নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড

Category: Politics Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6216

সংসদের বাহিরে বিরোধী দলগুলো বলছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন, এদের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। সম্প্রতি সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বললেন, “সময় এসেছে দেখার, নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড আছে কি নাই।”

সংসদের বাহিরে থাকা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করছে, আবার নির্বাচনে অংশও  নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন, সরকার নিরব। নির্বাচন হছে, জনপ্রতিনিধিগন শপথ নিচ্ছেন।

জীব বিদ্যায় জীব জগতকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ মেরুদণ্ডহীন ও অমেরুদণ্ডহীন প্রাণী। ছোট বেলায় পরীক্ষায় প্রায় আসতো।
-“কয়েকটি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর উদাহরন দাও।”
উত্তর পত্রে গড়গড় করে লিখতাম মানুষ, বানর, গরু, ছাগল, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি ইত্যাদি। পৃথিবীতে শতশত জীব মেরুদণ্ড ছাড়াও আছে। হাঁটছে, উড়ছে আর সাতার কাটছে। মেরুদণ্ড নাই বলে তাদের কোন আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। তারা দিব্যি আছে। মেরুদণ্ড আছে তাই মানুষের বড়াইয়ের অন্ত নেই। কেন এ বড়াই বুঝি না। মেরুদণ্ড ছাড়াই প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, আমরা মেরুদণ্ড নিয়ে উড়তে পারি? মৌমাছি মেরুদণ্ডের তোয়াক্কা না করেই মেরুদণ্ডীদের হুল ফোটাছে, মৌচাকে মধু ভাণ্ডার তৈরি করছে। আমরা মৌমাছির মধু চুরি করছি।

নির্বাচন কমিশনের মানুষগুলো মেরুদণ্ডী হলেও, কমিশন কোন প্রাণী নয়। এটা বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বারা গঠিত  প্রতিষ্ঠানের আমরা মেরুদণ্ড খুজছি কেন? জানি না।
নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্বাচন করা। নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বাছাই করা। রাজনৈতিক দল প্রতিনিধি মনোনয়ন করে, ইচ্ছা করলে যোগ্যতা সম্পন্ন যে কেউ দলের মনোনয়ন ছাড়াই প্রার্থী হতে পারেন। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের নির্ধারিত এলাকার ভোটারদের মধ্যে কে সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই করে ঘোষণা করেন, কে জনপ্রতিনিধি হিসাবে যোগ্যতম।

নির্বাচন কমিশনের কর্তা ব্যক্তিদের বলতে শুনেছি, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ইনারা আসল খেলোয়াড়, তারা রেফারী মাত্র। তাঁদের কাজ নির্বাচন  পরিচালনা করা। খেলায় কোন দল বা প্রার্থী জিতল এটা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। কারা খেলবেন এটাও কমিশন ঠিক করেন না। সরকার আইন দ্বারা খেলোয়ারের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যাদের যোগ্যতা আছে তারাই খেলতে পারবেন। তবে আইন অনুযায়ী কাদের যোগ্যতা আছে আর কাদের নাই এটাও বলে দিবে সরকারের প্রশাসন যন্ত্র। ব্যাংক বলে দিয়েছে ঋণ খেলাপী, তাতেই সই – তিনি খেলতে পারবেন না। প্রার্থী আদালতে যেতে চাইলে যাবেন। তথ্য প্রমাণ জমা দিলেও, কমিশন বলতে পারে না, প্রার্থী ঋণ খেলাপী নন।

নির্বাচন চলাকালীন সময়ে কমিশনের অসীম ক্ষমতা। ইচ্ছা করলে তারা আইনের আওতায় যে কোন প্রার্থীকে বাদ দিতে পারেন, সতর্ক, জরিমানা করতে পারেন। যেমন খেলায় রেফারী লাল হলুদ কার্ড দেখান। প্রয়োজনে খেলা সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিতে পারেন। খেলা চলাকালীন রেফারী ভুল করতে পারেন। তাও সই, খেলোয়ারদের কিছুই করার থাকে না। প্রতিবাদ করলে শাস্তি পেতে হয়। খেলা শেষ, রেফেরীর ক্ষমতাও শেষ। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম, নির্বাচন শেষ   ক্ষমতাও শেষ। যদি কারো কোন ওজর আপত্তি থাকে তা হলে ট্রাইবুনাল, আদালত দেখবে। খেলায় ফেডারেশন বা খেলা পরিচালনা কমিটি কিছু বাইলজ তৈরি করে তার ভিত্তিতে খেলার শিডিউল তৈরী করেন। প্রতিটি খেলার জন্য সময়, মাঠ, রেফারী  সবই খেলা কমিটি নির্ধারণ করে দেন। সংগঠক দল তৈরি করে মাঠে নামান। দলের শক্তি মত্তার উপর জয় পরাজয় নির্ভর করে। রেফারী কোন দলকে কিছু সুবিধা দিতে পারেন। যেমন  ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনার হাত  ঈশ্বরের হাত হয়ে গেলো। ঈশ্বরের হাত রেফারী দেখবেন কি করে। অথবা ম্যারাডোনার হ্যান্ডবলটা রেফারী দেখলেন না। গোল হয়ে গেলো। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ আসর থেকে বিদায় নিতে হল। ২০১৫ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ-ভারত এর মাহমুদুল্লাহর তুলে মারা বলটি সত্যই ক্যাচ হয়ে গিয়েছিল, না কি সেটি ছিল আসলে ছক্কা? রেফেরীর ঘোষনা ক্যাচ, মাহমুদুল্লাহ আউট। বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হল।

