আইসিটি এর একাল-সেকাল

Category: Science & Technology Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 7306

কয়েকজন বাচ্চাছেলের সাথে কথা হলো। গর্ব করে জানান দিলো তাঁরা আইসিটি গ্রাজুয়েট। আমার আইসিটি সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে সন্দেহ থেকে বললো, এটা নতুন একটা বিদ্যা। নতুন বিদ্যায় বিদ্যান লোক একটু আধটু গর্ব করবেই। গর্ব করারই কথা। তাদের কথাবার্তা আমাকে ভাবিত করলো। আইসিটি শুধু একালের এর সেকাল নাই। এ আবার কেমন কথা। ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। খেই হারিয়ে ফেললাম। বিরক্ত হয়ে বাদ দিলাম সবকিছু। সেলফ থেকে সুকান্ত সমগ্র নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছি। হঠাৎ নজর কাড়লো রানার কবিতা;
“রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে
......................................................
হাতে লুন্ঠণ ঠনঠন জোনাকীরা দেয় আলো......”

পড়ছি আর ভাবছি, ছেলেগুলো ঠিক বলেনি। খবরের বোঝা, পথ চলা, লুন্ঠণ, বল্লম এ সবইতো আইসিটির সেকাল। খবরের বোঝা এটা তথ্য ছাড়া আর কি? রানারের পথ চলাইতো ছিল যোগাযোগ। প্রশ্ন করবেন, ঘন্টা, বল্লম কেন?
“তথ্যের নিরাপত্তার জন্য”।

সেকালে মানুষ তথ্য সৃষ্টি করেছে তাঁর চেনা মানুষের জন্য। তথ্য সৃষ্টি কোন কর্মসংস্থান করতে পারেনি। এ তথ্যও বিপনন যোগ্য ছিল না। যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য রানারের জন্ম হয়েছে।

পথ পরিক্রমায় আইসিটি নতুন মাত্রা যোগ হলো। গণমানুষের সংবাদপত্র, বই, ম্যাগাজিন, পুথি নানা আকারের। তথ্য তৈরী করা হচ্ছে। সংবাদ কর্মী, লেখক, কবি অনেকে একযোগে কাজ করছে নতুন প্রযুক্তির সংগে। কম্পোজার, প্রুফ রিডার, মেশিনম্যান, এক এলাহী কান্ড। হকার, ফেরিওয়ালা, দোকানদার সবকিছু মিলে এক বিশাল যোগাযোগ প্রযুক্তি ভান্ডার গড়ে উঠেছে। রানারের জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত যান। বল্লম, ঘন্টা, হারিকেন হারিয়ে গিয়ে এসেছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ দিয়ে তৈরী টেলিগ্রাফ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিপ্লবের সূচনা করলো। টক্কা দিয়ে তথ্যের আদান প্রদান, অভাবনীয়। রানার ঘোড়া, গাড়ী কোন কিছু নাই। তথ্যকে কোডে রূপান্তর করে তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ দিয়ে শতশত মাইল দূরে টরে-টক্কা আওয়াজ। এই আওয়াজকে তথ্যে রূপান্তর। ছোট ছোট তথ্য আদান-প্রদানে এক অভিনব পন্থা। বিশাল বিশাল তথ্য ভান্ডারের আদান-প্রদানে এ প্রযুক্তি বড় অসহায়। কোড এবং ডিকোড জানা লোকদের হাতে বন্দী এ প্রযুক্তি। তাই বলে এদের হাতের পুতুল হয়ে বসে থাকেনি তথ্য প্রযুক্তি। হঠাৎ করে একদিন আবির্ভাব হলো টেলিফোন যন্ত্রের অবাক কান্ড, আমি মার সাথে কথা বলছি। মা জিজ্ঞাসা করছে,
“বাবা, ভালো আছিস? কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?”
জবাব দিচ্ছি,
“না মা, কোন কিছু হয়নি? ভালো আছি”।
কথার জবাবে মা উপদেশ দিলেন,
“ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস বাবা”।
অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল। কল্পনায় মায়ের মুখ, কানে মায়ের সত্যিকারের কন্ঠ। টেলিফোন কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্রণ দিয়ে আমাদের সামনাসামনি করতে পেরেছে।

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিকে রেডিও তারের ভিতর থেকে টেনে বাহির করে আনলো। একটা বাক্স থেকে কত রকমের মানুষের কথা শুনা যাচ্ছে। রেডিও নিয়ে আমাদের বাড়ির দু’টো ঘটনা আরেকটি লিখায় বলেছি। প্রাসংগিত তাই লোভ সামলাতে পারলাম না। আবার লিখছি। বিরক্তি লাগলে প্রিয় পাঠক এ অংশ ছেড়ে পড়বেন।

