আমার নিজের এই ওয়েবটাতে নিয়মিত লিখালিখি করি। পাঠক তার মতামত জানায়, আমি নিয়মিত তাদের জবাব দিই। মেইলটাও প্রতিদিন খুলি। দেখি কোন মেইল এসেছে কি না। মেইল এর জবাব দেই। কখনো কখনো নিজেই মেইল পাঠাই। আজ কাল ফেসবুকেই বেশী সময় চলে যায়। স্ট্যাটাস এর উপর ছোট খাটো মন্তব্য, বন্ধুদের ছোট ছোট বার্তা, ফেসবুক এ লাইভ চ্যাট এখন নিত্য দিনের কাজ। অফিস আর এসব নিয়েই কেটে যায় বেশীর ভাগ সময়। ফেসবুকের মাঝে কখন কবে রিয়াল আমি হারিয়ে গেছে। আমি এখন, ভারচুয়াল আমি।
ভারচুয়াল জগতে কোন বাস্তবতা নাই। এটা রূপ-রস-গন্ধ-আবেগ-যন্ত্রণা থেকে অনেক অনেক দূরে। শুধু কল্পনা মস্তিষ্কের ঘোরাফেরা।
ফেসবুক একাউন্টে ঢুকেছি। ফেসবুক মাস্টারের তাড়না, তোমার মনে কি আছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করি, আমার মনে কি আছে।
‘না কিচ্ছুনা। শুধুই শূন্যতা।'
এ সব লিখবো, দরকার নাই থাক। দেখি অন্যরা কি লিখেছে।
অনেক অনেক জনের মনের কথা ওয়ালে লিখা হয়েছে। ভারচুয়াল জগতে আসল আমিটা ধরা ছোয়ার বাহিরে। সত্য,মিথ্যা বুঝে না বুঝে সবাই লিখছে।
কেউ কেউ আসল আমির সংগে সম্পর্ক রেখেছে।
কারো আসল আমি নাই, পুরাপুরি ভারচুয়াল।
নাসরিন সিমা কবিতা লিখেছেন, “উন্নাসিক সময়”:
“নষ্ট প্রেমের উদ্দাম আবেগ নিঃসরণ ঘটে পতিতার ঘরে।
জন্মদাতারা সব পলায়নপর আজ উন্নাসিক সময়”
হঠাৎ করে নাসরিনকে এ বিষয়টা এত নাড়া দিলো কেন বুঝলাম না। কবিতাটি চমৎকার লিখেছেন। মন্তব্য করলাম, ‘‘চমৎকার’’।
মহিবুল হক রাশেল এখনও মনে প্রাণে সমাজতন্ত্রকে লালন করেন। সবকিছু সমাজতান্ত্রিক চেতনা দিয়ে বিচার বিশ্লেষন করেন। বাস্তবতাকে আবেগ দিয়ে পরিবেশন করে ভালো লাগে। আফগানিস্থানের একটি শিশু আমেরিকানদের ড্রোন হামলায় হাত পা সব হারিয়েছে। ফেসবুকে ওয়ালে ছবিটি লটকানো, নীচে মহিবুলের ক্যপশনঃ
“পৃথিবী দেখ, আমি স্বাধীন, আফগানিস্থান স্বাধীন”। ছবিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাড়া-তাড়ি স্ক্রল করে নিচে নেমে গেলাম। ভারচুয়াল হলেও ছবিটা রক্ত মাংসের আমিকে অস্থির করায় আমি পালিয়ে গেলাম। এছাড়া কাপুরুষদের আর কি করার আছে। মুকুল আহমেদ সব কিছুকে তীর্যক চোখ দেখেন। তিনি লিখেছেনঃ
‘‘জুলিয়ান এ সব করার আগে রোমান পোলানস্কি, ডমিনিক স্ট্রাউস কান এর কাছে পরামর্শ নিলে ভালো করতেন। তাহলে অন্তত বেচারাকে ট্রায়াল এর মুখোমুখি হতে হতো না।”
মামুনুল হক মন্তব্য পড়ে ‘হাহাহা ‘ফেস বুকের দেয়ালে একেঁ নিয়েছেন। জানিনা মহিবুলের ‘হাহাহা’
শুধুই ভারচুয়াল না রিয়াল। দেখুন, সব আজে বাজে ভাবনা ভাবছি। মামুনুল হক আসল না ভারচুয়াল তার হাসি নিয়ে ভাবতে বসে গেছি।
মহিবুল হক রাসেল জুলিয়ান এর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছে। সে বলতে চায়, তথ্য প্রবাহ উন্মুক্ত করেছে জুলিয়ান। যুক্তরাজ্য তাকে হয়রানি করবে কেন।