খেলার মাঠে দর্শকরা উৎসাহ যোগাতে পারেন, খেলতে পারেন না। তাদের উপর জয় পরাজয় নির্ভর করে না। নির্বাচনের মাঠে আমরা মনে করি প্রার্থীরাই আসল খেলোয়াড়। আসলে  তা নয়। আসল খেলোয়াড় জনগন - ভোটার। তারাই খেলেন। খেলার মাঠের সাথে নির্বাচনের মাঠের এখানেই তফাৎ। তাই নির্বাচনে হারে জনগণ, জিতে জনগণ।

নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটার নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তারা প্রার্থীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের খেলতে না দিলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের যোগ্যতম ওয়াক ওভার পেয়ে যান। ভোটারদের খেলতে না দিলে নির্বাচনী মাঠে নামা দলের যোগ্যতম প্রার্থী ভোটারদের যোগ্যতম প্রার্থী হয়ে যান। এটা মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি? ভোটারদের নির্বাচনী খেলায় অংশগ্রহন নিশ্চিত করার জন্য অনেক দেশেই ‘না’ ভোটের প্রচলন আছে। প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে না সূচক ভোট বেশি হলে জনগনকে বিজয়ী ধরে তাদের নতুন করে প্রার্থী বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হয়। অনেক ভেবে চিনতে বাংলাদেশেও ২০০৮ সনের নির্বাচনে নির্বাচনী আইনের সংশোধন করে ‘না’ ভোটের বিধান সংযোজন করা হয়েছিল। বিধানটির কার্যকারিতা নিয়ে কোন দল বা সিভিল সোসাইটি কোন কাজ করে নি। না ভোটের সংযোজনের মাহাত্ব ভোটারদের কাছে অজানা থেকে যায়। ২০০৮ সনের নির্বাচনে এ বিধানটি তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। ফলে না ভোটের বিধান সংশোধন গুরুত্বহীণ হয়ে পড়ে। বাতিল হয়ে যায়।

বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকে ওয়েস্ট মিনিস্টার ধরনের গনতন্ত্র চর্চা করা হচ্ছে। অবশ্য মাঝে কিছুদিন পাকিস্তান শাসনামলে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রাসি নামক গমতন্ত্র চালু ছিল। ওয়েস্ট মিনিস্টার ধরনের গনতন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের মত উদার হওয়ার সুযোগ নাই।  বলতে পারে না;
“যা পেয়েছি তা থাক, যা পাইনি তাও, তুচ্ছ বলে ফেলে দিয়েছি যা, হে মোর প্রভু তাও মোরে দাও।”

যা পাইনি তা পাওয়ার সুযোগ ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্রে নাই। তুচ্ছ বলে যা ফেলে দিয়েছি তা পাওয়ারও কোন অবকাশ নাই। যেমনটা আছে ফ্রান্সের গনতন্ত্রে। ভালো লাগেনি তাই তাঁকে ভোট দেই নাই। কিন্তু কোন প্রার্থীই ৫০% এর বেশী ভোট পায়নি। দ্বিতীয় দফা ভোটে ভালো না লাগা প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ওয়েস্ট মিনিস্টার গনতন্ত্রে কত ভাগ ভোটার ভোট দিলো এটা কোন বিষয় নয়। কত ভোট পড়েছে এবং কে সবচেয়ে বেশী ভোট পেয়েছে, এটাই বিবেচ্য। তিনিই জনপ্রতিনিধি। পরাজিতরা সকলে বেশির ভাগ ভোট পেলেও তারা পরাজিত। জয়ী প্রার্থীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন না থাকতে পারে। এমন অবস্থার কথা বিবেচনা করেই ওয়েস্ট মিনিস্টার ধাচের গনতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দলকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সকল দল মিলেই সরকার। সরকারী দল দেশ চালালেও বড় কোন জাতীয় ইস্যুতে বিরোধীদের নিয়েই সব কিছু করা হয়ে থাকে, যাতে জনগণের বিজয় নিশ্চিত হয়।

