ছোটবেলার ইচ্ছাগুলো মনে পড়লে হাসি পাই। অদ্ভুত সব ইচ্ছে মাথায় ভীড় জমাতো। ভাবলে অবাক লাগে। একা একা নিজের মনে আজও হাসি। ছোটবেলার ইচ্ছাগুলো খাবারের চারপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করতো। সবকিছু ছিল জিহ্বা আর পেট নিয়ে। অনেক খাবার দেখে জিহ্বায় পানি আসতো। তেতুল খাওয়ার ইচ্ছাটা কোনদিনই প্রবল ছিল না, তারপরও জিহ্বায় লালা ঝড়তো। আমড়া দেখেও একই অবস্থা। তেতুল আমড়া খাওয়া তেমন হতো না। না হলে কি হবে, জিহ্বার পানি আটকানো যায়নি।
আমাদের ছেলেবেলাটা ছিল বড় সাদামাটা। ক্যাটবেরী মিল্ক চকলেট, নাট ক্যান্ডি, চকলেট কিটক্যাট এগুলোর কোনটাই ছিল না। আমাদের মন ভোলাতে, কখনও কাঁন্না থামাতে বড়রা লোভ দেখাতো,
- “কাঁন্না বন্ধ কর। তোঁকে লেবনচুস কিনে দিবো”। কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিতাম
- “লেবুনচুস খাবো না। কাঠি লেবুনচুস দিতে হবে”।
দু'পয়সা দিয়ে কাঠি লেবুনচুস কিনে দেয়া সব সময় সম্ভব হতো না। অনুরোধ আসতো,
- “আজকে লেবুনচুস খা। আরেকদিন কাঠি লেবুনচুস কিনে দিবো”। কোন কোন দিন বলতেন,
- “ঠিক আছে কাঠি লেবুনচুসই কিনে দিবো”।
ইচ্ছাপূরণ যে কি আনন্দের লিখে আপনাদের বুঝাতে পারবো না। অনুভব করলেই বুঝবেন। আমাকে কাঠি লেবুনচুস কিনে দেয়া হবে শুনেই হাতের একটা আঙ্গুল ধরে লাফাতাম। বলতাম,
- “কি মজা, কি মজা, কাঠি লেবুনচুস খাবো, কাঠি লেবুনচুস খাবো”।
জলখাবার বলতে আমরা বুঝতুম গুড়মুড়ি। পোষে পার্বনে নারকেল, গুড়, মুড়ির নাড়ু ছিল অমৃত। আরো কিছু জিনিষ খেতে ইচ্ছে করলেও ছিল হাতের নাগালের বাইরে টিনের ডলি বিসকুট। মচমচে ছোট গোলগোল বাহিরে ঢেউ খেলানো খাঁজ কাঁটা বিসকুটগুলো দেখলেই জিভে পানি আসতো। কেনার ক্ষমতা ছিল না। আংগুর, আখরোট, নাসপাতি ছিল অভিজাত লোকের খাবার। বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে এসবের দেখা মিলতো। থানা শহরে এগুলো কোনদিন দেখিনি। অচেনা ফল খাওয়ার ইচ্ছে কোনদিনই হয় না। আমরা আম, জাম, লিচু, কলা, এসব নিয়েই ছিলাম।
গোদাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে আমাদের সংগে বৃত্তি পরীক্ষা দিবে। চেয়ারম্যান সাহেব রাজশাহী থেকে ছেলের জন্য আংগুর, বেদানা, নাসপাতি আনালেন। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে আংগুর, বেদানা, নাসপাতি খায়। দেখে খাওয়া ইচ্ছা জেগেছিল। খাওয়া হয়নি সেদিন। পরে একদিন আমিও খেলাম। পানি পানি তেমন লোভনীয় বলে মনে হয়নি। মনে মনে বললাম,
- “এসব এত মজা করে খাওয়ার কি আছে?”
