আমার ভাবনা

Category: Politics Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6412

কোন কাজ করতে বললেই আমি করি না। আসল কথা, আমি করতে পারি না। কোন কাজ করার আগে জানতে চাই, এখানে আমার আইডেনটিটি কি,
-'' আমি কে ?
আমাকে আইডেনটিটি দেয়া হলেও কাজটা করতে আমার মন সাঁয় দেয় না। জানতে ইচ্ছে করে,
-'' আমি কেন ?
-'' অন্য কেউ নয় কেন ?
জবাব আমার মনভুত না হলে নিজেকে কাজটার জন্য তৈরী করতে পারি না। যখন বুঝতে পারি কাজটা আমাকেই করতে হবে, আর কোন পথ নাই তখন কাজটা করি।

১৯৮৪ সালের গোড়ার দিকে আমি , শিল্প মন্ত্রনালয়ের সহকারী সচিব, উন্নয়ন। অতিরিক্ত সচিব মহোদয় আমাকে বললেন, ' সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমাজতান্ত্রিক কৌশল পরিবর্তন করে ধনতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছে। স্থাপিত শিল্পকারখানা বেসরকারী মালিকানায় ছাড়া হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় বড় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন শিল্প সরকারী উদ্যোগে স্থাপন করা হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে একটা শিল্পনীতি থাকা দরকার। তা না হলে বিনিয়োগ আসবে না। '
-'' ঠিক স্যার।'' বলে সায় দিলাম। সংগে সংগে অতিরিক্ত সচিব মহোদয় নির্দেশ দিলেন,
-'' তুমি একটা খসড়া দাঁড় করাও। পরে ঘসা মাজা করে ঠিক করা যাবে।'' জবাবে আপত্তি তুললাম,
-' স্যার, আমি সহকারী সচিব, উন্নয়ন। শিল্পনীতি তৈরী করার কাজ আমার নয়। শিল্প বিনিয়োগ অনুবিভাগের। ''
জবাবে বিরক্ত হয়ে বললেন,
-'' তুমিও তো শিল্প মন্ত্রনালয়ের সহকারী সচিব। তুমি করলে অসুবিধা কি? ''
-'' কোন অসুবিধা নাই স্যার। আমিও করতে পারি। ঐ শাখার নথি এনে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। আমি জানি না কোন নথিতে এগুলো আছে। তবে ওদের জানা আছে। সময়ও কম লাগবে। ''
শুনে বললেন,
-'' বুঝেছি। বলো এটা কার কাজ ?
-'' সহকারী সচিব আই ,আই, এর। শফিকের কাজ। ''
-'' ডাকো শফিককে।''

শফিককে ডাকে দিয়ে অতিরিক্ত সচিব মহোদয়ের হাত হতে রক্ষা পেলাম। শফিক শিল্পনীতির খসড়া তৈরী করছে। তাঁর পাগল হওয়ার জোগাড়। করিডোরে দেখা হলেই ,
-'' এই মিয়া! আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বেশ আরামে আছো, না। '' জবাব না দিয়ে মুচকি হাঁসি দিয়ে বিদায় নিতাম। মনে মনে বলতাম,
-'' শিল্পনীতি তুমি করবা না তো পোলাপান করবে। ''

শফিক শেষ মেস ওটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়লো। বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সহকারী পরিচালক হিসাবে বদলী হয়ে শফিক চলে গেল। অতিরিক্ত সচিব মহোদয় আমাকে বদলী করে শফিকের দায়িত্ব দিলেন। কাজটা এখন আমাকেই করতে হবে।
'' কি ভাবে করবো ?'' এ চিন্তায় মাথাটা খারাপ হওয়ার জোগাড়। শফিককে জিজ্ঞাসা করলাম,
-'' দেখ আমি একটা কংকাল দাঁড় করিয়েছি। অন্য সবার সংগে কথাবার্তা বলে মাংস লাগাও। হয়ে যাবে। তুমি পারবা।''
বলেই শফিক মুচকি হাঁসি দিয়ে কেটে পড়লো। মনে পড়লো , আমিও এরকম মুচকি হাঁসি হেঁসেছিলাম। শফিকের তৈরী শিঁল্পনীতির কংকালটা দেখলাম। মাংস লাগানোর কাজটাও সে অনেক খানি এগিয়ে রেখেছে। মনে মনে শফিককে ধন্যবাদ জানালাম।

নথিটা সামনে নিয়ে ভাবছি। কিভাবে শুরু করবো ? আমাকে কি কি করতে হবে ? শফিকের কথামত শুধু মাংস লাগালেই হবে কি ? এক ধরনের মাংস, না জায়গা ভেদে কোথাও পেশী, কোথাও রংগীন মাংস লাগাতে হবে ? এ সব নিয়ে ভাবছি আর চুল ছিড়ছি।
আমি খুজছি কি কি করতে হবে। কিভাবে করবো। হঠাৎ মাথায় এলো মানুষ শিল্পে বিনিয়োগ করে কেন ? বিনিয়োগ করে লাভের আশায়। যদি সে জানে;
- ‌বিনিয়োগ সুরক্ষিত;
- এ বিনিয়োগে প্রানোদনা আছে;
- বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হচ্ছে;
- বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ আছে;
- বিনিয়োগ সহায়ক জমি,শ্রমিক, যন্ত্রপাতি মূলধনের যোগান পাওয়া যাবে;
- প্রয়োজনে বিদেশী বিনিয়োগ আনা যাবে।

