গবেষকদের কাছে প্রত্যাশা

Category: Science & Technology Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 5029

গবেষকদের কাছে প্রত্যাশা

কয়েক বছর আগে পত্রিকায় ছোট একটি সংবাদ আমাকে আলোড়িত করেছিল। যাকে নিয়ে সংবাদ তিনি সমাজ, সরকার বা সুশীল সমাজের কেউ নন। তিনি সমাজের অতি সাধারণ একজন কৃষক হরিপদ, বাড়ী ঝিনাইদহ জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। তিনি একটা ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ ধানের অন্য জাতের চেয়ে ফলন বিশ ভাগ বেশী।

এমন শত শত হরিপদ বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দিতে পারতো। মনে হয়েছিল এদের জন্য আমাদের করার কিছুই নাই। কষ্টটা বুকে নিয়ে ছিলাম। জানতে পারলাম, সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুদান প্রদান করে। কষ্টটা থেকে মুক্তি না পেলেও স্বস্তি বোধ করলাম।

গবেষণা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত অনুদান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৪টি সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা আছে,

1) জীব বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা ও পুষ্টি বিদ্যা

২) এপ্লাইড সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং

৩) ফিজিক্যাল সায়েন্স

৪) এগ্রিকালচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট

বর্তমান সরকার এ খাতে ২০১২-১৩ অর্থ-বছরে ৩৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। এ বরাদ্দ দিয়ে মোট ৫৭ জনকে গবেষণা ও উন্নয়ন অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থ-বছরে ৩০ লক্ষ টাকা ৫৭ জন গবেষককে অনুদান প্রদান করেছে।

সরকারকে একটি নিষ্কন্টক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুদান প্রদান করতে হয়। এ জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালায় কোন ধরনের প্রকল্প অনুদান প্রাপ্তির যোগ্য হবেন; কোন ধরণের প্রকল্পে কি ভাবে অনুদান প্রদান করা হবে, অনুদান প্রদানের পদ্ধতি কি হবে, প্রকল্প পরিচালকদের কি কি বিষয় নিশ্চিত করবেন, প্রকল্পের অগ্রগতি কিভাবে মনিটরিং করা হবে, প্রকল্পের সময়সীমা ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা আছে।

সব কথা নীতিমালায় লিখা যায় না। সে রকম একটা বিষয় প্রত্যাশা। সরকার যে অর্থ আপনাদের দিচ্ছেন তা জনগণের ট্যাক্সের টাকা। তাই এখানে রয়েছে সরকারের প্রত্যাশা, জনগণের প্রত্যাশা।

নীতিমালায় প্রত্যাশার জন্য একটিমাত্র বাক্য রয়েছে।

‘‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক উদ্ভাবন এবং গবেষণার মানসিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশীয় বিজ্ঞানীগণকে তাদের চলমান/প্রস্তাবিত প্রকল্পে অনুদান হিসাবে কিছুটা পরিপ্রোষণা প্রদান করে বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত রেখে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন জোরদার করা।’’

জটিল একটি বাক্য, এর মর্মার্থ অনুধাবন করার জন্য সমাজ বিজ্ঞানীগণ গবেষণার দাবী করতে পারেন। আসলে সাদা-মাটা বাংলায় প্রত্যাশা কি?

গবেষণার দ্বারা মৌলিক গবেষণা করে দেশটাকে পালটিয়ে দিবেন। এ প্রত্যাশা জনগনের কারো নাই।

বক্তব্যের শুরুতে হরিপদ এবং হরিধানের কথা বলেছিলাম। হরিপদ, হরিধান উৎপাদনের সাথে কিছু যোগ করেছেন। হরিপদ সরকারের ও জনগণের প্রত্যাশার সামান্য কিছু পূরণ করেছেন। বিজ্ঞানীগণ হরিপদের মত জনগণের প্রত্যাশার বিন্দু বিন্দু পূরণ করবেন। আপনাদের বিন্দু বিন্দু একদিন অর্থনীতিতে আনবে উন্নয়নের জোয়ার।

টুক টুক, নসিমনের নাম শুনেছেন। মাঝে মাঝে রাজপথেও নসিমনের সদর্প পদচারনা লক্ষ্য করা যায়। ব্রেকহীন, নিয়ন্ত্রনহীন একটি যান। অনেকে এটাকে মৃত্যুফাঁদ, যন্ত্রদানব নামে ডাকছেন। এটা নিষিদ্ধ করার দাবী জানাচ্ছেন। এদাবী আমাদেরও। ভাবনাটা অন্য, অন্য জায়গায়। যন্ত্রটাকে নিয়ে গবেষণা করে উন্নত করা যায় কি? গেলে এ কাজটিতো করতে পারি।

