স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল গুলোর কল্যাণে বাজার দর আর বাজার অর্থনীতি বিষয়ে টিভি রিপোর্টিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চ্যানেল গুলো বাজার দর নিয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট করছে। যিনি কোনদিন ব্যাগ হাতে বাজার মুখো হননি, তিনিও জানেন কোন জিনিসের দাম কত। টিভি ক্যামেরা নিয়ে রিপোর্টার বাজারে হাজির হচ্ছে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার প্রতিক্রিয়া সরাসরি বাজার থেকে দর্শকদের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে প্রতিদিন।
২০০৬ সালের রোজার মাস, জিনিষপত্রের দাম বেশ বেড়ে গেল। টিভি ক্যামেরায় বাজার রিপোর্টিংও আকর্ষনীয় হয়ে উঠলো। বাজার করতে আসা লোকজনের হতাশা, ক্ষোভ, কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে টিভি চ্যানেলে প্রতিনিয়ত। বিক্রেতারাও অসহায়ের মত অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। তাঁদের দেখে, কথা শুনে মনেই হয়না যে তাঁরাও বাড়তি দামের ভাগীদার।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর বামপন্থী দলগুলো বড় বেশী অসহায় হয়ে পড়েছিল। জিনিষপত্রের দাম বাড়ায় বামপন্থী দলগুলোও একটু নড়ে-চড়ে উঠলো। আলু, পেয়াঁজ, বেগুন, টমেটো দিয়ে মালা তৈরী করে ছোটখাটো বিক্ষোভ মিছিল করলো ঢাকা শহরে। টিভিগুলো ভালো কভারেজ দিলো, উৎসাহ পেয়ে বামদলগুলো মিছিল মিটিং এর সংখ্যা বাড়াতে লাগলো। প্রথম দিনের মত লোকজন হলো না। দিন দিন লোকজন কমতে থাকলো। টিভি ক্যামেরাগুলোও মিটিং মিছিলের ছবি নেয়া বন্ধ করে দিলো। এসবে আগে কাজ হতো, এখন আর হয়না। সুশীল সমাজের ব্যাপারে বাম দলগুলো উৎসাহ হারিয়ে মিটিং মিছিল বন্ধ করলেন বটে। কিন্তু এতে সুশীল সমাজের বাঘা বাঘা নেতাদের তৎপরতা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। তারা বড় বড় হোটেলে সেমিনার ওয়াকর্শপ করতে শুরু করলেন। সেখানে ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চ্যানেলের ক্যামেরা আসা শুরু হলো। বিদেশী দুতাবাস, দাতা সংস্থার লোকজন এসে মূল্যবান উপদেশ দিচ্ছেন। পরদিন খবরের পাতা ভর্তি করে ছবিসহ রিপোর্ট হচ্ছে। সবাই সবকিছু করছেন, কিন্তু জিনিষপত্রের দাম কমছে না।
দাম বাড়লেও কোন কিছু বিক্রি বন্ধ হয়নি বা কমেনি, পড়েও থাকছেনা। সবকিছু দেদার বিক্রি হচ্ছে। সরকারী অর্থ শাস্ত্রীরা আত্ন-তৃপ্তিতে বলছেন-"মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। কোন মানুষ না খেয়ে নাই।" ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে জিনিষপত্রের চাহিদা বাড়বে। এজন্য দামতো বাড়বেই। এটাই বাজার অর্থনীতি।
বাণিজ্য মন্ত্রী বললেন, "বাজার অর্থনীতিতে দ্রব্য মূল্য নিয়ে সরকারের কোন কিছু করার নাই। সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে। জিনিষপত্রের দাম কিছুটা তো বাড়বেই"। অর্থ মন্ত্রী বললেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে সব কিছুর দাম বেড়েছে। আমরা আমদানী নির্ভর দেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের দেশেও দাম বাড়বে, এতে আমাদের কি করার আছে? এটা মেনে নিতে হবে"। অনেকে বললো-'দাম বেড়েছে বলা হচ্ছে। আসলে কি বেড়েছে? সংবাদপত্র গুলো যা খুশি রিপোর্ট করছে।' যে যাই বলুক, টিভির বাজার দর রিপোর্টিংগুলোতে দেখে বুঝা যায় মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।
গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে টাকার অবমূল্যায়ন হলো। এ এমন কিছু নয়, এ দেশে প্রায়ই হয়। এবারেও ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে গুড়ো দুধ, সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে গেল। আমাদের দেশের প্রধান সম্পদ জনশক্তি। এ জনশক্তি রফতানী করে আয় করা টাকা দিয়ে তেল, নুন, সবকিছু আমদানী করা হয়। বাংলাদেশ লিবিয়া, ইরান, ইরাকে জনশক্তি রফতানি করে। এদেশগুলোর অবস্থাও ভালো নয়।
