ষ ..... টাকা’। বিজ্ঞাপনটা আমাকে মেলায় যেতে বাধা দিয়েছে। যা কিনতে পারবো না তা দেখে কি লাভ। এতে হতাশাই বাড়বে।

‘ছেলের টিভি কার্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওর মত করে ও খেলা দেখতে চায়। একটা টিভি কার্ড কিনে দিতে বলেছে। আমি ভাবছি হাজার দশেক টাকার মধ্যে একটা টিভি কিনে দিবো। বাণিজ্য মেলার শেষে ‘সেল’ দিবে। তখন পাওয়া যেতে পারে’। বউ আমাকে কথাগুলো বললো।

আমাদের মেলা মানে ‘সেল’। যা বিক্রি হবে না ওগুলো আমরা কিনবো। আনন্দিত হবো। কিন্তু আমি যে সেলে কিনে আনন্দিত হতে পারি না। আমার খুব খারাপ লাগে। সুলতানগঞ্জের মেলায় পাপড় ভাজা খেয়ে আনন্দিত হতাম। এখন হতাশ হই। তাই মেলার টিকিট গাড়ীতে পড়ে থাকে। আমার মেলায় মেলায় যাওয়া হয় না।

স্কুল জীবনে ঈদে নাটক করতাম। হারিকেনের কেরোসিন, চা, স্টেজ তৈরী, সামিয়ানা ভাড়া, মেকআপ খরচ এ সবের জন্য টাকা দরকার। তা নাহলে নাটক হয় না। টিকিট কেটে কেউ নাটক দেখে না। তাই হাত পাততাম এলাকার ধনী লোকজনের কাছে। ভদ্র ভাষায় একে বলতাম, পুশ সেল। প্রথম দিকে ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে চালিয়ে নিতাম। খরচ কম হতো। পরে এতে হতো না। নাটোর থেকে মহিলা আনতে হয় অভিনয় করার জন্য। খরচ বেড়ে গেল। কষ্ট করে কয়েকটা নাটক মঞ্চে নামলেও পরে সবকিছু বন্ধ করে দিলাম।

বিদেশে লেখাপড়া করার সুবাদে অপেরার প্রতি দূর্বলতা এসে যায়। মাঝে-মধ্যে থিয়েটারও গিয়েছি। টিকিট পাওয়া যেমন ছিল কষ্টকর, দামও ছিল অনেক। ঢাকায় ফিরে আসলাম। প্রফেশনাল থিয়েটারের সবে মাত্র শুরু। মহিলা সমিতির মঞ্চ, ঢাকা থিয়েটার, শিল্পকলা মঞ্চে তখন টিকিট পেতে বেগ পেতে হতো না। আজকাল ও দিন আর নাই। এক কোটি ঢাকাবাসীর জন্য মঞ্চ সংখ্যা হাতে গোনা। হাজার দুয়েক লোক নাটক দেখতে পারে। নাটকের টিকিট পাওয়া আজ অনেকটা ঈদে বাসের টিকেট পাওয়ার মত।

