৩২ বছর আগে ছাত্র অবস্থায় জার্মানী ঘুরে এসেছিলাম। জার্মানী তখনও দু’টি দেশ। একটি সমাজতান্ত্রিক, অপরটা ধনতান্ত্রিক। রাজধানী বার্লিনও দু’ভাগে বিভক্ত । কংক্রিটের প্রাচীর ঘেরা। একই সময় ফ্রান্স গেছিলাম। তাই ফরাসী গৌরবের নিদর্শন, লা ল্যুভর মিউজিয়াম; যেখানে লিয়োনার্দো-দা-ভিঞ্চির মোনালিসা তাঁর রহস্যময় হাসি দিয়ে আজও হাজারও পর্যটকদের টানছে; নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সমাধি, আইফেল টাওয়ার, বাস্তিল দূর্গ, প্যারিস এর সেই বিখ্যাত ছায়া ঢাকা রাস্তা ‘স্যানজেলিজে’ সব কিছুই আগে থেকে চেনা। ২০০০ সালে ও গত বছরে ফ্রান্স ঘুরে এসেছি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৩ তে দেশ দু’টো আবারও ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। প্রকল্পের অধীনে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আমাদের মত দেশের বার বার কেনা সম্ভব নয়। যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের সফটওয়্যার, রিএজেন্টও পাল্টে যায়। আমরা যে যন্ত্রগুলো কিনেছি, জার্মানী উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। আমাদের মেশিনগুলো চালু রাখার জন্য সফটওয়্যার, রিএজেন্ট প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দরকার। এ জন্য উৎপাদকদের সংগে আলোচনা এবং একই সংগে সহযোগিতা প্রয়োজন। এ লক্ষেই আমাদের এবারের জার্মানী ও ফ্রান্স যাওয়া। আমার সফরসঙ্গী বিসিএসআইআর-এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ ওয়াই মোস্তাফা, চট্টগ্রাম বিসিএসআইআর-এর পরিচালক জরিফা বেগম এবং প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম। জার্মানী এখন একত্রিত, ধনতান্ত্রিক দেশ। বার্লিনের দেয়াল বুলডোজার দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেয়ালের কংক্রিটের টুকরাগুলো মিউজিয়ামে স্যুভেেভদহুতুনির হিসাবে সুদৃশ্য শো-কেইস এ শোভা বর্ধন করছে। একটা অংশ পর্যটকদের আকর্ষণ হিসাবে আজও সাক্ষী বহন করছে।
জার্মানীর রাজধানী বার্লিন হলেও আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরটি ফ্রাংকফুর্টে। ফ্রাংকফুর্টের উদ্দেশ্যে টার্কিস এয়ারলাইনে ঢাকা ছাড়লাম। তুরস্কের রাজধানী আংকারা হলেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইস্তাম্বুলে; বসফর প্রণালী যা কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযোগ করেছে, এর পাশের শহর। ঢাকা-ইস্তাম্বুল বিমানে ৭ ঘন্টার পথ। ইস্তাম্বুলে ৩ ঘন্টা যাত্রা বিরতি দিয়ে আবারও উড়লাম ফ্রাংকফুর্টের পথে। ৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিট উড়ে পৌঁছলাম ফ্রাংকফুর্টে। ইমিগ্রেশন পার হয়ে বিমানবন্দর হতে বাহির হলাম।
