হারানো মুখ

Category: Environment Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 7302

নোঙর নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। প্রথম দিকের পাতার ছবিগুলোর উপর চোখ পড়তেই বুকটা ধক ধক, চোখগুলো ছলছল করে উঠে। এখানে চোখ পড়লেই একটা অজানা ভয়, আতংক আর অদ্ভুত বিষন্নতা আমাকে পেয়ে বসে। নোঙরটা তাই খুলতে চাই না। না খুলেও পারি না। কোন বন্ধুর কাছে তদবির করবো। নোঙর খোল। নোঙর বিসিএস-৮২ ফোরামের সকল সদস্যের নাম ঠিকানা। প্রথম পাতার মুখগুলোকে আমরা হারিয়েছি। শিরিন মজিদ, গোলাম মোস্তফা, প্রদীপ কুমার মজুমদার, মোঃ মাহবুবুর রহমান, কাজী সাইফুন্নাহার, মোঃ আমানুল্লাহ, মোঃ খুরশীদ আলম, ওয়াকিল আহমদ, খন্দকার আব্দুস সামী, এদের দিকে চোখ পড়লেই ফিরিয়েনি। এ বছর এ পাতায় আরও দুটো নাম যোগ হলো। অতিরিক্ত সচিব আঞ্জুমানারা বেগম ও ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম। মোহাম্মদ আলী এককভাবে আজও নোঙর ছাপানো কাজটা করে যাচ্ছে। আগামীতে সে এ নাম দু'টোও হারানো মুখে যোগ করবে।

মরহুমা শিরিন, অডিট এন্ড একাউন্টস ক্যাডারের কর্মকর্তা। একসাথে ফাউন্ডেশন করলেও তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেনি। সম্পর্কটা হাই/হ্যালোর মধ্যেই ছিল। একদিন শুনলাম শিরিন নাই। আঁতকে উঠলাম। একজন বিসিএস কর্মকর্তা চাকুরীর শুরুতেই এভাবে বিদায় নিবেন ভাবতেই পারিনি। যা ভাবিনি তাই হলো।

গোলাম মোস্তফা, সহকারী কমিশনার, পুলিশ। আমার সংগে পরিচয় বা সখ্যতা হয়নি। শৈলকুপায় সর্বহারাদের সংগে বন্ধুক যুদ্ধে তাঁর পায়ে গুলি লাগলো। অজানা আশংকায় বুকের মাঝে চিন্ চিন্ করে উঠলো। অনেকদিন পর শুনলাম মোস্তফা মারা গেছে। মোস্তফা নিরবে নিভৃতে আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো।

প্রদীপ কুমার মজুমদার-এর সংগে দেখা হয়েছে। হাই-হ্যালো করেছি। নিজেও অসুস্থ ছিলাম। কারো খোঁজ-খবর রাখতে পারিনি। নতুন নোঙর পেলাম। পাতা উল্টাতেই দেখি প্রদীপ নেই। সেও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সচিবালয় ক্যাডারে আমরা একসংগে অনেক কয়েকজন যোগ দিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাদের পাঁচ জনকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে শাখা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। তাঁদের একজন মোঃ মাহবুবুর রহমান শিল্প মন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব কর্পোরেশনগুলোর বিষয়াদি সে দেখাশুনা করেন। একসংগে এক মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ায় সখ্যতা, হৃদ্যতা গড়ে তুলেছিল অনেক বেশী। প্রতিদিন অফিসে চা সিংগাড়ার আড্ডায় তৃপ্তি হতো না। অফিস শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে ফ্লোরা রেস্টুরেন্টে অথবা ১নং পুরানা পল্টনে আনসার ভাই-এর দোকানে আড্ডা দিতাম। চা, সিংগাড়া ধ্বংস, রাজা-উজির মেরে আমি তাঁকে বাড্ডাগামী হলার বা মুড়ির টিনে তুলে দিয়ে ফকিরাপুলের গরম পানির গলির আল্লাহওয়ালা ব্লিডিং-এ আমার আস্তানায় যেতাম। মাহবুবের মা-বাবা ছিল না। তিন ভাই, দুই বোন। সেই বড়। আমি তখনও বিয়ে করিনি। আল্লাহতায়ালা বিল্ডিং একটা অভিজাত মেস। এই মেসে আমি ভাড়া থাকি। অনুষ্ঠান পর্বনে আমি মাহবুবের চেয়ারম্যান বাড়ীর পাশের বাড্ডার বাড়িতে গেছি। সেও আমার মেসে এসেছে। ১৯৯২ সালের গোড়ার দিক থেকে সে মাঝে মাঝে কাঁশতো। আমি তখনও চেইন স্মোকার। মাহবুব শখ করে ছাড়া বিড়ি-সিগারেট টানেনি। তাঁর কাঁশি শুনে বললাম,
'সিগারেট-বিড়ি কিছুই টানিস না। এমন করে কাশিস কেন?'
'শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বুকে ব্যাথা করে। কাঁশিতো দেখছিস' - জবাবে সে হতাশা ব্যক্ত করলো।
'ডাক্তার দেখা' - আমি বললাম।
'দেখালাম তো। ঔষধও খাচ্ছি। কোন কাজ হচ্ছে না' - মাহবুব জবাব দিলো।
তাঁকে অন্য ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলাম। সে কয়েকজন ডাক্তার দেখালো। কোন উন্নতি হচ্ছে না।

