বিশ্বমন্দার বাংলাদেশ

Category: Politics Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 8369

আমেরিকার বাঘা বাঘা কোম্পানী বিশ্বমন্দার কবলে। ইউরোপ-অষ্ট্রেলিয়া দূরপ্রাচ্য কেউ বিশ্বমন্দার হাত হতে বাদ যায়নি। কোম্পানীগুলো তাদের কাজকাম গুটাচ্ছে। ছাটাই চলছে। বাংলাদেশে তেমন কোন প্রভাব আজও পড়েনি। বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদদের নিয়ে সোনারগাঁও, শেরাটন, ওয়েষ্ট ইন-এর মত হোটেলে সেমিনার, ওয়ার্কশপ চলছে। সবার প্রশ্ন, বিশ্ব মন্দার প্রভাব বাংলাদেশে কেমন হবে। সরকারী কর্মকর্তা হতে শুরু করে সিভিল সোসাইটি প্রেসক্রিপশান দিচ্ছে, বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে গ্রাস করবে। গার্মেন্টস ধ্বংস হয়ে যাবে। রেমিট্যান্স শূণ্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়াবে। 'রেমিট্যান্স কমে যাবে।' অন্য একদল বলছে, 'এখনই কার্যক্রম না নিলে পোশাক-শিল্পে ধ্বস নামবে'।

সরকারের উচিৎ আজ থেকেই প্রণোদনা প্যাকেজ-এর ব্যবস্থা করা। পত্রিকা পড়ি। পড়লে ভালো লাগে না। না পড়লেও সবসময় মনে হয়, 'কি যেন করা হয়নি।' তাই প্রতিদিন কয়েকটা পত্রিকা নাড়াচাড়া করি। একটা পত্রিকার একটি রিপোর্ট আমাকে চিন্তিত করে তুললো। পত্রিকাটি লিখেছে, 'বিশ্বমন্দার প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির। সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অর্থনীতিকে চালু রাখতে হলে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।' ভাবছি সরকার কি করবে? সরকারের কোন কিছু করার আছে কি? জানি না।

আমি নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব। একই সংগে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রকল্পের অধীনে একজন ট্রেনিং অর্গানাইজার নিয়োগ করা হবে। সকালে লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা হলো। পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির আমি সভাপতি ও উপ-প্রধান মতিউর রহমান, সদস্য সচিব। এছাড়াও কমিটিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপ-সচিব আহমেদ মোর্শেদ, পরিকল্পনা কমিশনের উপ-প্রধান এনায়েত হোসেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান মনিরা বেগম সদস্য আছেন। খাতাগুলো দেখলেন, মতিউর রহমান এবং মনিরা বেগম। খাতা দেখার পর আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করে তাদের নামের তালিকা টাংগানো হলো। ৬জনের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হবে। আমি বোর্ডের সভাপতি। বোর্ডকে সবাই আলাদা আলাদা মার্ক দিতে বলেছি। আমি প্রশ্ন করলেও করতে পারি, তবে কোন মার্ক দিবো না। সবার গড় মার্কটাই আমার নম্বর।

ভাইভার শুরুতেই বুঝতে পারলাম বিশ্বমন্দা বোর্ডের সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ট্রেনিং অর্গানাইজারের মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছি। বোর্ডের কোন সদস্যই এ সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে ভাবছেন না বরং এড়িয়ে মন্দার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিনিধি মৌমিতা আসাদ নামের প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আচ্ছা বলেন তো, বিশ্বমন্দা কোন ৩টি সেক্টরে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলবে"? মৌমিতা আসাদ, গার্মেন্টস সেক্টরের নাম বলার পর আমতা আমতা করতে লাগলেন। একবার বলছেন শিল্প আবার বলছেন, না কৃষি। মনিরা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন বললেন 'পত্রিকায় এ নিয়ে এত লিখালিখি হচ্ছে এই সামান্য বিষয়টি আপনার জানা নাই।'