লিবিয়ার ২জন নাগরিক যাত্রীবাহী বিমানে হামলা চালিয়েছে। বিমান বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে লিবিয়ার উপর জাতিসংঘ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। মারণাস্ত্র তৈরীর অজুহাতে আমেরিকা এবং ব্রিটেন ইরাক দখল করে নিয়েছে। দেশকে দখল মু্ক্ত করার জন্য ইরাকি গেরিলারা যুদ্ধ করছে। তেলের পাইপে আগুন জ্বলছে। ইরাকের প্রতিদিনের তেল উৎপাদন ও সরবরাহ শূণ্যের কোঠায় পৌঁছেছে। ইরান আনবিক বোমা তৈরীর সকল উপাদান সংগ্রহ করছে। পারমানবিক শক্তিকে শান্তি পূর্ণ কাজে ব্যবহার করার কথা ইরান বললেও পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বাস করতে পারছেনা। সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে। দারফুরে হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। দেশটার অঢেল তেল সম্পদ পাইপ লাইনেই ধ্বংস হচ্ছে বিদ্রোহী গ্রুপ গুলোর বোমায়। নাইজেরিয়ার তেল লুটপাটে সাবাড় হয়ে গেল। ফলে দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি শূণ্যের কৌঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। দলে দলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে লোকজন দেশে ফিরে বেকারের খাতায় নাম লিখছে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার যুক্তি, বাজারে যাওয়া মানুষের জন্য হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশ তেলে ভুর্তুকি দেয়। বাংলাদেশের সৌদি রাজা-বাদশাহদের শ্রদ্ধাভক্তির সুবাদে কম দামে তেল দেয়। তেলের মূল্য এদেশে বাড়েনি। নয় ছয় করে ভালোই চলছিল। বাদ সাধলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আর বিশ্ব ব্যাংক। তেলের মূল্য বাড়াতে হবে, তা না হলে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র বিমোচন বিশেষ তহবিলের অর্থছাড় করবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দারিদ্র বিমোচন বিশেষ সহায়তা তহবিল হিসেবে ৭ কিস্তিতে ৪৯ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার দিচ্ছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে আমদানী বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ভয়ানক অবস্থা দাঁড়াবে। এ নিয়ে জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। গোঁদের উপর ফোঁড়ার ঘা। অন্য মন্ত্রণালয়গুলো অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য মাত্রা অর্জন করতে পারেনি। তেলের দাম না বাড়লে বিশ্ব ব্যাংক অর্থ ছাড় করবে না শুনে অর্থমন্ত্রী বেজায় নাখোশ।
-'দাতা দেশগুলো টাকা দেয় কম, বেশী কথা বলে' বললেন অর্থমন্ত্রী। আমরা আশাবাদী হলাম। এবার বোধ হয় তেলের দাম বাড়বে না। আশা ভঙ্গ হলো। ক'দিন পর অর্থমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সুর মেলালেন। তেলের দাম বাড়লো। এ অজুহাতে জিনিষপত্রের দামও একধাপ বাড়লো। টিভির বাজার রিপোর্টিং প্রতিদিনের মত এখনও চলছে। রিপোর্টার হাতের মাক্রোফোনটা বাড়িয়ে ধরে একজন ক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলেন-'জিনিষপত্রের দামের ব্যাপারে আপনার মতামত কি?'
-'কি আর বলার আছে?' ক্রেতা ভদ্র মহিলা মলিন মুখে রিপোর্টারের দিকে চেয়ে রইলেন। রিপোর্টার বিব্রত হলেন। কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই অন্য আর একজনের দিকে মাইক্রোফোন বাড়ালেন। বাজারে জিনিষপত্রের দাম আর এক দফা বেড়ে গেলো। সবাই আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বৃদ্ধি আর দাতাদের দোষারোপ করতে লাগলেন।
গত রমজানে বেগুনের কেজি ৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল। অর্থ মন্ত্রী বললেন-'বেগুন না খেলে কি হয়?' অর্থ মন্ত্রীর কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল। বেগুন না খেলে কি হয়? না খেলেই চাহিদা কমবে, দামও কমে যাবে। আমার ছেলে জানতে চাইলো- 'বাবা বেগুন ছাড়া ইফতারীর কি হবে?'
