আমার পরমাণু ভাবনা

Category: Education Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 5385

 

রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুr কেন্দ্র নিয়ে আমরা ভাবছি। এবারের ভাবনা বেশ শক্তিশালী। এ জন্য আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা আয়োজিত ৫ (পাঁচ) দিনের কর্মশালায় যোগ দিতে প্যারিস এসেছি। কর্মশালার নামটা বেশ আকর্ষণীয়; ‌‌‌

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ জ্ঞানী ক্রেতা হবে।”

 

৩ নভেম্বর, ২০১২ তারিখ আমিরাতের একটা বিমানে ঢাকা ছাড়লাম।সাড়ে চার ঘন্টা উড়োজাহাজে কাটিয়ে দুবাই বিমানবন্দরে পৌছলাম।দুবাই বিমানবন্দর প্রতিদিন বাড়ছে। বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নীচে নামতে হলো। বাসে তিন নম্বর টারমিনাল হয়ে ২-সি তে পৌঁছলাম। সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি, তল্লাসি শেষে টারমিনালের ভিতরে ঢুকলাম।

বিজনেস্ লাউজে কয়েক মিনিট কাঁটিয়ে গেইটে ফিরলাম। চেয়ারম্যান সাহেব গেইটের পাশেই বসে ছিলেন। বাসে চড়ে বিমানের কাছে যেতে হবে। টিকিটের জাত ভেদের কারণে আলাদা হয়ে পড়লাম।বিমানে উঠেই একটা ঘুম দিবো ভেবে ছিলাম। ঘুম এলো না। দুবাই-প্যারিস সাত ঘন্টার পথ। শুয়ে বসে কাটালাম।সকাল আটটায় চার্লস দ্য-গল বিমানবন্দরে নামলাম। অপেক্ষা করছি পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের জন্য কোথায় উঠবো জানি না; সেমিনারের কাগজপত্রও আমার কাছে নাই। একজন সিকিউরিটি ডাক দিলো।

ম্যাসিয়ে’ বলে কি যেন বললো, বুঝলাম না। হাতের ইশারায় লাইনে দাঁড়াতে বললেন। ইমিগ্রেশন আংগুলের ছাপ নিয়ে ছেড়ে দিলো। চৌদ্দ নম্বর বেল্ট থেকে ব্যাগটা নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছি। উনি ব্যাগেজ নিয়ে আসলেন। চার্লস দ্য-গল বিমানবন্দর থেকে হোটেলের পথে রওনা দিলাম।বাতাসের তাপ মাত্রা ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস।বাতাসের গতি তেমন ছিল না। কোন অসুবিধা হলো না। একজন এসে জানতে চাইলো;

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ কোথায় যাবেন?”

চেয়ারম্যান কাগজটা দেখালেন। আগন্তক জানালেন;

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌৮০ ইউরো লাগবে।”

বুঝলাম না, কেন এসব জানালেন। যা লাগে লাগবে। ট্যাক্সি নিয়ে বিমান বন্দর ছাড়লাম। চার্লস দ্য-গল জেনারেল, পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, নতুন ফ্রান্সের জন্মদাতা। তাঁকে সম্মান জানাতেই এই নামকরণ।

হোটেল গেইট-এ এসেছি। মিটার দেখে বুঝলাম পঁয়তাল্লিশ ইউরো আশি সেন্ট হয়েছে। পরিশোধ করে হোটেল লবিতে উঠলাম। চেক-ইন করা যাবে বারটায়। তখন ঘড়িতে মাত্র আটটা ত্রিশ মিনিট। আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। বাহিরে ঠান্ডা, ছোট লবিতে বসে রইলাম। হোটেল রিশিপসনিষ্ট আলজেরিয়ার নাগরিক। কফি খাওয়ালেন। বারটা ত্রিশ মিনিটে রুম বরাদ্দ পেলাম। রুমটা ছোট, তেমন কোন চেয়ার টেবিল নাই। ভাড়ার তুলনায় সুযোগ সুবিধাগুলো নিতান্ত কম।

