বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ-২০১৩ এবং বিজ্ঞান মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের স্টলগুলো দেখছিলাম। বেশীর ভাগ প্রদর্শনী প্রযুক্তি নির্ভর। ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের উপস্থাপনা থেকে বুঝেছি, তাঁরা সমস্যাটা বুঝেন, সমাধানের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। বিজ্ঞান কি? এ নিয়ে আমি নিজেই গোলক ধাঁধাঁয়। আমি বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ কোনটাই নই। তবে জোর গলায় বলতে পারি, আমি একজন বিজ্ঞান-মনষ্ক, প্রযুক্তি-বান্ধব লোক। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ উভয়েই গবেষণা করেন। বিজ্ঞানীর গবেষণা নতুন আবিষ্কার। প্রযুক্তিবিদ গবেষণা করেন, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি প্রযুক্তি তৈরী করা; যা জনগণের কাজে লাগে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, এমন কিছু গ্যাস আছে যা চাপে গরম হয়, চাপ কমিয়ে দিলে ঠান্ডা হয়ে যায়। তাঁকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিবিদ আবিষ্কার করলেন, কমপ্রেসার দিয়ে নলের মধ্য দিয়ে এ ধরনের গ্যাস চালানো যায়। নলগুলো কোথাও মোটা কোথাও চিকন হলে, যখন চিকন অংশের মধ্য দিয়ে যাবে তাপ তৈরী হবে। গ্যাসগুলো বাতাসে তাপ ছেড়ে দিবে। যখন মোটা অংশের মধ্য দিয়ে যাবে, তখন ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন বাতাস থেকে তাপ শুষে নিবে। এমন একটি ব্যবস্থা যদি করা যায়, চিকন অংশ খোলা জায়গা দিয়ে আর মোটা অংশ একটি আবদ্ধ জায়গা দিয়ে যাবে, তা হলে এ প্রযুক্তি আবদ্ধ জায়গায় তাপ শুষে নিবে, আবার খোলা জায়গায় বাতাসে তাপ ছেড়ে দিবে। এ দিয়ে তৈরী হলো ফ্রিজ, রুম ঠান্ডা করার এয়ার কুলার। আমরা এ দিয়ে খাবার, রুম, গাড়ী ঠান্ডা রাখছি।
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন অনেক মৌলিক পদার্থ ইলেকট্রন ছেড়ে দেয়। কিছু মৌলিক পদার্থ রেডিওএ্যাকটিভ কণা দিয়ে এ ধরনের পরমাণুকে আঘাত করলে নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে যায়। তৈরী হয় প্রচুর তাপ। এ প্রক্রিয়া একটা আবদ্ধ পাত্রে ঘটালে, পাত্রটা গরম হয়ে যাবে। এ তাপ দিয়ে পানি বাষ্প করলে পাত্রটা ঠান্ডা থাকবে, গলে যাবে না, বাষ্প তৈরী হবে। বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ তৈরী করা যায়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার, ইউরেনিয়াম পরমাণু ভাঙ্গে। এ আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিবিদ তৈরী করলেন রিএ্যাকটর। তা দিয়ে পানি গরম করে করে, টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ।
বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কার আছে, যা কাজে লাগানোর জন্য প্রযুক্তি তৈরী হয়নি। প্রযুক্তিবিদের কাজ হলো এগুলোকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা। এটা দুরূহ কাজ। এ জন্য অনেক অর্থ, জনবল দরকার। বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তিবিদরা অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এ প্রযুক্তি সব সময়, সব দেশের উপযোগী নয়। অনেক প্রযুক্তির জন্য অনেক অর্থের দরকার। আমাদের মত গরীব দেশের পক্ষে এই প্রযুক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারবো না। কাজে লাগাতে হলে আমাদের পরিবেশের উপযোগী করতে হবে। খরচ কমাতে হবে। তাই আমাদের প্রযুক্তিবিদদের গবেষণা করতে হবে এ লক্ষ্যে। এটাই হবে আমাদের কাজ। চীন, ভারত এ ধরনের গবেষণা করে নতুন লাগসই প্রযুক্তি দিয়ে তাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে।
স্কুল কলেজে আমরা অনেক এক্সপেরিমেন্ট করি। এক্সপেরিমেন্ট করার সময় আমরা গবেষণা করি না। আমরা নির্ধারিত একটি কৌশল ব্যবহার করি মাত্র। এই এক্সপেরিমেন্টগুলো কোন আবিষ্কার নয়। এগুলো কোন প্রজেক্ট হবে না। বিষয়টা মাথায় রাখলে আমরা আমাদের প্রজেক্টগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি।
দস্তা একটি মৌলিক পদার্থ। হাইড্রোক্লোরিক এসিডে হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন আছে। দস্তায় পাতলা হাইড্রোক্লোরিক এসিড দিলে জিংক ক্লোরাইড তৈরী ও হাইড্রোজেন বাহির হবে। এটা করে দেখানো এক্সপেরিমেন্ট। এটা নতুন প্রজেক্ট নয়। ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট প্রজেক্ট হিসাবে আনলে সবাইকে হতাশ হতে হবে।