একটা কোর্সে তিন মাসের জন্য ইংল্যান্ডের নরিচ গেলাম। ফিরে আসার সময় তাঁর জন্য একটা গিফ্‌ট নিয়ে এসেছিলাম। গিফটা দিতে তাঁর মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শুনলাম মাহবুব অসুস্থ। অফিস আসে না। কাজের অসুবিধা তাই তাঁকে বদলী করে দিয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফিরে আসলাম। ২দিন পর শুক্রবারে গিফটা হাতে করে রাস্তার একটা দোকান থেকে আপেল আর আংগুর কিনে সকালবেলা তাঁর বাড়ী বাড্ডা গেলাম। আমাকে দেখে সে উঠার চেষ্টা করলো। আমি বাধা দিয়ে শুইয়ে দিলাম। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে। আমি বিছানায় তাঁর পাশে বসে হাতটা ধরে আছি। হঠাৎ তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আমার হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বললো,
'আমি হয়তো আর বাঁচবো না রে - আমার ভাইবোনগুলোকে একটু দেখিস। যেন মানুষ হয়।'
আমি ধমক দিয়ে বললাম,
'কি, আজে বাজে কথা বলছিস। চিন্তা করিস না। ভালো হয়ে যাবি'।
ও জানালো, 'কাশিটা বেড়েছে। কাঁশির সংগে রক্ত উঠছে। ডাক্তারের ডায়াগনোসিস, যক্ষা'।
'যক্ষা, কোন রোগ হলো' - তাঁকে শান্তনা দিলাম। তাঁর মুখে কয়েকটা আংগুর তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম।
'চিন্তা করিস না। সুস্থ হয়ে যাবি। আমি আগামী শুক্রবার আবার আসবো'। বলে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

অনেকদিন বিদেশে থাকায় শাখায় অনেক কাজ জমে ছিল। কাজের ভিতর ডুবে গেলাম। মাহবুবের তেমন খোঁজখবর নিতে পারিনি। কে একজন জানালো মাহবুবের অবস্থা ভালো নয়। তাঁকে বললাম, শুক্রবার দেখতে যাবো।

শুক্রবার সকালে মাহবুবের ছোট ভাই-এর টেলিফোন। কথা বলতে পারছে না। শুধু হু হু করে কান্না। আমি বুঝলাম মাহবুব আর নেই। তাড়াতাড়ি তাঁর বাসায় ছুটলাম। তাঁর কবরের ব্যবস্থা করা হলো। বুকের ভিতর হাহাকার আর শূণ্যতা নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।

প্রথম দিকে মাহবুবের ভাই-বোনদের নিয়মিত খোঁজ-খবর রেখেছি। মাহবুবের ছোট ভাইটা একটা প্রাইভেট ফার্মে যোগ দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীকে নিয়মিত গেছি। সব ছোটভাইটিও পড়াশুনা শেষে চাকুরীতে যোগ দিলো। ছোট বোনটার বিয়ে। তাঁর ছোট ভাই দাওয়াত দিয়ে গেল । বিয়েতে গেলাম। জামাইটা একটা চাকুরীর জন্য কয়েকবার অফিসে এসেছিল। চাকুরীর ব্যবস্থা করতে পারিনি। একদিন শুনলাম, মাহবুব-এর ছোট বোন 'ডিভি' পেয়েছে। আমেরিকা চলে যাবে। হঠাৎ করেই সব যোগসূত্র কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাঁর ভাইদের কোন খবর আজ আর জানা নাই।

কাজী সাইফুল্লাহ-এর সাথে দেখা হলেও কথা হয়েছে মনে পড়ে না। নোঙরে যাদের হারিয়েছি পাতায় তাঁর নামটা দেখে ভীষণ রাগ হলো। এত দ্রুত এই পাতাটা ভরে যাচ্ছে কেন? আকাশকে জিজ্ঞাসা করলাম 'এভাবে কেন ঝরে যাবে প্রাণগুলো'। আকাশ কোন জবাব দিলো না। চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।

মোঃ আমানুল্লাহ, হালকা পাতলা মানুষ। অনেকবার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। তবে কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ হয়নি। ১৯৯৭ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক। আমানুল্লাহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর তখন বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প। পদ সৃষ্টি, অর্থ ছাড়, এনজিও সাবডেনশন, নানা কাজে প্রায় প্রতিদিন আমাদের মন্ত্রণালয়ে আসতে হয়। বর্তমান ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদারও সে সময় প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলো। তাঁর কাজের চাপ বেশী। ব্যস্ত থাকতো। তাই একটা সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে আমানুল্লাহর কাছে এসে বসতাম। তাঁর এক কাপ লাল চা অনেকবার খেয়েছি। সদালাপী মানুষ ছিল আমানুল্লাহ। খুব সরল সহজ সাদাসিদা জীবনযাপন করতো। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা ছিল তার অভ্যাস। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের 'মিনিমাম লার্নিং সিস্টেমস্' নামের একটা শিক্ষা সফরে আমরা ২১ দিনের জন্য ইন্ডিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকা গেলাম। আমাদের সাথে পোষ্টাল ক্যাডারের একজন উপ-সচিবও গেলেন। আমানুল্লাহ তাঁর সংগে ডবল বেড রূম শেয়ার করলেও বেশীর ভাগ সময় আমাদের রুমে কাটাতো। শিক্ষা সফরের পুরো সময় দুপুরের খাবার তাঁরাই দিতো। রাতে আমরা নিজেরা খেতাম। আমানুল্লাহ রাতে খেতো না। এছাড়াও বিদেশ বিভূয়ে গিয়েও এক ওয়াক্ত নামাজও কাযা করেনি।