যষ্ঠিমধু খাননি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর হবে। লাল-কালোমুখি সুন্দর এই বীজটির পরিমান এক রতির মত। প্রতিটি জুয়েলারীর দোকানে বীজটির দেখা মেলে এক রতি সোনা মাপার জন্য। সীমের মত ফলের শক্তলতার একটি গাছ। এ গাছের শিকড়ই যষ্ঠিমধু। রাজশাহী এলাকার মানুষ ফলটিকে কুঁচ বলে।

কুঁচগাছের শেকড় কাশির মহা ঔষধ। কি আছে এর মধ্যে? কেন আমরা এটা খাই? এ সব জেনে কোরিয়ার মত জেনসেন ট্যাবলেটের মত কিছু তৈরী করতে পারিনা? ভেবে দেখবেন, দেশের জনগণ উপকৃত হবে।

রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। বাড়ীর আশে পাশে আমের ঁটি পড়ে থাকতো। তা থেকে গঁজাতো আমের চারা। চারাগুলোকে বাড়তে দেয়া হতো না। আঁটিঁ থেকে জন্ম নেয়া গাছের আমের আকার, স্বাদ মূল গাছের ফলের মত হয় না। মূল গাছে গুঁটি কলম করে নতুন গাছ দিয়ে নতুন বাগান করা হতো। পরবর্তীতে আঁটি আমের গাছের সাথে মূল গাছের ডাল দিয়ে জোড় কলম করে আম চারা আমচাষে বিপ্লব আনে। এতেও সময়ও শ্রম অনেক। পুরাতন গাছের ডালের পোকার আকর্ষণ অনেক। টিস্যু কালচার করে আমের চারা তৈরী করতে পারলে এ সমস্যার হাত থেকে কৃষক রক্ষা পেত।

হরিধানের খবর জানার পর থেকে তাঁর সংগে দেখা করে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ইচ্ছে মনে পুষে রেখেছিলাম। জানার ইচ্ছে ছিল তিনি কিভাবে এই আবিষ্কার করলেন। সরকারী কাজে ঝিনাইদহ গিয়ে ছিলাম। সরকারী কাজের ফাঁকে একটা সময় বের করলাম। খোঁজখবর নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলাম।

সাদা মাটা একটি কৃষক বাড়ী। জানলাম, হরিদা মাঠে কাজ করছেন। হাঁটা দিলাম। একজন হরিদাকে দেখিয়ে বললেন;

-‘উনি হরিপদ দাস।’ ছোট খাটো অতি সাধারণ একজন মানুষ।

সম্ভাষণ শেষে জানতে চাইলাম;

-‘‘কিভাবে এ আবিষ্কার সম্ভব হলো?’’ জবাবে তিনি জানালেন;

‘‘আমি লেখাপড়া জানিনা বাবু। আপনাদের মত গুছিয়ে বলতে পারবো না।’’ বললাম;

‘‘আপনার মত করে আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।’’

‘‘ধান লাগালাম। হঠাৎ দেখি এক ছড়া গাছ ধানের চেয়ে শক্ত মোঠা বেড়ে উঠেছে। প্রথমে মনে করেছিলাম আগাছা। তুলে ফেলে দিতে চেয়ে ছিলাম। পরে ভাবলাম, থাকনা, দেখি কি হয়। পরে শীষ ফুটলো। শীষগুলো বড় বড়। ধানের আকারও অন্য রকম। ধানগুলো পাকলে আলাদা করে রেখে দিলাম। পরের বছর আলাদা করে লাগালাম। তার পরের বছর জমির পরিমাণ বাড়ালাম। এবার বুঝলাম ফলন অন্য ধানের চেয়ে বেশী। পাশের বাড়ীর একজনকে বীজ ধান দিলাম। তারাও এধান লাগালেন। এভাবে এখানকার অনেকে এই ধান আবাদ করছে। এখন ধানটাকে লোকে ‘হরিধান’ বলে।’’

হরিদা এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেছিলেন।

ভাবছিলাম, যদি আরো কিছু হরিদা থাকতো দেশের চেহারা পালটে যেতো।

সরকার, জনগনের প্রত্যাশা নতুন নতুন হরিধান, হরিদা, হরিদার মত অনুসন্ধিৎসু মন। আমাদের বিশ্বাস আপনারা পারেন এই প্রত্যাশা পূরণ করতে।