আমাদের ওয়েস্ট মিনিস্টার গণতন্ত্র ব্রিটিশদের থেকে আলাদা। আমাদের নিজেদের মত। বিজিতদের জয় জয়াকার, পরাজিত অচ্ছুত, বিতাড়িত। পরাজিতের কোথাও কোন ঠাই নাই। তাই সকলপ্রার্থী বিজয়ী হতে চায়, জিততে চায়, কেউ পরাজিত হয়ে সব কিছু থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। জনগণ পরাজিত হলেও কিছু যায় আসে না।

খেলার মাঠে এক দল নামলো না। রেফেরীর কি করার আছে, অন্য দলকে জয়ী ঘোষণা করা ছাড়া। সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রলোভন দেখিয়ে আসল খেলোয়াড় ভোটারদের তাঁদের খেলা খেলতে দেওয়া হল না। নির্বাচন কমিশনের কি করার আছে? কিছু করার নাই, কিছু করতে পারবে না। এ জন্যই কি নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন বলা হচ্ছে? যদি তাই হয়, নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। মেরুদণ্ডী হওয়ার কোন সুযোগ নাই। মৌমাছির মত হুল ফুটাতে পারে, অবশ্যই ঝুকি নিয়ে।

ভোটারদের নির্বাচনী মাঠে খেলার সমান সুযোগ করে দিতে পারে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো যৌথ ভাবে। সব রাজনৈতিক দল খেলার নির্বাচনী মাঠে নামবে, সরকার দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রলোভন প্রদান বন্ধ করবে। এটা একমাত্র সরকারই করতে পারে, কারন মেরুদণ্ডটা শুধু সরকারেরই আছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, সরকারী কোষাগার সব কিছুই সরকারের হাতে। এগুলোই তো মেরুদণ্ডের একটা একটা হাড়।

যারা বলছেন নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন, তারা বোধ হয় চাচ্ছেন কমিশন মেরুদণ্ডী হোক। নির্বাচন কমিশনের কাছে মেরুদণ্ডের হাড় আইন প্রনয়নের ক্ষমতা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন যন্ত্র, অর্থ, কোন কিছু কি আছে? তা হলে তারা মেরুদণ্ডী হবে কি করে? এটা নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছার উপর। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড সরকার।

আমাদের গনতন্ত্রে সরকার মানে সকল ক্ষমতার উৎস সব কিছুর মালিক। ওয়েস্ট মিনিস্টার ধাচের পশ্চিমা গনতন্ত্র তা মনে করে না। তাঁদের কাছে সরকার মানে দায়িত্ব কর্তব্য শৃঙ্খল – একটা বোঝা। ঝামেলা হলেই বোঝা ফেলে দিয়ে হালকা হতে চায়। পদত্যাগ করে। আমাদের গনতন্ত্রে সরকার থেকে সরলেই ক্ষমতাহীন, অনাকাঙ্ক্ষিত ভিখারি। কে চাই ভিখারি হতে। তাই জেতার জন্য সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রলোভন সব কিছুই চলছে। প্রতিদিনের পত্রিকার রিপোর্টগুলো এর জ্বলন্ত প্রমাণ।

নির্বাচন কমিশন কি করবে? মেরুদন্ডী হয়ে এদের সকলের প্রার্থিতা বাতিল করবে? নির্বাচন স্থগিত করবে? এতে হয়তো কারো জয়ের পথ সুগম হবে, হেরে যাবে জনগণ।

জনগণ নির্দিষ্ট মেয়াদ কালের জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন। পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো শুধু কমিশনের হাতে থাকে না। সীমানা নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন- কাজের আইনি মারপ্যাঁচে আমরা তিন টার্ম আগের চেয়ারম্যানকে ক্ষমতায় দেখেছি। খোদ রাজধানী ঢাকায় একজন মেয়র পুনরায় নির্বাচিত না হয়েও জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এ সব কিছু নির্বাচন কমিশনকে অসহায়ের মত দেখতে হয়। শুনতে হয় কমিশন মেরুদণ্ডহীন। 

- মোঃ রফিকুল ইসলাম, পিএইচডি
সাবেক সচিব