টিকিট কোথায় ঢুকে পড়েনি। চ্যানেল ‘আই’ প্রতি বছর সেরাকন্ঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগিতা দেখতে গেলে টিকিট লাগে। টিকিট পাওয়ার জন্য ঢাকাবাসী মিনু, তাহের, কহিনুরের মত লাইন দেয়। এক জায়গায় না মিললে আরেক জায়গায় গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে কেটে যায়। পাওয়া না গেলে তদবীর। তাতেও না হলে ব্লাকে টিকিট কেটে হলেও চ্যানেল প্রতিযোগিতাগুলো তাঁদের দেখতে হবে। তাঁরা দেখতে চায়।
ডিস টিভির কল্যানে ভারতের সব গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, খেলোয়াড় আমাদের অতি কাছের মানুষ আপনজন। আমরা তাদের কাছ থেকে দেখতে চাই। আমাদের এই দূর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে; কিছু আয়োজক। তারা ভারতীয় গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকাদের ঢাকায় এনে স্টেজ পারফর্মেন্স করছে। উচ্চ মূল্যের টিকিট। তাতে কি? কোন পরোয়া নেই শো দেখতেই হবে, শাহরুখ, রানী, রেখা বলে কথা। ঢাকায় তাঁরা নাচবে, কথা বলবে, অন্যের গানে লিপ দিবে, আমরা দেখবো না, এটা হয়? এদের দেখতে না পেলে জীবনটাই যে বৃথা। এদের দেখার জন্য এদেশের প্রতিটি মানুষ পাগল। শাহরুখ তার দলবল নিয়ে ঢাকা আসছে। একজন আয়োজক ঢাকায় একটা অনুষ্ঠান করবে তাদের নিয়ে। আমার এক সহকর্মী জানতে চাইলেন,
- ‘স্যার! শাহরুখ-এর অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছেন তো’।
- ‘না’ বিরক্তি প্রকাশ পেলো।
- ‘টিকিট পাননি, স্যার!’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
- ‘না, পাইনি! পাওয়ার চেষ্টাও করিনি। পেলেও যেতাম না’। জবাব দিলাম। জবাবটা হজম করতে তাঁর সময় লাগলো। তারপরও বললো,
- ‘যদি পান, যদি না যান তাহলে টিকিটটা আমাকে দিবেন স্যার’।
- ‘আচ্ছা’ বলে তাঁর বিরক্তিকর কথা-বার্তা থেকে নিজেকে বাঁচালাম। শাহরুখ এসে নাচলো, আধো বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করলো। বাংলার মানুষকে তার ঘামে ভেজা শরীরটা দেখিয়ে তাঁর পাওনা নিয়ে চলে গেল।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১১ এর সহ-আয়োজক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও ভারত এই তিনদেশে ১৪টি দলের ১৩টি ভেনুতে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ঢাকায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজকগণ উদ্বোধনী দিনের জমকালো অনুষ্ঠান এবং প্রতিটি ম্যাচ দেখার জন্য উচ্চ মূল্যের টিকিট নির্ধারণ করেছে। তাতে কি? সবার এক কথা। খেলা দেখতে হবে। টিকিট চাই। আমাদের বিল্ডিং-এর ছেলেমেয়েগুলো মনে করে আমি বড় কর্মকর্তা। আমার দ্বারা সব কিছু সম্ভব।
- ‘আংকেল ২-৩টা টিকিট যোগাড় করা যাবে। মাঠে বসে খেলাগুলো দেখতে চায়। আপনি সাহায্য করতে পারবেন’ বিল্ডিং-এর কয়েকটি ছেলে বাসায় এসে অনুরোধ করলো।
- ‘আমার ক্ষমতার বাইরে বাবা!’ অসহায়ের মত জবাব দিলাম।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর দ্বিপাঞ্জন অনুরোধ করলো,
- ‘দেখ না বাবা। যদি পারা যায়। আমিও ওদের সংগে মাঠে গিয়ে খেলা দেখতাম’।
ছেলের অনুরোধের কোন জবাব জানা ছিল না। অসহায়ের মত চুপ করে রইলাম।

ক্রিকেট উন্মাদনায় ভাসছে সারাদেশ। টিকিট নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। টিকিটের জন্য ছেলেমেয়েরা সারারাত সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। চ্যানেলগুলো রিপোর্ট করছে, টিকিটের জন্য মানুষের ভোগান্তির কথা। রিপোর্টার লাইনে দাঁড়ানো দর্শককে জিজ্ঞাসা করছেন,
- ‘কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন’।
- ‘চৌদ্দ ঘন্টা!’ দর্শকের জবাব।
একজন মহিলা দু’টো টিকিট নিয়ে বাহির হলেন। মুখে হাসি, আর প্রশান্তি। দাঁতগুলো টেলিভিশনের ফ্লাড লাইটে ঝলমল করছে। রিপোর্টারের জিজ্ঞাসা,
- ‘আপনিতো টিকিট পেয়েছেন। আপনার অনুভূতি কি?’
- ‘কষ্ট, বিরক্তি, অব্যবস্থা সবকিছু ভুলে গেছি। আমি মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারবো’ বলেই নাচতে লাগলো।
নির্বাচন কমিশনের উপ-সচিব আবুল কাসেম। আশাবাদী লোক। কথার ছলে জানালো, মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে চায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘টিকিট পেয়েছেন?’ জবাবে জানালো,
- ‘অনেক পরিচিত লোক আছে। কারো না কারো কাছ থেকে একটা টিকিট পাওয়া যাবে’।
আমি বললাম,
- ‘আমার ছেলেটা মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে চেয়েছিলো। কিন্তু যে অবস্থা’।
জবাবে কাসেম জানালো,
- ‘দেখি স্যার! আমি ব্যবস্থা করতে পারলে ওর জন্যও একটা যোগাড় করবো’।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। সচিবের ডাকে তাঁর রূমের দিকে যাচ্ছি। সচিবের একান্ত সচিবের হাতে একটা ডিও চিঠি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের ডিও’।
জবাবে সচিবের একান্ত সচিব মঈন জানালো, ‘সচিব স্যার ক্রিকেট খেলার টিকেট-এর জন্য ডিও দিচ্ছেন’।

