জীবন

Category: Religion Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 5569

অনেকদিন লিখি না। সেই কবে চাকুরী থেকে বিদায় নিয়েছি ১লা জানুয়ারী ২০১৪। বিদায়ের দিনও নথিতে লিখেছি- সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা। ডিও দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। অবসরের মুহুর্তে আসার অনুভুতিগুলোকে জানানোর জন্য লিখেছিলাম “অবসরপ্রাপ্ত সচিব”। নেটে আমার শেষ লিখা। আর লিখা হয়নি। অফুরন্ত অবসর; কেন লিখছি না ? কেন লিখা হচ্ছে না ? জানি না। কাগজ কলম নিয়ে বসে ভাবি;

-“ কি লিখবো ? আচ্ছা না হয় লিখলাম,

-“ কে টাইপ করে দিবে ?

-“ দেয়ার পর সংশোধন কি ভাবে করবো ?

বাংলা টাইপ করতে পারি না। কেন শিখিনি জানি না। শিখলে ভালো হতো। চিন্তাগুলো আছন করে রয়েছে। কাগজ কলম তুলে রেখে ঘুম দেয়ার চেষ্টা করি। ঘুম আসে না। আইপ্যাডটা টান দিয়ে নেটে পত্রিকা পড়ি। ফেসবুকে ব্রাউজ করি। এ ভাবেই ৬ মাস কেটে গেল অবসর জীবন।

সমবায় অধিদপ্তর তাদের কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। রেজিষ্টার কো-অপারেটিভ হুমায়ন খালিদ, (বর্তমান সচিব) বন্ধু মানুষ। কিছু করছি না জানে। টেলিফোনে জানতে চাইলো;

-“ কি করছিস ?”

-“ কিছু না।”

-“ কো-অপারেটিভ কর্মকর্তাদের জন্য ট্রেনিং করছি। একটা ক্লাস নিয়ে যা। দেখা তো হবে।”

এ রকম অনুরোধ এখন আর কেউ করে না। নিতান্ত বন্ধু বলে করছে। বন্ধুত্বের উষ্ণতায় মুগ্ধ হয়ে স্বানান্দে রাজি হলাম। কোনো দিন হ্যান্ড আউট ছাড়া কোন ক্লাশে উপস্থিত হইনি। বিপদে পড়লাম;

-“ টাইপ করবে কে ?”

সিদ্ধান্ত নিলাম অভ্র ফনেটিক্স দিয়ে ছোট খাটো একটা কিছু নিজেই তৈরী করে নিবো। ল্যাপট্যাপটা খুলে দিন শেষে একটা প্যারা লিখলাম।

-“ আমার দ্বারা হবে না।”

সব কিছু বাদ দিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে ইংরেজিতে কয়েকটা স্লাইড তৈরী করে হুমায়নের কাছে হাজির হলাম। ক্লাস শেষে আড্ডা মেরে কলাবাগানে ফিরলাম। অনেকদিন আড্ডা দেয়া হয়নি। আড্ডা ছাড়া জীবনের মানেই বদলে গেছিল।

মোর্শেদ, যুগ্ম-সচিব, সে আমার সাথে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব তিন পদেই কাজ করছে। তাঁর বউ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। ডেপুটেশনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপ-প্রধান ছিল। তখন আমি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকল্প পরিচালক। বসে আছি, মোর্শেদ মেনে নিতে পারছে না। মোর্শেদ এর বউ তাঁর ক্যাডারে ফিরে গেছে। এখন ‘নায়েম’ এর উপ-পরিচালক। নায়েমে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। সেখানে ক্লাস নেয়ার কথা বললে রাজি হয়ে গেলাম। পাওয়ার পয়েন্টে ইংরেজিতে কয়েকটা স্লাইড তৈরি করে নায়েমে হাজির হলাম। সময় কাটানো ছাড়াও জীবনের প্রয়োজনে কিছু একটা করতে হবে। তাই কাউকেই না করি না।

ইউএনডিপিতে কনসালটেন্ট পদে আবেদন করবো। বায়োডাটা পুর্ণগঠন করছি। একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্পে ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট পদে আবেদন চেয়েছে। বায়োডাটাটা কাঁটাছেঁড়া করে আবেদন পত্রটা প্রকল্প অফিসে জমা দিতে গেলাম। প্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত সচিব, ‘প্রশান্ত’ ছোট একটা হাসি দিয়ে বললো;

