চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন প্রশিক্ষণ উপলক্ষে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। গাড়ী আগাতে চায় না। উদাস মনে জানালা দিয়ে রাস্তার মানুষ, বাড়িঘর, আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। মাটিয়ে মানুষ আর মানুষ। বাড়ীতে পতাকা আর পতাকা। ছিটাফাটা দু'একটা অন্য পতাকা দেখা গেলেও ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাই বেশী। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে বাড়ীর ছাদে পতাকা উড়াতাম। এখনও বাড়িতে গাড়ীতে পতাকা উড়াতে দেখি। স্কুল কলেজের ছোট ছেলেমেয়েরা কাঠিতে কাগজের পতাকা নিয়ে রাস্তায় পার্কে হেঁটে বেড়ায়। গত ২৬শে মার্চেও বাংলাদেশের এত পতাকা দেখিনি।
পতাকা আকাশে উড়ছে। একটা বাড়ী আমাকে কৌতুহলী করে তুললো। ৪র্থ তলায় সামনে প্রায় ৩০গজ বারান্দা জুড়ে ব্রাজিলের পতাকা লাগানো। ৩য় তলায় আর্জেন্টিনার পতাকা। ২য় তলায় আবার ব্রাজিল। ছাদে অসংখ্য ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা পতাকা। মাঝে একটা জার্মানী আর ঘানার পতাকা দেখে অবাক হলাম।
যাত্রাবাড়ি পার হচ্ছি। সামনে একটা ছোটগেইট। বিয়ে, ওরস অথবা কোন বড় নেতা-নেত্রীর আগমনে এ ধরণের গেইট বানানোর রেওয়াজ হয়ে গেছে। এখন বিয়ের মৌসুম। ভাবছিলাম কোন বিয়ে বাড়ীর গেইট হবে। সামনে আসতেই ভুল ভাংগলো। কোন আর্জেন্টিনা ফুটবল প্রেমী আর্জেন্টিনার পতাকা, ম্যারাডোনা, মেসির ছবি আর কয়েকটা ফুটবল দিযে চমৎকার গেইট তৈরী করেছে। বুঝলাম এটা আজের্ন্টিনার গলি। ভাবছি ব্রাজিল বাদ গেল কেন। ভাবতে ভাবতে আর একটা গলি পার হচ্ছিলাম, দেখি আর একটি গেইট। এ গেইটটি আরও সুন্দর। ব্রাজিলের পতাকা, রোনালদিনহো, কাকা, পেলে, সাম্বা নৃত্যরত রমণীদের ছবি দিয়ে সাজানো পুরো গেইট। অন্ততঃ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। একটার পর একটা গলি পার হচ্ছি। প্রায় প্রতিটি গলিতে একটা সুদৃশ্য গেইট। আজের্ন্টিনা না হয় ব্রাজিল-এর সমর্থকদের গেইট।
তখনও কাঁচপুর ব্রীজ পার হতে পারিনি। ভাবলাম ঢাকার ছেলেমেয়ে, কাজকাম নাই, বাপ-মায়ের টাকারও কোন কমতি নাই। তাই এতসব। রাজধানী পার হলে এসব আর দেখা যাবে না।
কাঁচপুর ব্রীজ পার হলাম। না কোন পরিবর্তন দেখলাম না। শনির আখড়ার পর গেইট চোখে পড়লো খুব কম। তবে বাড়ীর ছাদে, রাস্তায়, পোলে পতাকার কোন কমতি নাই। মেঘনা পার হয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পতাকার সংখ্যা কমলো। চান্দিনা, কুমিল্লা জেলার একটা উপজেলা পার হচ্ছি। পতাকার ঘনত্ব আবার বেড়ে গেল। কুমিল্লা শহর পার হওয়ার সময় দেখলাম ঢাকার অবস্থা সারাদেশের। সারা রাস্তায় কোন ব্যতিক্রম দেখিনি। চট্টগ্রাম শহরে এসে পৌছলাম। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচার চলছে। ভেবেছিলাম এখানে ব্রাজিল আজের্ন্টিনার পতাকার চেয়ে মহিউদ্দিন, মঞ্জুর, মহিলা কাউন্সিলর ও কাউন্সিলদের ছবি পোষ্টার প্রাধান্য পাবে।