চেয়ারম্যান সাহেব রাইস কুকার এনেছেন। আলু ভর্তা দিয়ে ভুনা খিচুড়ি তৈরী করেছেন। খেয়ে, মেট্রো ষ্টেশন দেখতে বাহির হলাম। ৩০ মিনিটের হাঁটা পথ।

৫ তারিখে পাতাল রেল ধরে ওয়ার্কশপ ভেনু্তে আসতে হবে। পাশের এলাকাগুলো হেঁটে দেখলাম। একটা দোকান থেকে কলা, পানির বোতল কিনে হোটেলে ফিরলাম। চেয়ারম্যান রাতেও সাদা খিচুরী আলু ভর্তা তৈরী করলেন। খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। আগামীকাল সকাল ৭.০০টায় উঠে ৭.৩০ মিনিটে নাস্তা খেয়ে রওনা দিবো। টিকিটও সংগ্রহ করতে হবে।

রাত ২.০০ টায় ঘুম ভেঙে গেল। ৬.০০ টায় হাত মুখ ধুয়ে গোসল সেরেছি। চেয়ারম্যান টেলিফোন করলেন। নাস্তার টেবিলে ‘ওলেগস লিনকোভিচ’ এর সংগে পরিচয় হলো। লাটভিয়ার কর্মকর্তা, একই সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন। সংগে বেলোরসের কর্মকর্তাও ছিলেন।

একই সাথে পাতাল রেল ধরতে রওনা দিলাম। টিকিট কাঁটবো শুনে তিনি আমাদের ২টি টিকিট দিলেন। সময় নষ্ট হলে এক সংগে আসা হবে না, তাই এই বদান্যতা। তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।

রেজিষ্ট্রেশন কিছুই নয়। প্রোগ্রাম আর কাগজ পত্রের একটা ব্যাগ।সাদা মাটা একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সূচনায় ইভান ভিদোনভিচ, ডন কোভাচিক এবং ষ্টেফান মরটিন কার্যক্রম সমন্ধে কিছু কথা বললেন। ছবি তোলা হলো।ষ্টেফান মারটিন, জ্যাক ও পেলিন বক্তা হিসাবে তিনটি পেপার উপস্থাপন করলেন।

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতা ।”

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতার মূল দক্ষতা কি?”

আলোচনা শেষে দূপুরের খাবার দিয়ে প্রথম অধ্যায় শেষ হলো।বিকালের সেশানে মালেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পোলেন্ড, ভিয়েতনাম এবং তুরস্ক; তাঁদের অর্জন, প্রতিবন্ধকতা, কিভাবে ‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ ‘জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতা’ হওয়া যায় এ সমন্ধে আলোচনা এবং শেষে কমস্ স্কয়ার এ স্বাগত অভ্যার্থনা দিয়ে প্রথম দিনের কর্মসূচি শেষ হলো।

আসার সময় ট্রেনে বেশ ভিড় ও বেশ ঠান্ডা। ইউরোপের জৌলুস ম্লান হচ্ছে মনে হলো। ক’দিন আগে সিউল, সিংগাপুর ঘুরে এসেছি। এখানে সে রকম কোন চমক নাই, রাস্তা-ঘাট, ভবনের গায়ে চটা ধরেছে। পূর্বব ফরাসি ললনারা এখনও তাদের বুকের অংশ দেখাতে কার্পন্য করেন না। ঠান্ডার মধ্যেও কিছুটা খুলে রেখেছেন।

ফরাসি ললনারা উদার হলেও ওয়ার্কশপের বক্তারা খোলামেলা ভাবে আলোচনা করছেন না। আবৃত আলোচনা নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। বেশীর ভাগ প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।নলেজেবল কাষ্টমার-এর শর্ত বলতে গিয়ে সবাই বলেছেন;

