ঘরে ফেরা

Category: Bangladesh Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 7571

অফিস, বাজার, বিদেশ থেকে ঘরে ফিরি। এ ঘরে ফেরা কোন অনুভূতি সৃষ্টি করে না। তবুও যান্ত্রিক এই ঘরে ফেরাও লক্ষণীয়। ৫টার আগেই কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ গুটানো শুরু করেন। ঠিক পাঁচটায় অফিস গেইটে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা। একটা গাড়ী অফিসের কাজে বাহিরে গেছে। পাঁচটার পরও ফিরছে না। ও গাড়ীর যাত্রীদের অন্তহীন অভিযোগ। উপ-সচিব, সাধারণের অভিযোগ শুনতে শুনতে অতীষ্ঠ হয়ে অনুযোগ;
'আমি কোন কথা শুনবো না। আজই সব গাড়ী বন্ধ করে দিবো।' অনুযোগ করলেও গাড়ী বন্ধ হয় না। অভিযোগ অনুযোগ নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের ঘরে ফেরা। দেশেই ট্যুর থেকে ঘরে ফিরি। বিদেশ থেকে ঘরে ফেরা একটু আলাদা। ঘরে ফেরার সময় আত্মীয়-স্বজন মাঝে মধ্যে এয়ারপোর্টে রিসিভ করে বিদেশ থেকে ঘরে ফেরার সুযোগ আমার অনেকবার হয়েছে। ১ম বার বুলগেরিয়ায় পড়াশুনা করতে ৭৪ সালে বিদেশ গেলাম। টানা ৭ বছর ঘরে ফেরা হয়নি। ৮২ সালে ঢাকা আসলাম। ৭ বছর ঘরে ফেরা হয়নি; কোন তাড়া ছিল না। ঢাকা এসেই আর সহ্য হচ্ছে না। মনে মনে বললাম,
'ঢাকায় এক রাতও নয়। আজকেই ঘরে ফিরতে হবে।'
ফিরবো কি করে? আমার লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে না। টিকিট, লাগেজ, স্লিপ নিয়ে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে আর একজনের কাছে ছোটাছুটি করছি। সবার এক জবাব,
'অভিযোগ করেন। আমরা দেখবো। ক'দিন পরে এসে খবর নিবেন।'
কিছু কথা খরচ হলো, সময়ও চলে গেল। কোন লাভ হলো না। লাগেজ হারানোর অভিযোগ করে বিমানবন্দর ছাড়লাম। খালি হাত-পা নিয়ে ঘরে ফিরবো। কোন অসুবিধা নাই। বাস না থাকলে কি হবে? ট্রাকে বা কাঁটা বাসে ঢাকা থেকে আরিচা গেলাম। নগরবাড়ী ঘাটে পৌঁছলাম সন্ধ্যাবেলা। লঞ্চে নগরবাড়ী পৌঁছালাম। ৮টা বাজে, বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র উপায় নগরবাড়ী ঘাটের চিৎকাৎ বোডিং-এ রাত কাটানো। মাঝে মধ্যে দু'একটা ট্রাক চলছে। নিজেকে বললাম,
'ঘরে ফিরবো যখন ঠিক করেছি। তখন ঘরেই ফিরবো। চিৎকাৎ বোডিং-এ কিছুতেই নয়।'
একটা ট্রাক নগরবাড়ী ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখেই ট্রাক ড্রাইভারকে ধরলাম।
'ভাই, আমি বিপদে পড়েছি। রাজশাহী যাবো। আপনি কোথায় যাচ্ছেন।'
'আমিও তো রাজশাহী যাবো। কিন্তু আপনাকে যে নিতে পারবো না' - ট্রাক ড্রাইভারের সোজা জবাব।
'কেন ভাই? আমি তো ভাড়া দিবো।' - অনুরোধের সুরে বললাম।
'ভাই, আমার সাথে হেলপার আছে। এছাড়াও আপনার মত দুইজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। আপনাকে বসতে দিতে পারবো না।' ট্রাক ড্রাইভার তাঁর কারণ দর্শালো।
আমি হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছি। এমন সময় হেলপার ছোকরা বললো,
'আমি ট্রাকের মালের উপর বসে যাবো। আপনার ইচ্ছা হলে আমার সাথে মালের উপর বসে যেতে পারেন'। প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। বললাম,
'আমি রাজি। এভাবেই যাবো'।
'পঞ্চাশ টাকা লাগবে'। হেলপার জানালো।
রাজী হয়ে গেলাম। ৭ বছর ইউরোপের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষে ঘরে ফেরার নেশায় ট্রাকের হেলপারের সাথে মালের উপর চেপে বসলাম। হেলপার সাথী পেয়ে মহাখুশি। বললো,
'আপনারা ভদ্রলোক। এভাবে যাওয়া-আসা করার অভ্যাস নাই। ভালো করে রশিটা ধরে রাখবেন। না হলে বিপদ হতে পারে'। হেলপার আমাকে সাবধান করে দিলো।
উপদেশের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। শক্ত করে দঁড়িটা ধরে আছি। ট্রাক চলছে। বেপরোয়া বাতাস এসে শরীরটাকে ধাক্কা মারছে। হঠাৎ বড় একটা ঝাঁকি খেলাম। ড্রাইভার কষে ব্রেক মেরেছে। হেলপারটা এক হাত দিয়ে আমাকে সামলাতে চেষ্টা করলো্
'ট্রাক থামলো কেন?' হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলাম।
'ওস্তাদ পেশাব করবে'। দাঁত বাহির করে হাসতে হাসতে জানালো।
ড্রাইভার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেশাব শেষে ট্রাকে উঠলো। ট্রাক চলছে।
'বিড়ি খাবেন।' বলে একটা কুন্ডু পাতার বিড়ি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো হেলপার ছোকরা।
রাগ হলো। আবার ভালো লাগলো তার 'কেয়ারিং এন্ড শেয়ারিং' এর জন্য। ৭ বছর ইউরোপে ছিলাম। পরতো দুরের কথা আপন লোকদের জন্যও ওরা কোন কিছু করে না। একা একা লং ড্রাইভিং-এ যেতে ভালো লাগে না। একজন সংগী দরকার। রাস্তায় দাড়িয়ে হাত তুললেই তাঁকে তুলে নিবে। এটাকে তারা 'কেয়ারিং' দাবী করে। চালক তাঁর একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য এ 'কেয়ারিং'-এ অভ্যস্থ। শেয়ারিং, তাঁদের মাঝে খুব একটা নজরে আসে না।