আমার ধারণা ভুল। এখানেও ম্যারাডোনা, মেসি, কাকা, রবিদিনহো, সাম্বা নৃত্যরত সুন্দরীদের আড়ালে সাদা-কালো মহিলা কমিশনার পদপ্রার্থী কয়েকজনের পোষ্টার দেখা গেল। বড় ম্লান লাগছিল সাম্বার পোষ্টারের কাছে।
সময় অল্প তাই নির্বাচন সংক্রান্ত কয়েকটি সভা, সেমিনার, ওরিয়েনেটশন বিকালে ও রাত্রের বেলায় আয়োজন করতে হলো। রাত ৮.০০ টায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে উসখুস শুরু হলো। একজন তরুন বয়েসী কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে বলে ফেললেন 'তাড়াতাড়ি শেষ করলে বাধিত হবো।' বাড়ী গিয়ে খেলাটা দেখবো। আরও কিছু আলাপ করার ছিল। অগত্যা তা বাদ দিয়েই শেষ করলাম। বিকালে চট্টগ্রাম ড. খাস্তগীর বিদ্যালয় হতে পিডিবি রেস্ট হাউসে আসছি। হঠাৎ মাইকের আওয়াজ। মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল কয়েকদিন ধরেই। কোন প্রার্থীর মাইকিং শোনা যাচ্ছিল না। কার মাইকিং জানার জন্য জানালার কাঁচ নামালাম। না কোন প্রার্থীর মাইকিং নয়। একজন জাপান ভক্ত বিশ্বকাপ উপলক্ষে জাপান দলের মেজবান খাওয়াবেন। তাই মাইকিং করে দাওয়াত দিচ্ছেন। বৃষ্টি না থাকলে দেখে আসতাম। যেতে পারতাম না জানি।
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা পতেঙ্গার দিকে গেলাম। পথেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। গাড়ী থেকে নামা গেল না। জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখে পিডিবি রেষ্ট হাউজে ফিরছি। সামনে বিশাল মিছিল।
- 'অঝোর বৃ্ষ্টিতে কার মিছিল?' - চালকের কাছে জানতে চাইলাম।
- 'কোন প্রার্থীর মিছিল নয়, স্যার। এটা আজের্ন্টিনার সমর্থকদের মিছিল।' গাড়ীচালক আমিনুলের জবাব।
- 'এই বৃষ্টিতে ভিজে এই পানির মধ্যে।' আমি অবাক হলাম।
- 'এদেশে পাগলের অভাব নাই, স্যার। পতাকাটা কি বিশাল, দেখছেন।' আমিনুলের স্বগোক্তি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৪ই জুন ২০১০ ঢাকা ফিরলাম। ঢাকার কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু আকাশে পতাকার ঘনত্ব বেড়েছে। বেড়েছে তোরণের সংখ্যা।
পত্রিকার পাতা উল্টালেই নানা বিষয় নিয়ে খুন জখম মারামারি লেগেই থাকে। নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাড়াবাড়ি, মারামারি। মুগদাপাড়ার এক ব্রাজিল সমর্থক বলেছে দক্ষিণ কোরিয়া আজের্ন্টিনার কুপোকাৎ করে দেবে। আর যায় কোথায়? আর্জেন্টিার সমর্থক এক ঘুষিতে ব্রাজিল সমর্থকের কুপোকাত করে দিয়েছেন। উনি এখন হাসপাতালে।
নির্বাচন সংক্রান্ত নানা কিছু নিয়ে মাথা গরম। সকালবেলা প্রায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী দেরী করে আসেন। এসে ঘুমান। না ঘুমালে ঢুলতে থাকেন। জিজ্ঞাসা করলে সবার এক জবাব,
'সারারাত খেলা দেখেছি স্যার। ঘুম হয়নি।'