-'ছোলা, পিঁয়াজু, জিলাপী খাবি।' জবাব দিলাম ছেলেকে। সে সন্তুষ্ট হলো না। এদেশে ইফতারীর সাথে বেগুনী একাকার হয়ে গেছে। বেগুন খাবো না, এ কথা এ দেশে চলবে বলে মনে হয় না। বেগুন জাতে উঠেছে, এরা পত্র-পত্রিকাগুলোর ভালো লাগলো না। বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রীরাও এটাকে ভালোভাবে নিলো না। স্লোগান দাবী উঠলো দাম কমাও। কিন্তু যেমন ছিল তাই রইল। কিছুদিন পর এমনিতেই সব হৈ চৈ থেমে গেল। এতে একটা লাভ হয়েছিল, ইফতারীতে নতুন ক'টা আইটেম 'আলুনী', 'পেপেনী' যোগ হলো।
শুক্রবারে থলে হাতে শুক্রাবাদ বাজারের আমি নিয়মিত ক্রেতা। বেগুন শুরু থেকেই ৬০ টাকা কেজি। আলু এক লাফে ১২ টাকা থেকে ২৪ টাকায় উঠেছে। সবাই মেনে নিয়েছি। 'কি আর করার আছে।' মুখটা একটু মলিন হয়েছে। বেগুনের সামনে দাঁড়ালে একটু ভয় লাগে। এসব নিয়েই কলাবাগান এলাকায় থাকি। রাস্তার পাশে লেকের পাড়ে একটা সুন্দর 'ওয়াক ওয়ে' আছে। সকালে হাঁটতে যাই। লেকের পাড়ে এক চিলতে সবুজে ঢাকা 'ওয়াক ওয়ে' তে সকাল-সন্ধ্যা অনেক বুড়ো, যুবা, বালকের আগমন ঘটে। কিছু মহিলা হাটেনওয়ালীও নিয়মিত আসেন। 'ওয়াক ওয়ে' এর পাশে বসার জন্য লাল ইটের ঢিপির মত বেঞ্চ আছে। বসে অনেকে গাল-গল্প করেন। রাজা উজিরও মারেন।
প্রতিদিন লেকের পাড়ে হাঁটতে যাই। অনেক দিনের পুরানো অভ্যাস। সহকারী সচিব হিসাবে বাংলাদেশ সচিবালয়ে চাকুরী করার সময় থেকেই শুক্রাবাদ কলাবাগানে ভাড়া থাকি। অফিসে যাওয়া আসার জন্য পরিবহন পুলের একটা মাইক্রোবাস বরাদ্দ ছিল। প্রায়ই নষ্ট থাকতো। বাড়ী ফিরবো, নীচে নেমে অপেক্ষা করছি, কিন্তু গাড়ীর দেখা নাই। অগত্যা রিক্সা বা স্কুটার খোঁজা শুরু হতো। সচিবালয় হতে শুক্রাবাদ রিক্সা বা স্কুটার পাওয়া ছিল অসম্ভব। পাওয়া গেলেও ভাড়া শুনে উঠে বসার সাহস হারাতাম। সচিবালয় হতে হেঁটে শুক্রাবাদ আসার সাহস পেয়ে গেলাম। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে একটা অপারেশন করতে হলো। চেক আপে রক্তে গ্লুকোজ ধরা পড়লো। ডাক্তার ইনসুলিন দিলেন। অপারেশন হলো। তারপর থেকে ডায়বেটিস এর জন্য আধখানা ডায়া মাইক্রন এমআর ৩০ খেতাম, আর লেকের পাড়ে হাটতাম। জায়গাটায় রফিক চত্তর নামে একটা সাইনবোর্ড ছিল। কিছু কম বয়েসী ছেলে ব্যায়াম করতো। এখনও হাটি অভ্যাস মত। ডায়া মাইক্রন অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
রফিক চত্বরের পাশে বন্ধু মেলা, তার পাশে আরো কয়েকটা সংগঠন গড়ে উঠছে। কেউ জিমনাষ্টিক, কেউ ভলিবল নিয়ে আছে। চত্তর অঙ্গনগুলোর আশে পাশে গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমান দোকান-পাট। মেশিন দিয়ে ম্যাসেজ এ করা হচ্ছে একপাশে। ছোট ছোট দুটো টেবিলে রক্তের সুগার মাপার যন্ত্রপাতি দিয়ে বসে আছেন দু'জন। কেউ কেউ পাকা কলা, পেঁপেও নিয়ে এসেছেন। কালি জিরার তেল, লাঠি, বাঁশিও বিক্রি হয়। লোকগুলো হাঁটছে, কালি জিরার তেল মাখছে, খাচ্ছে, তারপরও মুখগুলো কেন জানি মলিন। জিজ্ঞাসা করলে জবাব 'কি করবো ভাই। ডায়াম্যাইক্রন এমআর, ৩০ এর একপাতার দাম এক লাফে ৩০ টাকা বেড়ে গেছে। বেগুনের দাম ৬০ টাকা।