আমার সংগে ছিল খিজির আহমেদ। হাসি-খুশি আমুদে লোক। লম্বা পাতলা হলেও খেতে ভালোবাসে। তাঁর জন্য সুদুর ফিলিপাইনে গিয়েও বাংলা খাবারের দোকান খুঁজে বাহির করতে হলো। সংগে ছিল শিক্ষা ক্যাডারের নিলুফা। প্রতিদিন আমরা তিনজন বাংলা খাবার খেয়ে আসতাম। আমানুল্লাহ না খেয়ে থাকে। আমার খারাপ লাগলো। একদিন বললাম,
'চলেন যাই, রাতে খেয়ে আসি। একটা ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান খুঁজে পেয়েছি।'
আমানুল্লাহ বিনয়ের সাথে না করলো। খিজির একটু রগচটা। আমানুল্লাহ একটু দূরে সরে গেলেই বললো,
'হাড় কিপঁটে। খরচ করবে না, স্যার। চলেন আমরা যেয়ে খেয়ে আসি।'
আমরা নিয়মিত রাতের বেলা খাচ্ছি। দেশে ফেরার আগের রাতে একটা অভিজাত হোটেলে ফিলিপিনো শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের খাওয়ার দাওয়াত করলো। আমানুল্লাহ বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলো। ফিলিপাইন থেকে ব্যাংকক হয়ে শ্রীলংকা। শ্রীলংকা থেকে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা ফিরলাম। আমানুল্লাহ তাঁর রুটিন মত পুরো সফর শেষ করলো। সে তেমন কোন কেনাকাটা করেনি। তাই তার ব্যাগটা খালি। আমি আমানুল্লাহকে বললাম,
'তোমার তো তেমন লাগেজ নাই। ম্যাটেরিয়ালগুলো তোমার ব্যাগে নাও ভাই'।
'কোন চিন্তা করার দরকার নাই। আমি আছি।' আমানুল্লাহ হাসি মুখে জবাব দিলো।
দেশে ফিরে তাঁর অফিসে বসেই ট্যুর রিপোর্ট লিখে জমা দিলাম। মাঝে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম,
'বিদেশে পুরো সময় রাতে তুমি খেলে না। তেমন কোন কেনাকাটাও করলে না। কেন?'
হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
'একা চাকুরী করি। বাড়ী-ভাড়া, খাওয়া আর ছেলেমেয়েদের খরচ কুলাতে পারি না। ধার দেনা হয়ে গেছে.....'।

আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
'সরি! আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।'

আমানুল্লাহর এক বন্ধু মাহবুব একটা এনজিও প্রধান। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেই সুবাদে পরিচয় আর আমানুল্লাহ-এর সুবাদে ঘনিষ্ঠতা।

আমি অনেক আগেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ছেড়ে অর্থ বিভাগে যোগ দিয়েছি। মাহবুব-এর সাথে যোগাযোগটা রয়েছে। মাঝে আমানুল্লাহর সাথে দু'একদিন রাস্তায় দেখা কথা-বার্তা হয়েছে। কিন্তু তেমন খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। মাহবুব-এর টেলিফোন,
'শুনেছেন আমানুল্লাহ মারা গেছে'।
কথাগুলো একটা বজ্রপাতের মত মনে হলো। অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারিনি। আজও ভাবতে অবাক লাগে আমানুল্লাহ আমাদের মাঝে নেই। আমানুল্লাহ আমার কাছে একজন সৎ, উদার, ধার্মিক ও বন্ধু বৎসল মানুষ।

আমি আত্মকেন্দ্রিক নই। তবে সবার সংগে সম্পর্ক তৈরী বা রক্ষা করা আমার হয়ে উঠে না। একবার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেল তা ধরে রাখি আজীবন। ওয়াকিল আহমেদ-এর সংগে দেখা হলেও কথা হয়েছে কিনা মনে পড়ে না। আমিও ৮৮ সালে এক্সিডেন্টের পর চোয়ালে টিউমার নিয়ে দেশে-বিদেশে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরছি। নতুন নোঙরটা হাতে পেলাম। হারানোর পাতায় আর একটি নতুন মুখ ওয়াকিল আহমেদ। বিসিএস-৮২ ফোরামের আকার আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। জানি একদিন আমরা সবাই হারিয়ে যাবো। কিন্তু এভাবে কেন? নিয়তির কাছে আমরা বড়ো অসহায়।

সামী সচিবালয় ক্যাডারে যোগদান করেছিল। সচিবালয় আমাদের দু'জনার চাকুরীর সুবাদে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, তুমি থেকে তুই। এমন প্রানোবন্ত মানুষ আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। মানুষটা নাই। ভাবতে পারি না।

৮৮ সালে বাড়ী যাওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করলাম। এক্সিডেন্ট থেকে চোয়ালের হাড়ে একটা টিউমার হলো। নাম এ্যামিবোব্লাসটোমা। ডাক্তার জানালো, চিকিৎসা একটাই কেটে ফেলতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'রিকন্সট্রাকশন। ডাক্তার জানানো এখানে রিকন্সট্রাকশনের কোন চিকিৎসা নাই। বিদেশে গিয়ে দেখাতে পারেন। বিদেশ যেতে মেডিক্যাল বোর্ডের সম্মতি লাগবে। মেডিক্যাল বোর্ড গঠণ, পরীক্ষা সুপারিশ অনেকদিনের ব্যাপার। আমার সময় কমে আসছে। সামী তখন স্বাস্থ্য সচিবের একান্ত সচিব। কোন কিছুই টের পেলাম না। মেডিক্যাল বোর্ড গঠণ, পরীক্ষা সুপারিশ সব এক সপ্তাহে শেষ হলো। মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ অনূকুল হলো না। তাঁদের যুক্তি বিদেশে চিকিৎসা বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। সামী ভীষণ রেগে গেল। আমাকেই সামীকে শান্তনা দিতে হলো। বললাম,
'মারা গেলে তো চাকুরীর দরকার হবে না। আমি অনুমোদন ছাড়াই বিদেশে যাবো। যদি বেঁচে যাই তাহলে দেখা যাবে।'