বড় হলাম। খাওয়ার ইচ্ছা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। কিন্তু খেলনা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠতাম। মেয়েরা কাপড়ের পুতুল, মাটির ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল, কুলা নিয়ে দিন কাটালেও আমাদের এসবে কোন মনোযোগ ছিল না। লাটিম খেলা, লাটাই-এ সুতা দিয়ে আকাশে ঘুড়ি উড়ানো, লোহার চাকা তাড়ানো, ডাংগুলি খেলা, এসব নিয়ে মেতে উঠতে চাইতো মন সারাক্ষণ। আমি চাইলে কি হবে। মার বারণ। তাই খেলা নিয়ে মার সাথে লুকোচুরি খেলতে হতো। কয়েকবার ধরাও খেয়েছি। সংগে বকুনি।
মাঠে ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে চোখ থাকতো ঘুড়ির দিকে। পাশের ঘুড়িটাকে প্যাঁচ মেরেছি। কায়দা করে তার ঘুড়ির সুতাটা কাটতে হবে। টান টান উত্তেজনা। উচ্চ নিচু আইল দিয়ে ঘেরা জমি। আগে পিছে করে ঘুড়িটাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। হঠাৎ পিছনের জমিতে চিৎ হয়ে পড়লাম। ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ। মা লাটাই সুতো ঘুড়ি চুলায় দিলেন। আমাদের পকেটে তেমন কোন পয়সা থাকতো না। ঘুড়ি, লাটাই, সুতা কিনে নতুন করে ঘুড়ি উড়ানোর কথা চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না। তাই ঘুড়ি কেনার কথা বাদ দিলাম।
কেটে যাওয়া ঘুড়ি গনিমতের মাল। যে ধরতে পারবে তাঁর। ঘুড়ি কেনার পয়সা না থাকায় কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরার নেশা আমাকে পেয়ে বসলো। কেটে যাওয়া ঘুড়িগুলোর সুতা গাছের ডালে পাতায় আটকে যেতো। এরকম একটা ঘুড়ি ধরতে গিয়ে গাছের ডগায় গিয়ে উঠলাম। ডগাটা ভর সামলাতে পারলো না। ঘুড়িটার সুতাটা হাতে ধরেছি মাত্র। মড় মড় করে গাছ থেকে ডাল আলাদা হয়ে গেল। ৩০ ফুট ওপর থেকে ডালবুকে করে ঝপাৎ করে মাটিতে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নাই। যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম আমি বিছানায়। চোখ খোলার সাথে সাথে মায়ের ঝামটা,
- “আর যদি কোনদিন তোঁকে ঘুড়ির পিছে দেখেছি তো, তোর একদিন কি আমার একদিন”।
ভেবেছিলাম, জ্ঞান ফিরে আসায় মা খুশি হবেন। উল্টো বকা শুনে চুপচাপ আবার চোখ বন্ধ করলাম। পরের বছরগুলোতে পড়াশুনার চাপ বেড়ে গেল। ভয়ও পেয়েছিলাম। আর ঘুড়ি ধরতে যাওয়া হয়নি। এছাড়াও খেলনা পাওয়ার ইচ্ছেগুলো আস্তে আস্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
সত্তরের দশকের গোড়া থেকে বই পড়ার নেশায় পেয়ে বসলো। গল্পের বই উপন্যাস। স্কুলের টেক্সটবুক ভালো লাগে না। শরৎ, তারাশংকর, আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা কিছুই বাদ দিতাম না। নতুন নতুন বই এর স্বাদ পাওয়ার আশায় স্কুল লাইব্রেরীর গন্ডি ছেড়ে গোদাগাড়ী ক্লাব, মাটিকাঁটা রেলওয়ে ক্লাব ঘুড়ে বেড়াতাম। নতুন বই পাই না। এখনকার মত ইন্টারনেটও ছিল না। অগত্যা বই পড়ার নেশাতেও ভাটা পড়লো।
শুরু করলাম খেলাধুলা। ক্যারাম নিয়ে মাতলাম। যেকোন জায়গার গুটি পকেটে ফেলতে হবে। সবাইকে হারাতে হবে। ইচ্ছাগুলো সার্বক্ষণিক তাড়া করতে লাগলো। সারাবছর ক্যারামের পাশাপাশি শীতকালে ব্যাডমিন্টন ও ভলিবলের নেশায় ডুবে ডুবলাম।