জেসমিন টুলি, নির্বাচন কমিশনের উপ-সচিব। তাঁর ২ ছেলে। একজন ব্রাজিল, অন্যজন জার্মানীর সমর্থক। কাজের ছেলে আর্জেন্টিনার সমর্থক। তাঁদের সামনে 'এ' লেভেল পরীক্ষা। পড়াশোনা চাংগে উঠেছে। তিনি মহাবিরক্ত। কবে শেষ হবে এই বিশ্বকাপ। তবে না তিনি ছেলেদের পড়ার টেবিলে বসাতে পারবেন। তারপরও একটা প্রস্তাব ছেলেদের দিলেন-
'তোমাদের দুই ভাই ও কাজের ছেলের দলের খেলা যেদিন থাকে সেদিন তোমরা খেলা দেখ।'
ছেলেদের সাফ জবাব, 'না, আমরা সবখেলা দেখবো।'
জেসমিন টুলির কিছুই করার নাই। মেনে নেয়া ছাড়া। কাজের ছেলের আবদার অনুযায়ী তিনি তাঁকে আর্জেন্টিনার একটা জার্সি কিনে দিয়েছেন। সে ঐ জার্সি গায়ে দিয়ে খেলা দেখে।
মিহির সারওয়ার মোর্শেদ ব্রাজিলের একনিষ্ট ভক্ত। তাঁর দুই কন্যা। তারা আর্জেন্টিনার সমর্থক। বাড়ীতে মেয়েরা আর্জেন্টিনার বড় পতাকা উড়িয়েছে। মিহির মেয়েদের পাশে তাঁর অস্তিত্ব জাহির করার জন্য ছোট করে ব্রাজিলের একটা পতাকা উড়ালো। পরদিন সকালে ব্রাজিলের পতাকাটা আর দেখা গেল না।
খুরশিদ আনোয়ার অফিসে আসেন আধো ঘুমে। বুঝি সারারাত খেলা দেখেছে। তবে দল নিয়ে বাড়াবাড়ি তার নাই।
আবুল কাশেম নির্বাচন কমিশনের উপসচিব। তিনি আর্জেন্টিনার অন্ধ ভক্ত। তাঁর ভাইরা ও তাঁর ছেলে ব্রাজিল সমর্থক। দুই ভাইরা একবাড়ীতে থাকেন। ভাইরা ২০গজ লম্বা ব্রাজিলের পতাকা তৈরী করে বাড়ীর বারান্দায় ঝুলিয়েছেন। তাই দেখে তিনি ২৫ গজের আর্জেন্টিনার পতাকা তৈরীর অর্ডার দিয়েছেন। বাবার কৃর্তি দেখে ছেলে রাগ করবে বুঝতে পেরে কাশেম ছেলেকে বললো,
-'বাবা, আমার ১ম চয়েস আর্জেন্টিনা। কিন্তু ২য় চয়েস ব্রাজিল।'
-'আর্জেন্টিনা ব্রাজিল হতে পারে না। ব্রাজিলও কোনদিন আর্জেন্টিনা হবে না। আমাকে শান্তনা দিচ্ছ।' কাশেমের ছেলের জবাব।
কাশেম কোন জবাব না দিয়ে চুপ করেছিল বলে সে আমাদের জানিয়েছে। এভাবেই বিশ্বকাপ চলছিল। এরমধ্যে ১৭ই জুন ২০১০ চট্টগ্রাম সির্টি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সারারাত নির্বাচন কমিশনে থাকতে হলো। নির্বাচন সংক্রান্ত খবর দেখার জন্য আমার রুমে একটা ডিস সংযোগসহ টিভি আছে। সকলের অনুরোধে নির্বাচন বাদ দিয়ে খেলা চ্যানেল চালালাম। অনেক কথাবার্তার মাঝে মিহির জানালো তাঁর কন্যাদের আর্জেন্টিনা প্রীতির কারণ। মেসির চেহারা সুন্দর।
কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বের খেলা চলছে। ২রা জুলাই ২০১০ শুক্রবার, সংসদ ভবনের এমপি হোষ্টেল-এ ফয়সাল কাদের, নির্বাচন কমিশনের সহকারী সচিবের বিয়ে। দাওয়াত পেলাম বুধবার। দাওয়াত করার সময় মিহির সামনে উপস্থিত ছিল। ফয়সাল বিয়েতে যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করছে। মিহির বললো-
"ফয়সাল তুমি রাগ করতে পারো। বিয়ের দিন ব্রাজিল-নেদারল্যান্ডস খেলা। খেলা দেখতে হবে। আমি যেতে পারবো না।" ফয়সাল সংগে সংগে জবাব দিলো, "স্যার, ওখানে খেলা দেখার ব্যবস্থা রেখেছি।"
"তাহলে কোন অসুবিধা নাই। যাবো" - মিহিরের জবাব।