মহিবুলের কথায় যুক্তি আছে। পছন্দ হলেও ওয়ালে কোন মন্তব্য করার সাহস হলো না। আমার ফেসবুক এর আমিটা ভারচুয়াল হলেও তার পিছনের মানুষটা রিয়াল। তাই আমি অনেক কিছু পারিনা। স্ক্রল করে নীচে নামলাম।
মোস্তফা জাব্বার ভাই বিজয় বাংলা নামে লিখেছেন, “ডিজিটাল যন্ত্রহিসাবে এ্যাপেলের আইপ্যাড-আইফোন, স্যামসাং এর গ্যালাক্সি নোট এস থ্রি, মাইক্রো সফট এর সারফেসপ্রো মনে রাখার মত যন্ত্র”।
জাব্বার ভাই ভারচুয়াল জগতের মানুষ। তিনি আরও বেশী মানুষকে এ জগতে টানছেন। অনেকটা সিগারেট এর বিজ্ঞাপনের মত;
‘‘সিগারেট টানবেন না, যদি সেটা বেনসন হয় তবুও।’’
তাতিয়ানা পাবলোভা রাশিয়ান মেয়ে; সে তার মত করে অদ্ভুত কিছু ছবি ওয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে বেশ খোলামেলা মানুষের ছবিও স্থান পায়। ছবি গুলো মাঝে মধ্যে বেশ বিব্রত করে। তাতিয়ানা জানে না এগুলো আমাদের সমাজে চলে না। আমরা বিরক্ত হই।
তাহমিনা ইয়াসমিন তার কাভার ছবি পরিবর্তন করেছে। পানিতে বসে জল কেলি করছে। অনেকে অনেক মন্তব্য করেছে। আমি লিখলাম,
“জল পরীটারে মনে হয় চিনি চিনি”। হঠাৎ করে ফেসবুক চ্যাট উইনডোটা বেরিয়ে আসলো।
আনোয়ার চৌধুরী চ্যাটে সুইডেন থেকে, প্রশ্ন, “তুমি কি বুলগেরিয়া ভার্ণার রফিক?”
জবাব দিলাম, ‘‘জী আমি বুলগেরিয়ার’ রফিক।’’
‘‘রফিক আমি বুলগেরিয়ার হাফিজ। ত্রিশ বছর আগে তোমার সাথে দেখা, আর দেখা হয়নি।’’
‘‘হ্যঁ হাফিজ ভাই। ভারচ্যুয়ালিটির সুবাদে অন্তত কিছু খবর পাওয়া গেল।
কুশলাদি শেষ করে তিনি সুইডেনে আমন্ত্রণ জানালেন। আমিও তাঁকে বাংলাদেশ আসলে যোগাযোগ করার অনুরোধ করলাম।
মনির আইসিটি বিশেষজ্ঞ। নানা সময় নানা কাজে ব্যস্ত। আমার সংগে পরিচয় ইউনিকোডে বাংলাকে অন্তর্ভূক্ত করার সময়। ই-এশিয়া ২০১২, ডিজিটাল উদ্বোধনী মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড এ সব নিয়েই তার দিন কাটে। যত না যায় তার চেয়ে বলেন বেশী। তাই তার ভক্ত মহলে আড়ালে আবডালে তাকে পেটুক স্যার বলে ডাকতে ছাড়ে না। গণিত অলিমপিয়াড এর সুবাদে তিনি চষে বেড়ান বাংলার আনাচে কাঁনাচে। স্ট্যাটাস আপলোড করতে হয় অনেক বেশী। নানা জায়গার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করেন। তিনি ফেসবুকে ওয়ালে জানতে চেয়েছেন ‘মূমূর্ষ’ কোন বানানটি সঠিক। অবাক হলাম। মন্তব্য করলাম;
“আগে জানতাম গণিত নিয়ে আছেন। ভালোই ছিলেন। বাংলার দিকে হাত বাড়ালেন কেন? আনিসুজ্জামান স্যার রাগ করতে পারেন।’’
অর্চিতা বাড়ই বাচ্চা মেয়ে; সম্প্রতি সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছে। কভার ছবি পছন্দ হয় না । ঘন ঘন ছবি বদল করে। তার পোস্ট গুলো জুড়ে থাকে সুন্দরীদের ভীড়। সংবাদ তৈরী তার কাজ হলেও মাঝে মাঝে নিজেই সংবাদ হতে চায় বলে মনে হয়। ওয়ালে ঝোলানো তার ছবি দেখলে সুকান্তের ‘একটি মুরগের কাহিনী’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। একদিন মুরোগটি মিটসেফে ঢুকলো, তবে খাবার খেতে নয়, খাবার হিসাবে।