শাহ আলম ভাই, বাংলাদেশী জার্মান অধিবাসী, প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের পূর্বপরিচিত। এখন জার্মানীতে ব্যবসা করেন। অনেক ধন সম্পদের মালিক। তাঁর মার্সিডিজ জীপ নিয়ে এসেছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হলো। চমৎকার মানুষ। নিজে ড্রাইভ করছেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তার বাবা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আগরতলা মামলার আসামী ছিলেন। ১৯৮৬ সালে জার্মানী এসেছেন। বিয়েও করেছেন একজন ভারতীয় জার্মান অধিবাসীকে। আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের আবাস একটি থ্রিস্টার হোটেলে। ছোট একটা হোটেল, বেশ ছিমছাম। এপ্রিল মাস হলেও আবহাওয়া চমৎকার। হোটেলের সামনে সামার রেস্টুরেন্ট। সন্ধ্যায় সামার রেস্টুরেন্টে কফির আড্ডায় বসলাম। মোস্তফা স্যারের ছাত্র-বন্ধু ফ্রাংকফুর্টে থাকে। তার কথা জানতে চাইলে, শাহ আলম ভাই সেল এ যোগাযোগ করলেন। কিবরিয়া ভাই শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। আগামীকাল আসবেন বলে কথা দিলেন।
পরের দিন আমরা যাবো একটা কেমিক্যাল রিএজেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীতে। সন্ধ্যায় কোম্পানীর একজন রিপ্রেজেনটেটিভ হোটেলে এসে প্রাথমিক আলাপ সেরে গেলেন। ভদ্রমহিলা ভারতীয়। পশ্চিম বাংলার মেয়ে হলেও বড় হয়েছেন দিল্লীতে। চমৎকার হিন্দি, ইংরেজী ও জার্মান বলেন। চীনে ৬ বছর লেখা পড়া করেছেন। চীনা ভাষায়ও রয়েছে তার দখল। ঠিক হলো, পরের দিন সকাল ৯-০০ টায় গাড়ী নিয়ে আসবেন। পরের দিন সকাল বেলায় কোম্পানীর গাড়ীতে করে ফ্যাক্টরিতে গেলাম। ছিমছাম, সুন্দর অফিস। মালিক একজন মহিলা। তিনি কথা দিলেন আগামী ৫ বছর আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট সরবরাহ করবেন। কোম্পানী আমাদের সৌজন্যে দূপুরের খাবারের আয়েজন করেছেন। জার্মান খাবার কষ্ট করে গিলে তাদের গাড়ীতে হোটেলে ফিরলাম। আমার ক্ষুধা পেয়েছে, প্রজেক্ট ডাইরেক্টরকে নিয়ে খাওয়া খুঁজতে বাহির হলাম। বেশী দূর যেতে হলো না। অনেকগুলো ইন্ডিয়ান হোটেল। একটায় ঢুকে পড়লাম। নানরুটি-ভাজি খেয়ে হোটেলে ফিরলাম।
সন্ধ্যায় হোটেলের সামনের সামার রেস্টুরেন্টে কফির আড্ডা, আমরা ৪ জন, সংগে শাহ আলম ভাই। আড্ডায় যোগ দিলেন চেয়ারম্যান সাহেবের ছাত্র-বন্ধু কিবরিয়া ভাই। ১৯৭৩-৭৪ সালে ইউরোপে পাড়ি জমান। এখন জার্মানীতে স্থায়ীনিবাস। অনেকদিন জার্মানীর আমেরিকান বেইস-এ চাকুরী করেছেন। বর্তমানে নানাবিধ ব্যবসা করেন। বাংলাদেশের সংগে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। নিয়মিত বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেন। পরেরদিন ছুটি, ঠিক হলো শাহআলম ভাই-এর গাড়ীতে করে আমরা জার্মানীর কিছু ঐতিহাসিক স্থান বেড়াতে যাবো। একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন শাহআলম ভাই তাঁর মার্সিডিজ কার নিয়ে এলেন। অত্যাধুনিক একটি যান, আরামদায়কতো বটেই। ১৮০ কিলো