আমি তখনও চেইন স্মোকার। পকেটে 'স্টোয়ারদেশা' ব্রান্ডের বুলগেরিয়ান সিগারেট রয়েছে। অনেকক্ষণ হলো সিগারেট টানিনি। তাঁর অফারটা নিতে ইচ্ছে করলেও কুন্ড পাতার বিড়ি টানার সাহস হলো না। পকেট থেকে প্যাকেটটা বাহির করে তাঁকে একটা সিগারেট দিলাম। তাঁর চোখ দু'টো জ্বল জ্বল করে উঠলো। একটা সিগারেট বাহির করে তাঁকে দিয়ে বললাম,
'বাতাসে ধরাতে পারবো না। তুমি একটা ধরাও। একটা আমাকে ধরিয়ে দাও।'
'ঠিক আছে, ওস্তাদ।' মহাখুশি হয়ে জবাব দিলো।
তাঁর সাথে বাকি সময় গল্প করতে করতে কাঁটালাম। তাঁর বাড়ী কোথায় সে জানে না। পথে পথে ট্রাকের সাথে দিন কাটে। ঘরে ফেরার কোন তাড়া নাই। রাজশাহী পৌছলাম রাত একটায়। আরও ২০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। ট্রাক আর যাবে না। ৫০ টাকা, সাথে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম।

