ভারসাম্য

Category: Religion Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6120

 

লেখকের বক্তব্য : পাঠক এ পন্ত সকল গল্পে নাম ও ঠিকানা সঠিক ব্যবহার করেছি। এ লিখাটিতে কিছু ছদ্দনাম ও ঠিকানা ব্যবহার করতে হলো; ক্ষমা করে দিবেন।

ধানমন্ডি লেক দিয়ে হাটছি। লোকজন ক’দিন আগের মত জোরে জোরে হাঁটছে না। পাশ দিয়ে পড়ন্ত বয়সী দু’জন লোক আস্তে আস্তে হাঁটছেন। মনে মনে জবাব খুজছি, লোকজন হঠাৎ এত আস্তে হাঁটা শুরু করলে কেন ?

-“ আজ ১৭ ই চৈত্র ১৪১৮ সাল।বেশ গরম পড়েছে। ঘাম কাহিল করে ‍দিচ্ছে।”

-“ পৃথিবীটা উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে ।” মনকে জিজ্ঞাসা করলাম । মনটা বিরক্ত হয়ে উঠলো;

-“ এতশত জানি না । উষ্ণ হচ্ছে কি না, বুঝি না । গরম টেরপাচ্ছি ।”

আমি আমার হাঁটার বেগ কমাতে পারি না। দ্রুতগতিতেই হাটছিলাম। হঠাৎ কানে এলো, কে যেন ছন্দে বলছে;

-“ শরীরে হারাম খাদ্য

রোগ বালাই হতে বাধ্য

শরীরে নিয়ে যত দুষিত রক্ত

কোন দিনই হওয়া যাবে না আল্লাহ্র ভক্ত।”

দাঁড়ালাম পিছু ফিরে তাকালাম। লাভ হলো না। চিনতে পারলাম না। অনেক দূর চলে এসেছি। লোকের ভিড়ে চেনার কোন উপায় নাই । খুঁজে বের করার ইচ্ছে ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটছি, কিন্তু ভাবনাটাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারছি না।

খাবার তো খাবারই। হারাম হলে রোগ হবে, হালাল হলে হবে না; এ কেমন কথা। পঁচা, বাসি, দুষিত, ফরমালিন, হরমোন, কারবাইড দেয়া কত খাবার তো আমরা খাচ্ছি।

-“ এ গুলো খেলে অসুখ হবে না? নিশ্চয়ই হবে। তা হলে ঐ ভদ্রলোক শুধু হারাম খাবারের কথা বললো কেন?”

কোন জবাব পেলাম না। এ নিয়ে নিজের মাথাটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মনে মনে বললাম;

-“ ইচ্ছে হয়েছে বলেছে; বলুক । এ নিয়ে আমার এত ভাবনার কি আছে !”

হাঁটছি। হঠাৎ কে যেন সালাম দিলো;

-“ আসসালামুওয়ালাইকুম, স্যার।”

সামনে দাঁড়িয়ে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এর ব্যক্তিগত কম©কর্তা মজিবর । মুখে চিরচারিত হাসি। আবারও প্রশ্ন ?

-“ কেমন আছেন স্যার? শরীরটা ভালো?” জানতে চাইলো;

-“ মোটামুটি। আপনি কেমন আছেন ? আপনিও হাঁটেন না কি ?”

জবাব দেয়ার বদলে অনেক গুলো প্রশ্ন করে বসলাম। সে জানালো;

-“ আগে হাঁটতাম না স্যার। খারাপ লাগছিল, ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছ । এখন প্রতিদিন হাঁটি।”

-“ এখন কেমন আছেন ?”