সিরাজী বিসিসি এর মেইন্টেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার, ধর্ম বোধের মানুষ। মানবতা, গণতন্ত্র, স্বাধীন মত প্রকাশেও তার রয়েছে আকর্ষন। এ গুলোর মাঝে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারেনি। ভারসাম্যটা না থাকায় অস্থির সিরাজী। অসহায় মানুষ গুলোর বাঁচার অনুপ্রেরনা গুলো খুঁজে খুজে বাহির করে ওয়ালে ঝুলিয়ে দেয়। ভালোলাগে। মাঝে মধ্যে মন্তব্য করি; কখনো শুধু ‘লাইক’ এ চাপ দিয়ে আমার ভালোলাগা সবাইকে জানিয়ে দেই।
ড. নাসির উদ্দীন খান আমার বন্ধু। ১৯৭৪ সালে বুলগেরিয়া গেছিলাম। বুলগেরিয়া থেকে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও আমরা দুজন ঢাকায় রিয়াল যোগাযোগ না থাকলেও ভারচুয়াল যোগাযোগ রয়েছে। নিজে ব্যবসা করে, স্বাধীন ভাবে মতামত ওয়ালে সেটে দিয়ে মতামত তৈরী করে। যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পায়ে চাপা পড়ে তিনজন মারা গেছে। ছবিটি ওয়ালে দিয়ে মন্তব্য জুড়ে দিয়েছে,
“যাকাত দাতাদের বিচার হওয়া উচিৎ।
কোন মন্তব্য না করাই ভালো।’’
আমি লিখলাম,
‘দোস্ত কোন মন্তব্য না করাই ভালো।’
সুমাইয়া রশীদ সোসাল রেসপনসিবিলিটি এশিয়া চ্যাপ্টারে আছে। সামজিক ব্যবস্থা, সামজিক দায়িত্ববোধ কনসেপ্ট গুলোকে বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। নিজেকে পরিচিত করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর। ওয়ালে একটি ছবি, ক্যাপসন, সুমাইয়া পরিকল্পনা কমিশনে। কঠিন কাজ, সুমাইয়া পারবে কি? মেয়েটা চেষ্টা করছে। তাঁর জয় হউক। সুমাইয়া সফল ইউক।
একজন তাঁর মায়ের অসুখের বিস্তারিত বিবরণ ওয়ালে দিয়েছে। খুব যত্ন করে। শেষে দোয়া চেয়েছে। আমরা দোয়া করবো। আমাদের দোয়ায় তাঁর মা সুস্থ হয়ে উঠবে কি না জানি না। তবে জানি তার মায়ের চিকিৎসা দরকার, সেবাদরকার। এ দিতে পারে রিয়াল আপনজন। কেন সে ভারচুয়াল মানুষ গুলোর কাছে মায়ের দোয়া চাওয়ার জন্য এত কষ্ট করছে আমি জানি না। মনে হয়েছে ভদ্র লোক ভারচুয়াল জগতের ভারচুয়াল করুণা চায়। মন্তব্য করলাম,
‘‘পরম করুনাময় আপনার মা কে সুস্থ করে তুলুক। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি।’’
জানি তিনি মায়ের অসুস্থার খবর আমাদের দিয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন খবরটা চিরদিন অজানা থাকবে। আমি ধরে নিবো তাঁর মা সুস্থ হয়ে উঠেছে।
মৌসুমী হতাশাগ্রস্থ একটি মেয়ে। প্রতিদিন ওয়ালে লিখে,
‘‘ভালো থাকতে চাই, ভালো থাকতে পারছি না।’’
একজন মন্তব্য করেছে, ‘এত হতাশা কেন?’