ব্যাডমিন্টন খেলাটা আমাদের দেশে কেন জনপ্রিয় হলো বুঝি না। আমাদের দেশটা খরচবিহীন হাডুডু খেলার দেশ। এখানে প্রতিদিন ২০ টাকা খরচ করার মত লোক কোথায়? শ্যাটল বা ফেদার না জোগাড় হলেই ভলিবলের মাঠে হাজির হতাম। ভলিবলের সুবিধা হলে দু’দিকে দু’জন হলেই খেলা যায়। লোকজন বেশী হলেও কোন ক্ষতি নাই।
আঠারোজন একসংগে মাঠে নামতাম। খেলাটাই মুখ্য, কতজন খেলেছি এটা কোন ব্যাপার নয়। এক পক্ষ থেকে কয়েকজন চলে গেল। কোন অসুবিধা নাই, এ পক্ষ হতে কয়েকজনকে অন্য পক্ষে পাঠিয়ে দাও। কোন পক্ষ নয় খেলা। ভালো খেললেই তালি। মজা পেতাম। তালির জন্য ঝুঁকি নিতেও কোন কুন্ঠা করতাম না। ভলিবল খেলছি। বাদরু ভাই সার্ভ করেছে। মধ্য মাঠে রাজ্জাক চাচা বলটা লব করতে গিয়ে মাঠের বাহিরে চলে গেল। বৃষ্টি ভেজা বাহির মাঠ। মাঠের বাহিরটা কাঁদা-কাঁদা পিছলা। দৌড়ে একটা ড্রাইভ দিয়ে বলটাকে মাঠে ফিরালাম। পায়ের গোড়ালীতে কচ করে একটা শব্দ হলো। মাঠে করতালি। আমি ব্যাথায় কোঁকাচ্ছি। উঠতে পারলাম না। কয়েকজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সরকারী ডাক্তারখানা। সেখান থেকে দু’জনের ঘাড়ে ভর দিয়ে বাড়ী ফিরলাম।
পা মঁচকে গেছে। প্লাষ্টার অব প্যারিস দিয়ে মোড়ানো গোড়ালী। এ্যালাজির কারণে ব্যাথার কোন ঔষধ নিতে পারি না। যন্ত্রনায় কঁকাচ্ছি, এমন সময় মা এসে চিৎকার দিয়ে বললেন,
- “আর কত জ্বালাবি? তোর বাপ এ সব কিছু আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ওপারে চলে গিয়ে শান্তিতে আছে। আমার কেন মরণ হয় না”।
মায়ের কন্ঠ আমি বুঝি! তাঁকে শান্তনা দেয়ার জন্য বললাম,
- “তুই মারা গেলে আমাদের কি হবে?” মা জবাবে বললেন,
- “কি হবে জানি না। আমি শান্তি পাবো”।
শুনেছি মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কর্মের ফল ভোগ করবেন। মা বলছেন তিনি মারা গেলে শান্তি পাবেন। ভালো লাগলো যে মা মনে করেন তিনি সাধ্যমত ভালো কাজ করেছেন তাই শান্তি পাবেন তিনি প্রায় নিশ্চিত।
ব্যাথায় আমার মুখটা নীল হয়ে গেছে। মা রান্না বান্না শেষ করে খাটে আমার মাথার কাছে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলেন,
- “বাবা খুব কষ্ট হচ্ছে?” জবাবে বললাম,
- “হ্যাঁ”।
- “ভাত হয়ে গেছে। একটু অপেক্ষা কর। আমি তোকে ভাত খাওয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। তুই ঘুমানোর চেষ্টা কর”।
মা আমাকে তার ইচ্ছাটা জানালেন। মা ভাত খাওয়ালেন। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। মা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলেন,
- “এসব খেলা কেন খেলিস বাবা!” জবাবে বললাম,
- “কি খেলবো, তুই বল?” মা সরাসরি কোন জবাব না দিয়ে বললেন,
- “খেল! কোন অসুবিধা নাই। একটু দেখে শুনে খেলতে পারিস না”। মায়ের কথাগুলো শুনে হাসি পেল। বললাম,
- “মা, কেউ কি নিজে ইচ্ছে করে পা ভাংগে। ব্যাথা কষ্ট দু’টোই তো আমার। কয়েকদিন আমাকেই তো শুয়ে শুয়ে কাটাতে হবে। ইচ্ছা করে কি আমি এ কাজ করেছি”।
- “তা করিসনি”। কিন্তু যন্ত্রনাটা বাড়লো আমার”। মার অভিযোগ।