মনে মনে খুশি হলাম। মাথা ঘামিয়ে অনেক কিছু পেয়ে গেছি। বুঝলাম, কি কি করতে হবে, জানার জন্য মাথা ঘামাতে হবে। আমি একা মাথা ঘামালে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে; সবকিছু পেতে হলে অনেক মাথা এক সাথে ঘামাতে হবে। একার মাথায় হবে না। শুধু মাথা ঘামালেই হবে না, জানার জন্য পড়াশুনাও করা দরকার। কয়েকটা দেশের শিল্পনীতি শফিক সংগ্রহ করে নথিতে রেখেছিলো। পড়া শুরু করলাম। শেষমেশ ঠিক করলাম, শিল্পনীতি সংশ্লিষ্ঠ একাডেমিক,প্রাকটিশনার হিসাবে বিনিয়োগকারীদের মতামত নিবো। কি ভাবে মতামত নিবো জানি না। বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। একজন উপদেশ দিলেন ,

-" খসড়াটা পাঠিয়ে দিয়ে ৭ দিনের মধ্যে মতামত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিন।'' অন্যজন বাগড়া দিয়ে বসলেন ,
-'' ওদের দায় ঠেকেছে। মতামত দিবে ? তাঁদের সময় আছে ? সরকারী চাকুরী করে আমরা মতামত দিতে গড়িমসি করি। ওরা দিবে কেন দিবে ? দেখেন যদি পান"।
আর একজন বললো।
-'' ও ঠিক বলেছে। চিঠি দিয়ে মতামত পাওয়া যাবে না। ''আলোচনা করার জন্য এক্সপার্ট আনা যায়।''

মোটামোটি ঠিক করলাম, বিশেষজ্ঞদের এনে আলোচনা করে সব কিছু ঠিক করবো। অতিরিক্ত সচিব মহোদয়কে জানালাম। উনি বললেন,
-'' বিশেষজ্ঞদের নানা মুনির নানা মত। এ ধরনের আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। একটা ওয়ার্কশপ করো। কি করবো বুঝলাম। কিন্তু কিভাবে করবো?"

মোটর গাড়ীর ওয়ার্কশপের কথা শুনেছি। হরিয়ানা সুগারমিলের ওয়ার্কশপটাও দেখেছি। শিল্পনীতি তৈরী করবো এ জন্য ওয়ার্কশপ লাগবে কেন ? বুঝে উঠতে পারছি না। একজন সিনিয়র ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম । '' অতিরিক্ত সচিব মহোদয় শিল্পনীতির উপর একটা ওয়ার্কশপ করতে বলেছেন। কি করবো ? কিভাবে করবো বুঝছি না। '' তিনি বললেন,
-'' এটা কিছু না। এটা এক ধরনের মিটিং। শিল্পনীতির সাথে জড়িত সকল সরকারী অফিসার শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তালিকা করে একদিন তাদের ডাকেন । ''

আমি আগ্রহ ভরে জানতে চাইলাম,
-'' তারপর । '' জবাবে বললেন।
-'' আপনি কি করতে চান। এটা জানানোর জন্য একটা পেপার তৈরী করেন পেপারটাকে বলবেন, কী-নোট পেপার। এটা পড়বেন। পরে প্রতিটি বিষয়ে ছোট ছোট গ্রুপ করে দিয়ে সে বিষয়ে তাঁদের মতামত নিন।''
জানতে চাইলাম কেন মতামত নিবো ? '' জবাবে তিনি বললেন।
-'' তাহলে তাঁরা নীতিটির অংশীদার হবেন। আপনার কাজ হয়ে যাবে।''
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। ওয়ার্কশপের আয়োজন শুরু করলাম। ওয়ার্কশপ হলো।