আমাদের অনেক কাঁচামাল আছে যা অন্যদের নাই। যেমন, যষ্ঠি মধু। নামে মধু হলেও এটা মধু নয়। কাঁটাওয়ালা শক্ত লতা গাছের শিকড়, এই যষ্ঠি মধু। গাছটার ফলের নাম ‘লাল কুঁচ’। যাঁরা স্বর্ণকারের দোকানে গেছেন তাঁরা নিক্তিতে এই লাল কুঁচ দেখবেন। লাল কালো মুখি ছোট্ট এই বীজটির ওজন এক রতি। তাই স্বর্ণের দোকানে এই বীজটির কদর এত বেশী। গাছটির শেকড় ফুসফুসের রোগে কাজে লাগে, বল-বর্ধকও বটে। কোরিয়াতে আছে জেনসেন। তা দিয়ে তারা তৈরী করেছে নানা ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট। কোরিয়ার পরিচিতি জেনসেন দিয়ে। তাঁরা জেনসেনকে কাজে লাগিয়েছে। আমরা পারিনি যষ্ঠি মধুকে কাজে লাগাতে। বিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসলে যষ্ঠি মধুও বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে দিতে পারে।
শীতকালে আলোর কাছে পতঙ্গ আসে। আলোর সাথে উত্তাপ আছে। পতঙ্গগুলোর শরীর বাটার দিয়ে তৈরী। শীত আসলে এগুলোর শরীর জমে যায়। মরতে হবে সব পতংগকে। এ কারণে শীতপ্রধান দেশে পোকা তথা পতংগের উৎপাত কম। শুধু মানুষ নয়, সব জীব বাঁচতে চায়। তাই ছুটে আসে আগুনের পাশে। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে আমরা ক্ষেতের পোকা মাকড় ধ্বংস করতে পারি। বাঁচাতে পারি আমাদের মাঠের কষ্টের ফসল। পানির পাত্রের উপর হারিকেন, বাল্ব জ্বালিয়ে উদ্ভাবন করেছি আমাদের নিজস্ব টেকনোলজি। পেস্টিসাইড ছাড়াই বালাই নাশক ব্যবস্থা। মরা কিট পতঙ্গগুলো মাটির জন্য উত্তম সার। পতঙ্গসহ এই পানি জমিতে ঢেলে দিলে, জমি পানি, সার দুটোই পাবে।
বিজ্ঞানীদের মাঝে বাড়তি কিছু থাকা প্রয়োজন। ছোট বেলায় আমাদের র্যাপিড রিডার পড়ানো হতো। একটা বই এর নাম ছিল “সেভেন ইনভেনসন”। এখানে সাতটা গল্প ছিল, চার্লস গুড ইয়ারের রাবার আবিষ্কারের কাহিনী; জন রসের বসন্তের টিকা আবিষ্কারের কাহিনী; আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনেসিলিন আবিষ্কারের কাহিনী; বাকি গুলো আজ আর মনে নাই। চার্লস গুড ইয়ার একটার পর একটা গবেষণা করছেন। রাবারকে কাজে লাগানোর কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারছেননা। গবেষণা করতে গিয়ে সবকিছু খুইয়েছেন। গবেষণা চালানোর মত কোন অর্থ নাই। তবুও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। কিছু কেমিক্যালস লাগবে। হাতে কানা-কড়িও নাই। ঘরে বেচার মত কোন জিনিস নাই একমাত্র বউ এর নতুন পেটিকোট ছাড়া। এটাই বিক্রি করে গুড ইয়ার কেমিক্যাল কিনলেন। তিনি সফল হলেন। বউ তাঁর পেটিকোট বিক্রি করার জন্য ঝগড়া করে গুড ইয়ার-কে ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা পেলাম রাবার। সভ্যতার অন্যতম উপাদান।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং গবেষণাগারে দিনের পর দিন গবেষণা করছেন; কি করে মানুষকে রোগ জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। তার পরিবার থেকে ল্যাবরেটরির দরজার নিচ দিয়ে খাবার রুটি দিয়ে যায়। ফ্লেমিং এর খাবার সময় কোথায়? অন্য দিকে পরিবারের লোকজন বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। ল্যাবরেটরির দরজায় পড়ে আছে বেশ কয়েকদিন আগে দিয়ে যাওয়া রুটি; বাসি, পঁচা, ফাংগাস পড়ে গেছে। ফ্লেমিং এর ক্ষিধা পেয়েছে। রুটিগুলো নিয়ে আংগুল দিয়ে ফাংগাস সরালেন। কাজ করতে করতে আংগুল কেটে ঘা হয়ে গেছিল। ফাংগাসগুলো ঘা এর মধ্যে লাগলো। কয়েক দিন পরে দেখলেন ঘা শুকিয়ে গেছে। বুঝলেন ফাংগাস এ কাজ করেছে। তিনি ফাংগাস থেকে তৈরী করলেন পেনেসিলিন। মানুষকে রক্ষা করলেন নানা জাতের রোগ বালাই থেকে।
আজকে ভাবি, গুড ইয়ার, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কি পেয়েছেন? মাঝে মধ্যে মনে হয়, নিঃস্ব হয়েছেন। পরক্ষণেই মনে হয়, কি পাননি তাঁরা। জানতে ইচ্ছে করে;
-‘তাঁরা কি চেয়েছিলেন?’
-“তাঁরা তা পেয়েছেন কি?”
আমরা জানি না। আজ জানার কোন উপায় নাই। তবে জোর গলায় বলতে পারি-তাঁরা মানব কল্যাণ করে গেছেন। আজ তাঁরা কালজয়ী মানুষ।
/* Style Definitions */ table.MsoNormalTable {mso-style-name:"Table Normal"; mso-tstyle-rowband-size:0; mso-tstyle-colband-size:0; mso-style-noshow:yes; mso-style-priority:99; mso-style-qformat:yes; mso-style-parent:""; mso-padding-alt:0cm 5.4pt 0cm 5.4pt; mso-para-margin:0cm; mso-para-margin-bottom:.0001pt; mso-pagination:widow-orphan; font-size:10.0pt; font-family:"Times New Roman","serif"; mso-bidi-font-family:Calibri;}
Normal 0 false false false EN-GB X-NONE X-NONE