ফয়সালের বিয়েতে গেলাম। খেলা দেখারর সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিয়েতে সচিব বর্তমানে সদস্য পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নাসির স্যারের সংগে দেখা হলো। অনেক কথার মাঝে তিনি খেলা সম্বন্ধে মন্তব্য করলেন- "যদি ফাইনাল ইউরোপের দুটো দেশের মধ্যে হয়, তবে আমি অবাক হবো না।"
আমি বললাম, "আজ কি হয় জানি না। তবে আগামীকাল আর্জেন্টিনার পেরে উঠা সম্ভব হবে না।"
আমার কাছে জার্মানী একটা ব্যালান্স দল। রক্ষণভাগ অতিরিক্ত শক্তিশালী। একইসাথে কাউন্টার এ্যাটাকে তাঁরা পারদর্শী। জার্মানদের গতি অনেক বেশী। আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড খুব ভালো। তারপরও জার্মানীর রক্ষণভাগ ভেদ করা কঠিন হবে এটা আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে জার্মানী কাউন্টার এ্যাটাকে গোল করবে।
নাসির স্যারের সংগে কথা বলছি। "ব্রাজিল নেদারল্যান্ডকে একটা গোল দিয়েছে।" বলেই মিহির পুনরায় খেলার বাক্সের সামনে গিয়ে হাজির হলো। আমার একটা কাজ ছিল। আমি ফয়সালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম। তখনও খেলা চলছে। করিডোর দিয়ে হাটছি। টেলিফোনে ড্রাইভার আমিনুলকে খুজছি। সে ধরছে না দেখে তাঁকে খুঁজতে বাহির হলাম।
এক ভদ্রলোক। বয়সে তরুন। সদ্য বিয়ে করেছেন। বউটি দেখতে বেশ সুন্দর। বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ একজন ব্রাজিল সমর্থক মন্তব্য করে বসলো, "আগামীকাল আর্জেন্টিনা অন্ততঃ এক গোলে জার্মানীর কাছে হারবে।"
-"কি বললেন। আপনি বললেই হলো" সুন্দরী বউ-এর স্বামী প্রতিবাদ জানালো।
এসব নিয়ে জটলা তুমুল হট্টগোল। গালাগালি মারামারি পর্যায়ে পৌছে গিয়েছে। আমার ড্রাইভার সাহেব দু'জনের মধ্যে দাড়িয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত সুন্দরী বধুটি শেষ রক্ষা করলেন। স্বামীকে টেনে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের দিকে চলে গেলেন। গাড়ীতে উঠতে যাবো এমন সময় নির্বাচন কমিশনের সহকারী সচিব মাহবুব ও রফিকের সংগে দেখা। তাঁরা দু'জনই বউ নিয়ে বিয়েতে এসেছে। আমার সাথে তাঁদের বউদের পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। দাঁড়াতে হলো। মাহবুব সদ্য বিয়ে করেছে। তাঁর বউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক এডমিনিষ্ট্রশনে ৩য় বর্ষে পড়ে। গায়ে একগাদা গয়না। রফিক-এর বউর সাজগোজ কম ছিল। কোলে একটা বাচ্চা।
মাহবুবের বউকে দেখে মনে হলো, এদেশের মেয়েরা নারী স্বাধীনতার কথা যতই বলুক। এটা সহজে আসবে না। এরা কারও বউ, কারো মা হয়ে থাকতে চায়। এদের স্বাধীনতা দিলেও এরা কি স্বাধীন হতে পারবে? ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ী ফিরলাম। ব্রাজিল ২-১ গোলে নেদারল্যান্ডস-এর কাছে হেরে গেল। টিভি-র কাছ থেকে উঠে খাবার টেবিলে বসেছি। হঠাৎ রাস্তায় মিছিল আর শব্দ।
"ব্রাজিল ভুয়া। কাকা" অদ্ভুদ সব শব্দ দিয়ে আর্জেন্টিনার সমর্থক দল আনন্দ মিছিল করছে। হেরেছে ব্রাজিল, আনন্দ মিছিল হচ্ছে ঢাকার ঢালি রোডের গলিতে বাংলাদেশে। কি অদ্ভুত কান্ড।