সামী স্বভাবসুলভ ভাবে হা হা করে হাসতে হাসতে আমাকে বুকে চেপে ধরে পিঠ চাপড়াতে লাগলো। মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ ছাড়াই বেড়াতে থাইল্যান্ড গিয়ে অপারেশন করে চোয়ালের তিন ভাগের এক ভাগ কেটে ফেললাম। দেশে ফিরে এসে নিজের মধ্যেই গুটিয়ে ছিলাম। অফিস বাসা এভাবেই দিন কাটছিলো। হঠাৎ সামী আমার অফিসে হাজির। জানালো,
'স্কলারশীপে এমএস-কাম-পিএইচডি করতে ইন্ডিয়া যাচ্ছি।'
'কোন বিষয়ে?' জিজ্ঞাসা করলাম।
'ইকোনমিক্স এ‍!' জবাবে জানালো।
আমি কনগ্রোচুলেট করলাম। সে আমার কাছে কিছু তথ্য চাইল। আমার কাছে যা ছিল দিলাম। ও ইন্ডিয়া চলে গেল। অনেকদিন দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন সচিবালয়ে তাঁর সংগে দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম,
'ছুটিতে এসেছিস? কতদিন থাকবি?'
'আমার দ্বারা পিএইচডি-ফিএইচডি হবে না। একেবারে চলে এসেছি'। জবাবে সামী বললো।
'কি বললি?' আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
সে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে জানালো,
'সত্যি চলে এসেছি। পোষ্টিং-এর জন্য চেষ্টা করছি।'
এরপর অনেকদিন সামীর সংগে দেখা নাই। প্রমোশন পেয়ে যুগ্ম-সচিব হয়েছে। আমি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আঞ্চলিক পানি ও নদী প্রবাহ সম্মেলন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামীর সংগে দেখা। পাশাপাশি বসে সারাদিন কাটালাম। কথার ফাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করলাম,
'সুযোগ পেয়েও পিএইচডিটা করলি না।'
'জয়েন্ট সেক্রেটারী হয়ে গেলাম। পিএইচডি কি হবে বল'। আমাকে হেয়ালী করে বললো।

২০০৫ সাল, দেশের উত্তর অঞ্চলে তীব্র সার ও ডিজেল ক্রাইসিস চলছে। ১৬জন যুগ্ম সচিবকে উত্তরের ১৬টি জেলায় পাঠানো হলো। আমি গেলাম লালমনিরহাট জেলায়। সার্কিট হাউজে জায়গা হলো না। এলজিইডি-এর ডাকবাংলোয় উঠলাম। একদিন সন্ধ্যার সামীর ফোন। জানতে চাইলো,
'কোন ডাক্তার আমার চোয়াল আর মাড়ির চিকিৎসা করেছিলো।'
আমি কারণ জানতে চাইলাম। সামী জানালো,
'তাঁর মাড়ি ফুঁলে গেছে। প্রচন্ড ব্যাথা আর জ্বর।'
আমি তাঁকে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রফেসর আল-মামুন ফেরদৌসীর সংগে যোগাযোগ করতে বললাম। তাঁকে আরো স্মরণ করিয়ে দিলাম,
'যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে ৭দিনও সময় পাওয়া যায় না। দেরী করিস না।'
সে তাঁর স্বভাবমত হাসতে লাগলো। হাসি থামে না। হাসতে হাসতে বললো,
'নিজে ভুগছিস। কারো কিছু হলেই তোর মত ভাবিছ।'
'যাইহোক, দোস্ত। অবহেলা করিস না।' আমি অনুরোধ করলাম।
'চিন্তা করিস না, মরবো না।' বলেই লাইনটা কেটে দিলো। দুইদিন পর মঞ্জু টেলিফোন জানালো সামী নাই। সামী আমাকে মরতে দিলো না। আর সে নিজে চলে গেল ফাঁকি দিয়ে। লালমনিরহাটে ছিলাম। তাঁর মরা মুখ দেখতে হয়নি। তাঁর মরা মুখ দেখতে পারতাম না। তাঁর প্রাণবন্ত মুখটা আজও চোখে প্রায় ভেসে উঠে। তখনই চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, 'এ প্রাণগুলো চলে যাবে কেন? কেন?' জবাব পাই না।

মোঃ খুরশীদ আলম চুপচাপ সাদাসিদা মানুষ। লেখক হিসেবে পরিচিত। অনেকগুলো বই লিখেছেন। নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। আমার ধারণা ছিল খুরশীদ কারো খোঁজ রাখে না। একদিন জিজ্ঞাসা করলো,

- 'রুহুলের খবর জানো। সে অসুস্থ।'

- 'না' জবাব দিলাম।

- 'এত ব্যস্ত থাকলে চলবে'। খুরশীদ অভিমান করে বললো। একসংগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেলাম। আর দেখা সাক্ষাৎ নাই। সিতাংশুর টেলিফোন পেয়ে অবাক হলাম। ও জানালো খুরশীদ আমাদের ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি কোন জবাব দিতে পারিনি।

৮২ ব্যাচে সচিবালয় ক্যাডারে এক সংগে অনেকগুলো মুখের একজন আঞ্জু। খুব একটা কাছাকাছি আসতে না পারলেও আমার সংগে আঞ্জুর আত্মীক একটা যোগাযোগ ছিল। আমাদের সুখে দুখে আঞ্জু সবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি অসুস্থ চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আঞ্জু উদ্যোগ নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ালো। আমি তাঁর ঋণ কি করে ভুলবো?
আমরা যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেলাম। আঞ্জু পদোন্নতি পেলো না। তাঁর সংগে দেখা করতে গেলাম। অভিমান করে বললো,
'হাতি পিঁপড়ার বাসায়! কি করি আপনি বলেন।' একটা মাত্র পদোন্নতি না পেয়ে আঞ্জু তুমি থেকে আপনিতে গেছে।'
'কি আর করবা। অপমান যখন করতেই চাও কথা বাদ দিয়ে পাছায় একটা লাত্থি দাও' - বুঝলাম কাজ হয়েছে। আঞ্জু জবাবে বললো,
'বাদ দাও অসব। বলো কি খাবা।'
'মাছ মাংস ছাড়া তুমি যা খাওয়াতে চাও খাওয়াও' - জবাব দিলাম।
'তোমাকে সিংগাড়া, পুরী ছাড়া কিছুই খাওয়ানো যাবে না' - আঞ্জু আক্ষেপ করলো।
বললাম,    'তাই খাওয়াও'।
তাঁর কাছ থেকে সিংগাড়া চা খেয়ে বিদায় নিলাম।

ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যাই। আঞ্জুকে হাঁটতে দেখে অবাক হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, 'হঠাৎ হাটাহাটি শুরু করলে যে ভাই'।
জবাবে সে জানালো, 'কি আর করা। তোমার মত আমাকেও যমে ধরেছে। ডাক্তার হাটাহাটি করতে বলেছে'।
কয়েকদিন পর খোঁজ নিয়ে জানলাম আঞ্জু অসুস্থ। তাঁর বাড়ীতে কলাবাগান সরকারী কোয়ার্টারে দেখতে গেলাম।
মাহবুব-এর মত আঞ্জুও বললো,
'আমি হয়তো আর বাঁচবো না। না থাকলে বাচ্চাগুলোর খোঁজ খবর নিও।'
'এ কিছু না। সুস্থ হয়ে উঠবা' সান্তনা দিলাম। জবাবে ও বললো,
'আমি বুঝতে পারছি রফিক, শেষ হয়ে গেছি'।
তাঁকে সান্তনা দেয়ার মত কোন ভাষা আমার ছিলো না। চুপ করে রইলাম।
ক'দিন পড়ে আঞ্জুর বাসা থেকে টেলিফোন পেলাম। আঞ্জু অসুস্থ। শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। তাঁকে দেখতে শমরিতায় গেলাম।
কথা-বার্তা হলো। সান্তনা দিলাম। আমার উদাহরণ দিয়ে সাহস রাখতে বললাম। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। নির্বাচনের ঝামেলায় তাঁর কোন খোঁজ-খবর নিতে পারিনি। নির্বাচনের কাজে বরিশালে গেলাম। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো-এর মহাপরিচালক ইফতেখার-এর টেলিফোন, জানালো আঞ্জু নাই। জানাজায় অংশ নিতে বললো। তাঁকে আমার অবস্থানের কথা জানালাম। আঞ্জুকে মনে পড়লো। অনুষ্ঠান ভরে থাকতো আঞ্জু। তাঁর ভালোবাসা ছিল সবার জন্য। সে নাই।

আঞ্জুর নিথর মুখটা নিয়তিই আমাকে দেখতে দেয়নি। আমাকে বরিশালে রেখেছিলো। এজন্য নিয়তিকে হাজার শুকরিয়া। আমি সহ্য করতে পারতাম না। পরে হলেও আঞ্জু তো প্রমোশন পেয়েছিল। সে অতিরিক্ত সচিব হয়েছিল। তবে কেন অভিমান করে আমাদের কাছ থেকে চলে গেল। আঞ্জু বলেছিল, খোঁজ-খবর নিতে। কোন খোঁজ-খবর নিতে পারিনি। এ অপরাধবোধ সারাক্ষণ তাড়া করে।

আঞ্জুকে ভুলতে পারিনি। এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। ৩১শে জুলাইম শনিবার। অফিস যাবে না। টেলিভিশন ছেড়ে দাঁড়িয়ে খবর দেখছি। কি দেখছি বিশ্বাস করতে পারছি না। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম এবং বিসিক চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমান মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

ধপাস করে বসে পড়লাম। নড়াচড়া করতে পারছি না। বুকে তীব্র যন্ত্রনা। এক গ্লাস পানি খেয়ে কি  করবো ভাবছি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। গাড়ীটা নিয়ে রাজিয়ার বাড়ী আসলাম। নামতেই দেখি জনস্রোত। তথ্য সচিব কামাল চৌধুরী নির্বাক দাড়িয়ে আছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝে। অনেকের সাথে দেখা হলো। আমরা রাজিয়ার বাড়িতে, রাজিয়া নাই। রাজিয়ার স্বামীর দুই কাধে মাথা রেখে বাচ্চা দুটো অঝরে কাঁদছে। ইচ্ছে ছিল কথা বলবো। ইচ্ছাকে গুটিয়ে নিলাম। মনে মনে বললাম- কাঁদুক, কাঁদলে হালকা হতে পারবে। রাজিয়ার মৃত লাশ তখনও বাসায় আসেনি। মানিকগঞ্জ থেকে রওনা হয়েছে। ৩ টায় শেরে বাংলানগর জামে মসজিদে জানাজা।

রাজিয়া ৮২ ব্যাচের হলেও শুরু থেকে সখ্যতা গড়ে উঠেনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সংগে দেখা হয়েছে। দেখেছি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তাঁর আঁচার আচরন মুগ্ধ হওয়ার মত। উপ সচিব হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পর এসিডি কোর্সে এক সংগে ছিলাম। অন্য গ্রুপে থাকার কারনে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। দেখা হলেই সালাম , আন্তরিক অভিনন্দন ভোলার মত নয়। যুগ্ম-সচিব হিসাবে পদোন্নতির পর এক সংগে সিনিয়র স্টাফ কোর্সে মনোনয়ন পেলাম। ২৬ জনের মধ্যে এক মাত্র মহিলা কর্মকর্তা রাজিয়া। ভেবেছিলাম রাজিয়া আসবে না। কোর্স শুরুর আগের রাতে হোস্টেলে গিয়ে দেখি রাজিয়া। সালাম দিয়ে বললাম,
‘- তুমি এসেছো ? ভেবেছিলাম আসবে না!'
‘- দেখ রফিক, আমি একা নই। আমরা ২৬ জন যুগ্ম-সচিব' - তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদ জানালো।

তাঁর বলিষ্ঠতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সে এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ দিলাম। ৭৫ দিন এক সংগে বিপিএটিসিতে ক্লাস, খেলার মাঠ, লাইব্রেরী, কম্পিউটার, ল্যাব, সবকিছুকে সে পরিপূর্ণ করে রেখেছিল।