বেগে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ী ছুটে চলছে। পাশে আংগুর ক্ষেত। ছোট ছোট গ্রাম, যেন কোন শিল্পীর নিখুঁত হাতের ছবি। রাইনের তীরে ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামটির মালিকানা নিয়ে ফ্রান্সের সংগে জার্মানী কয়েকবার যুদ্ধ করেছে। জয়ী জার্মান সম্রাট তৈরী করেছেন একটি বিশাল মনুমেন্ট। মৃত সকল সৈনিকের স্মরণে নাম সহ একটি ফলক। নদীর ওপাশে গ্রীণহাউজে জার্মানরা সারাবছর টমেটো, সব্জি তৈরী করছে। হাটা-হাটি ছবি তুলে পাশের কফিশপে কফি পান করে রওনা দিলাম ‘লরে লি’ এর উদ্দেশ্যে।
‘লরে লি’ জার্মান রূপকথার এক নায়িকা। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে বাইন নদী। এক জায়গায় ৪৫ ডিগ্রীর একটি বাঁক। নদীতে জাহাজ চলে। বাঁকের উপর পাহাড়ে বসে ‘লরে লি’ তাঁর সুরেলা কন্ঠে গান গায়। এক নাবিক জাহাজের হাল ছেড়ে তন্ময় হয়ে ‘লরে লি’ এর গান শুনে। একদিন হঠাৎ জাহাজ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। ‘লরে লি’ এর নামানুসারে জায়গাটার নাম আজ ‘লরে লি’। পর্যটন কেন্দ্র। শাহ আলম ভাই যাওয়ার পথে খাবার কিনে এনেছেন। মাটিতে বসে আমরা দূপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আমাদের পাশে একদল জার্মান ছেলে-মেয়ে নাচছে; গান গাইছে, ছবি তুলছে। তাদের বয়সে আমিও আর একবার ‘লরে লি’ এসেছিলাম। তাঁদের মতই উপভোগ করেছি। মনে মনে বললাম, এরই নাম তারুণ্য। ‘লরে লি’ হতে বিদায় নিলাম। রাতে শাহ আলম ভাই এর বাসায় দাওয়াত।
কিবরিয়া ভাই, সংগে একজন আরও একজন জার্মান বাংলাদেশী এসেছেন আমাদের নিতে। তাঁর বাসায় গেলাম। মিসেস শাহআলম নানা পদের আয়োজন করেছেন। সংগে আছে ইউরোপীয় আতিথেয়তার সকল উপকরণ। মিসেস আলম আমার মত ভেগিয়ান। ফলে আমার জন্যও কম করেননি। খাওয়া-দাওয়া সেরে, কথা বার্তা শেষ করে বিদায় নিলাম। শাহ আলম ভাই আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
পরের দিন ট্রেনে পোল্যান্ডের পাশে একটা ছোট্ট শহরে যাবো। সেখানে তৈরী হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার অনেক যন্ত্রপাতি। ফ্রাংকফুর্টে আমাদের চার রাত্রি থাকার কথা। আমরা হোটেল বুক করেছিলাম ৩ রাত্রির জন্য। রাতে হোটেল ম্যানেজারকে বললাম,
-“আমরা আরো এক রাত্রি থাকবো।”
রিসেপশনিস্ট মহিলা কম্পিউটার চেক করে বললেন,
-“সরি, কোন রুম খালি নাই। সব বুক হয়ে গেছে।”
আমাদের সকালে রুম ছেড়ে দিতে হবে। শাহ আলম ভাই হোটেল খুঁজে বাহির করলেন।
সকালে নাস্তা সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নতুন হোটেলে গেলাম। চেক-ইন ১২:০০ টার পর। আমাদের ৯:০০ টায় স্টেশনে পৌছতে হবে। হোটেল লবিতে ব্যাগ রেখে যাওয়া যাবে। তবে এখন চেক-ইন করতে হলে কিছু ইউরো গুনতে হবে। রাজি হয়ে গেলাম। রুমে উঠে স্টেশনে দৌড় দিলাম। অগণিত মানুষ। একটা ট্রেন আসছে, আর একটা ছাড়ছে। ট্রেনে উঠে সিটে বসলাম। ট্রেনটা ঠিক সময়ে ছেড়ে গেল। ট্রেন নিয়ে ইউরোপিয়ানদের অনেক গর্ব; এক মিনিটও লেট করে না। আমাদের গন্তব্য যেতে ট্রেন বদল করতে হবে। ইলেকট্রিক ট্রেন ছেড়ে ডিজেল ট্রেন। স্টেশন থেকে কোম্পানীর গাড়ী এসে আমাদের পিক-আপ করলো। আমরা কারখানায় পৌঁছলাম।