টিভি চ্যানেলগুলো রিপোর্টিং করছে। ব্রাজিল সমর্থকদের কান্না দেখাচ্ছে। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের আনন্দ মিছিলের বন্যা। সকালবেলা পত্রিকা থেকে জানলাম একজন ব্রাজিল সমর্থকের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। তিনি মৃত্যুর সংগে যুদ্ধ করছেন। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ। অনেক গাড়ী ঘোড়া ভাংচুর। কি বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস।
৩রা জুলাই ২০১০ শনিবার। আমার ব্যাচমেট আব্দুস সোবহান-এর মেয়ের বিয়ে। মিরপুর সিতারা কনভেনশন সেন্টারে। কি কারণ, জানি না, আমাদের ব্যাচে একমাত্র সেই সিনিয়র সহকারী সচিব পদেই রয়ে গেছে। আমি তার মেয়ের বিয়েতে যাবো। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আর্জেন্টিনা জার্মানীর খেলা। রাস্তাঘাট ফাকা। সময়ের আগেই সিতারা কনভেশন সেন্টারে গিয়ে পৌছলাম। হলে সবাই খেলা দেখতে চায়। খেলা দেখার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বাধ্য হয়েই মাঝে মধ্যে মোবাইলে নিউজ আপডেট শুনছিলাম। জার্মানী এক শূণ্য গোলে এগিয়ে।
অনেকদিন পর সোবহান আর তাঁর বউ-এর সংগে দেখা হলো। তাঁর বউ আমাকে চিনতে পারলো না। আমার শরীরটা ভালো ছিল না। তাই তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। শেওড়াপাড়ায় এসে আটকে পড়লাম। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা রাস্তা আটকে দিয়েছে। টায়ারে আগুন দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ রেফারী আর্জেন্টিনার একটি গোল অফসাইড-এর কারণে বাতিল করে দিয়েছে। এটা রেফারীর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ। কি বিচিত্র। গাড়ী-ঘোড়া ভাংচুর করছে। বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকার পর ছাড়া পেলাম। বাড়ীতে এসে পৌছেছি। খেলা শেষ হলো। জার্মানী ৪-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে বিধ্বস্থ করে সেমিফাইনালে উঠছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই গতকালের শব্দ চিৎকার আনন্দ মিছিল। শুধু একটি শব্দ পরিবর্তন হয়েছে, আর্জেন্টিনা।
"আর্জেন্টিনা ভুয়া। মেসি না মাছি।"
চ্যানেলগুলোতে আর্জেন্টিনার কান্না আর ব্রাজিলের আনন্দ মিছিল দেখানো হচ্ছে। কয়েক জায়গায় মিছিল ও ভাংচুর-এর খবরও পাওয়া গেল।
সকালবেলা পত্রিকার হেডলাইন। বাঙ্গালীর বিশ্বকাপ শেষ। অবাক হলাম বাঙ্গালীর বিশ্বকাপ শেষ হবে কেন? আমি কি তাহলে অবাঙ্গালী। আমার বিশ্বকাপ আছে। জেসমিন-এর ছেলের বিশ্বকাপ আছে। আমরা খেলা উপভোগ করতে চাই। আমরা আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দিয়ে জোর করে দেখার পক্ষপাতি নয়। তারা পেলে পাক আমরাও খুশি হবো।
৪রা জুলাই ২০১০ অফিসে এসে দেখি। সবার মুখভার। জেসমিন খুশি। তবে জানালো তার কাজের ছেলেটি না খে কাদতে কাদতে শুয়ে পড়েছে। সে অনুযোগের সুরে জেসমিনকে বলেছে, -"আপনি কেন জার্সিটা কিনে দিলেন"।