‘আইনী কাঠামো থাকতে হবে, ব্যবস্থাপনা হতে হবে সামগ্রিক, সব কিছু বুঝে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।’ কেউ বলছেন এগুলোর জন্য কি করতে হবে। ফরাসী ইডিএফ সাধারণত নলেজেবল কাষ্টমার ছাড়া অন্য কাউকে যন্ত্রপাতি দেয় না।

মালয়েশিয়ার অগ্রগতি তেমন কিছু হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যু কেন্দ্র আছে । তারা শক্তির ঝুড়িতে আরও বড় একটি অংশ পরমাণু বিদ্যুr কে দিতে চায়।

রিশিপসনে কিছু খাওয়া দাওয়া থাকবে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু ছিল না। ফরাসী প্রথা অনুযায়ী শ্যামপেন আর মিষ্টি কুকি। সামান্য গ্রহণ করে বিদায় নিলাম। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। খাওয়া বলতে যা ছিল তার সবগুলোই এটমিক। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটা তা হলো সব কিছু মাছ, মাংস। আমার খাবার উপযোগী কিছুই ছিল না। আজকেও চেয়ারম্যান সাহেব ভলেনটিয়ার করলেন। প্রেসার কুকারে ভাত, ডাল, আলু ভর্তা রান্না করলেন। বাতাস বেশ ঠান্ডা, বাহির হওয়ার সাহস হলো না। খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

ভোর চারটায় ঘুম ভেংগে গেল। এপাশ ওপাশ করে বিছানায় ছয়টা ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত কাটালাম। উঠে চেয়ারম্যান সাহেবকে টেলিফোন করতে গেলাম। বিধিবাম, টেলিফোন নষ্ট। নীচে নেমে লোকজন খুজলাম। হোটেলের লোকজন লবিতে ঘুমাচ্ছে। ফিরার পথে ৩২ নম্বর রুমে টোকা দিলাম। কোন সাড়াশব্দ নাই। আমার ৪৩ নম্বর রুমে ফিরে আসলাম। সকালের কাজ-কাম শেষে টেলিফোনটা নাড়া চাড়া করতে করতে ডায়াল টোন পেলাম। চেয়ারম্যানের অবস্থা জানার জন্য টেলিফোন করলাম।

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ চেয়ারম্যান সাহেব, নাস্তা করে ফেলেছেন?”

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ স্যার কয়টা বাজে’’ জবাবে জানালাম;

-‘‘‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ সকাল ৮.০০টা’’

তিনি অবাক হলেন। আমি টেলিফোন করে তার ঘুম ভাংগিয়েছি। বললাম;

-“ ঠিক আছে। আপনি রেডি হয়ে নেমে যান। একবারে রওনা দিবো।’’

তিনি সম্মতি জানালেন। আমি নাস্তা করার জন্য রওনা দিলাম। নাস্তা শেষে লবিতে অপেক্ষা করছি। চেয়ারম্যান আসলেন, আমরা মেট্রোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মেট্রো এর টিকিট কিনতে হবে। আগের দিনও কিনেছি। বুঝলাম না, আগের মেশিন থেকে এটা আলাদা। ইংরেজী ভাষায় কোন নির্দেশনা নাই। চেষ্টা করলাম, না পেরে তথ্য বুথের মাঝ বয়সী মহিলাকে অনুরোধ করলাম। তিনি বিরক্ত হলেন। অনিচ্ছা শর্তেও বাহির হয়ে দেখিয়ে দিলেন।দু’টো টিকিট কিনে রওনা দিলাম। পাতাল রেলে বাংলাদেশী ঈদের ভীড়। ধাক্কা ধাক্কি করে ট্রেনে এলাম। দু’টো ট্রেন পরিবর্তন করে ভেনুতে যেতে হয়। পরের ট্রেনে উঠে একটা ষ্টেশন পর ট্রেনটা আর গেল না। ফরাসি ভাষায় যাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা হলো। সবাই ঘুড় মুড় করে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। আমরাও নেমে পড়লাম। পরের ট্রেনে প্রায় যুদ্ধ করে উঠলাম। আবারও নির্দেশনা এলো সবাই নেমে পড়লেন। আমরাও নামলাম।