লেকের পাড়ে বয়সী মানুষগুলো নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। আলোচনা আটকে যায় রাজনীতি হয়ে অর্থনীতির ঘুর পাকে। জটলার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। বয়স্ক এক ভদ্রলোক তাঁর কম বয়সী সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলেন - 'সবাই বাজার অর্থনীতি, বাজার অর্থনীতি বলে চিৎকার করছে। দাম বাড়ার দায় নাকি পুরোটাই এই বাজার অর্থনীতির! এটা আসলে কি, জানিস!'
জবাবে সঙ্গীটি বললেন 'এটা এমন কিছু না। এ হলো সাপ্লাই আর ডিমান্ড................।'
বুড়ো ভদ্রলোক সঙ্গীকে কথা শেষ করতে দিলেন না। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন-' সাপ্লাই কারা করে?'
-'উৎপাদক'। সঙ্গীটি জবাব দিলেন।
পাশে বসা আর একজন বললেন, 'বাধা দিয়ে যদি উৎপাদন হতে না দেয়া হয়; যদি বাজারে আসতে না দেয়া হয়; তাহলে সরকারের কি কিছুই করার নাই?'
আলোচনায় অন্য একজন ঢুকলেন। ৪র্থ জন উৎসাহিত হয়ে বললো, "এটাইতো সিন্ডকেট। সিন্ডকেট করে জিনিস পত্রের দাম বাড়ানো হচ্ছে।"
আলোচনা জন সমুদ্রে হারিয়ে গেল। কে একজন বললো 'এখানে সরকারের হাত আছে।'
-'সরকারের কি করার আছ?' অন্য একজন বিরোধিতা করলো। একজন জোর গলায় বললো- 'সিন্ডকেটের কাছে সরকার অসহায়।'
আলোচনায় আগ্রহ হারিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। ওয়াকওয়ের শেষ প্রান্তে বাঁধা ডিঙ্গিগুলোর কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলাম। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আলোচকরা সবাই চলে গেছেন। বুড়ো আর তার সঙ্গীটি তখনও বসে কি যেন আলাপ করছেন। কানে এলো 'তুমি তো জানো, আমি বিলাতে ছিলাম, ছেলের কাছে। কোন ঝামেলা নাই তবুও ভালো লাগলো না।' বুড়ো বলছেন। আমি দাড়াঁলাম।
-'জ্বী, তাতো জানি।' সঙ্গীটির জবাব।
-'তেলের দাম বিলাতেও বেড়ে ছিল। অন্য জিনিসপত্রের দাম কিন্তু বাড়েনি।' বুড়ো বললো।
-'তাই না কি?" অবাক হয়ে সঙ্গীটি জানতে চাইলো।
-'হ্যাঁ, দাম বাড়েনি। ' দৃঢ় স্বরে বুড়ো ঘোষনা দিলেন।
-'কেন বাড়েনি?' জানতে চাইলেন সঙ্গীটি।
বুড়োর উত্তর 'জানি না। জানি না কেন দাম বাড়েনি।'
আশ-পাশটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি দাড়িয়ে তাঁদের কথা শুনছি দেখে, মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালেন। কুশল বিনিময় হলো। পরিচয়ের পর বললাম- "কেন দাম বাড়েনি, তার একটা জবাব আমার কাছে আছে। জানি না আপনার পছন্দ হবে কি না।"
-'বলুন না, শুনি।'
তিনি সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যাটা জানতে চাইলেন। বুড়োর সঙ্গীটি দেরী হয়ে গেছে বলে উঠে পড়লেন। বাজার অর্থনীতির মূল্য বিষয়গুলো তুলে ধরলাম। বাজার অর্থনীতির ভিত্তি উৎপাদন, সরবরাহ, আইন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সক্রিয় সংগঠন। যে কেউ পণ্য তৈরী করে বাজারে আনতে পারবে। তৈরী বা বাজারে আনতে কোন বাধাঁ থাকবে না। এটা নিশ্চিত করবে আইন প্রয়োগকারী সংগঠন। এটা হলেই তা হবে বাজার অর্থনীতি।
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুড়ো বললেন, 'যদি সবাই এক সাথে সিন্ডিকেট তৈরী করে দাম বাড়ায়?'