-“ কাগজগুলো সত্যায়িত করে দিলে ভালো হতো স্যার।”

-“ করে দিচ্ছি ? দাও। ” সম্মতি জানালাম।

-“ দরকার নাই স্যার, আমরা তো চাইনি।”

মনে হলো প্রশান্ত করুনা করলো। বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ঘুমাই, বাজার করি, মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরা ফিরা, পত্রিকা পড়া, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, এসব নিয়ে আছি। বিরক্তি ভরা এ জীবন।

জীবনের উপর ঘেন্না না ধরলেও বিরক্তি এসে গেছে। জানি না বাকি সময় কাটাবো কি ভাবে! প্রতিদিনের মত আইপ্যাডটা নিয়ে ফেসবুকে ব্রাউজ করছি। ম্যাসেস অপশনে একটা চিহ্ন দেখে লগইন করলাম। একজন লিখেছে;

-“ এ জীবনের কোন মানে হয় না। ”

তাঁকে সান্তনা দিতে লিখলাম;

-“ বন্ধু এটাই জীবন। জীবনে সুখ আছে, দুঃখ আছে, জ্বরা আছে, আনন্দ হতাশা সবই আছে। এটাই জীবন বন্ধু।”

জবাবে জানালো;

-“ এত কষ্ঠ আর পারছি না। ”

তাকে ধৈর্য্য ধরার উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলাম। ব্রাউজ করতেও ভালো লাগছিলো না। লগঅফ করে চোখ বন্ধ, ভাবছি।

-“ আসলে জীবনের মানে কি ?”

-“ জীবনের মানে কি সবার কাছে এক ?”

ভাবনাগুলো আমাকে তেড়ে বেড়াচ্ছিল। মনে পড়লো, বুলগেরিয়ান কবি ‘বাপছারভ’ এর ‘জীবন’ কবিতার চরনগুলো। তিনি আমার ভীতরে মস্ত একটা আঁচড় কেঁটে রেখেছেন। অনেক লেখায় আমি তাঁকে স্মরন করেছি। কেউ আগে পড়ে থাকেন বিরক্ত হন, ক্ষমা করে দিবেন। বুলগেরিয়ান ভাষা থেকে বাংলা;

-এইতো আমি নিশ্বাস নিচ্ছি

যেমন পারছি কবিতাও লিখছি, কাজ করছি।

জীবন তুই ভাবছিস আমি তোকে কত ভালোবাসি।

তুই তো জানিস না জীবন, আমি তোকে কত ঘৃনা করি।

কবিতা লিখা, কাজ করা জীবন নয় ! কাজগুলো জীবন হলে ঘৃনায় তিনি এগুলোও করতেন না। তাহলে;

-“ জীবন কি ?”

ছোট বেলা থেকেই পাগলাটে। হাই স্কুল পর্যন্ত এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার আমাকে পাগলা ডাকতেন। তাঁর মুখে আমার নাম কোনদিন শুনিনি। আর ডাকবেন নাই বা কেন ! এমন এমন কান্ড ঘটাতাম যার জন্য আমাকে পাগল ভাবাই ঠিক ছিল। স্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটি ছাড়লাম। পাগলামি আমাকে ছাড়লো না। পাগলামি নিয়েই চাকুরী জীবনও শেষ করলাম। স্কুলে মাস্টার মশাই পাগল ডাকলেও এখন কেউ ডাকে না।

মাথায় পাগলামি চাপলো জীবনের মানে আমি খুঁজে বাহির করবো। সংসদ লাইব্রেরীটা বেশ সমৃদ্ধ। অনেক বই, পত্রিকা ঘাটাঘাটি করলাম। মনে ধরে এমন কোন জীবনের মানে পেলাম না। নেটে আজকাল অনেক কিছু থাকে। শুরু হলো নেটে ঘাটাঘাটি। বস্তা পঁচা গাদি গাদি লিখা;

-“ জীবন মানে যুদ্ধ।”

-“ জীবনে জ্বরা থাকবে, কষ্ঠ, বেদনা থাকবে।”

মনে ধরলো না। সামাজিক গবেষণা আমার নেশা। হঠাৎ মনে হলো দেখি না মানুষের কাছে জীবনের মানে কি ?

শুক্রাবাদ বাজারে ডালি নিয়ে কাজের জন্য বসা লোক; রিক্সাওয়ালা, রাজমিস্ত্রি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম,

-“ জীবন মানে কি ?”