কারখানার পাশে আমার বড় ভায়রার মেয়ে প্রিয়াংকা আর্কিটেকচারে এমএস করছে। আমার ছোট ভাইয়ের বড়ছেলেও জার্মানীতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি করছে। দু’জনের সাথেই টেলিফোনে কথা হলো। প্রিয়াংকা দেখা করতে আসবে। তাকে কারখানায় আসতে বললাম। কারখানা দেখে আলাপ আলোচনা শেষে রওনা দিবো। প্রিয়াংকা এসে পৌঁছেনি। তাঁকে স্টেশনে অপেক্ষা করতে বললাম। স্টেশনে প্রিয়াংকার সংগে দেখা হলো। সবার সংগে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ট্রেন আসার কথা ৩ মিনিট আগে। প্রিয়াংকার সাথে তাঁর জার্মান এক বন্ধু, ক্ষিপ্ত হয়ে জানালো,
-“ট্রেন ঠিক সময়ে আসবে না কেন?”
পাঁচ মিনিট পরে ট্রেন আসলো। ট্রেনে আসতে আসতে প্রিয়াংকার সাথে কথা হলো। সে ভালো আছে। ভালো লাগলো। তাঁকে পথে বিদায় দিয়ে ফ্রাংকফুর্ট পৌছলাম। সন্ধ্যায় বাংলাদেশী কমিউনিটির দাওয়াত। হোটেল হয়ে রেস্টুরেন্টে পৌছলাম। রেস্টুরেন্টে ছেলেটি একজন বাংলাদেশী, চাকুরী করে। যত্ন করে পরিবেশন করলেন। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব শেষে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। সকালে ট্রেনে প্যারিস যাবো। সকাল ৮:০০টায় ট্রেনে ফ্রাংকফুর্ট হয়ে আমরা ফ্রান্স যাবো। রাতে ঘুম হলো না। গতকাল ট্রেনে আসার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী হত্যাকান্ডের নিদর্শন একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প পার হচ্ছিলাম। প্রিয়াংকা একটা বিশাল কমপ্লেক্স দেখিয়ে বলেছিল:
-“এটা একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এটাই হিটলারের ডান হাতের বাড়ীর এলাকা। হাজার হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়। হিটলারের ডান হাতের নাম কেউ এখন মুখে আনে না।”
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশেও লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। আমরা স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করতে পারিনি। আজও অনেকে হত্যাকারীদের নাম গর্বের সাথে উচ্চারণ করে। অভাগা এ জাত।
সাড়ে সাতটায় রেল স্টেশনে গেলাম। ৮ টায় ট্রেন ছাড়বে। মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। ৯ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে। ট্রেনের কোন চিহ্ন নাই। আমাদের উৎকন্ঠা বাড়ছে। মাঝে মাঝে জার্মান ভাষায় ঘোষণা দিচ্ছে। কিছু বুঝি না। মনে মনে বলছি,
-“যে ট্রেন নিয়ে ইউরোপের এত গর্ব! এ কি অবস্থা! জার্মান প্রযুক্তির একি দশা!”