ভাগ্য ভালো বলতে হবে। রাস্তার পাশে একটা বেবি ট্যাক্সি দাড়ানো। ড্রাইভার ভিতরে আধা ঘুমে। তাঁকে জাগালাম। বেবি ট্যাক্সিওয়ালার জিজ্ঞাসা,
'কোথায় যাবেন।'
'গোদাগাড়ী'। বলার সাথে সাথে জবাব, 'না! এত রাতে এত দূর যাবো না।'
আমি তাঁকে আমার অবস্থা জানিয়ে অনুরোধ করলাম। মনটা গললো। সে জানালো,
'যাওয়া-আসার ভাড়া দিলে সে যাবে।' ৭ বছর দেশে ছিলাম না। যাওয়া-আসার ভাড়া জানা নাই। জিজ্ঞাসা করলাম, 'যাওয়া-আসার ভাড়া কত?'
'দেড়শো টাকা'। নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিলো। কোন গত্যান্তর ছিল না। রাজি হয়ে গেলাম। রাত ২টায় ঘরে ফিরলাম। অনেক হাংগামা করে দরজা খুলালাম।
৭ বছর পর খালি হাত-পা নিয়ে বিদেশ থেকে ঘরে ফিরলাম। ঘরে ফেরায় খুশি হলেও খালি হাত অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। বিষয়টা ক'দিন পর বেশ ভালোভাবে টের পেলাম। বেশীদিন ঘরে থাকা হলো না। আবার ঘর ছাড়লাম। ঢাকায় মেসে থাকি। মাঝে মধ্যে ঘরে ফিরি। এ ঘরে ফেরার তেমন কিছু বলার নাই। ঘরে ফেরার আসল রূপ রস টের পেলাম ঈদে। প্রতি ঈদে ঘরে ফিরি। মেসে মিনু, আবু তাহের, ফজলু একসংগে থাকি। ফজলুর বাড়ী নোয়াখালী। সে ঈদে ঢাকায় থাকে। তাঁর অবস্থা ট্রাকের হেলপারের মত। ঘরে ফেরার কোন তাগাদা নাই।

মিনু, তাহের, আমার বাড়ী গোদাগাড়ী। প্রতি ঈদে আমাদের ঘরে ফেরার তাগিদ থাকে। ঈদে মা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের এক সাথে কাটাতে হবে। তাহের-এর কাজ, ঈদের অগ্রীম টিকিট কবে বিক্রি শুরু হবে, এ খোঁজ-খবর রাখা। মিনু রাত ৪টায় টিকিটের লাইনে দাঁড়াবে। মিনু আছে মানে টিকিট আছে। মিনু কোনদিন টিকিট ছাড়া ফিরেনি।

যমুনার উপর 'বঙ্গবন্ধু' ব্রিজ তখনও হয়নি। রাজশাহীর গাড়ী সকালবেলা ছেড়ে যায়। ৮ ঘন্টা পর রাজশাহী পৌছে। ফেরীতেই লাগে ৩-৫ ঘন্টা। ফেরি না পেলে ৩৪ ঘন্টা লাগার ইতিহাসও আছে।

একবার বাসে ঈদে ঘরে ফিরছি। সিটের মাঝখানে মোড়া বসানো হয়েছে। মোড়ার ফাঁকে ফাঁকে গাদাগাদা দাঁড়ানো মানুষ। নয়ারহাট টোল প্লাজায় বাসটা থামলো। চোখের সামনে আমার ব্যাগটা নিয়ে একজন দৌড় দিলো। ধর ধর বলে চিৎকার দিলাম। কোন কাজ হলো না। নিজে বাহির হবো এ উপায়ও ছিল না। মানুষের জ্যামে আমি আটকা পড়ে শুধু তাকিয়ে দেখলাম। আরও একবার খালি হাতে ঘরে ফিরলাম।