একজন বললেন;

-“ আমরা কি বুঝি। আপনারাই ভালো জানেন।”

-“ আপনাদের কি মনে হয় ? আপনাদের কথা আমি জানতে চাই।”

বলতে চাইছিলনা। আমার অনুরোধে ঢেঁকি গিললেন।

একজন বললেন;

-“ এই কাজ কাম করি/বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা।”

কলা বাগানে কাজ করে তরতাজা একটা প্রাণ। সে জানালো;

-“ জীবন মানে কি ? এই কাজ করা। আনন্দ ফুর্তি করা। মাঝে মধ্যে একটু সুখ খোজা।”

ধানমন্ডি লেকে রবীন্দ্র সরবরের কংক্রিটের বেঞ্চে বসা এক জন হতাস মাঝ-বয়সিকে জিজ্ঞাসা করতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন;

-“ যান ভাগেন মিয়া। নিজে বাঁচি না নিজের জ্বালায়, উনি জানতে চান জীবনের মানে কি ?”

হা করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে আরও রেগে গিয়ে বললেন;

-“ মিয়া, হা করে দেখছেন কি ? যান ভাগেন। আমার মত ম্যানকার চিপায় পড়লে বুঝতেন জীবন মানে কি ?”

পিয়ন, চাপরাশি, কেরানীরা বললো;

-“ জীবন মানে ছেলে মেয়েদের মানুষ করা।” সরকার সময় মত পে-স্কেল দিলে, জিনিষ পত্রের দাম কম থাকলে ভালো হয়, আর কি?

কয়েকজন কর্মকর্তা বললেন;

-“ জীবন মানে ৯টা - ৫টা অফিস যাওয়া আসা। শুক্র-শনি ঘুম পাড়া। সরকার কবে প্রমোশন, পে-স্কেল দেয় অপেক্ষা করা।”

আজও জীবনের মানে পেলাম না। মাঝে মাঝে আগের অফিসে যাই। আড্ডা মারি। অবসরপ্রাপ্ত একজন লোক পাঁচটা পর্যন্ত বসে থাকলে পরে আমার গাড়ি ঘোড়া নিয়ে এরা বিব্রত হবে। তাই ৪:৩০ টার দিকে সচিবালয় ছাড়লাম। সচিবালয়ের সামনে থেকে কোন সিএনজি পাওয়া যাবে না। শিক্ষা ভবনের সামনে হাইকোর্টের পাশ থেকে নিবো ভেবে হাঁটা দিলাম। পাঁচটা বাজো বাজো, পিপড়ার সারির মত জনস্রোত। সবাই কিছু একটা খুজছেন। সিএনজি এখানে কপালে জুটবে না। রুটের বাসে বাদর ঝোলা ঝুলে যাওয়ার তাগদ শরীরে নাই। অগ্যতা পা দু’টোকে ভরসা করে হাঁটছি, হাইর্কোট গেইট, পূর্তভবন, মৎস ভবনের সামনে এসে চোখে পড়লো, রমনা পার্কের গেইট।

মৎস ভবনের ৯ তলায় এনজিও এ্যাফেয়ার্স ব্যুরো। তিন বছর পরিচালক হিসাবে কাজ করেছি। প্রতিদিন ভবন থেকে রমনা পার্ক দিয়ে ঁেহটে শুক্রাবাদ আসতাম।

কয়েকটা সিএনজির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে রমনার গেইট দিয়ে পার্কে ঢুকে পড়লাম। হাটছি, কাকরাইল মসজিদের কাছে এসে টের পেলাম, বয়স হয়েছে। বসা দরকার। একটা বেঞ্চে বসে আছি। পাশের বেঞ্চে দু’জন লোক। তাঁরা তাবলিকে জামায়েতে চিল্লাহয় এসেছেন। এক কথা দু’কথার পর জানতে চাইলাম, জীবনের মানে কি ?

একজন বললেন;

-“ বুঝলেন না ভাই! এই বাড়ী গাড়ী কিচ্ছু না। জীবন মানে পরকালের জোগাড় যন্ত্রনা করা। আল্লাহ তালার জিকির বন্ধেগি করা।”

মাগরেবের আযান পড়ে গেছে। তাঁরা বিদায় নিলেন। আমিও হাঁটা দিলাম। ইন্টারকন্টিনেন্টাল আজকের রূপসী বাংলার কাছে এসে আবারও বসলাম। পাশে একজন অসুস্থ পৌড় বসে আছেন। মাঝে মাঝে কাঁশছেন। আলাপ শুরু করার জন্য জানতে চাইলাম;

-“ কেমন আছেন ?”