খেলা ও জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা টিকিট। সংসদ সদস্য, সরকারী কর্মচারী, সাংবাদিক সবার দাবী, ‘টিকিট চাই’। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। খেলা উপলক্ষে বিদেশ থেকেও কিছু লোক এসেছেন। টিকিট মাত্র সত্তর হাজার। বাংলাদেশ ক্রিকেট কাউন্সিল সবাইকে টিকিট দিবেন কি করে? মাফ চাইলেন। মাফ নাই। আমাদের টিকিট চাই। এ সময় কাগজগুলো বোমা ফাটানোর মত জানালো,
“সংসদ সদস্য, সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব সস্ত্রীক উদ্বোধনী দিনের টিকিট পাচ্ছেন”।

‘আমার যাওয়া বাধ্যতামূলক না হলে আমি ঠেলাঠেলি করে যাবো না’ - আমার বউ সাফ জানিয়ে দিলো। খুশি হলাম এই উন্মাদনার বাহিরেও কিছু লোক আছে। মেয়ে জামাই জিজ্ঞাসা করলো, টিকিট পেয়েছি কি না? পাইনি জানানোর পর বললো,
- ‘খেলার টিকিট না পেলেও তো ১৭ই ফেব্রুয়ারী ২০১১ এর উদ্বোধনীর টিকেট পাবা’।
- ‘পেলেও যাবো না’ জবাব দিলাম।
- ‘না গেলে টিকিট দু’টো আমাদের দিয়ে দিয়ো। আমরা যাবো’। মেয়ে আবদার করলো।
‘দু’টো টিকিট পেলে দিয়ে দিবো। তোরা যাস। আমার এসব ভালো লাগে না। এছাড়াও তোর মা যাবে না’। মেয়েকে কথা দিলাম। মেয়ে খুশি হলো।

উদ্বোধনী দিনের একটি টিকিট পেলাম। সচিব পর্যায়ে সস্ত্রীক টিকিট দেয়া হয়েছে। বিপত্তি বাধলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় সস্ত্রীক উদ্বোধনী দিনের টিকেট পেয়েছেন। কিন্তু দুই নির্বাচন কমিশনার টিকিট পাননি। আবুল কাসেম-এর মাথায় বাজ পড়লো।

ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব এর সংগে যোগাযোগ করে টিকিট প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ভার পড়লো কাসেমের উপর। কার্ড পাঠানো হয়েছে না হয়নি, জানা গেলো না। টেলিফোনে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পরে জানাবে বলে টেলিফোন কেটে দিলো। কাশেম কিছুক্ষণ পর পর টেলিফোন করছে। বিরক্ত হয়ে ক্রীড়ার উপ-সচিব টেলিফোন ধরা বন্ধ করে দিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় ক্রীড়া সচিব মাহবুবকে টেলিফোন করে নির্বাচন কমিশনারদের টিকিট না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১১ কমিশন সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আক্ষেপ করে বললেন,
- ‘নির্বাচন কমিশনারগণ কি উদ্বোধনী টিকিটও পেতে পারেন না?’

অফিস রুমে বসে একা বসে ভাবছি। এ যেন চাঁদে যাওয়ার টিকিট। না পেলে চাঁদে যাওয়া হবে না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বনি এম এর একটি কলি, “One way ticket, One way ticket to the moon”.

শেষ পর্যন্ত কমিশনার মহোদয়গণ টিকিট পেলেন। কাশেম স্বস্তি ফিরে পেলো।

টিকিট ও কার্ড এক জনের। হস্তান্তরযোগ্য নয়। ছেলে মেয়েজামাই কেউ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মাঠে গিয়ে দেখতে পারবে না। আমি যাবো? টিভিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলছে। আমার কার্ড অফিসের ড্রয়ারে পড়ে রইল।