এ সময় আমাদের ওয়ার্কশপে থাকার কথা। ৯’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ৯.০০টায় ওয়ার্কশপ শুরু হবে। চেয়ারম্যান সাহেবকে বললাম,

-“ কোন নিশ্চয়তা নাই। চলেন হাঁটা দিই। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’’

জবাবে চেয়ারম্যান অনুরোধ করলেন;

-“ না স্যার । চিনি না, হারিয়ে যাবো। সবাই অপেক্ষা করছে। আমরাও করি।”

তাঁর কথার যুক্তি আছে। একমত পোষণ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চেয়ারম্যান এক সুন্দরীকে জিগালেন,

-“ আমাদেরকে নেমে যেতে হলো কেন? পরের ট্রেন কখন আসবে?”

ফরাসী ললনা জানালেন

-“ আগের ট্রেনে একজন রোগী ছিল।”

আমি তার জবাবে সন্তুষ্ঠ হতে পারলাম না। ললনাও জানেন না পরবর্তী ট্রেনে যাওয়া যাবে কি না? তবুও ধন্যবাদ জানালাম। একটি মিষ্টি হাসি উপহার পেলাম। পরের ট্রেনে উঠলাম।এ দৃশ্য দেখলে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ঈদে ঘরে ফেরার রিপোর্টিং করতেন না।

নির্ধারিত ষ্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভেনুতে আসলাম। গত কালের চেয়েও বেশ ঠান্ডা। ওয়ার্কশপ শুরু হয়ে গেছে। আয়োজকরা আড় চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন।ওইসিডি এর প্রতিনিধি নামস্কি পরামর্শ দিচ্ছেন,

-“ রেগুলেটরকে অবশ্যই পরমাণু শক্তি নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল বিষয় জানাতে হবে।”

ইউকে এর তিনজন প্রতিনিধি, ব্যবহারকারী, নিয়ন্ত্রণকারী এবং সরবরাহকারীর দৃষ্টি কোন থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা জানালেন।

ডেড ওয়াইডেন, দাবী করলেন সরবরাহকারীর অভিজ্ঞতা অনেক। তাঁর অভিজ্ঞতার কিছুটা ব্যবহারকারী ও নিয়ন্ত্রণকারীকে গ্রহণ করতে হবে।নাইজেরিয়ার প্রতিনিধি প্রশ্ন করলেন;

-“ সবাই বলছেন, ব্যবহারকারী ও নিয়ন্ত্রণকারীকে সব কিছু জানতে হবে। কি জানতে হবে? কি ভাবে জানা যাবে? একথা তো কেউ বলছেন না।”

জবাবে আয়োজনদের প্রতিনিধি জানালেন;

-“ আমরা সময়ের অভাব বোধ করছি। পরে আলাপ করা যাবে।”

গত কালেও একই বক্তব্য আমরা শুনেছি। এ পর্যন্ত যা শুনেছি। যা বুঝেছি;

-“ বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধতে হবে।”

কে বাধঁবেন। কি ভাবে বাধঁবেন এটা কেউ বলছেন না। তবে সবাই বলছেন;

-“ পরমাণু জগতের নবাগতদের ‘জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতা’ হতে হবে।” আমার মনে হচ্ছে;

-“ শুনছি, জানছি না। যে তিমিরে ছিলাম, সেখানেই রয়ে যাচ্ছি।” ভাবছি এ সবের শেষ কোথায়? কোন জবাব নাই;

রাশিয়ার দাবী তাঁদের প্রযুক্তি সবচেয়ে ভালো। তাঁরা সব দেশকে সবচেয়ে ভালো নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।ইউকে এবং ফরাসিরা বলছে, রাশিয়ার দাবী কতটুকু যুক্তিযু্ক্ত তা প্রমাণ করতে হবে।মনে হলো এটা নোড়া পাটার ঘসাঘসি, মরিচ হিসাবে নবাগতদের জান যায় যায়।