বাবা ঢাকা থেকে একটা মারফি রেডিও কিনে আনলেন। মহা হুলুস্থুল। বাক্সটা দিয়ে গান, নাটক শোনা যাবে। বাঁশঝাড় থেকে দু’টো লম্বা বাঁশ কেঁটে এ্যান্টেনা লাগানো হলো। গাড়ীর ব্যাটারী দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। সবাই চারপাশে বসে। সংযোগ দেয়ার সাথে সাথে বাক্সটার পিছনে একটা বাতি জ্বলে উঠলো। বাতির আলোয় সবার চোখে আনন্দ, অবিশ্বাস-এর মিশ্রণ দেখা যাচ্ছিল। বাবা চাকার মত একটা জিনিষ ঘুরাচ্ছেন। হঠাৎ একটা ছোট ছেলের আওয়াজ শোনা গেল,
“বাগবাকুম পায়রা মাথায় দিয়ে টায়রা,
................................................................

রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠান চলছে। তেনু চাচা নিজেকে চেপে রাখতে পারলেন না। বললেন,
“হাজি ভাই। এ্যাটা কথা হইলো। বাক্স কথা বলছে। আপনি ছোট একটা ছ্যালাকে বাক্স ঢুকিয়ে রাইখাছেন। সেই কথা বলছে। বাক্সটা খুলেন। হামরা দেখভো”।
বাবা মুচকি হেসে তেনু চাচাকে বললেন,
“তেনু ভাই। দেখতে অসুবিধা নাই। দেখাতে হলে রেডিওটা বন্ধ করতে হবে”।
ছোটরা না না করে উঠলো। তেনু চাচা ধমক দিলেন।
“চুপ কর! পরে শুনিস, বাক-বাকুম”।
তেনু চাচার ধমকে সবাই চুপ। বাবা কানেকশনগুলো অফ করে পিছনের কার্ডবোর্ডটা সরালেন। বাক্সের ভিতর স্পিকার, তার, ট্রানজিস্টার, রেজিষ্ট্যান্ট, কার্বন রড় দিয়ে ভর্তি। কোন ছেলেমেয়ে নেই। তেনু চাচা অবাক বাকরুদ্ধ। বাচ্চাগুলো সাহস পেয়ে মুখ খুললো।
“হয়্যাছে। দেখ্যাছেন তো। এবারে মাফ করেন। হামরাকে শুনতে দেন”।
সবকিছু সেট করে সংযোগ দিয়ে অনুষ্ঠান আবার চালু করা হলো। ততক্ষণে ছোটদের অনুষ্ঠান শেষ। খবর শুরু হয়েছে।

অন্য ঘটনাটি রোজার মাসের। ২৯ রোজা শেষে রাতে রেডিওর খবর, পটুয়াখালীতে চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকাল ঈদ। বাচ্চারা পটকা ফুটাচ্ছে। গ্রামের মানুষ ইমাম সাহেবকে ধরলেন,
“মসল্লা কি? নামাজ হবে কি না”
ইমাম সাহেব বলেন,
“আপনারা ঠিক করেন। আপনারা বুললে হ্যামি নামাজ পড়হিয়া দিবো”। ইমাম সাহেব নিজে কোন সিদ্ধান্ত দিলেন না।
সবদর মন্ডল বললেন,
“হাদিসে আছে, দু’জন সুস্থ সবল মানুষ চাঁদ দেখ্যাছে বুললে নামাজ পড়হা যায়। তুফানী ভাই-এর রেডিওতে বুল্যোছে। রেডিওটা লতুনই। ভাংগা চোরা নাই। এখন দেখতে হব্যে আর একটা এমন রেডিও বুল্যাছে কি না”।
শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল। বললাম,
“চাচা, সব রেডিওতে একই কথা বলে”। চাচা ধমক দিয়ে বললেন,
“যা বলছি তাই কর”।
বাবা আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন। এদের বোঝানো যাবে না। বোঝাতে চাইলে একজনকে সাইকেল নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাঠাও। সে শুনে এসে বললে এদের ভুল ভাঙ্গবে। তুমি বললে তোমাকে বিশ্বাস করবে না, বরং বেয়াদব ভাববে।