মেয়েটাকে হতাশার হাত থেকে রক্ষা করতে চাই, লিখলাম,
‘‘যখন যেমন আছো, মনে করো ভালো আছো, শান্তি পাবে না, সুখও মিলবে না। তবে স্বস্তি অবশ্যই পাওয়া যায় । এটাই বা কম কি?”
আমেরিকা থেকে রউফ ভাই চ্যাট উইনডোতে উঁকি দিলেন। আমরা বুলগেরিয়ার ভার্ণায় এক সংগে ছিলাম। ভাবী বুলগেরিয়ান, দেশে ফিরেন নি, এখন সপরিবারে আমেরিকায়। রউফ ভাই জানতে চায়,
‘কেমন আছো?’ জবাবে লিখলাম,
‘ভালো? আপনি কেমন আছেন? শুনলাম ঢাকা আসবেন?’’
‘‘এখনেও ঠিক হয়নি। তারিখ ঠিক হলে তোমাদের জানাবো।’’
ইচ্ছা ছিল আরও কিছু সময় চ্যাটে কাটানো। ভারচুয়াল অংশটুকু ভালোই চলছিল। রিয়াল অংশে ঢুকতেই রউফ ভাই লিখলেন,
‘‘গুড বাই, এখন ঘুমাবো।’’
“বুঝলাম শূণ্যতা চারিদিকে, রউফ ভাই সুদূর আমেরিকা গিয়েও শূন্যতার হাত হতে রক্ষা পাননি।
রনবী লিখেছে, ‘নকীব মুসলিম স্যার হারিয়ে গেছেন। আপনি কেমন আছেন, স্যার।’’
রনবীকে জবাব দিলাম, “ধন্যবাদ রর্নবী। আমি ভালো আছি।’’
ভারচুয়াল আমার সুবিধা এই। ভালো না থাকলেও ভালো আছি লিখা যায়। ভারচুয়াল জগতের পিছনের রিয়াল মানুষ গুলোর বোঝার কোন উপায় নাই। আমি শূন্যতায় ভুগছি। রিয়াল আমি, ভালো আছি বললে গলা কাঁপতো, চোখ মুখ লাল হতো, কপালে ঘাম দেখা দিতো, ধরা পড়ে যেতাম। ভারচুয়াল জগতে কাঁপাকাঁপি, লালচে হওয়া, কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম বোঝার কোন উপায় নাই।
কামরুল ভাই আমুদে মানুষ । সে সুন্দর মুখেগুলোকে সাবসক্রাইব করে ওয়ালে দিবেন। জানি না এতে তার সুবিধা কি? কোন মতামত নয়, মন্তব্য নাই, নির্মল আনন্দ।
সব কিছুর মাঝে মাক্সওয়েল তার মতামত দিয়ে যাচ্ছে। সেবা, প্রডাক্ট কোনটাই বাদ যাচ্ছে না।
১৪, আগষ্ট একজন লিখেছে,
‘‘ঈদ মোবারক’’।
দিন পুঞ্জিটার দিকে তাকালাম। ঈদ কি এসো গেল। আমার মনে হলো এটা তাড়াতাড়ি, একই সংগে বাড়াবাড়িও। মন্তব্য করলাম,
‘‘বেশী আগাম হয়ে গেল না। রমজানুল মোবারক হলে ভালো হত।’’
কে শোনে কার কথা। পরদিন, ওয়াল ভরে গেছে
‘‘ঈদ মোবারক’’
‘এলো খুশির ঈদ, ঈদের শুভেচ্ছা।’
আজ জাতীয় শোক দিবস। আমরা হারিয়েছি পিতাকে। লিখলাম,
‘‘শোক ইউক শক্তি, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়।“
নতুন নতুন ঈদকার্ড, ঈদের শুভেচ্ছায় ভরে আছে আমাদের ভারচুয়াল জগৎ।
আজ ঈদ। ভারচুয়াল জগতের লোকজনকে কোন শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। নেটে গিয়ে ফেসবুকে লিখলাম, ‘‘আজ ঈদ।’’