-'দাম বাড়াতে হলে সরকারের কাছে কারণ দর্শাতে হবে।' আমি বললাম।
-'সরকারী লোককে ম্যানেজ করা কোন ব্যাপার হলো।' বুড়োর প্রত্যয়ী যুক্তি।
-'হয়তো বা হ্যাঁ, হয়তো বা না। সরকারকে ম্যানেজ করা সম্ভব হলেও ভোক্তা সংগঠন। কিভাবে ম্যানেজ করবেন। তাঁরা বিরোধিতা করলে কোন কিছুর দাম বাড়ানো সম্ভব নয়।' বললাম আমি। বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো 'কিভাবে?'
আমি বুড়োকে আমেরিকার একটা ঘটনা বললাম। ঘটনাটি আমেরিকার গরুর মাংসের দাম বাড়ানো নিয়ে। গরুর মাংস ব্যবসায়ী সংগঠন দাবী করলো গরুর মাংস উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। দাম বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনটি গরুর মাংসের দাম দ্বিগুন করার প্রস্তাব করলো। সরকার আংশিক মূল্য বৃদ্ধিতে রাজি হলেন। ভোক্তা সংগঠন মানলেন না। তাঁরা বললেন- 'এ দাবী যৌক্তিক নয়'। তারপরও উৎপাদনকারীদের সংগঠন দাম বাড়ালো। ভোক্তা সংগঠনটি সকলকে বেশী দামে মাংস কিনতে নিষেধ করে ব্যাপক প্রচার প্রচারনা শুরু করলো। ১ম দিন, বাজারে থলে হাতে ক্রেতা গরুর মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে চলে গেল। মাংস ব্যবসায়ী সংগঠন অভয় দিল 'এটা সামায়িক। আমেরিকানরা গরুর মাংস খাবে না, এটা হতে পারে না। দু'দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।' মাংস কেনা বন্ধ রইল আগের মত। একই অবস্থা চলতে থাকলো। অবশেষে মাংস ব্যবসায়ী সংগঠন বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে নিল।
-'এটা সত্যি ঘটনা?' বুড়ো জানতে চাইল।
-'হ্যাঁ, আমি বললাম।
-'তাঁরা পারলে আমরা পারছিনা কেন?' বুড়ো জিজ্ঞাসা করলো।
-'জানি না।' বললাম আমি। 'এতক্ষণ আপনাকে একটা সত্যি ঘটনা বলেছি। এবার একটা গল্প বলি।' গল্পটা শুরু করলাম।
বুড়ো হাসি মুখে আমাকে সম্মতি জানালেন। গল্পটা আমার বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। বন্ধু বিদেশে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে এসেছেন। একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চান। জিনিষটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিদেশেও রফতানী করা যাবে।
কারখানা করার জন্য সরকারের অনুমতি দরকার। অনুমতি পাওয়া গেল না। কারণ কি? আমার বন্ধুটি জানেন না। সেও নাছোড় বান্দা। দেন-দরবার চলতে থাকলো। টাকা হলে অনুমতি মিলতে পারে বলে তাঁকে ঐ অফিসের একজন কর্মচারী জানালো। তিনি সোজা গেলেন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের বড় কর্মকর্তার কাছে। জানতে চাইলেন-' আপনি চাকুরী করেন। বেতন পান। নিজের টাকা দিয়ে পরিশ্রম করে কারখানা করবো আমি অনুমোদন দেয়া আপনার কাজ। এজন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে কেন?