পাশের বাড়ী রাজ্জাক ভাই আমাকে নিয়ে সাইকেলে করে বাসুদেবপুর গেলেন। মজিবুর রহমান সাহেবেরও একটা রেডিও ছিল। বৈঠক ঘরের টেবিলে রেডিওটা রাখা আছে। রংগীন কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমাদের কথা শুনে মজিবুর রহমান সাহেব বৈঠক ঘরে আসলেন। আমরা কেন এসেছি জানার পর ইফতারীর বেগুনী, পেঁয়াজু, ঘুঘনি খেতে দিয়ে বললেন,
“বুঝেছি। সব রেডিও একই কথা বলে। কিন্তু ওরা তো বুঝতে চায় না”।
ফিরে আসলাম। সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে। রাজ্জাক ভাই বললেন,
“শুনে আসলাম। বাসুদেবপুরের মজিবুর রহমান সাহেবের রেডিওতে। পটুয়াখালীতে চাঁদ উঠার খবর দিয়েছে”।
শুনে সবদর মন্ডল চাচা জানতে চাইলেন,
“রেডিওটা দেখেছো। ভাংগা চোরা ছিল না তো?”
জবাবে রাজ্জাক জানালেন,
“দেখেছি। খুব সুন্দর রংগীন কাপড় পড়ানো”।
কে একজন বলে উঠলো,
“কাপড় পড়ানো কেন, মহিলা রেডিও নাকি?” কথাগুলো কেউ আমলে নেয়নি। বাঁচা গেল। নিলে যন্ত্রনা বাড়তো। সবদর মন্ডল রায় দিলেন,
“ঠিক আছে হুজুর। আর তারাবি না। কাল নামাজের ইন্তেজাম করেন। ঢোল পিটিয়ে দ্যান”।

রেডিও, ঢোল পাশাপাশি কাজ করছে। আইসিটি-এর সেকাল একাকার হয়ে গেল। রেডিও পটুয়াখালীর চাঁদকে সারাদেশের আকাশে এনেছে। ঢোল, চাঁদকে মানুষের ঘরে নিয়ে গেছে। ঢোল-এর জায়গায় মাইক দখল করেছে।

সেলুলয়েডে ছবি, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার সবকিছু তথ্য প্রযুক্তিতে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে কম্পিউটার তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। আজকাল সবকিছু ভার্চুয়াল।

রানার ছুটেছে তাই ঘন্টা বাজছে রাতে; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কোন রূপ আজ আর মনে হয় না। আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে এটা একটা বড়জোর ঘুম পাড়ানী গান।

এসেছে ভালো থাকার যুগ। কি মনে করে রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লা লিখেছিলো,
“ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো”।

সেদিন তাকে অনেকে আমরা পাগল ভেবেছি। আজ আমরা সবাই পাগলের মত আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখছি। তথ্যভান্ডার তৈরী করে আকাশের ঠিকানায় পাঠাচ্ছি। আমাদের ঠিকানায় বাড়ী নম্বর, রাস্তা নম্বর এসব বড্ড সেকেলে। আমরা সবাই এ্যাট দা রেট অব ইয়াহু, হটমেল, লাইভ ডট কম দিয়ে আকাশে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, এইচটিটিপি-এর জালে জড়িয়ে পড়েছি।

ই-মেইল, ওয়েভ, টুইটার, ফেসবুক-এর জগতে আমি ভার্চুয়াল। একসংগে আমি আকাশের ঠিকানায় সবার সংগে যুক্ত। সাহিত্য টেলিভিশনেও ডট কম ঢুকে পড়েছে। ভারতের একটা চ্যানেলের সিরিয়ালের নাম ভালোবাসা ডট কম। ভালোবাসাকেও আমরা আকাশের ঠিকানায় আপলোড শুরু করেছি।

ভার্চুয়ালিটির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে বসবাস করে রিয়ালিটির চিন্তা করা যায় না। বর্তমানের ছেলেরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সেকাল বলতে বোঝে ভার্চুয়ালিটির গোড়ার দিক।

আমি ভার্চুয়াল জগতের সংগে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করি। আমার বউ এর কাছে ধারেও নেই। সে সবসময় বাস্তব জগতে। বাড়িতে ল্যাপটপ, ডেক্সটপ থাকলেও কোনদিন এগুলো হাতে নিয়ে দেখে না। তার সেলফোনটায় কোন গন্ডগোল বাধলে,
“দ্বীপন, বাবা দেখতো, আমার মোবাইলে রিংটোন নাই”।

ছেলে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার বন্ধুদের সাথে গেইম কম্পিটিশন খেলছে। মার সেল ঠিক করে দেয়ার মত সময় তার নাই। খেলতে খেলতে জবাব দেয়,
“বাবাকে বলো”।
“বাবা পারে না”। মার উত্তর
“বাবা আমার চেয়ে ভালো পারে”। ছেলের জবাব।
“বল, তুই করে দিবি কি না?”
মার জবাবে ছেলে চুপচাপ। শেষেমেষ আমাকেই সেল ঠিক করে দিতে হলো।

কেউ বাংলাদেশের আইসিটি দেখলে আলেকজান্ডারের মত বলবে, সেলুকাস বিচিত্র এই বাংলাদেশ। বিচিত্র এদেশের আইসিটি, আইসিটি-এর সেকাল একাল সব একাকার হয়ে আছে এ দেশে। শত প্রতিবন্ধকতার মাঝে নতুন প্রজন্ম লালন করছে এই আইসিটির অগ্রযাত্রাকে। জয় হোক এ যাত্রার।