-“ ভালো স্যার। বেশ ভালো। হাঁটাহাঁটি করলে, চিনি না খেলে ভালোই থাকি। মাঝে মাঝে বেশী খাওয়া হয়ে গেলে খারাপ লাগে।”

মজিবরকে দেখে বাংলা ১৪06 সালের কথা মনে পড়ে গেল। মজিবর অফিসে নাই। মৎস্য ভবনের সামনে প্রতিদিন ভ্রাম্যমান বাজার বসে। সে কলা কিনতে গেছে । বেশ কিছুক্ষণ পর মজিবর ফিরে আসলো, খালি হাতে । আমি মজিবরকে জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ মজিবর কলা কই?” জবাবে মজিবর যা বললো, অবাক হলাম।

-“ নিচে অনেক কলা। কলা গুলো দেখতেও সুন্দর । কিন্তু স্যার, ভয়ংকর হলুদ। কিনতে সাহস হলো না ।”

অবাক হলাম;

-“ বাঘ, ভাল্লুক, মানুষও ভয়ংকর হয়। রং তাও আবার নিরীহ কলার। কিভাবে ভয়ংকর হবে মাথায় ডুকছিলো না । জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ রং কি করে ভয়ংকর হয় ?” জবাবে সে কোন যুক্তি তক© ছাড়াই জানালো;

-“ জি স্যার! ভয়ংকর হলুদ। আপনিও দেখলে কিনতেন না।”

বললাম সব কিছুই ভয়ংকর হয়; কারন ক্ষতিকর ফরমালিন, কার্বাইড, দেয়া খাবার ক্ষতি করবে। না খাওয়াই ভালো। শুকর হারাম। আমরা খাইনা। খেলে হয়তো ক্ষতি হবে। অনেক দিন ইউরোপে ছিলাম। পড়াশোনা করেছি। ওরা সবাই শুকর খায়। ওদের কোন ক্ষতি হয় কখনতো দেখিনি। মনে মনে ভাবলাম;

-“ দেখিনি এটা ঠিক । তবে হয়তো হয় । কে জানে ?” মনকে প্রবোধ দিলাম।

হালাল পশু পাখি, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বলে দোয়া ছাড়া জবাই করা হলে এ মাংস নাকি হারাম । কারন বুঝতে না পেরে আমাদের জুম্মা মসজিদের ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ আমার বাড়ীর মুরগী, দোয়া না পড়ে জবাই করেছে । এ মাংস খাওয়া যাবে হুজুর ?”

হুজুর জবাব দিলেন;

-“ নাওজবিল্লাহ্। না, হারাম।”

জানতে চাইলাম;

-“ কেন হারাম, দয়া করে বলবেন।”

তিনি রেগে গিয়ে বললেন;

-“ এত প্যাঁচাল পাড়ার দরকার নাই। কেতাবে বলেছে, হারাম। তাই আমি বলেছি হারাম। যাও নিজের কাজ কর।”

হুজুরের জবাবটাই হয়তো সঠিক। কিন্তু আমাকে সন্তুó করতে পারছিলো না। মনে বারবার খোঁচা দিচ্ছিল । মিজান ভাই রাশিয়া থেকে ডাক্তারী শেষ করে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে চাকুরী করেন। শুক্রাবাদ আহম্মদ ফার্মেসির পিছনে একটা কোনায় নিয়মিত বসেন। রাশিয়া থেকে পড়াশুনা করা ডাক্তার, তাই পশার নাই। মাঝে মধ্যে গিয়ে আড্ডা মারি। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ হালাল টাকায় কেনা মুরগী, দোয়া পড়ে ঠিকমত জবাই না করলে হারাম হয়ে যায়। এর কোন ডাক্তারী যুক্তি রয়েছে কি ?” আপনার জানা আছে ?” মিজান ভাই প্রথমে জবাব দিতে চাইছিলেন না। বললেন;

-“ আমি রাশিয়া থেকে পাশ করা ডাক্তার। লোকে পছন্দ করে না। মানুষ বিধর্মী মনে করে। এ সব বিষয়ে কথা না বলাই ভালো। কোন মৌলভী মাওলানাকে জিজ্ঞাসা করেন।”

জবাবে জানালাম;

-“ করে ছিলাম। জবাবটা পছন্দ হয়নি। তাই একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজছি ।”

বললেন; “কতটুকু বৈজ্ঞানিক জানি না। শুনেছি রক্তে অনেক সময় অনেক রোগ জীবানু থাকে। জবাই করার সাথে সাথে রক্ত কনাগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। জীবানুগুলো বেঁচে থাকে মাংসে। এ মাংস ক্ষতিকর। বিধি অনুযায়ী জবাই করলে রক্তের সংগে জীবানুগুলো বেরিয়ে যায়। এ জন্য বোধ হয় হারাম, হালাল।”