অনুমোদনকারী হাঁ হাঁ করে হেসে বললেন- 'বাজার অর্থনীতি, মিয়া, বাজার অর্থনীতি।'
বন্ধুটি ভয় পেয়ে বললেন 'বাজার অর্থনীতি কি করলো?'
জবাবে অনুমোদনকারী জানালেন, " এদেশে সব কিছুই পণ্য। চাকুরী একটা পণ্য। টাকা দিবেন, কিনবেন। কিনেছি তাই চাকুরী করি। সেবাও তেমনি। আপনি অনুমোদন পেতে চান। এটাও একটা পণ্য। টাকা দিবেন কিনবেন।"
বন্ধুটি লা জবাব। কি করবেন ভেবে মরছেন। এমন সময় কর্মকর্তাটি কড়া ধমকের সুরে বললেন 'বাজার অর্থনীতির সামান্য বিষয়টিও বোঝেন না। কারখানা দিতে এসেছেন। যান মিয়া আমার সময় নষ্ট করবেন না।' বন্ধুটি আর অপেক্ষা করেননি। কয়েকদিন পর আমেরিকার ভিসা নিয়ে আবার সেখানে ফেরৎ গেলেন। এখন আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। মাঝে মাঝে মাটির টানে দেশে বেড়াতে আসেন। সেই আমাকে খুঁজে বাহির করে। আলাপ হয়। মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চায়, - 'এদেশে মানুষ কিভাবে বাস করে।'
আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। যার যা অভ্যাস। 'তুই, জানিস মাগুর মাছ কাঁদা পানি ছাড়া বাঁচে না। কাতলার দরকার পরিষ্কার পানি। কাতলাকে কাঁদা পানিতে রাখলে কাতলা বাঁচবে না।' বললাম আমি।
-'আইন, সংগঠন সবকিছু নিয়েই বাজার অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। আমাদেরকে এই পরিস্কার অর্থনীতিই উপহার দেয়া হয়েছিল। আমরা আমাদের অভ্যাস দিয়ে অর্থনীতিকে পাল্টিয়ে দিয়েছি। আর কি বলতে পারি আপনাকে' বুড়োকে বললাম। জবাবে বুড়ো ক্রুদ্ধ স্বরে বললো- 'অন্য রকম নয়, বলুন বাজাইরা অর্থনীতি। আইন নাই, আইনের প্রয়োগও নাই। সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এটা দেশ হলো?'
অনেক বেলা হয়ে গেছে। হাঁটার পথটা ফাঁকা। বসার জায়গা গুলো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের দখলে চলে গেছে। তারা জড়াজড়ি করে নিজেদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। চির বিদায় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দু'জন প্রৌঢ়ের উপস্থিতিতে তাঁদের কোন মাথা ব্যথা নাই। আমার কোন তাড়া ছিল না। বুড়োর সঙ্গে ভালই লাগছিল। তাই আলাপচরিতা চালিয়ে গেলাম।
-'আপনিও কি রিটায়ার্ড?' বুড়ো জানতে চাইলেন।
-'না। জবাবে বললাম।
-উঠার তাড়া নাই যে?' আবারও জানতে চাইলেন বুড়ো।
-'ওএসডি' -তাড়া নাই। অফুরন্ত অবসর।' আমি বললাম।
-'তাহলে কোন অসুবিধা নাই। বসেন, আরো কিছুক্ষণ গল্প করি। আমার বাসায় কেউ নাই। ছেলে-মেয়ে সব বিদেশে থাকে।' বুড়ো করুণ সুরে জানালেন।
-'ছেলে-মেয়েদের কাছে চলে যান। ভালো লাগবে।' পরামর্শ দিলাম।
-'গিয়েছিলাম তো। তারাও চায় আমি তাঁদের সাথে থাকি। পারলাম না। ভালো লাগে না। বড় যান্ত্রিক ওদের জীবন।' জবাব দিয়ে বুড়ো আকাশের দিকে চেয়ে রইল। বুড়ো এ দেশ নিয়ে খুশি নয়। বিলাতে গিয়েও থাকতে পারেন না। সেখানে তাঁর ভালো লাগে না। একটা শূন্যতা বুড়োকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
-"আপনি অর্থনীতি নিয়ে ভাবেন। তাই আপনাকে এটা গল্প শোনাতে ইচ্ছা করছে। একটা গল্প বলি। ভালো লাগবে।" বলে বুড়োর ধ্যান ভাঙ্গার চেষ্টা করলাম।