- “তা ঠিক। ক্ষমা করে দিস”। মাকে একটু খোটা দিলাম। তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে উঠ্ বাবা বলেই মা মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
এতকিছুর মধ্যেও আমার একটা ইচ্ছে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। আমাকে স্কলারশীপ পেতে হবে। ‘আমার আমি’ আমাকে বলতো,
- “স্কলারশীপ ছাড়া তোর লেখাপড়া বন্ধ”। আমি আমার আমিকে জিজ্ঞাসা করি,
- “তুমি বলো, আমাকে কি করতে হবে”। কে যেন বলতো,
- “তোকে বড় হতে হবে”। তোকে স্কলারশীপ পেতে হবে। তুই পড়। আরও বেশী বেশী করে পড়”।
আমার ইচ্ছেগুলো ‘আমার আমি’ নিয়ন্ত্রিত। পড়াশুনা, স্কলারশীপ, আবার পড়াশুনা, এভাবে একটা একটা করে ধাপ পার হচ্ছিলাম। তেমন কোন বাধা আসেনি। মধ্যে বুলগেরিয়ার একটা স্কলারশীপও পেয়ে গেলাম। বুলগেরিয়ায় থাকাকালীন সময়ের বছরগুলোতে আর ভাবতে হয়নি। লেখাপড়া শেষ করে বাংলাদেশী সহপাঠিরা সুইডেন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমালো। কয়েকজন জানতে চেয়েছিল,
- “তুই যাবি না। দেশে গিয়ে কি করবি?” জবাবে বললাম,
- “দেশে গিয়ে কি করবো জানি না? তবে আমার বিদেশে থাকার কোন ইচ্ছে নাই”।
শেষমেস দেশে ফিরে এলাম। এতদিন ভালোই ছিলাম। জানতাম ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে। ভালো পড়াশুনা করলে স্কলারশীপ পাওয়া যাবে। পড়েছি, স্কলারশীপ পেয়েছি। এখন কি করবো। খাই দাই, ঘুরে বেড়াই, ঘুমাই। এভাবে কতদিন চলে। পকেটের টাকা শেষ হওয়ার পথে। ক’দিন পর মার কাছে হাত পাততে হবে। একদিন মা বললেন,
- “একটা চাকুরীর চেষ্টা কর বাবা”। জবাবে জানতে চাইলাম,
- “কিভাবে কি করবো?” মা অসহায়ের মত বললেন,
- “তা আমি কি জানি”।
বুঝলাম কোন পরামর্শ আমি পাবো না। আমাকেই আমার পথ খুঁজে নিতে হবে। একদিন ব্যাগটা গুছিয়ে মাকে বললাম,
- “মা, ঢাকা গেলাম। দেখি কি করতে পারি”।
ঢাকায় আছি। একটা মেসে রাজশাহীর কিছু লোকজনের সংগে থাকি। মাঝে মধ্যে লোকজন বেড়ে গেলে ডাবলিং করি। প্রতিদিন বিকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের ফ্লোরা রেস্টুরেন্টে আরও অনেক বেকারদের আড্ডাঢ রাজা-উজির মারি। হঠাৎ করে দু’একজনের চাকুরীর খবর পাওয়া যায়। আশায় বুক বাঁধি।
একজন চাকুরী পাওয়া লোককে জিজ্ঞাসা করলাম,
- “কিভাবে চাকুরীটা হলো ভাই। তরিকাটা একটু বলেন। আমরাও বেকারদের খাতা থেকে নাম কাঁটাই”।
জবাবে বললেন,
- “আপনার এলাকার মন্ত্রী, এমপি, বড় বড় কর্মকর্তাদের চেনেন না। তাদের ধরেন কাজ হয়ে যাবে”। জবাবে বললাম,
- “তাঁদেরকে তো ধরাধরি করলাম। কোন কাজ হলো না”।
- “ধরার মত করে ধরেন। কাজ হয়ে যাবে”। ভদ্রলোক উপদেশ দিলেন। উপদেশ শুনে আমি বোকার মত বললাম,
- “আর কিভাবে ধরবো বুঝতে পারছি না”। শুনে ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বললেন,
- “মিয়া আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যান প্যাঁচাল পাড়িয়েন না”।
নিজের প্রতি ঘেন্না হলো। নিজেকে অপদার্থ মনে হলো। কয়েকদিন ফ্লোরায় আসা বন্ধ করে দিলাম। বেশীদিন বন্ধ রাখতে পারলাম না। আবার নিয়মিত ফ্লোরায় আসি। আড্ডা দি। গোদাগাড়ীর জামাই কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট কলেজে চাকুরী করেন। ঢাকায় কি কাজে এসেছিলেন। বিকালে ফ্লোরায়। কথায় কথায় বললেন,