মিনু একটা কোম্পানীতে চাকুরী নিয়ে বগুড়ায় গেলো। তাহের মেরি স্টপস্ ক্লিনিকে চট্টগ্রামে। ঈদে ঘরে ফেরার টিকিট সংকট দেখা দিলো। একবার কোনভাবেই টিকিট পেলাম না। অগত্যা কাঁটা বাসে, ঢাকা-আরিচা, আরিচা-পাবনা, পাবনা-রাজশাহী করলাম। পাবনা পর্যন্ত ভালো ভালোই চলে এলাম। ঝামেলা বাঁধলো পাবনা-রাজশাহীর মাঝ পথে। বনপাড়ায় বাসটা একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি লাগলো। পাঁচ জন স্পটেই মারা গেল। হাতে পায়ে জখম। ঈদের আগের দিন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেউ রেখে গেছে। সংগের ক্যামেরা ব্যাগ কোথায় কে নিয়ে গেছে জানি না। ঈদে ঘরে ফেরা হলো না। ঈদের তিনদিন পর আবারও খালি হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘরে ফিরলাম।

১৯৮৪ সাল হতে ঢাকা-রাজশাহী নাইট কোচ চালু হলো। মাঝে মধ্যে নাইট কোচেই ঘরে ফিরি। বিয়ে করেছি। ঈদে বউ ছেলে মেয়ে বাড়ী যায়। একবার বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে বাড়ী যাচ্ছি। আগেই অফিসের লোকজন দিয়ে টিকেট কাটলাম। গাড়ী সকাল ৭টায় গাবতলি ছাড়বে। ঈদে এক সিটের টিকিট দুই তিন বার বিক্রি হয়। যে আগে দখল করে সে বসে। বাকিদের ভাগ্য ভালো হলে মোড়া, তা না জুটলে দাঁড়িয়ে যায়। এ নিয়মের ব্যতিক্রম এবারও হবে না। তাই ৬টায় গাবতলী গিয়ে হাজির হলাম। বাস লাগেনি। হাজার হাজার যাত্রী দাঁড়িয়ে। আরিচা নগরবাড়ী ঘাটে জ্যাম। ৮টায় বাস লাগলো। বাসে উঠে সিট দখল করলাম। প্রায় প্রতিটি সিটের ডবল টিকেট বিক্রি হয়েছে। আমাদের সিটেরও একাধিক টিকেট। ভাগ্য ভালো আগে সিট দখল হয়েছে। সিট নিয়ে বাক-বিতন্ডা। আগে দখলকারীর সিট, কিছু মোড়া আর বাকিরা দাঁড়িয়ে রইল। ৮টার গাড়ী ১০টায় ছাড়লো।

মানিকগঞ্জের উথলী পার হতেই বিকাল ২টা। গাড়ী নড়ে না। সন্ধ্যা হলো। সংগে যা কিছু ছিলো তা আগেই শেষ। রাস্তায় রুটি-কলা পানি কিছুই জুটছে না। পানি খাবার ছাড়াই কাটলো। রাত ২টায় ফেরী মিললো। ভোর ৫টায় নগরবাড়ী ঘাটে আসলাম। ৮টায় পাবনায়, ঈদের জামাত হচ্ছে। ড্রাইভার থামাতে রাজী ছিলো না। যাত্রীদের দাবী মানতে হলো। কিছু যাত্রী ঈদের জামাতে অংশ নিলো। অবশেষে ৩৪ ঘন্টা পর পরদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলাম। ঈদ অনেক আগেই পার হয়ে গেছে।

অন্য একবারের ঘটনা। বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে নাইট কোচে বাড়ী ফিরছি। ভাগ্য ভালো পথে তেমন কোন ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হলো না। বাসটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবে। আমাদের ডাংগপাড়ায় নামতে হবে। ভোর ৪:৩০ মিনিট। চোখে তন্দ্রাভাব। ডাংগপাড়া পার হয়ে দু'মাইল দূর সারাংপুর চলে এসেছি। টের পেয়ে নামলাম। রাতে বাচ্চা-কাচ্চা, পোটলা-পাটি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলো। এ অবস্থায় একটা গরুর গাড়ী আমাদের উদ্ধার করলো। গাড়ীটি ডাংগপাড়া হয়ে মাঠে যাবে। গাড়ীয়াল আমার পরিচিত। ব্যাগ, বাচ্চা, বউকে নিয়ে গরুর গাড়ীতে উঠলাম। ডাংগাপাড়ায় এসে নেমে গাড়ীয়ালকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরলাম। নিজের বাড়ী চিনতে পারিনি, এ খোটা আমার বউ মাঝে মধ্যে আজও দেয়। তাদের এ সুবাদে গরুর গাড়ীতে চড়ার সুযোগ হলো। আগে কোনদিন গরুর গাড়ীতে চড়েনি।

উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতির কিছুদিনের পর এনজিও বিষয়ক ব্যুরের পরিচালক হলাম। গাড়ী নিয়ে যাতায়াত করি। এরপর হতে ঘরে ফিরতে তেমন অসুবিধা হয়নি। পরবর্তী পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম-সচিব হয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরের একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক যোগ দিলাম। তারপর থেকে একটা পাজেরো গাড়ী আর ড্রাইভার আমিনুল আমার নিত্যদিনের সাথী। তাঁকে নিয়ে ঘরে ফিরছি। কালিয়াকৈর বাজার থেকে টাংগাইল পর্যন্ত জ্যাম। কখন ছাড়ে তার কোন মাথা মুন্ডু নাই। বামদিকে একটা কাঁচা রাস্তা। আমিনুলকে বললাম,
'আমিনুল, কাঁচা রাস্তা দিয়ে চালান। না হলে ঘরে ফিরা হবে না'।
আমিনুলের আদেশ পেলেই হয়। কোন রা করে না। কাঁচা রাস্তায় গাড়ী নামিয়ে দিয়েছে। এর মাঝে জবাব দিলো, 'জ্বী, আচ্ছা। স্যার।'
ধানক্ষেত মাঠ দিয়ে জ্যাম পার হয়ে টাংগাইল-এর কাছে এসে মেইন রোডে উঠলাম। কোন জ্যাম নাই। তারপর সোজা ঘরে।

ছোট ভাই, তার বউ ছেলেমেয়ে, মা গোদাগাড়ীতে থাকে। বড় ভাই ইলিয়াস বেঁচে থাকতে প্রতি ঈদে আসতো। সে মারা যাওয়ার পর ভাবী মাঝে মধ্যে মেয়ে দু'টিকে নিয়ে গোদাগাড়ী আসতো। বড় ভাই-এর মেয়েরা চাকুরী করে। বিয়ে হয়েছে। ভাবী তাঁর মেয়ে জামাই নাতনীকে নিয়ে রাজশাহীতে মেয়ের বাসাতেই থাকেন। গোদাগাড়ী খুব একটা আসেন না।

আমার ছোট ভাই শফিক। রাজশাহীতে চাকুরী করে। তাঁর বউও চাকুরে। তাঁর শ্বশুরবাড়ীও রাজশাহীতে। সেও ঈদের আগে আসে না। ঈদ শেষে কখনও মেয়েদের নিয়ে, কখনও একলা মার সাথে দেখা করে যায়।

আমার ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে গেছে। দেবযানীর বিয়ে হয়েছে। ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। পরীক্ষা, নানা কারণে আগের মত সবাইকে নিয়ে ঘরে ফেরা হয় না। তারপরও বাংলাদেশে থাকলে আমি একা ঈদে এখনও নিয়মিত ঘরে ফিরি। জানি না এ ঈদে ঘরে ফেরা হবে কি না? যাওয়া না হলে মা কাঁদবে।

এত যন্ত্রণা, এত বিড়ম্বনা সবকিছু নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। নাড়ীর টানে। গোদাগাড়ী আমাকে টানে। আমি ঘরে ফিরি। আমার ছেলেমেয়েরা কি ঈদে গোদাগাড়ী যাবে? জানি যাবে না। তাঁদের নাড়ীর কোন টান নাই। গ্রামের গরম মাটিতে বৈশাখের বৃষ্টির সেঁদো গন্ধ তাঁদের টানে না। তাঁদের মা, বন্ধু-বান্ধব গোদাগাড়ীতে নাই। তাঁরা সেখানে যাবে কেন? তাঁরাও তো তাঁদের মা-বাবার কাছে থাকতে চায়। আমি তাঁদের বাবা। আমি মার কাছে যাবো। তাঁরাও তো তাঁর বাবাকে চায়। এ দ্বন্দ্ব আমাকে কুঁরে কুঁরে খায়। অনেক চিন্তা ভাবনার পর ছেলে দ্বিপাঞ্জনকে বললাম,
'বাবা, তুই তোঁর মার সাথে ঢাকায় ঈদ কর। আমি গোদাগাড়ীতে আমার মায়ের সাথে ঈদ করি।'