আমি প্রসংগটা অন্যদিকে নিয়ে বললাম, "আপনিতো ট্রেনিং অর্গানাইজার পদে আবেদন করেছেন।"
'জ্বী, স্যার!' মৌমিতা আসাদ জানালো।
'শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের ৫টি বাক্য বলেন'- আমি মৌমিতাকে অনুরোধ করলাম।
'শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড' - বাক্যটি দিয়ে সে শুরু করলো। শিক্ষা সম্বন্ধে বহুজনের কাছ থেকে এই বাক্যটি শুনতে শুনতে বাক্যটির প্রতি এলার্জি হয়ে গেছে। ভালো লাগলো না। তাঁকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'শিক্ষা কি'?
'শিক্ষা হলো জ্ঞান অর্জনের উপায়.....।' সে অনেক কিছুই বললো। অনেক ভালো ভালো কথা ছিল তার বলায়। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো কি যেন বলা হয়নি। মৌমিতা কি যেন বলেনি।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি জানতে চাইলেন, 'ট্রেনিং অর্গানাইজার হিসেবে আপনার কাজ কি হবে বলে আপনি মনে করেন'। টিওআরটা তার ভালো করেই পড়া ছিল মৌমিতার। গড় গড় করে সে জবাব দিল। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করলাম।

পরেরজনকে ডাকা হয়েছে। আইএমইডির প্রতিনিধি তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, 'বিশ্বমন্দা আমাদের অর্থনীতিতে কি কি প্রভাব ফেলবে।' বেচারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম এদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস নাই। চাপাবাজিও তেমন শেখেনি। তাঁকে রেসকিউ করার ইচ্ছা থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'ট্রেনিং আর শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য কি?' 'ট্রেনিং হলো শিক্ষা তবে কম সময় ধরে। শিক্ষা হলো শিক্ষা বেশী সময় ধরে।' পরীক্ষার্থী জবাব দিলো। খুব রাগ হলো জবাবটা শুনে। প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ করার আগেই মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় আমাকে কি শিখানো হয়েছে। আমাকে যা শিখানো হয়েছে আমিতো তাই বলবো। যা জানি না তা বলবো কেমন করে। হঠাৎ নষ্টালজিয়া পেয়ে বসলো। স্কুলের বেঞ্চে চলে গেছি।

অংক শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। শিখাচ্ছেন, 'বিন্দু কাহাকে বলে'। ছাত্ররা একসংগে জানতে চাইলেন, 'কাহাকে বলে?' স্যার বললেন, 'যাহার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ, উচ্চতা কিছুই নাই তাহাকে বিন্দু বলে।"
সবাই খাতায় তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি পেন্সিলটা একটা প্রান্ত গালের মধ্যে ঢুকিয়ে ভাবছি, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ, উচ্চতা কিছুই নাই এমন একটা জিনিষ থাকে কি করে? ভাবনাটা বেশী দূর আগাতে পারল না। গণিত স্যার নতুন প্রশ্ন করলেন, বলোতো, রেখা কাহাকে বলে'?
গণিত স্যারের সংগে আলতাফ ভাইয়ের ছোটবোনের সংগে প্রায় ফিসফাস হয় তার নাম রেখা। দুষ্টমি করার ইচ্ছা হয়েছিল। বলতে চেয়েছিলাম আলতাফ ভাইয়ের ছোটবোন রেখা বলে। কিন্তু পারলাম না। অবদমন করলাম। বললাম, 'বিন্দুর চলমান পথকে রেখা বলে। চলার পথে দিক পরিবর্তন না করলে তা হবে সরল রেখা। আর দিক পরিবর্তন করলে তা হবে বক্র রেখা'।
বলা শেষ করার আগেই শিক্ষক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন, 'বড় পন্ডিত হয়েছিস। সোজা জিনিষ সোজা বললে কি হয়'। তিনি বললেন, "দুইটি বিন্দু সংযোগ করলে রেখা উৎপন্ন হয়।'
সবাই মেনে নিলেন। তারা খাতায় টুকেও রাখলেন। আমি মানতে পারলাম না। কারণ এটা রেখার সংগা নয়। আমাকে বলা হলো, রেখা কিভাবে তৈরী হয়।