খুরশিদ আনোয়ার যথারীতি ঢুলছেন। বাতেন আর্জেন্টিনার সমর্থক। জোর করে মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। মিহির গতকাল ভেংগে পড়েছিল। আর্জেন্টিনার বিদায়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। কাশেম হঠাৎ রূমে ঢুকলো। বিমর্ষ হতাশ বিধ্বস্থ চেহারা। দুলদুল চোখে সে বললো, "স্যার আমার ভালো লাগছে না। আমি চলে গেলাম"। কোন জবাবের অপেক্ষা না করে আর্জেন্টিনার অন্ধ ভক্ত কাশেম অফিস ছাড়লো।"
৫ই জুলাই ২০১০ যথারীতি অফিসে এসেছি। মিহির জানালো, তাঁর কন্যারা আজও শোকে শোকাকিভুত। সকালবেলা বদনা বুকে করে দাড়িয়ে আছে। মিহির ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছে। সবাই মন্তব্য করেছে,
'কি আর করা বিশ্বকাপ পেল না মেসি। বদনাই তার বিশ্বকাপ।'
কাশেম অফিসে এসেছে। আজও আগের মত বিধ্বস্থ। চোখ ছলছল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা কররাম, "কাশেম! আর্জেন্টিনা আমাদের কে? কেন এমন ভেংগে পড়েছেন?" জবাবে কাশেম জানালো, "স্যার! জানি আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ নয়। এক মহাদেশ নয়, এক জাত, ধর্ম কিছুই নয়। তবুও জানি না কেন এম খারাপ লাগে"।
আমি কি বলতে যাবে এমন সময় কাশেম বললো, "স্যার, আমি যাই। আমার কান্না পাচ্ছে।"
চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আমার মাথায় একটা পোকা ঢুকে ছিল। একটা সার্ভে করবো।
আমার বাহিনীকে দিয়ে একটা সার্ভে করালাম। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, গ্রাম সবকিছুকে স্যাম্পল হিসেবে নেয়া হয়েছিল। তাঁদের হিসাবমতে মোট পতাকা উড়েছে এক থেকে দেড় কোটি। প্রতিটি পতাকার দাম গড়ে একশত হতে দেড়শত টাকা। নীচের দিকের হিসাবেও আমরা শুধমাত্র পাতাকার জন্য খরচ করেছি অন্ততঃ ১০০ কোটি টাকা। গাড়ী-ঘোড়া ভাংচুর বাবদ খরচ বাদ দিলাম।
অর্থনীতিবিদগণ বললেন, তাতে কি? কিছু কর্মসংস্থান হয়েছে। ভ্যালু এড হয়েছে। মন্দ কি? হয়েছে তা ঠিক। তবে ১০০ কোটি টাকার জাতীয় সম্পদের ক্ষতি আমাদের পূরণ করতে হবে।
৫ই জুলাই ২০১০ সকালবেলায় বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। সামনের বাড়ীর ৪তলার ছাদ হতে এক মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক তাঁর উড়ানো ব্রাজিলের পতাকাটা নামাচ্ছেন। আর চোখ মুছছেন।
আমি বাঙ্গালী। আমার দেশ বাংলাদেশ। আমার দেশের না পাওয়ার বেদনা আমাকে বঞ্চিত করতে পারে। আমি কাঁদতে পারি। অন্য দেশের না পাওয়ায় আমার এত হতাশা কেন? বুঝি া, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলছে না। আমার জীবদ্দশায় খেলতে দেখবো এটা বিশ্বাসও করি না। আমি ভালো খেলা দেখতে চাই। এটা না পেলে আমি হতাশ হতাম। আমি ভালো ভালো খেলা এ বিশ্বকাপে উপভোগ করেছি। কে কাপ নিয়ে যাবে, এটা কি আমার আমাদের কোন বিষয়! যদি জার্মানী নিয়ে যায়, নিক। স্পেন নিলে আমার ক্ষতি কি? নেদারল্যান্ডস বা উরুগুয়ে নিয়ে গেলেই বা আমার কি আসে যায়? যদি বিদ্যুৎ থাকে, আমি ভালো খেলা দেখতে চাই।