তাঁরা জানে, আমাকে, কিছুতেই আটকাতে পারবে না। তাই কখনো কোন ওজর আপত্তি করেনি। আমি আজও সব বিড়ম্বনাকে দু'হাতে সরিয়ে ঘরে ফিরি। ঘরে ফেরার তাগাদা না দেখলে বউ বাচ্চারা জিজ্ঞাসা করে,
'তুমি গোদাগাড়ী যাবা না।' জবাবে বলি, 'দেখি'।

আমার বউ-এর ছোট ভাই মামুন। এখন কানাডা প্রবাসী। কানাডা যাওয়ার আগে ঢাকায় থাই দুতাবাসে চাকুরী করেছে। ছুটি পেতে তাঁর অসুবিধা ছিলো। সবকিছুকে ম্যানেজ করে সেও আমার মত চাঁদপুর মায়ের কাছে ছুটে যেতো। বিয়ে করার পরও এর কোন পরিবর্তন হয়নি।

কানাডা থেকেও তাঁর ঘরে ফেরার আকুতি অনুভুব করি। কোন একটা উপলক্ষ পেলেই ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে। তাঁর ছোটটা মাসুম, সিংগাপুরে চাকুরী করে। সে পারলে প্রতি মাসেই একবার আসে। তাঁর টেলিফোন পেলেই জিজ্ঞাসা করি,
'তুমি কোথায়? সিংগাপুর, না ঢাকায়?'
সে হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয়,
'আমি তো একটা চাকুরী করি। এভাবে এত ঘন ঘন কি ঢাকায় আসতে পারি'।
আসতে না পারলেও নাড়ীর টানে ঘন ঘন টেলিফোন করে খোঁজ-খবর নিতে কোনদিন ভুল করে না। ওরা দুজনাই নিয়মিত টেলিফোন করে ঢাকা, চাঁদপুরে।

আমি ঘরে ফিরার জন্য ব্যাকুল, আমার ছেলেরা নয় কেন? ভাবনাগুলো আমাকে তেঁড়ে নিয়ে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে ভাবি, আমার ঘর আমার ছেলের ঘর বোধ হয় আলাদা। আমি যে ঘরে ফিরতে চাই, সে ঘর বোধ হয় আমার ছেলেমেয়েদের নয়। ছেলেরা আমার ঘরে যাবে কেন? তাঁরাও তো আমার মত তাঁদের ঘরে ফিরতে চায়।

মামুন চাঁদপুরে আসতে চায়। নাড়ীর টানে। তাঁর ছেলে আব্রার কি আসবে কানাডার বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে। আমি জানি না, হয়তো হ্যাঁ, হয়তোবা না। এটাই বোধ হয় জীবন। তাই আমরা মেনে নিই। মেনে নিয়েছি।

কয়েকদিন পর ঈদ। প্রতিদিন টিভি রিপোটিং হচ্ছে। দেখছি বাস ট্রেনের টিকেটের জন্য উপচেপড়া ভিড়। সারারাত ধরে লাইনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ঘরে ফেরার তাগিদে। হতাশা আর উদ্বিগ্নতা তাঁদের গ্রাস করে রেখেছে। টিকিট মিলবে কি? ঘরে ফেরা হবে তো?

সবার মুখে অনুযোগ অভিযোগ। টিকিট কালোবাজারী হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ মালিক অস্বীকার করছেন। কে সঠিক? কে জবাব দিবে?

৩০ বছর আগের ঘরে ফেরার আকুতির সাথে আজকের আকুতির কোন তফাৎ নাই। ৩০ বছর আগের বিড়ম্বনা আজও আগের রয়ে গেছে। তবুও আমাদের ঘরে ফিরতে হবে। আমরা ঘরে ফিরতে চাই।