এসব ভাবনা আমাকে মৌখিক পরীক্ষা থেকে দূরে আমার ছোটবেলায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। বোর্ডে এসেছি। ভাবলাম এদের আর দোষ কি? যা শিখে এসেছে তাইতো বলবে। পরীক্ষার্থীকে ধন্যবাদ দিয়ে পরেরজনকে আসতে বললাম। প্রায় সবার কাছ থেকে জানতে চাইলাম, 'শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য কি?' সবাই যে যার মত করে বললো। মনে ধরলো না। বোর্ডের অন্য মেম্বারগণ বিশ্বমন্দা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন। এভাবেই মৌখিক পরীক্ষা শেষ হলো।

পরীক্ষা শেষ তারপরও মনিরা তার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না। বললেন, 'বিশ্বমন্দা নিয়ে এত লিখালিখি হচ্ছে। একজনও বলতে পারলো না কোন ৩টি সেক্টর বিশ্বমন্দায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।'
আমি হাসতে হাসতে বললাম, 'মনিরা, সত্য কথা বলতে কি, আমিও জানি না, কোন ৩টি সেক্টর বিশ্বমন্দায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে?'

-'কি বলছেন, স্যার! প্রতিদিন পত্রিকায় আসছে' বললো। আর আপনি বললেন, 'আপনি জানেন না'। মনিরা অবাক হলো।
-'দেখেছি, পড়েছি। কিন্তু মেনে নিতে পারিনি' বললাম আমি।

-'কেন স্যার?' সবাই জানতে চাইলেন। আমি সবাইকে যা বললাম তার সারঅংশ নিম্নরূপ।

'বাংলাদেশ যে গার্মেন্টসে যা উৎপাদন করে তা গরীবদের জন্য মন্দা হলেও তারা কাপড় ছাড়া থাকতে পারবে না। কাপড় তাদের পরতেই হবে। ওদের ওখানে শীত বেশী। মন্দায় মধ্যবিত্তও গরীবের খাতায় নাম লিখাবে। আমাদের তৈরী গার্মেন্টসের প্রয়োজন বাড়বে, কমবে না।'

বিশ্বমন্দায় ইউরোপ আমেরিকায় বিনিয়োগ কমবে। পুরাতন জিনিষ তারা বেশী ব্যবহার হবে। তা ঘন ঘন নষ্ট হবে। আমাদের লেবারদের কাজ বাড়বে। বাংলাদেশ থেকে নতুন লেবার যাবে। রেমিট্যান্স-এর উপর বিরূপ প্রক্রিয়া পড়বে তা বিশ্বাস করি না' - জানালাম আমি।
বারী জানালো, "ঠিক আছে স্যার। কিন্তু আমরা সব কিছু আমদানী করি। আমদানীর কি হবে?'
বললাম, 'মন্দায় বিক্রিবাট্টা কমে যাবে। তাদের দেশে দাম কমবে। বাংলাদেশের আমদানী ব্যয় কম হবে। রিজার্ভ বাড়বে। এতে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান এ কথাই বলে।'

কমিটির সদস্যগণ যুক্তিগুলোকে ফেলে দিতে পারলো না। অন্যদিকে মেনে নিতেও পারলো না বলে মনে হলো না। 'আপনারা বিশ্বমন্দা নিয়ে চিন্তিত। আমি তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত না'- বললাম আমি। 'কেন?'- সবাই একসংগে জানতে চাইলো। 'কারণ আমি আগেই বলেছি। তবে এখন যা বলবো তা আপনাদের অবাক করবে। বিশ্বমন্দা আমাদের জন্য ভয়ের কিছু নয়, বাংলাদেশের আর্শিবাদ। এটাকে কাজে লাগাতে হবে'- বললাম আমি।