-'ঠিক আছে। বলুন।' বুড়ো সম্মতি দিলেন।
গল্পটা বাজার অর্থনীতি চালুর গোড়ার দিকের। দুই প্রতিবেশী পাশাপাশি বাস করতেন। একজন কমলা চাষী। তাঁর বেশ বড় একটা কমলার বাগান ছিল। অন্যজন মৌমাছি পালক। মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করতেন। দুজনে যেমন ভাব ছিল, তেমনি আবার ঝগড়াও করতেন। একজন উকিল তাঁদের পাশেই বাস করতেন। বাজার অর্থনীতির আইন কানুন তখন তৈরী হচ্ছিল। এ সব নিয়ে উকিলের সঙ্গে তাদের আলাপও হতো। মৌমাছি পালকের আয়-রোজগার কম ছিল। কমলা চাষীর কাছ থেকে সে প্রায়ই ধার-কর্জ করতেন। কমলা চাষী তাঁকে সময়ে অসময়ে কাছে পেতেন। তাই ধারকর্জ দিতে কোন দ্বিধা বোধ করতেন না। বদলে মৌমাছি পালক কমলা চাষীর অনেক অন্যায় আবদার শুনতেন।
একবছর মৌমাছি পালকের অনেক মধু হলো। মধুর দামও পেলেন খুব ভালো। এ সময় কমলা চাষী তার কাছে একটা অন্যায় আবদার করে বসলো। মৌমাছি পালক রাজী হলেন না। কমলা চাষী খুব রেগে গেলেন। তাকে শায়েস্তা করার জন্য পাশের বাড়ীর উকিল সাহেবের সংগে শলা-পরামর্শ করলেন।
'একটা মামলা ঠুকে দেন। আপনার বাগানের ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করেছে। নতুন আইনে এ মধুর ভাগ আপানার প্রাপ্য।' উকিল পরামর্শ দিলেন। যেই বলা সেই কাজ। কমলা চাষী মুধর ভাগ দাবী করে কোর্টে মামলা ঠুকে দিলেন। কোর্ট থেকে সমন জারী হলো। মধুচাষী সারা জীবন মৌমাছি নিয়ে থেকেছেন। আইন-কানুন, মামলা-মোকাদ্দমাকে ভীষণ ভয় করেন। তিনিও দৌড় দিয়ে গেলেন অন্যপাড়ার অন্য এক উকিলের কাছে। সব শুনে উকিল বললেন- 'কোন চিন্তা করবেন না। আমরাও মামলা ঠুকে দিব। আপনার মৌমাছির জন্য তার কমলা বাগানে ভালো পরাগায়ন হয়েছে। তাই বেশী কমলা হয়েছে। নতুন আইনে এর ভাগ আপনারও প্রাপ্য। ২য় উকিল মৌমাছি পালককে আশ্বস্থ করলেন।
দুটি মামলাই আদালতে চলছিল। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে কমলা চাষী তাঁর কমলা বাগান উকিল সাহেবের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। উকিল সাহেব তাঁর কমলা ফলের ভালো পরাগায়নের জন্য মৌমাছি আর বক্সগুলোও কিনে নিয়েছেন। কমলা চাষী ও মৌমাছি পালক দুজনেই উকিলের ফার্মে চাকুরী করা শুরু করেছেন।
গল্পটা শেষ হলে বুড়ো মুচকি হেসে বললেন- 'তাহলে আমাদের একে বারে নিরাস হওয়ার কারণ নাই। ঠেঁকায় পড়ে হলেও শিখাবো।' উত্তরে বললাম 'একমাত্র ভবিষ্যতই জানেন।'
অফিসে যেতে না হলেও বাজার-ঘাট করতে হয়। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আর গল্প করা যায় না।
'ভাইজান, এবার উঠতে হবে যে।' আমি বললাম।
বুড়ো তৃপ্তি নিয়ে বিদায় নিলেন। এখনো নিয়মিত হাটি। বুড়োকে বসে থাকতে দেখেছি কয়েক দিন। কথাবার্তা হয়নি।
বুড়োকে ওয়াকওয়ের পাশে আর দেখি না। হয় দেশ ছেড়ে ছেলেমেয়ের কাছে বিলাত চলে গেলেন। কে জানে হয়তো পৃথিবী ছেড়েই গেছেন। বাজাইরা অর্থনীতি তাঁকে আর কোনদিন ধরতেও পারবে না।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||
We have 111 guests and no members online