শিল্প উদ্যোক্তরা প্রানোদনা চান। বিনা সুদে ব্যাংক থেকে মূলধন প্রাপ্তির দাবী উঠলো। ট্যাক্স হলিডে এর ব্যবস্থা করতে বলা হলো। বাণিজ্য মন্ত্রনালয় বলো , শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোকে অবশ্যই রফতানিমুখী হতে হবে। নানান জনের নানান কথা । তবে ওয়ার্কশপ থেকে বেশ ভালো ভালো সুপারিশ পাওয়া গেল। কী-নোট পেপারে বা মাথায় ও গুলো ছিল না। কিছু সুপারিশ নীতিমালায় ঢুকালাম। অনেক কিছুই বাদ দিলাম। শিল্পনীতির খসড়া তৈরী হলো। খসড়াটা নিয়ে শিল্প মন্ত্রনালয়ে বেশ কয়েক বার সভা হলো। সভার সুপারিশ অনুযায়ী শিল্পনীতি সংশোধন,পরিমার্জনও করা হলো। শিল্পনীতির উপর আন্ত:মন্ত্রনালয় সভা ডাকে আলোচনা সমালোচনা শেষে শিল্পনীতির খসড়া চুড়ান্ত হলো। মাননীয় শিল্পমন্ত্রী খসড়া অনুমোদন করলেন। নীতির চুড়ান্ত অনুমোদন দিবেন মন্ত্রিসভা। শিল্পনীতির ৫৫টি কপি সহ সারসংক্ষেপ এবং নীতির যৌক্তিকতা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে হবে। সারসংক্ষেপ তৈরী করলাম। মন্ত্রী মহোদয়ের অনুমোদন নিয়ে সারসংক্ষেপ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হলো। শিল্প সচিব শিল্পনীতি উপস্থাপন করলেন। আমি নথি পত্র নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ কক্ষের বাহিরে অপেক্ষা করলাম। ভাগ্য ভালো ডাক পড়েনি। শিল্পনীতি ১৯৮৪ মন্ত্রি পরিষদের অনুমোদন পেল। পরের দিন পত্রিকার পাতায়,
-'' অবশেষে শিল্পনীতি তৈরী হলো।''
-'' এই শিল্পনীতিতে শিল্পের বিকাশের জন্য তেমন কোন দিক নির্দেশনা নাই।''
-'' দেশ পুঁজিবাদের হাতে জিম্মি করা হলো।''

শিল্পনীতি কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে পত্রিকায় আর কোন লিখা লিখি নাই। আমি শিল্পনীতির খসড়া চুড়ান্ত করতে পেরেছি। পারার জন্য আমাকে জানতে হয়েছে,
-'' কেন আমি করবো ? কেন অন্যরা নয় ?''
-'' কি করবো ?কিভাবে কাজ গুলো করবো ? কৌশল গুলো কি ? জানার পর আমি কাজটার জন্য
উদ্দীপ্ত হয়েছি ।

এগুলো জানা না থাকলে চাকুরী জীবনের শুরুতে এধরনের একটা কাজ করা সম্ভব হতো না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কৌশল হিসাবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল তথ্য ও যোগযোগ বিকাশের লক্ষে প্রতিটি জেলায় ২জন করে সহকারী প্রোগ্রামার নিয়োগ করেছে। তাঁরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা, কর্ম সংস্থান, আইসিটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে কাজ করবেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিন দিন ব্যাপী একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসাবে গিয়ে জানতে ইচ্ছে হলো; তাঁরা কি জানে , তাঁরা কে ? জিজ্ঞাসা করলাম। জবাবে একজন বললো,
-'' বাংলাদেশের নাগরিক।'' বললাম
-'' আমিও তো বাংলাদেশের নাগরিক। তোমার আমার মাঝে তফাৎ কোথায়?" একটা মেয়ে বললো,
-'' আমরা সহকারী প্রগ্রামার ।'' জবাবে বললাম,

'' আমি ভালো করেই জানি , আপনারা সহকারী প্রোগ্রামার। আমি কেন এই প্রশ্ন করেছি ? ''একজন লাফ দিয়ে উঠে বললো,
-'' আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। '' অবাক হয়ে বললাম;
-'' আপনারা মাত্র ১২৮ জন। আপনারা একাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারবেন? আপনি সাহসী,
প্রশংসা করতে হয়। তবে আস্থা রাখতে পারছি না।''
আর একজন কি যেন বলতে চেয়ে ছিল। তাঁকে বাধা দিয়ে আলোচনা এখানেই থামালাম। আমার মনে হলো ওরা অন্ধকার ঘরের মধ্যে একটা কালো বিড়াল খুঁজছে। ওদের কাছে পরিস্কার নয়,
-'' ওরা কারা ?'
-'' ওরা কি করবে ?'
-'' কেন করবে ?'
-'' কি ভাবে করবে ?'
ওরা এই প্রশ্ন গুলোর জবাব না জানলে কাজ গুলো ঠিকমত করতে পারবে কি ? কাজ গুলো করার জন্য আগ্রহ জন্ম নিবে কি ? জানি না। আমার মনে হয়েছে তাঁদের জানাতে হবে তাঁদের আইডেনটিটি, তাঁদের কাজগুলো সমন্ধে। কেন এগুলো করা দরকার জানিয়ে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। তাঁদের দেখিয়ে দিতে হবে কৌশলগুলো।

তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, গাড় সালফিউরিক এসিডে দস্তা দিলে কি হবে ? জবাবে একজন বললো,
-'' জিংসালফেট ও হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরী হবে। ''উত্তর দিলাম
-'' ঘোড়ার আন্ডা। কিছুই হবে না। হবে যদি ওতে পানি না থাকে। পানি ওখানে অনুঘVক"।

বুঝেছো তোমরা কে ? তোমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের অনুঘVক। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরী করবে নতুন প্রজন্ম। তোমরা অনুঘঠক হিসাবে তোমাদের কাজগুলো কর। কোন সাড়া শব্দ নাই। বুঝলাম তাঁরা তাদের পরিচয় জেনেছে।