বিক্রেতা, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপট থেকে জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে গ্রুপে আলোচনা হবে। চেয়ারম্যান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের গ্রুপে, আমি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের গ্রুপে আছি। ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি তাঁর দেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিলেন। তাঁরা অনেক এগিয়ে, পারমাণবিক বিদ্যুr কেন্দ্র আছে। রিয়্যাক্টরের জন্য বিভিন্ন অংশও তাঁরা উৎপাদন করে। যদিও তাঁরা আশির দশকে পরমাণু শিল্প থেকে দূরে সরে গেলেও আবার নতুন করে শুরু করেছে।

আজ তিন দিন চলছে হোটেল, ওয়ার্কশপ ভেন্যু পাতাল রেলওয়ে, এর বাহিরে কোথাও যাওয়া হয় না। প্যারিসে এসে মোনালিসার বাড়ি ‘লা লুভার’ মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সমাধি, শপেন এর সমাধি-সেখানে ফুল কোনদিন শুকনা হয় না; এ সব না দেখে ফিরে যাবো, ভাবতে পারছিলাম না। চেয়ারম্যান মন্তব্য করলেন,

-“ স্যার প্যারিস এসে কিছুই দেখবো না, এটা কি করে হয়?” স্যার অন্তত কিছু দেখে আসি।” জবাবে বললাম,

-“ উপযোগিতা বা বিচার করে ঠিক করেন কোন সেসানটা বাদ দিবো। না হলে আগামীকাল ঘুরে আসা যাবে।”

ঠিক হলো আগামী কাল ১১.০০ টার দিকে শহরে যাবো; দেখে আবার ৪.০০ টার দিকে কর্মশালায় ফিরে আসবো।০৬-১১-২০১২ তারিখ বিকালে হোটেলে ফিরলাম। শিন নদীতে ইস্টিমার ভ্রমণ আছে। হোটেল থেকে মেট্রো করে প্যারিসের নাম করা রাস্তা ‘সানজে লিজে’ হয়ে হাঁটা দিলাম। বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করতে হলো।

ফরাসি পুরুষেরা তেমন কিছু জানে না। ইংরেজীতে তাঁদের আগ্রহ নেই। অন্য দিকে ফরাসী ললনারা ইংরেজীতে মোটামুটি কথা বলতে পারে। অন্যকে সাহায্য করতেও আগ্রহী। তাঁদের কয়েক জনের সাহায্য নিয়ে ৫ নম্বর জেটিতে পৌঁছলাম।

বেশ বড় জাহাজ, চমrকার বসার জায়গা । ফ্রেঞ্চ শ্যামপেন নিয়ে টেবিলগুলো সাজানো। আমরা ৪ ঘন্টা শিন নদীতে কাটালাম । অনেক দিন পর নিজেকে ছাত্র মনে হলো।

সুন্দর একটা সন্ধ্যা জাহাজে কাটিয়ে ফিরে আসলাম। নদী থেকে নটরডাম ক্যাথেড্রাল, আইফেল টাওয়ার দেখলাম; ছবি তুললাম। পরে সিংগাপুরের ২ জন মহিলা, লাটভিয়া এবং বেলোরসের প্রতিনিধিদের সংগে হাঁটতে হাঁটতে সানজেলিজে হয়ে রুসভেল্ট স্টেশন থেকে এক নম্বর পাতাল রেল ধরে চার্লস দ্য-গল স্টেশনে আসলাম। আমরা ট্রেন পরিবর্তন করলাম। সিংগাপুরের প্রতিনিধিরা ট্রেনটার শেষ গন্তব্য ‘লা ডিফেন্স’ যাবেন। সেখানেই তারা থাকেন। আমরা থাকি অন্য এলাকায় আমাদের গন্তব্য ‘রোম’ ষ্টেশনে। ফরাসীরা অদ্ভুদভাবে নামটা উচ্চারন করে। রোম হয়ে হোটেলে ফিরলাম।রাত শেষে প্রতিদিনের মত ওয়ার্কশপে যোগদানের প্রস্তুতি। এক এবং অভিন্ন নাস্তা খেয়ে একই গন্তব্যে যাত্রা।