'তাহলে আপনাকে বিচলিত মনে হচ্ছে কেন স্যার?' - অন্যরা জানতে চাইলেন।

'অর্থনীতিতে কোন মন্দা নাই ঠিক। তবে মন্দা আমাদের গ্রাস করছে। এটাতো ঠিক' - বললাম আমি। 'শিক্ষায় যে মন্দা লেগেছে এটার প্রভাব যে কি হতে পারে জানি না। এ মন্দা কাটাতে না পারলে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।' বললাম আমি। এনায়েত একমত হতে পারলো না। প্রতিবাদ জানালো, 'আজকালকার ছেয়েমেয়ের স্যার বেশী জানে।'

আমি একমত পোষন করলাম। তবে এও জানালাম, 'আমি জানতে চেয়েছিলাম, শিক্ষা আর প্রশিক্ষণের মধ্যে পার্থক্য কি?'। সবাই বলেছে, 'শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এটা এখানে কতটুকু প্রযোজ্য।'

বারী বললো, 'এছাড়া তাঁদের আর কি বলার ছিল, স্যার।'

'ছিল, তাদের এভাবে শিখানো হয়নি। যা শিখানো হয়েছে তা তাদের মনে বাসা বেঁধে আছে। তাই তারা এগুলো বলছে। অন্যভাবে চিন্তা করতে পারছে না। অন্যভাবে শিখালো তারা অন্য কথা বলতো।' বললাম আমি।

মনিরা আমার কাছে জানতে চাইলো, 'আপনাকে একই প্রশ্ন করা হলে কি জবাব দিতেন'।

আমি বললাম, আমার জবাবটা হতো ঠিক এরকম-
'শিক্ষা হলো একটি প্রসেস যার মাধ্যমে আমাকে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ধারণা দিয়ে আমার মস্তিস্কের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণ একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাকে কোন উদ্দেশ্যে কিছু কৌশল, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দেয়া হয়। যাতে আমি কম সময়ে, কম খরচে একটি কাজ ভালোভাবে করতে পারি। শিক্ষার মন্দা, বিশ্বমন্দার চেয়েও ভয়াবহ বলে আপনি মনে করেন।' সংগাটা একটু আঁতেল মার্কা। তবে অনেক কিছু বলে।
'অবশ্যই, তাই' - সবাই একমত হলো।

মন্দা অর্থনীতির না থাকলেও শিক্ষার মন্দা বিজ্ঞানের মনের, বিবেকের, সংস্কৃতির মন্দাতো রয়ে গেছে। এতকিছুকে সামাল দিব কি করে। এসব বিষয় মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় কে যেন জিজ্ঞাসা করলো,
'আপনি মন্দাকে আর্শিবাদ বলছেন। তাহলে বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগণ এত চিন্তিত কেন?'

'জানি না' - বললাম আমি। আরও বললাম আমার কাছে একটা কারণ জানা আছে। শুনবেন। বলেন, শুনি।
'তাঁরা বাংলাদেশে থেকেও আমেরিকায়, ইউরোপে। যারা আমেরিকায় তাদের কাছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অচেনা। তারা অর্থনৈতিক মন্দায়। তাই তারা এটা নিয়েই চিন্তিত। আমি বাংলাদেশে, বাংলাদেশের আবহাওয়া। আমি চিন্তিত আমাদের মনের, শিক্ষায় সংস্কৃতির মন্দা নিয়ে চিন্তিত।'

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সবার মাঝে বাড়ী ফেরার তাড়া দেখা দিলো। লিখিত, মৌখিক, অভিজ্ঞতার মার্কযোগ করা হয়ে গেছে। ১ম জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে আমরা বিদায় নিলাম। তখন দিনেরও মন্দা শুরু হয়ে গেছে।