জবাবটা আমার মনে ধরলো। বৈজ্ঞানিক অবৈজ্ঞানিক জানি না, তবে যুক্তি আছে। আমার কাছে যুক্তিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

মোশারফ হোসেন, পিওন, সহজ সরল ছেলে, বোকাও বটে। একদিন বললো;

-“ স্যার গ্রামে জলসা শুনতে গিয়েছিলাম। বড় হুজুর ওয়াজ করছেন। শেষে গ্রামের মসজিদের জন্য চাঁদা তোলা হলো ।”

ওকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম;

-“ তুমি কি জানতে চাও সোজাসোজি বল।” মোশারফ কাচুমাচু হয়ে বললো;

-“ আমাদের গ্রামের ‘সাব এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার’ এক কালে গরীব মানুষ ছিলেন। চাকুরী পাওয়ার পর ঘুষ খেয়ে অনেক ধনী হয়েছেন। তিনি মসজিদে এক লাখ টাকা দিয়েছেন।”

-“ খুব ভালো কথা । ভালো কাজ করেছেন। তুমি কি বলতে চাও।” জবাবে সে জানালো;

-“ জী স্যার! বড় হুজুরও বললেন ‘মাশাল্লাহ্ আলহামদলিল্লাহ্’ আল্লাহ্তালা যেন ‘সাব এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারেরর’ হায়াত দরাজ করেন, আরও দান খয়রাত করার তৈফিক দান করেন। তারপর সবাইকে বললেন; বলুন আলহামদুলিল্লাহ্।”

-“ প্যাঁচাল পাড়া বাদ দিয়ে কি জানতে চাও বল।” জবাবে সে বোমা ফাঁটালো;

-“ স্যার ! আল্লাহ্তালা তাঁর আরো হায়াত দরাজ করলে সে আরো ঘুষ খাবে।” জবাব দিলাম;

-“ শোন। হুজুর তো জানেন না, সে ঘুষ নেয়। ঘুষের টাকা দান করেছে। হুজুর জানে, সে মসজিদে টাকা দান করেছে। দান দানই।”

কোন প্রসংগ ছাড়াই মোশারফ জানতে চাইলো;

-“ ঘুষের টাকায় হালাল জিনিষ হালাল ভাবে জবাই করে খেলে পাপ হবে ।”

মেজাজটা বিগড়ে গেল। জবাব দিলাম;

-“ অন্যায় অন্যায়। বৈধ পথে অন্যায় কাজ করা যায় না। ঘুসের টাকায় কেনা মুরগী দোয়া দূরুদ পড়ে জবাই করলেও হারাম। এটা শরীরে লাগবে বটে, উপকার হবে না। ক্ষতি হবে।”

সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো;

-“ এটা কেমন কথা স্যার। শরীরে লাগবে, উপকারে আসবে না।”

মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো, রসিকতা করে জিজ্ঞাসা কললাম;

-“ তোমাকে কউ ঘুষ দিলে তুমি কি করবে ? ”

-“ কি যে বলেন, স্যার। আমাকে কে ঘুষ দিবে ? কেন দিবে ? নিবো কেন? ” জবাব দিলাম;

-“ ধরো তোমাকে ঘুষ দিয়েছে, তুমি নিয়েছো । টাকাটা দিয়ে কি করবে ?”

মোশারফ আমতা আমতা করে জবাব দিলো;

-“ স্যার পায়েস খাবো, চিনিগুড়া চাল , দুধ, চিনি কিনবো। গরুর মাংস কিনবো আর বাচ্চাদের ল্যাগা আংগুর আর আপেল কিনবো।” জবাব শুনে জানতে চাইলাম;

-“ তোমরা নিয়মিত পায়েস, গরুর মাংস খাও।”

অবাক হয়ে জবাব দিলো;

-“ টাকা পাবো কোথায় যে, পায়েস খাবো স্যার ।”

-“ তা হলে ঘুষ দিয়ে এ সব কেন খেতে চাও?”