পৌড় আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টি রেখে বললেন;

-“ এ জীবনের কোন মানে হয় না ভাই। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করা।”

কথা ক’টা বলেই পৌড় আবার কাঁশতে লাগলেন। কাঁশি আর থামছে না। আমি বিদায় নিয়ে হাঁটা দিলাম।

বিকালে বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। একজন মা তার ছোট বাঁচ্চা নিয়ে হাঁটছেন। বাঁচ্চাটা থেমে হাত উচু করে দাড়ালো। অবলম্বন খুজছে। মা ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটা দিলেন।

সকাল বেলা আগে নিয়মিত ধানমন্ডি লেক ধরে হাঁটাহাঁটি করতাম। এখন আর আগের মতো যাওয়া হয় না। বাচ্চা গুলো বই এর বোঝা নিয়ে ছুটছে। স্কুল থেকে কোচিং। কোচিং শেষে পড়ার টেবিল, হোমওয়ার্ক। ভালো রেজাল্ট এর প্রতিযোগিতা চোখে গোল্ডেন ফাইভ এর স্বপ্ন। তার কাছে এটাই জীবন।

স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে উজ্জল যুবক সনদ হাতে থমকে দাড়িয়ে আছে। কাজ চায়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন, চাকুরী পরীক্ষার প্রতিযোগিতা তাঁর জীবন। চাকুরী না পাওয়ার হতাশা, বেদনা জীবনসংগী। চাকুরীজীবি খুজছে প্রমোশন, নতুন পে-স্কেল। রোগী খুজছে রোগহীন জীবন। আমরা সবাই খুজছি। খুজছি আর চলছ্।ি এ চলার শেষ নাই। জীবন মানেই চলা। চলার বাঁকে বাঁকে থমকে দাঁড়ানো স্বন্দি খোজা। কিছুটা সময় নিজেকে নিয়ে হারিয়ে থাকা। একদিন মৃত্যুর মাঝে হারিয়ে যাওয়া।

-‘জীবন মানে মৃত্যুর জন্য পথ চলা। পথ চলা শেষ-জীবনের কোন মানে থাকে না।’

একমাত্র বড় বোন ক্যান্সার আক্রান্ত। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। মায়ের জন্য স্বাধ্যের অতীত সব কিছু করছে ভেলো। ইন্ডিয়ায় ভেলোর নিয়ে অপারেশন চিকিৎসা করার জন্য সেখানে ছয় মাস, মোটামুটি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছে। ভালই ছিল; হঠাৎ বিছানায়। শুনে, মেজো ভাগ্নেকে ফোন করলাম। কাঁদতে কাঁদতে জানালো;

-“ হ্যা মামা, ঠিকই শুনেছেন। আগামীকাল রাতে ঢাকা আনছি।”

শান্তনা দিয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। দু’দিন পর সকালে ভাগ্নের টেলিফোন;

-“ মামা, আম্মাকে ঢাকা আনা হয়েছে। এখন স্কয়ার হাসপাতালে আছি।” জবাবে বললাম;

-“ রাখ আমি এখনই আসছি।”

স্কয়ার হাসপাতালে গিয়ে দেখি হুইল চেয়ারে বুবু বসা, নানা রকম টেষ্ট করা হচ্ছে। পরে ডাক্তার দেখানো হবে। টেষ্ট শেষ হলো। ডা. রাজেশ রেডিওলোজিষ্ট। ভারত থেকে এক বছরের চুক্তিতে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে এসেছেন। রোগীর, রিপোর্ট দেখে মুখ গম্ভীর করে বললেন;

-“ ভর্তি করে দেন। কয়েকটা দিন অবজারভেশনে রাখতে হবে।”

ডাক্তার সাহেবের কথা মত ভর্তি করা হলো। আমরা কেবিনে। বুবুর একটার পর একটা টেষ্ট চলছে। শরীরে নানা যন্ত্রপাতি লাগানো। ছেলে মেয়ে আমরা যারাই দেখা করতে যাচ্ছি সবার কাছে তাঁর জানার আকুতি;

-“ আমি ভালো হয়ে উঠবো না!”