পাতাল রেলে অসম্ভব ভিড়। চালর্স দ্য-গল এসে ট্রেন পরিবর্তন করলাম। মানুষের ভিড়ে চেয়ারম্যানকে হারিয়ে ফেললাম। আমি তাঁকে খুঁজছি। আমি জানি, তিনিও আমাকে খুঁজছেন। কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই যাবো। ভেন্যুতে আসলাম। চেয়ারম্যান এসেছেন, ওয়ার্কশপ সবে মাত্র শুরু হয়েছে।

পর পর তিনটি উপস্থাপনা হলো। ফরাসী ইডিএফ চীনে তাদের অভিজ্ঞতা বললেন। রাশিয়ার রসাটম তুরস্কে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। ভিয়েতনাম তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন।

ইডিএফ চীনের বিদ্যু প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে সেখানে বিনিয়োগ ও পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল। চীনের প্রযুক্তিগত অবস্থান বিশাল বাজারে কৌশলগত পার্টনারশীপ অনেক সহজ। বাংলাদেশের জন্য এ ধরণের কৌশলগত পার্টনারশীপ তেমন কার্যকরী হবে না।

রাশিয়ান ফেডারেশন তুরস্কে একটি কোম্পানী করে তার মাধ্যমে পরমাণু বিদ্যুr কেন্দ্র করছে। দু’দেশের মধ্যে চুক্তির অধীনে কাজ হচ্ছে। তৈরী কর, মালিকানা তোমার, পরিচালনা করো যাকে কনসালটেন্টরা বলে বিওও। এ ধরণের মডেল বাস্তবায়নে জ্ঞান সমৃদ্ধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তুরস্কের তা আছে। আমাদের যা নাই, তাই এই কৌশলটিও আমাদের জন্য তেমন কার্যকর নয়।

ভিয়েতনাম জি-টু-জি মডেলে তাদের পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে। রাশিয়া সাইট সিলেকশন, রিএ্যাক্টর তৈরী, ম্যানপাওয়ার তৈরী, ব্যবস্থাপনা, পুড়ে যাওয়া ফুয়েল ব্যবস্থাপনা করবে। তাঁরা ম্যানপাওয়ার তৈরীর বিষয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। আমরা তাঁদের অনুসরণ করতে পারি।

ভিয়েতনামে রাশিয়া স্থান নির্ধারন, রিএ্যাক্টর ডিজাইন, অপারেশন, জনবল তৈরী, ফুয়েল ব্যবস্থাপনা করে দিবে। এখানে ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশী হবে মর্মে অংশ গ্রহণকারীরা আশংকা করছেন। রাশিয়ার সংগে ভালো সম্পর্কই তাঁদের একমাত্র ভরসা। পারমাণবিক বিদ্যুr কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে আমাদেরও এটা করা ছাড়া গতি নাই।

আলোচনা হচ্ছে, সবাই সবার মত করে মন্তব্য করছেন। আমরা কি করবো? সবাই বলছে; তোমাদের সিদ্ধান্ত তোমাদের গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি।

আমাদের শুধু অভিজ্ঞতা হলেই চলবে না, অর্থও প্রয়োজন। মি. রেলোট অর্থ প্রাপ্তি এবং অনিশ্চয়তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বললেন। পারমাণবিক বিদ্যু উপাদন প্রকল্প অন্য প্রকল্পে বিনিয়োগ থেকে আলাদা।

তিনি দাবী করলেন শুধু মাত্র বিদ্যু তৈরী করার জন্য এ ধরণের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগে লাভ খুঁজবে ঠিক। অনেক দেশ জানে বিনিয়োগকারী পাওয়া যাবে না। সেখানে সরকারকেই বিনিয়োগ করতে হবে। না হলে জনগণকে বিদ্যু দেয়া যাবে না।

নিউক্লিয়ার বিদ্যু কেন্দ্রের জন্য একটি আইনগত ভিত্তি দরকার। আইনগত ভিত্তি নির্ভর করে;

(১) সরকারের ভূমিকা কি?