পিএটিসির আমের গাছ গুলোতে আমের কলিগুলো বেশ লোভনীয় হয়ে উঠেছে। সবার ইচ্ছা লবন মরিচ দিয়ে কাঁচা আম খাবে। আমাদের হোস্টেল ব্লকের কাছেই একটা বড় আম গাছ ছিল। একদিন বিকালে প্রচন্ড শীলা বৃষ্টি আর ঝড়। অনেক আম নিচে পড়লো। ঝড়ের মাঝেই আমতলায় গিয়ে বেশ কয়েকটা আম কুড়িয়ে আনলাম। ৮১ ব্যাচের মনসুর ভাই আমের চাটনী বানাতে ওস্তাদ। তাঁর কাঁটা আমের কুচিই আলাদা। তিনি চাটনি বানালেন। রাজিয়াও চাটনি খেয়েছিল। ঝড় শেষে লবিতে আমাদের বসে থাকতে দেখে বললো‘-চলো যাই আম কুড়িয়ে আনি।’ আমি বললাম আম কুড়ানো অনেক আগেই শেষ। তার পরও জোর করলো,
‘-চলো না যেয়ে দেখে আসি।’

গেলাম। কোন আম পেলাম না। অম্রপালি আমের বাগানের অংশটা ঘেরা। তাই কয়েকটা আম তখন পড়েছিল। ঘেরা বলে কেউ নিতে পারেনি। পাহারাদারকে বলে বেড়া খুলে ২ টা আম কুড়িয়ে এনে তাঁকে দিলাম,। আম ২টো দিয়ে চাটনি করে ও আমাদের সবাইকে খাওয়েছে।

প্রতিদিন সকালে হাঁটাহাঁটি করে এসে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আমি ছোট বেলা থেকে খেলাধুলা করি। সে দেখেছে। তাই আমার সংগে নামতো না। তবে সে মজুর সাথে প্রতিদিন ব্যাডমিন্টন খেলতো। একদিন তাঁকে বললাম ব্যাটটা নিয়ে নামো। কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই নামলো। আমি খেলার বদলে তাঁকে খেলাচ্ছিলাম। ও বললো।
‘-তুমি আমার সংগে পোলাপানের মত খেলছো। আমার ভালো লাগছে না।' বলেই পাশের   কোটে চলে গেল।
২০০৭ সালে ম্যানেজিং এ্যাট টপ সংক্ষেপে ‘ম্যাট’ কোর্সে মনোনয়ন পেলাম। রাজিয়াও এ কোর্সে ছিলো। কোর্সের প্রথম দিনেই গ্রুপ করা হলো। প্রতিটি গ্রুপকে একটা পিআইপি তৈরী করে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজিয়া বললে,
- ‘তুমি যে গ্রুপে, আমি সেই গ্রুপেই থাকবো।’
- 'তুমি থাকলে আমার আপত্তি কি বলো'। জবাব দিলাম।

আইইএলটিএস দিয়ে এক সংগে ১৪ দিনের জন্য সিংগাপুর যাবো। আমার ছোট শ্যালক সিংগাপুরে থাকে। রাজিয়া বললো,
‘- এক সংগে থাকবো। ভীষন ভালো হবে। সিংগাপুর আমাকে বাজার করতে সাহায্য  করবা।’
‘ এক সংগে থাকতে পারবো না। আমি আমার শ্যালকের বাসায় থাকবো। ঘুমানোর  সময়  বাদ দিয়ে বাকি সময় তোমাদের সংগেই থাকবো' - জানালাম আমি।

রাজিয়া কষ্ঠ পেল। পিপ গ্রুপের সদস্য হওয়ায় প্রতিদিন এক সংগে কাজ করতাম। সিংগাপুরে এসেও একই গ্রুপে কাজ করলাম। ১৪ দিন এক টেবিলে এক সংগে বসতাম।

আমাদের গ্রুপটি সিংগাপুরে লিটল ইন্ডিয়ার একটা হোটেলে ছিল। ওখান থেকে ৫ মিনিটের পথ লিটল বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশীদের প্রিয় শপিং মল মোস্তফা সেন্টার। আমি থাকতাম হিলটাউন রেসিডেন্টশিয়াল এরিয়ায়। ওখান থেকে ট্রামে আধা ঘন্টার পথ।

ছুটির দিন ছাড়াও অন্যদিনগুলোতেও তাঁদের হোটেলে এসেছি। একসংগে বাজারে গেছি। সিংগাপুরে আমাদের প্রগ্রামের একটা অংশ ছিল সিংগাপুরকে চেনা। ৩ জনের একটি গ্রুপকে একটি জায়গায় গিয়ে নিদৃষ্ট কিছু লোকের সংগে আলোচনা ও তথ্য সংগ্রহ করে এনে রিপোর্ট করতে হবে। আমাদের জন্য নির্ধারিত জায়গা ছিল উডল্যান্ড। একসংগে ট্রেনে উডল্যান্ড গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরছি। সিংগাপুরে অনেক বাংলাদেশী নির্মাণ শ্রমিক কাজ করে। সেদিন বাংলাদেশের সংগে পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা। বাংলাদেশ জিতেছে। সংবাদটি ট্রেনের টিভিতে দেখার সংগে সংগে যাত্রীদের মধ্যে জয়বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো। রাজিয়া লাফিয়ে জনতার সংগে মিশে গেছে। একবারও মনে করেনি, সে বাংলাদেশের যুগ্ম-সচিব। পরে দেখলাম একজন শ্রমিকের সংগে তাঁদের জীবন নিয়ে কথা বলছে।

দেশে ফিরে পিপ তৈরী ও বাস্তবায়ন শুরু করতে হলো। আমি নির্বাচন ও ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যস্ত। আমার পক্ষে সময় দেয়া অসম্ভব। রাজিয়া উদ্যোগ নিয়ে আমার অফিসে, তাঁর অফিসে, অফিস সময়ের বাইরে কাজ করে একটা পিপ খাঁড়া করে জমাও দেয়া হলো। এতকিছুর পরও বেচারা সুপারম্যাটে যেতে পারেনি। সে কন্ঠ পেয়েছিল কি না জানি না। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম।