জবাবে জানালো;

-“ খেতে পাই না তো স্যার, তাই ।”

-“ পেলেও খেয়ো না।” তাঁকে পরামশ© দিলাম;

-“ কেন খাবো না স্যার?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো;

-“ কারন তোমার শরীরে তৈরী ভারসাম্যটা নষ্ট হয়ে যাবে।” জবাব শুনে বললো;

-“ বুঝলাম না স্যার।”

বললাম;

-“ শোন তোমার বাচ্চারা মাসে একটা আপেল, কয়েকটা আংগুর চোখে দেখে। এতে যে পরিমান প্রিজারভেটিভ আছে তার সংগে শরীর অভ্যস্থ হয়ে গেছে। একটা ভারসাম্য তৈরী হয়ে গেছে। বেশী খেলেই পরিমান বেড়ে যাবে, ভারসাম্য নষ্ট হবে ।” বুঝলো যুক্তিতে কুলাবে না, তাই প্রসংগ পালটিয়ে বললো;

-“ বুঝলাম, ফলগুলাতে ফরমালিন আছে। ক্ষতিকর, পায়েস তো ভালো জিনিষ। এটা খেলে অসুবিধা কি স্যার?”

জবাবে বললাম;

-“ ভাত, আলু, রুটি যাই খাও, সব কিছুই পেটে গিয়ে গ্লুকোজ হয়। শরীরের কোষ গ্লুকোজ ছাড়া কিছুই খেতে পারে না। প্রতিদিনের খাবার থেকে শরীর প্রয়োজন মত কোজ তৈরী করে। হঠাৎ পায়েস খেলে অতিরিক্ত গ্লুকোজ তৈরী হবে। কোষের উপর গ্লুকোজ এর আবরণ পড়বে। লবন, ভিটামিন, এর মত মাইক্রোনিউট্রেন্ট গুলো কোষে ডুকবে না। এ্যামিনো এসিড কোষের বাইরে থেকে যাবে।”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে মোশারফ বললো;

-“ তাহলে এখানেও ভারসাম্য। পায়েশ খাবো না স্যার? সুযোগ হলে মাংস খাবো? ” জবাবে তাঁকে জানালাম;

-“ পায়েস, মাছ, মাংস, ভাত, লবন হাজার রকম খাবার সব কিছু মুখের। কোষের খাবার মাইক্রোনিউট্রেন্ট, গ্লুকোজ আর এ্যামিনো এসিড। পেট মাংসকে এ্যামিনো এসিডে পরিনত করে ।” অবাক হয়ে সে জানতে চাইলো;

-“ আপনি তো স্যার মাছ, মাংস খান না । তা হলে আপনার কোষ এ্যামিনে এসিড পায় কোথা থেকে?”

জবাব দিলাম;

-“ গরু ঘাস খায়, দুধ, মাংস দেয় । এ গুলো আসে কোথা থেকে?” সে অবাক হয়ে মন্তব্য করলো;

-“ তাইতো স্যার।” বললাম;

-“ লতাপাতা, শাক সব্জি, ফলমুল সব কিছুতেই সব কিছু আছে। শুধু কম আর বেশী । শরীর তার প্রয়োজনমত সব কিছু তৈরী করে।”

মোশারফ হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম;

-“ জানতে চাও, ঘুষ দিয়ে কেনা মাংস খেলে কি হবে? প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ্যামিনো এসিড তৈরী হবে । কোষের পাশে অবস্থান নিবে । কোষের প্রয়োজন নাই, তাই ক’দিন পড়ে থাকবে । একদিন তা চর্বি হয়ে যাবে।” তার মাথায় ডুকছে না, জিজ্ঞাসা করলো;

-“ স্যার তাহলে ভেজেটেরিয়নদের চর্বি হয় কেন?”

জবাবে বললাম;

-“ আগেই বলেছি; সব কিছুতেই সব কিছু আছে। শরীর তার প্রয়োজনমত তৈরী করে নেয়। ভারসাম্য হারালেই সমস্যা ?”

হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ জানতে চাও কি সমস্যা?”