(২) কোথা থেকে বিনিয়োগ আসবে?

(৩) কোন ধরণের আইনগত কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে?

নিউক্লিয়ার আইন কাঠামো তৈরীর সময়। সকল ধরণের আইনী কাঠামো মাথায় না রাখলে পরে জটিলতা দেখা দিবে মর্মে বক্তারা সতর্ক করলেন।

০৮.১১.২০১২ তারিখ থেকে টেকনিক্যাল সেশান শু্রু। ফ্লামাভিল যেতে হবে। সকালে সেই পরিচিত নাস্তা শেষে লাতভিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে ‘লাজারে’ ট্রেন ষ্টেশনের জন্য রওয়ানা দিলাম। ট্রেনে গ্রুপে ‘ভালোগনেস’ পৌঁছলাম। পরে বাসে ফ্লামাভিল। ট্রেনে বাক্স খাবার ফ্রিজ থেকে বাহির করে দেয়া হলো। পনির, টমাটো, রুটি দেয়া হয়েছে। ট্রেনে আসছি টের পেলাম না। কোন ঝাঁকুনি, শব্দ নাই। কোন হকার বা ভিক্ষুকের দেখা মিলল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল, এরা পেরেছে আমরা আজও পারলাম না।

সেশান শুরু হয়েছে। উপস্থাপিকা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং স্থানীয় শেয়ার হোল্ডারদের কিভাবে আরও সম্পৃক্ত করা যায় এ সমন্ধে বলছেন। পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্রের জন্য এগুলো নতুন কিছু নয়। এদেরকে জানাও; এদের সাথে আলোচনা করা; তাঁদের বলো; আরও নানান কিছু। সব প্রকল্পের জন্যই এগুলো করতে হয়। এরা করে আমারাও কখনও সখনও করি। সব সময় করলে ভালো হয়।

পরবর্তী বক্তা বললেন এই প্রকল্প কি করা হয়েছে। কিভাবে সুপারভিশন এবং কমিশনিং করতে হয়েছে ইত্যাদি। একজন কর্মকর্তা আমাদের দু’ভাগে বিভক্ত করে কন্ট্রোল রুম সিমুলেটর দেখালেন।

হোটেল বার্নাডিল ডিক্যাপ রাত ৮.০০ টায়, হোটেল ডে প্যারিসে ইডিএফ এর ডিনার আছে। আগামীকাল ফার্মাভিল পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্র দেখবো।

পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্রে ঢুকার আগে পাশপোর্ট পরীক্ষা করা হলো। আমাদের দু’ভাগে বিভক্ত করা হলো। সকালে গেলাম চলমান পারমানবিক বিদ্যু কেন্দ্রে, বিকালে নির্মাণাধীন কেন্দ্রে। অন্য একটি লিখায় আপনাদের ‘পরমাণু চুল্লিতে কিছুক্ষণের’ অভিজ্ঞতা জানাবো।

দুপুরের খাওয়া শেষ করেছি। টেকনিক্যাল ওয়ার্কশপ শেষ হলো। কফি খেয়ে বাসে ‘ভালগনে’। সেখান থেকে প্যারিসে রাত ৯-৩০ মিনিটে আগের হোটেলে ফিরলাম।

সকালে সেই নাস্তা শেষ ১১ টায় চেক আউট করে ট্যাক্সি নিয়ে চালর্স দ্য-গল বিমানবন্দরে; ইমিগ্রেশন শেষে আমিরাতের বিমান ধরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশ পৌঁছলাম। ঢাকা সময় সকাল ৮-৩০ মিনিট; বাসায় গিয়ে গোসল নাস্তা শেষে অফিসে আসতে হলো। আমি এখন অফিসে।