অফিস ছাড়াও আমরা পারিবারিকভাবেও ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তাঁর বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছি। গেলেই আক্ষেপ করতো,
'ঘাস পাতা ছাড়া তো কিছুই খাও না। কি যে করি। তোমাকে কি খাওয়াব'। ঠাট্টা করে বলতাম,
'তোমার গালি খেতেও কোন আপত্তি নাই।' প্রতিবার দেখেছি তাঁর বাড়ী আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবে ভরা। তারপরও কাউকে না খেয়ে উঠতে দিতো না। রাজিয়ার মত তাঁর স্বামীর শরীরের গঠন ও চেহারায় বয়সের তেমন ছাপ পড়েনি।'
আমার বউ তাঁকে প্রায় বলতো, 'আপনাদের এই বাচ্চা থাকার রহস্য কি?' দুলাভাই শুধু হাঁসতেন।

আমরা অতিরিক্ত সচিব হলাম। আদালতের রায় অনুযায়ী সিনিয়রটি তালিকা একীভুত হলো। আমার নাম রাজিয়াদের আগে চলে যাওয়ায় তাঁরা কয়েকজন কোর্টে কেইস করলো। ব্যক্তিগত হলেও ভুলক্রমে কমিশনের উপ-সচিব, আইন সলিমুল্লাহর কাছে বিষয়টি চলে গেছিলো। সলিমুল্লাহ কাগজটা এনে আমাকে বললেন,
'স্যার, এটা এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েন না। দরকার হলে আমরা সহযোগিতা করবো।'
আমি মুচকি হেসে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। এর মধ্যে কেসের ডেট পড়লো। কোর্টে যায়নি। কয়েকদিন পর রাজিয়ার সংগে দেখা। বললাম,
'রাজিয়া আমার সিনিয়রিটি নিয়ে কোন চাওয়া পাওয়া নাই।'
আমি কনটেষ্ট করবো না। এতে তিক্ততা বাড়ে। আমি আমাদের সম্পর্ককে তিক্ত করতে চাই না।
সে কোন জবাব না দিয়ে অন্য প্রসংগে চলে গেল।

রাজিয়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পেল। তাঁকে কনগ্রোচুলেন্ট করলাম। খুশি হলো। খাওয়ার দাওয়াত করলো। আমি আমার অবস্থা বললাম। সে ক্ষেপে গিয়ে বললো, 'তুমি প্রতিদিন আমার বাড়ীর পাশ দিয়ে যাও ও আসো। যাওয়ার সময় নামতে পারে না।' জবাবে বললাম, 'রাতে তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না। তবে আসবো।" আমার আর যাওয়া হয়নি।

রাজিয়া টেলিফোন করলো,
'রফিক আমার ছেলের জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়নি। তুমি করে দিবা। আমি ছেলেকে পাঠালাম।'
আমি বললাম,
'ওকে একটা আবেদন করতে হবে। কিছু ডকুমেন্ট দিতে হবে।'
জবাবে বললো,
'আমি কিছু করতে পারবো না। তুমি করবা'। বলেই টেলিফোনটি রেখে দিল। রাজিয়ার ছেলে কিছুক্ষণ পর আমার অফিসে হাজির। আমি ছেলেকে প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক-এর কাছে পাঠালাম। আনিস তাঁর ছেলের আইডি কার্ড করে দিলো।

রাজিয়ার পিও-র বউ নেত্রকোনা একটা উপজেলায় চাকুরী করে। পিও প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরের আগেই অফিস ছাড়ে। রবিবার দুপুরের পর অফিসে আসে। তাঁকে ঢাকায় বদলী না করলে সমস্যা দূর হবে না। টেলিফোন তুলতেই রাজিয়ার কন্ঠস্বর,
'রফিক, শোন। আমার পিও-র বউকে ঢাকায় আনতে হবে। কেমন করে আনবা জানি না।' বলেই টেলিফোনটা রেখে দিল। পিও-কে বললাম কোন পদ খালি নাই। সংযুক্তিতে কোন অফিসে আনতে পারি। মাসে মাসে নেত্রকোনা গিয়ে বেতন আনতে হবে। সে রাজি নয়। আমি কিছু করতে পারছি না। মারা যাওয়ার দু'দিন আগে বৃহস্পতিবার, রাজিয়া আবার ফোন করলো,
'রফিক, তুমি কিন্তু আমার পিও-র বউ-এর ট্রান্সফার করে দাওনি'।
'সে তো সংযুক্তিতে আসতে রাজি নয়'। বললাম আমি।
'আমি বলে দিবো। সে রাজি হবে। আপত: সংযুক্তিতে তাঁকে বদলী করো। আমি আর পারছি না।' রাজিয়া অনুযোগ করলো।

তাহেরও আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আবু তাহের বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব, বিসিএস ৮২ ফোরামের সদস্য। সাবেক সচিবালয় ক্যাডারের সদস্য, এছাড়াও একসংগে ফাউন্ডেশন, এসিডি কোর্স করায় ঘনিষ্ঠতা আন্তরিকতা কোন কিছুর কমতি ছিল না। ১৯৮৫ সালে বিপিএটিসিতে ফাউন্ডেশন করছি। প্রতিদিন সকালে পিটি প্যারেড; সমস্ত দিন ক্লাশে বসে থাকা; রাতে লাইব্রেরী, রিপোর্ট লিখার কোন কাজে তাঁকে অনুপস্থিত থাকতে দেখিনি।