জানিনা, আমাদের প্রত্যাশা, বুবু ভালো হয়ে উঠুক। তাঁকে প্রত্যাশাটাই জানাচ্ছি;

-“ হ্যা বুবু, ভালো হবি। ডাক্তার সাহেব ঔষধ দিয়েছে।”

ছেলেমেয়েরা নাতি নাতনি নিয়ে এসেছে। হাড্ডিসার হাত অতিকষ্ঠে মাথায় দিয়ে আদর করে দিচ্ছেন। আমাদেরকে বসতে বলছেন। আমি ভাবছি;

-“ এই বুঝি পথ চলা।”

প্াঁচ দিন হলো। ডাক্তার জানালেন;

-“ ফুসফুস প্রায় অকেজো। অক্সিজেন নিতে পারছেন না। কিডনিও অর্ধেক এর বেশী নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কোন মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না।”

জানতে চাইলাম;

-“ আমরা এখন কি করতে পারি ?” জবাবে ডা. রাজেশ বললেন;

-“ দেশের বাড়ি নিয়ে যান। যেখানে উনি বড় হয়েছেন। পরিচিত লোকজন দেখলে তাঁর ভালো লাগবে।”

বুবুর তিন ছেলে দুই মেয়ে। কেউই দেশের বাড়ীতে থাকে না। লেখা পড়া, চাকুরী, সংসার নিয়ে সবাই যে যার জায়গায়। ভাই বোনের সাথে আলাপ হলো, মেয়েরা দু’জনই জয়পুরহাটে, সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। বুবুকে জানালাম, সে রাজি নয়। সে তাঁর জন্ম স্থান গোদাগাড়ী যেতে চায়।

গোদাগাড়ীতে কে দেখাশোনা করবে। ওখানে আছে বলতে মা, ভাংগা পা নিয়ে বিছানায়। জয়পুরহাটে পাঠানোর জন্য এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করা হলো। আগেই রিলিজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিল পরিশোধ করে রওনা দেয়ার আগে সিসটারকে হাসপাতালের কাপড়গুলো পালটিয়ে দিতে বললাম। সিসটার এসেই দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। বুঝতে পারছি, বুবুর পথ চলা শেষ হয়ে গেছে। ডাক্তার আসলেন, দেখলেন। সিস্টাররা যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিচ্ছেন। একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন;

-“ সরি। ”

ভাগ্নে ভাগ্নিদের গগনবিদারি চিৎকার। কেবিনের বারান্দায় গড়াগড়ি; তাদের কান্নায় গুমোট হয়ে গেছে।

-“ মা হামরাকে কুনঠে র‌্যাখ্যা চল্যা গেলিগে মা।”

-“ একটা কথাও বুইল্যা গেলি না মা।”

বুবু নিশ্চুপ। এতে তার কিছুই আসে যায় না। বুবু তার পথ চলা শেষ করেছেন।

কি অদ্ভুত। ঘন্টা দুয়েক আগে মেজো ছেলে মনিরের ছেলেটা কাঁদছিলো। বুবু ইশারায় তার মাকে ডেকে ছেলেকে চুপাতে বললেন। এখন সবাই কাঁদছে, কান্নায় স্কয়ারের তেরোতলা কাঁপছে, বাতাস ভারী হয়ে গেছে। বুবুর কোন কিছুই আসে যায় না।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, বাবার পথচলা শেষ হয়। সেই রাতে বুবুসহ আমরা বাবার বুকে আছড়ে পড়ছি। সেই একই চিৎকার। একই আবহাওয়া;

-“ বাবা তুমি হামরাকে কুনঠে র‌্যাখ্যা চইল্যা গেল্যা।”

বাবা চুপ। তার পথ চলা শেষ। তার কিছুই যায় আসে না।

জয়পুরহাটের জন্য ঠিক করা এ্যাম্বুলেন্সে বুবুকে নিয়ে গোদাগাড়ী রওনা দিলো। বুবু তার ইচ্ছে অনুযায়ী গোদাগাড়ী গেলেন। বুবুকে মাটি দিয়ে পরের দিন রাতের ট্রেনে ঢাকা পৌছালাম। দৌড়াদৌড়ি, গরম, ঘামে ডিহাইড্রেশন হয়ে গেল। জ্বর সাথে পাতলা পায়খানা। জ্বর সারলেও ডাইরিয়ার মত হয়ে গেল। পাঁচ দিন, সারছে না। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বউ জোর করে স্কয়ার হাসপাতালে এক জনের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। সকাল ১২:০০ টায়। আমার সমন্ধি মহসীন ভাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করার আগে রুটিন চেক আপ;

-“ রক্ত চাপ মাপা;”

-“ ওজন নেয়া,”

-“ উচ্চতা মাপা।”

সিস্টার জানতে চাইলেন;

-“ আপনি কি হুইল চেয়ারে এসেছেন ?”