হঠাৎ ৯ নম্বর প্লাটফর্মের সব যাত্রী হুড়মুড় করে ৩ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে দৌড়াচ্ছে। আমরাও দৌড় দিলাম। একজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম; সে আধা ভাংগা ইংরেজিতে জানালেন;
-“এ ট্রেন যাবে না। ৩ নম্বর প্লাটফর্মের ট্রেনে যেতে হবে। আমরাও দৌড় দিয়ে গিয়ে উঠলাম। দোতলা ট্রেন। আগের ট্রেনে বগি, সিট নম্বর নির্ধারিত ছিল। নতুন ট্রেনে আমরা উদ্বাস্তু। দৌড়া-দৌড়ি, ছুটাছুটি দেখে বাংলাদেশের চিত্র মনে হলো। বুঝলাম কোন সিট পাওয়া যাবে না। দাঁড়িয়ে রইলাম। পরিচালক রেজাউল দু’টা ফাঁকা সিট খুঁজে পেয়েছে।
আমি চেয়ারম্যান সাহেব এবং চট্টগ্রামের পরিচালককে বসতে বললাম। চেয়ারম্যান সাহেব বসলেন না। আমরা দু’জন বসলাম। ট্রেন চলা শুরু করল। এক স্টেশন গিয়ে থেমে গেল। কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পরে যাত্রীরা নামতে শুরু করলো। কিছুই বুঝছি না। আমরা কি করবো? চেয়ারম্যান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-এখন কি করবো?
চেয়ারম্যান সাহেব জবাবে জানালেন;
-“সবাই নেমে যাচ্ছে। চলেন স্যার আমরাও আল্লাহর নাম নিয়ে নেমে পড়ি। পাশ দিয়ে ফরাসি একজন ভদ্রমহিলা নামছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম;
-“কি হয়েছে? সবাই নামছে কেন?”
তিনি জবাবে যা জানালেন তা হলো;
-“ট্রেনে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। এ ট্রেন যাবে না। অন্য ট্রেনে যেতে হবে। নেমে পড়ুন।”
আমরাও নেমে পড়লাম। ঠিক করলাম, আমরা ঐ মহিলাকে অনুসরণ করবো। তাই তার পাশে প্লাটফর্মে দাড়ালাম।
ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ভাবছিলাম,
-“আমরা বাংলাদেশী হয়তো জার্মান ট্রেন কর্তৃপক্ষ এটা জেনে গেছে। তাই আমাদের বাংলাদেশী পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করতে চায় না।”
নিজে নিজে হাসলাম। আমি না হয় উপভোগ করছি। ইউরোপিয়ানরা জার্মানীতে বাংলাদেশী পরিবেশে কেমন আছে? পাশে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-“ আমি ইউরোপে ছাত্র ছিলাম। এমন তো কখনও দেখিনি। ট্রেন তোমাদের গর্ব ছিল।”
একটা গালি দিয়ে বোঝোতে চাইল বিশ্বমন্দা, পূর্ব ইউরোপ আর সন্ত্রাস এজন্য দায়ী। অবশেষে একটা ট্রেন আসলো। উঠে সিট দখল করলাম। ছাত্রাবস্থা থেকেই ইউরোপের রেলপথ জানা। আমাদের যাওয়ার পথ সমতল। হঠাৎ মনে হলো আমরা পাহাড়ে উঠছি। প্রকল্প পরিচালক রেজাউল জিজ্ঞাসা করলো;
-“স্যার, আমরা প্যারিস যাচ্ছি তো?” জবাবে বললাম,
-“উঠে পড়েছি। এখন করার কিছুই নাই। জাহান্নামে যাক।”