-“ জী স্যার।”

জবাবে জানালাম;

-“ রক্তে সুগার বেড়ে যায়, ডায়াবেটিস হয়। শরীরে চর্বি জমা হয়। রক্ত নালীগুলো বন্ধ হয়ে যায়। একটার পর একটা বাধা তৈরী হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। কিডনিতে চাপ পড়ে। আমরা তাড়াতাড়ি আজিমপুরের দিকে যাই ।”

সব কিছু শুনে মোশারফ বললো;

-“ তাহলে আমরা কিসের পিছনে ছুটছি স্যার।” তাঁর জিজ্ঞাসার কোন জবাব আমার জানা নাই। বললাম;

-“ গাধা যেমন ছোটে মূলার পিছনে, আমরাও ছুটছি ।”

-“ তাহলে কি আমরা গাধা ?”

-“ গাধা বই আর কি? তা না হলে ছুটছি কেন ?”

-“ এসব করে আসলে লাভ কার?” মোশারফ জানতে চাইলো;

তার আগ্রহ আর সরলতা দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। তাঁকে বললাম, শোন তোমাকে একটা গল্প বলি;

আমার ষ্টেনোটাইপিষ্ট ডায়াবেটিসের রোগী। ডাক্তার তাঁকে হাঁটতে নির্দেশ দিলেন। প্রতিদিন চল্লিশ মিনিট হাঁটতে হবে। তার বউ জোর করে তাঁকে হাটতে পাঠান। তিনি ধানমন্ডি লেকে একটু ঘোরা ফেরা করে একটা আইসক্রিম খেঁয়ে বাড়ী ফিরেন। রক্তে সুগার দশের উপরে উঠলো। ডাক্তার ট্যাবলেট দিলেন। হাঁটা নাই, তার উপর প্রতিদিন একটা আইসক্রিম, ট্যাবলেটে কোন কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার তাঁকে ইনসুলিন দিলেন। প্রতিদিন দুই বেলা ইনসুলিন নেয়া বড় কóকর। তারপরও বেচারার বোধ হয়েছিল শেষ বেলায়। পায়ের আংগুলে একটা জায়গা কেঁটে গেল। কাঁটা শুকালো না। পরে গ্যাংগ্রিন হয়ে ডাক্তার হাঁটু পয©ন্ত কেটে ফেললেন। কোন কাজ হলো না। শেষ পয©ন্ত বিদায় নিলেন। সচিবালয়ে তাঁর জানাজায় অংশ নিলাম।

ঘটনাটা শুনে জানতে চাইলো;

-“ এটা কি সত্য ঘটনা বললেন স্যার?”

জবাবে বললাম;

-“ জী। তবে ইচ্ছে করে তার নামটা বললাম না।”

-“ বড় মর্মান্তিক! ” সে মন্তব্য করলো;

কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। বললাম;

-“ শোন তোমাকে আর একটা ঘটনা বলি। ” ‍খুশি হয়ে জবাব দিল;

-“ বলেন স্যার! খুব ভালো লাগছে । জীবনে এগুলো কোন দিন শুনতে পাবো না।”

আমার এক স্যার ছিলেন। অবসরে গেছেন। সময় কাটে না তাই মাঝে মাঝে তাঁর আগের জুনিয়র কলিগদের সংগে দেখা করতে আসেন। স্যার কাটলেট খেতে খুব ভালো বাসতেন। তিনি আসলে, আমার পক্ষে সম্ভব হলে, তাঁকে কাটলেট খাওয়াতাম। বেশ কয়েকদিন পর তিনি আসলেন। কয়েকটা ক্লাস নিয়েছিলাম। এনজিও থেকে টাকা গুলো দিয়ে গেছে। পিওনটাকে ডাক দিয়ে বললাম;

-“ স্যারের জন্য দু’টো কাটলেট নিয়ে এসো।” বলার সংগে সংগে স্যার বললেন;

-“ রফিক! কাটলেট খাবো না। হাই প্রেসার , মাংস খাওয়া সম্পণ© নিষেধ। এককাপ চা দাও।”

পিওনটাকে চা দিতে বললাম। স্যার দুধ চিনি দিয়ে ঘন চা খেতেন। পিয়নটাকে স্যারের চায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। স্যার সংগে সংগে আপত্তি করলেন,

-“ না না রফিক । ডাক্তার সাহেব সব কিছু মানা করে দিয়েছেন। দুধ চিনি ছাড়া রং চা দাও।”