- “কুমিল্লা বেড়াতে আসেন। ভালো লাগবে”।
- “আসবো”। জামাইবাবুকে কথা দিলাম।
কিচ্ছু হচ্ছে না। ঢাকায় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কুমিল্লার বাস ধরে ঢাকা ছাড়লাম। আপার বাসায় উঠলাম। পরের দিন জামাইবাবুর অনুরোধে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের বাসায় গেলাম। প্রিন্সিপ্যাল মন্ডল স্যার সিরাজগঞ্জের মানুষ। কথায় কথায় জানতে চাইলেন,
- “আপনার সাবজেক্ট কি ছিলো?” জবাবে অর্থনীতি বলার সাথে সাথে বললেন,
- “আমার এখানে অর্থনীতির শিক্ষকের পদটি খালি। আপনি চাইলে জয়েন করতে পারেন। পরে আমরা রেগুলার করে নিবো”। প্রস্তাবটা শুনে জামাইবাবু বললেন,
- “তুমি তো ভাই বেকার। খারাপ কি, জয়েন করো। ভালো কিছু হলে চলে যাবে”।
ভাবলাম মন্দ না। তাছাড়া হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলতে নাই। বললাম,
- “ঠিক আছে”।
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব পরের দিন ১০টায় কলেজে আসতে বললেন। কলেজে আসতেই আমাকে একটি ক্লাস রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। পড়াতে হবে চাহিদা বিষয়ে। পড়ালাম। মন্ডল স্যার সারাক্ষণ পিছনে বসেছিলেন। তাঁর সংগে সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল। মুখ দেখে তাঁরা খুশি হয়েছেন বলে মনে হলো ক্লাশ শেষে এসে বললেন,
- “আজকে যোগদান করেন”। জবাবে ধন্যবাদ জানিয়ে যোগদান করলাম। বেকারের খাতায় আমার নাম আর নাই। তারপরও আমি খুশি হতে পারিনি। আমার ইচ্ছেগুলোর সাথে আমার কাজটার মিল হয়নি। বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করাই ছিল। ১৯৮২ সালে পরীক্ষা দিলাম। শেষমেস একটা চাকুরী জুটলো। বলে রাখি আগেই কুমিল্লা ছেড়ে ছিলাম।
চাকুরী করছি। আমাদের এক বড় ভাই মনিরুজ্জামান উপদেশ দিলেন,
- “পড়াশুনা করেন। তাড়াতাড়ি ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষাটা দিন। ফাউন্ডেশনটা শেষ করেন। তা না হলে চাকুরীতে স্থায়ী হবে না”।
জামান ভাই-এর উপদেশ মতে পরীক্ষা দিলাম। পাশ করলাম। ফাউন্ডেশনও শেষ হলো। আমার চাকুরী কনফার্ম হয়েছে। সিদ্দিকী বললো,
- “সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দিবি না? আমরা সবাই দিচ্ছি”। জানতে চাইলাম,
- “ওটা আবার কি?” জবাবে সিদ্দিকী বললো,
- ‘ওটা পদোন্নতির চাবিকাঠি। সিনিয়র স্কেল না হলে সবকিছু আটকে যাবে”।
তারপর সময়গুলো পোষ্টিং, পদোন্নতির মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। কখনো আনন্দে, কখনো হতাশা, কখনো বেদনা। ইচ্ছেপূরণ আশাভংগ এসব নিয়ে বেঁচে ছিলাম।
সিনিয়র স্কেল পাশ হলো। পদোন্নতিও পেলাম। চাকুরী জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। মাত্র কয়েকটা মাস পর চাকুরী থেকে বিদায় নিবো। ইচ্চেগুলো নিয়তো পরিবর্তন হলো। ইচ্ছেগুলোর কাছাকাছি এসে দেখি ওগুলো আর নাই। নতুন নতুন ইচ্ছে এসে ভীড় জমিয়েছে। ইচ্ছেগুলোর পিছনে শুধু দোড়ালাম।
ক্লান্ত আমি।