প্যারিস পৌঁছার কথা রাত ১১:০০ টায়। পৌঁছলাম ১২:৩০ মিনিটে। রেল স্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলে। চেক-ইন করে রুমে। রেজাউল হেঁটে মেট্রোর ভিতরে একজন বাংগালীকে আবিষ্কার করেছে। সে রাতে চিতই পিঠা আর মাংস বিক্রি করে। আমার জন্য চিতই পিঠা আর আধা সিদ্ধ সব্জি এনে আমাকে দিয়ে গেল। প্রচন্ড ক্ষিধা; খেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। ঘুম দিলাম। সকালে নাস্তা সেরে সবাইকে নিয়ে ট্যাক্সিতে রওনা দিলাম।
-আইফেল টাওয়ার, সিন নদীর তীর ঘেরে ‘প্যারি’ এভাবেই ফরাসীরা আদর করে তাদের রাজধানীকে ডাকে; এর ছায়াতরু দিয়ে ডাকা ‘সানজে লিজে’, বাস্তিল দূর্গ, লা ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে। আধা বেলার মধ্যে সবকিছু শেষ করতে হবে। তাই ভিতরে গেলাম না। আগে অনেকবার ভিতরে ঢুকেছি। ইচ্ছেও ছিল না। ক্ষিধা লেগেছে। আগে এ জায়গাটায় একটা ইন্ডিয়ান খাবার দোকান ছিল। খুঁজে পেলাম না। ফরাসি খাবার খেয়ে পেটকে স্বান্তনা দিলাম। বাস্তিল থেকে লা ল্যুভর এর পথে হাঁটছি। এক দংগল সাদা, কালো, হলুদ, চকলেট রংগের লোক নানা জিনিস বিক্রি করছে। আগে তারা কেনার জন্য মুখে আমন্ত্রণ জানাতো। কোন দিন হাত ধরে টানা-টানি করেনি। বিক্রেতারা নাছোড়বান্দা, হাত ধরে টানা-টানি করছে। পুলিশ অনেক দূরে নির্বিকার দাড়িয়ে আছে। প্যারিসে গুলিস্থানের দৃশ্য দেখে মুচকি হাসলাম। মজাও পেলাম।
পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম। এই হই-হাল্লা, ভিড়-ভাট্টার মাঝে পকেটমার হয় কি না? পুলিশ নির্বিকার ভাবে জবাব দিল:
-“প্রতিনিয়ত, সংখ্যাও অনেক।”
তাড়াতাড়ি অন্য তিনজনকে বললাম, এখানে কেনা-কাটা, দরদাম করা বাদ। তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে।
প্যারিস দেখা, কেনা-কাটা শেষ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে একটা ইউনিভার্সিটি গেলাম। একজন প্রফেসর এর সাথে আমাদের আলোচনা আছে। তিনি জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম, যাকে আমরা সংক্ষেপে জিএমও বলি, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। নির্ধারিত জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমরা আগেই এসে গেছি। একটা কফি হাউসে বসে কফির অর্ডার দিলাম। কফি খেয়ে ওপেন স্পেসে অপেক্ষা করছি। প্রফেসার সাহেব আসলেন। আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। বিরক্তিকর সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তার সাথে আলাপ হলো। তিনি আমেরিকা, ইউরোপ, এর জিএমও নিয়ে আইনগত কাঠামো, স্ট্যান্ডার্ড, এক্সপাট, ল্যাব অনেক বিষয়ে কথা বললেন। ইউরোপে পাপেরুস ছাড়া অন্য সব কিছু জিএমও মুক্ত। পাপেরুস এক ধরণের নলখাগড়া।
জিএমও বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করলাম;
-“কোন ক্ষেত্রেই জিএমও অনুমোদন করছেন না। পাপেরুস এর ক্ষেত্রে করছেন কেন?” জবাবে বিশেষজ্ঞ জানালেন;
“প্রয়োজন তাই। তা না হলে আমরা কাগজ পাবো কোথায়?”