আমি অবাক হলাম। স্যারের জীবন থেকে মাংস, মিষ্টি সব কিছু বিদায় নিয়েছে। কি হবে স্যারের এত সম্পদ দিয়ে। অনেক দিন স্যারের সংগে দেখা নাই। একদিন সংবাদ পেলাম, স্যার অসুস্থ্য, হাসপাতালে। পেস মেকার লাগানো হয়েছে। স্যারকে দেখতে গেলাম, করুন ভাবে তাকিয়ে রয়েছেন। বড় খারাপ লাগছিলো।

মধ্যে স্যারের ওপেন হাট সার্জারী হয়েছে। দেশের বাইরে ছিলেন । আমিও কাজে ব্যস্ত । জানতে পারিনি। একদিন তিনি নিজেই আমার অফিসে আসলেন। দূর্বল, কাহিল, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। বললেন;

-“ মাছ, মাংস খাওনা তুমি ভালো আছো । লোভ তোমাকে ধরতে পারেনি। দু’হাতে কামিয়েছি। পায়েস, আইসক্রিম, ফলমুল কোনটাই বাদ দেয়নি । ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখে ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গেছি। তাঁরা ঔষধ দিয়েছে, অপরেশন করেছে। কোন লাভ হয়নি ।” আমি আমার ভিতর, বাহির সব কিছুর ভারসাম্য হারিয়েছি ।

স্যারের চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে গেল। টেলিভিশনের টেলপে লিখা দেখা যাচ্ছে, আমার স্যার সাবেক সচিব মারা গেছেন।

আমি স্যারকে বলতে পারিনি। ভেজিটেরিয়াদের; সমস্যা আছ । 50 এর পর তাঁদের হাড় নরম হয়ে যায় ব্যাথা করে।

মনযোগ সহকারে সে গল্পটা শুনছিলো। শেষে মন্তব্য করলো;

-“ স্যার । তাহলে কি আমরা সব কিছু ডাক্তার, ঔষধ, কোম্পানী, হাসপাতালের জন্য করছি? ”

জবাব জানা ছিল না। বললাম;

-“ জানি না। তাঁরাও কি সুখে আছে ? ”

ক’দিন আগে গ্রামের বাড়ী গিয়েছিলাম। মাকে দেখতে গিয়ে শুনলাম, আমার স্কুলের সহপাঠী ডাঃ ইসাহাক অসুস্থ । তাঁকে দেখতে গেলাম। ডাঃ ইসাহাক জটিল ডায়াবেটিস এ ভুগছে। হাত পা নাড়া চড়া করতে কó হয়। পায়ের তালু জ্বালাপোড়া করে। ¯ú‡Ýi কোন স্যান্ডেল পায়ে দিতে পারে না। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম;

-“ তোরা ডাক্তার। তোদের এসব কেন হবে? ” ইসাহাক জবাব দিলো;

-“ হবে না কেন বল। অফিস শেষ তুই কি করেছিস ”

-“ খেলাধূলা করেছি। আড্ডা মেরেছি। ”

-“ আমি অফিস শেষ করে মহিশাল বাড়ী ফার্ম্মেসির পিছনে ছয় হাত বাই ছয় হাত একটা অন্ধকার ঘরে লাইট জ্বালিয়ে রোগীর জন¨ বসে থেকেছি। চা সিংগারা খেয়েছি । শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করেছি। ”

কে যেন চিৎকার করছে;

-“ ভালো থাকতে ভারসাম্য দরকার, ভিতরে বাহিরে। পৃথিবী ভারসাম্য হারালে ভুমিকম্প, সুনামী, বন্যা হবে; দেশ ভারসাম্য হারালে যুদ্ধ হবে, সমাজ শৃংখলা হারাবে; পরিবার নিয়ন্ত্রন হারাবে; আমরা সুস্থ্যতা হারাবো।”

আমি কোন কথা বলছি না দেখে মোশারফ রওনা দিল । সে গুনগুন করে গান গাইছে;

-“ তোরা যে যা বলিস বল ভাই; আমি সুস্থ্য থাকতে চাই;

আমি ভারসাম্য চাই। ”

ভারসাম্যের জন¨ó করতে হয়। এ জন¨ সাধনারও প্রয়োজন আছে।