নাস্তার পরে ক্লাশে প্রায় সবাই মাঝে মধ্যে সুখ নিদ্রা দিয়ে বিরক্তিকর লেকচারগুলোর হাত থেকে বাঁচতাম। তাহের দেখতে পাতলা ছিপ ছিপা গড়নের ছিল। ক্লান্তি তাঁকে কোন দিন নাগাল পেতনা। ও পাশে থাকলে রক্ষা ছিলো না। তাঁর আঙ্গুলের গুতো ফিরিয়ে (আনত) বিরক্তির সাগরে। সব জায়গায় নিরবে ছিল তাঁর উপস্থিতি। কোন কিছুতেই নজর কারার মত কোন কিছু ছিলো না। কিন্ত  অবাব কান্ড, ম্যারাথনে  ১ম, রেজাল্টও ১ম দিকে? কি যাদু বলে এসব অসাধ্যকে সাধন করতো বলে গেল না।

তাঁকে ঘিরে কোন আড্ডা তৈরী হয়নি। তবে আড্ডায় তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য আন্দঘন। আড্ডার মাঝে হঠাৎ তাঁর স্বভাবসুলভ কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় একটা মন্তব্য। হাসিতে আড্ডাটা লুটিয়ে পড়তো।

ছুটিতে তাঁকে বাড়ী ফিরতেই হবে। অদ্ভুত একটা টান। রবিবারে আমরা সবাই পিটির লাইনে, তাহের এসে যোগ দিল।
-    "কাথায় গেছিলি ?" জানতে চাইলাম।
-    "বাড়ীতে?" সংক্ষিপ্ত জবাব।

এসিডি কোর্সের সময় পাশের রুমে তাহের থাকতো। যাওয়া আসার পথে তার রুম পার হওয়ার সময় দেখলাম একটা লুংগী পরে টেবিলে কি যেন লিখছে। জানতে চাইলাম,
-    "কি করছিস?"
-    "বইটা আপডেট করছি। প্রকাশক তাড়া দিচ্ছে" যান্ত্রিক জবাব। সিনিয়ার সহকারী সচিব থাকা অবস্থায় ডিভি নিয়ে আমেরিকা চলে গেল। কয়েক বছর আমেরিকা যাওয়া আসা করে বন্ধ করে দিলো। জিজ্ঞাসা করলাম,
-    "আমেরিকা যাওয়া ছেড়ে দিলে যে?"
-    "নারে ভাই। ভালো লাগে না। আমেরিকা আমার জন্য নয়। তোর ভাবীকে রেখে এসেছি। ছেলে দুটোর একটা গতি হলেই আর কিছু চাই না।"

অনেকদিন তাহেরর সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার মাত্র তিনদিন আগে আমার রুমে ডুকেই বললো,
-    "কোন কাজে আসিনি। তোঁকে দেখতে আসলাম।" তাঁকে দেখে তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছি। নিরবে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে জানালো;
-    "বেশীক্ষন বসবো না। তাড়াতাড়ি চলে যাবো।" জানতে চাইলাম,
-    "কেমন আছিস?" কোন অভিযোগ অনুযোগ ছাড়াই জবাব দিলো,
-    "খুব ভালো আছি। ব্যস থাকি?" জানতে চাইলাম,
-    "তোর পোস্টিং হয়েছে নাকি?" জবাবে বললো,
-    "না। পোস্টিং হোক, এটা আমি এখন আর চায়ও না।" জানতে চাইলাম,
-    "কেন?"
জবাবে সে বললো,
-    "সাইন্স ল্যাবরেটারির মোড়ে একটা স্পোর্টের দোকান, শ্যামলীতে একটা হোমিও প্যাথিল্যাব, একটা কাপড়ের দোকান দিয়ে চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। পোস্টিং হলে ঝামালা  আরও বাড়বে।"

আমি কোন জবাব দিলাম না। সে আমার অবস্থা জানতে চাইলো?
-    "ঔষধপত্র আর হাঁটহাঁটি করলে ভালো থাকি? নির্বাচন কমিশনে আসার পর ৪ বছর চারটা পদের ঝামালা নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠিকমত সব কিছু করা হয়ে উঠে না।"
তাহের ভীষন ক্ষেপে গিয়ে বললো,
-    "রাখ তোর কাম। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কেউ মনে রাখবে না। ডাক্তারের কথা মত চলবি।"
চা খাওয়া শেষ। কথা গুলো বলেই দাঁড়িয়ে হাঁটা দিলো,
-    "যাই। ভালো থাকিস।"
তাঁর সংগে গাড়ী পর্যন্ত গিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম। শুক্রবার সকাল ১১.৩০ মিনিটে টিভি স্ক্রল এ ব্রেকিং নিউজ,
-    "অতিরিক্তি সচিব জনাব মোঃ আবু তাহের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।"
কয়েকজন বন্ধুর সাথে কথা বলে তার বাড়ী ঠিকানা জোগাড় করে একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দিয়েছি, সোবহানের টেলিফোন।
-    "তাহের মারা গেছে। তোকে জানানো দরকার মনে করলাম।"
-    "টেলিভিশনে দেখলাম। তাঁকে দেখার জন্য আমি সিএনজিতে মিরপুর যাচ্ছি।" তাঁকে জানালাম।
-    "যাস না। গেলে তাঁকে দেখতে পাবি না। আমি ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তার লাশ নিয়ে তার দেশের বাড়ী কুমিল্লার হোমনায় সরাসরি যাচ্ছি।"
সংসদের সামনে সিএনজি থেকে নেমে পড়লাম। হাঁটছি আর নিজের গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম আমি আছি তাহের নাই। সামনের পরবর্তী সংখ্যার নোংগরে তাঁর নাম হারানো মুখের সারিতে নতুন করে যোগ হবে।

কিছু কথাবার্তার পর টেলিফোনে বিদায় নিলাম। বদলীটা করতে পারিনি। রাজিয়ার বাড়ীতে যাওয়া হয়নি। রাজিয়া চলে গেলো। আজও আমি প্রতিদিন তাঁর বাড়ীর পাশ দিয়ে যাই আর আসি। বুকের ভিতর একটা ব্যাথা বোধ করি।