কোন জবাব দিলাম না। মনে মনে বললাম,
“গরজ বড় বালাই। প্রয়োজন নাই, তাই জিএমও নিষিদ্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢুকে গ্রীস, ইতালি জিএমও যুক্ত কোন কিছু তৈরী করতে পারছে না। আমেরিকা আজও জিএমও যুক্ত খাদ্যদ্রব্য তৈরী করছে।” আমাদের গরজ ১৬ কোটি মানুষের খাবার যোগানে। তাই ফরমালিনসহ খাবার খাচ্ছি। সেখানে আমাদের জিএমও নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে মনে হলো না। তাই সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
ট্যাক্সিস্ট্যান্ড ছাড়া ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না। ট্যাক্সিস্ট্যান্ড খোঁজার জন্য প্রানবন্ত অবস্থা। হাঁটছি তো হাঁটছি। একে ওকে জিজ্ঞাসা করেও কোন কুল-কিনারা হচ্ছে না। অবশেষে মিললো। ট্যাক্সি করে হোটেলে ফিরলাম। দূপুরে তেমন খাওয়া হয়নি। রাতে খেতে হবে। ফরাসী খাবারগুলো চোখের তৃপ্তি মিটালেও পেটের ক্ষিধা মিটে না। হোটেলে ঢুকেই আবার বাহির হলাম এশীয় কিছুর খুঁজে। পেলাম না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী, পরিচালক বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, একই সংস্থার একটি গবেষণা ল্যাবের পরিচালক মালা খান একটা সেমিনারে প্যারিস এসেছেন। তাঁদের সংগে যোগাযোগ হয়েছে। সন্ধ্যায় তাঁরা দেখা করতে আসবেন। টেলিফোনে যোগাযোগ হলো। মেট্রো থেকে নেমে আমাদের হোটেল খুঁজে পাচ্ছেন না। মেট্রো স্টেশনটা ঘুরে এসেছি। আমাদের হোটেলের কাছেই। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে বলে নিজেই গেলাম। জানালো মেট্রোর পাশে ম্যাকডোনাল্ডসে তাঁরা অপেক্ষা করছে। ঢুকে দেখি মালা খান লাইনে দাড়িয়ে ফ্রাইড চিকেন আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিনছে। তাঁদের নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। খুচরা কথা বার্তা শেষে তাঁদেরকে আমার সাথে খাওয়ার আমন্ত্রণ জালালাম। রেজাউল জানালো,
-“আমি বাহির হয়েছিলাম। একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরা খুঁজে পেয়েছি।”
সবাই লাফিয়ে উঠলাম। দুই দিন হতে ভালো করে খাওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথের মুখ দেখে বুঝলাম তারা আসার পর থেকেই খাওয়ার কষ্টে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম;
-“কত দূর? ট্যাক্সি নিবো কি?”
জবাবে জানালো;
-“কাছেই, হেঁটে যেতে দশ মিনিট লাগবে”।
আমরা রেস্টুরেন্ট-এর কাছে আসলাম। অবাক হলাম, আমিও এখানে এসেছিলাম। তখন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টকে আমি ইটালিয়ান পড়েছি। ভিতরে ঢুকে বসলাম। আমরা স্টিম রাইস খাবো। বুঝানোর জন্য চেস্টা করছি। হঠাৎ ম্যানেজার বললেন;
-“এখানে তোমাদের দেশী একজন কাজ করে। তাকে ডেকে দিচ্ছি, বলে দাও, কোন অসুবিধা হবে না।”
বঙ্গসন্তান হাজির হলেন। আমাদের দেখে যারপর নাই খুশি। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। সে আমাদের আশ্বস্ত করলো,
-“কোন অসুবিধা নাই স্যার। আপনাদের মাছের ঝোল, ভাত, সব্জি ও চিকেনকারী খাওয়াব।”