জবাব না দিয়ে জানতে চাইলাম;

-“ কেন এ প্রশ্ন করছেন ?”

-“ আপনার প্রেসার খুব বেশি। এ অবস্থায় আপনার হাঁটা ঠিক নয়।”

জবাবে বললাম, আর জানতে চাইলাম;

-“ সিস্টার আমি কলাবাগান থেকে হাটতে হাটতে এসেছি। প্রেসার কত? ”

জানালেন,

-“২০০/১০০।”

ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার সাহেব মেপে অবাক হলেন। নিজের ড্রয়ার থেকে দুটো ট্যাবলেট বাহির করে পানি আনিয়ে খেতে দিলেন। বললেন;

-“ নড়াচড়া করবেন না। বাহিরে গিয়ে চুপচাপ আধা ঘন্টা বসে থাকবেন। তারপর টেষ্ট গুলো করাবেন। আর হ্যাঁ ঔষধ গুলো ঠিকমত খাবেন।”

বাহিরে এসে বসলাম না। টেষ্টগুলো করিয়ে বাসায় ফিরলাম। হাটতে হাটতে গিয়ে রাতে রিপোর্ট আনলাম। সকালে রিপোর্ট দেখাতে সরাসরি ডাক্তারের চেম্বারে ডুকলাম। ডাক্তার সাহেব ব্লাড প্রেসার চেক করছেন। তার চেহেরা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তিনি সিস্টারকে মাপতে বললেন। সিষ্টার মেপে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি জানতে চাইলাম;

-“ কত ? ”

-“ ২২০/১১০।”

ডাক্তার নাজিমুদ্দিন সাহেব এবার বললেন;

-“ আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না। কয়েক দিন ভর্তি হয়ে থাকতে হবে।”

আমি খাট থেকে উঠে হাঁটা দিবো, ডক্তার সাহেব বললেন;

-“ না আপনি উঠতে পারবেন না। এখান থেকেই কেবিনের বেডে যেতে হবে।”

হাঁসতে হাঁসতে বললাম;

-“ ডাক্তার সাহেব আমার সাথে কেউ নাই। ভর্তি হওয়ার মত টাকাও সাথে নাই। আমাকেই সব করতে হবে।”

অগত্যা তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি এডমিশনের কাজ শেষ করে ছেলেকে এবং বউকে জানিয়ে টাকা নিয়ে আসতে বললাম। ছেলে এসেছে। ভর্তি শেষে ছেলেকে নিয়ে বেডে গেলাম। শুরু হলো টেষ্ট, এক্স-রে....।

যে অভিযোগ নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসে ছিলাম-পাতলা পায়খানা, তা একে বারে বন্ধ। প্রেসার ওঠা নামা করছে।

ব্লাড সুগার কখনও বাইশ কখনো সাতাশ। ঔষধের ঠেলায় প্রেসার ১০০/৭০ নামলো। ব্লাড সুগার ১৪। তিন দিন পর চেয়ে রিলিজ হয়ে বাসায় ফিরলাম।

২০০/১০০ প্রেসারে মাথা ব্যাথা ঘাড় ব্যাথা কোনটাই হয়নি; দূর্বলও লাগেনি। এখন দূর্বল লাগে। দাঁড়াতে, হাঁটতে পারি না। রোজ লার্জ ফার্মা যাই। প্রেসার, সুগার মাপি। বাসায় ফিরে এসে চার্ট করে রাখি। এটা নিয়ে ২০.০৯.১৪ তারিখে আবারও ডাক্তার সাহেবের কাছে যেতে হবে। ভাবি এই বুঝি জীবন।

আমার চলার এখনও শেষ হয়নি। আরও কিছুটা পথ হয়তো এখনো বাকি। বাকি পথ টুকুই আমার জীবনের শেষ অংক।

বি:দ্র: লিখাটা আগেই লিখেছি। টাইপ করতে পারছিলাম না। তাই নেটে দেয়া হয়নি। বাবুল সরকার নির্বাচন কমিশনে আমার সাথে কাজ করেছে। এখন এফ এ ও খুলনায়। সে রাজি হয়ে গেল। তার কল্যাণে লিখাটা নেটে।