মজা করে খেলাম, গল্পগুজবে ১১টা বেজে গেল। ঝির-ঝির বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের বেরুতে হবে। বঙ্গ সন্তানের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে বিদায় হলাম। আসার সময় তার হাতে বিশ ইউরো তুলে দিলাম। ছেলেটা খুশি হলো।
আমরা আগামীকাল সকালে ট্রেন ধরে ফ্রাংকফুর্ট হয়ে বিমান ধরবো। রবীন্দ্রনাথরা আরো কয়েকদিন প্যারিসে থাকবে। তাঁরা তাদের মত, আমরা আমাদের মত হোটেলে ফিরলাম।
সকালে ট্যাক্সি নিয়ে রেলস্টেশন আসলাম। রেজাউল বুদ্ধি করে কলা, আপেল কিনে নিয়েছে। ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন জার্মানীর দিকে ছুটে চলছে। জার্মানী-ফ্রান্সের বর্ডারে এসে পৌঁছেছি। হঠাৎ ট্রেনটা মাঠের মাঝে থেমে দাঁড়ালো। চলার কোন লক্ষণ নাই। এঁকে-ওঁকে জিজ্ঞাসা করছি। একজন জানালো;
-“একজন লোক লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ আসবে। ক্লিয়ারেন্স দিলে তারপর ছাড়বে।”
আমাদের মাথা খারাপ। আমাদের ৩:৪০ এ এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। ভাবছি, আমরা ভাগ্য খুঁজতে এখানে আসছি। এরা এখানে থেকে আত্মহত্যা করছে কেন? কি দু:খ এদের? পাশের এক ভদ্রলোক জানালেন;
-“আমরা অভাব কি জানতাম না। এখন কষ্টে আছি। তাই সহ্য করতে পারি না। অনেকে ট্রেনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করছে।”
ক্ষিধায় পেট জ্বলছে। রেজাউলের কলা বড় কাজ দিলো। তাঁর কাছ থেকে জানলাম এ ট্রেন ফ্রাংকফুর্ট পৌঁছবে বিকাল ৪:০০ টায়। আমাদের অবস্থা শুনে জানালেন, সামনের স্টেশনে নেমে একটা লোকাল ট্রেন ধরে দুই স্টেশন পর নেমে একটা মেল ট্রেন ধরলে আমরা দুইটার মধ্যে ফ্রাংকফুর্ট পৌঁছতে পারবো। লোকাল ট্রেন প্রতিটা স্টেশনে থামছে। আমাদের শংকা বাড়ছে। আবারো কোন ইউরোপীয় সন্তান ঝাঁপ দিলে আমাদের রক্ষা নাই।
আমাদেরকে ফ্রাংকফুর্ট এসে শাহ আলম ভাই এর কাছ থেকে লাগেজ নিতে হবে। ফ্রান্সে আসার আগে তাঁর বাড়িতে লাগেজ রেখে এসেছি। ভদ্রলোকের পরামর্শ শুনলাম। লোকাল ট্রেনে কোন মতে ২:০০ টার দিকে ফ্রাংকফুর্ট পৌঁছলাম। স্টেশনে শাহ আলম ভাই এর গাড়ী লাগেজ নিয়ে থাকার কথা; তাঁর দেখা নাই। টেলিফোনে জানলাম, আমাদের ১২:০০ টায় পৌঁছানোর কথা। আমাদেরকে বিমানবন্দরে নামিয়ে তাঁর এক বন্ধু ২:০০ টায় ফ্রাংকফুর্ট আসবে তাঁকে নিয়ে ফিরবেন। আমাদের দেরী দেখে তাঁকে আনতে বিমানবন্দরে চলে গেছেন। আমরা রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছি। শাহআলম ভাই তাঁর বন্ধুকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসলেন। গাদা-গাদি করে বসে বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। শাহআলম ভাই এর সাহায্য নিয়ে লাগেজ বেল্টে দিয়ে চেক ইন করে ইমিগ্রেশন পার হলাম। যাবার বেলায়ও নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। আমরা ঢুকছি, আমাদের বিমান ফাইন্যাল কল দিচ্ছে। একজন ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বললেন। তাঁকে না করে দিলাম।
বিমানে উঠলাম। ইস্তাম্বুল হয়ে ঢাকা বিমানবন্দর। শাহ আলম ভাই এর কল্যাণে বিমানটা মিস হয়নি। তাঁর সাহচর্য, সহযোগিতা আমাদের জার্মানীতে অবস্থান স্বস্তিদায়ক হয়েছে। আমাদের পক্ষ হতে তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||
We have 1039 guests and no members online