ইন্টারভিউ

Category: Interview Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6690

ইন্টারভিউ শব্দটা কয়েক দিন থেকে আমাকে বিচলিত করছে। অকারণেই মাথায় একটা প্রশ্ন। ইন্টারভিউ-এর বাংলা শব্দ কি?
‘‘- সাক্ষাৎকার।’’
এটা তো সবাই জানে। হ্যাঁ আমরা ইন্টারভিউ-এর বাংলা হিসাবে সাক্ষাৎকার শব্দটা ব্যবহার হচ্ছে। যুৎসই মনে হয় না। জ্ঞানী বন্ধুকে হাতের কাছে পেলেই জিজ্ঞাসা করি;
‘‘- ইন্টারভিউ-এর বাংলা শব্দ কি? ’’
ড. নাসিম আমার বন্ধু। বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স, পিএইচডি করেছে। জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্তব বিভাগের শিক্ষক। শুনেছি দেশ ছেড়েছে। দেশ ছাড়ার আগে মাঝে মধ্যে বাংলা একাডেমিতে আমতলায় আড্ডায় বসতো। কোন কোন দিন এ আড্ডা রাত ১২টা গড়িয়ে যেত। আড্ডা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ ওরই সবচেয়ে বেশী ছিল। আড্ডা চলছে। ১০টা তখনও বাজেনি। হঠাৎ নাসিম জানান দিলো;
‘‘- আজ বেশীক্ষণ আড্ডা দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। ’’
আমরা সবাই অবাক। যে জোর করে আড্ডা চালিয়ে যায়, সেই বলে আড্ডা দেয়া যাবে না। সবাই এক সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
‘‘- আজ এ কি শুনি।’’ জবাবে নাসিম জানালো।
‘‘- ঠিকই শুনেছো। আজ আড্ডায় আমি থাকতে পারছি না। ’’ জানতে চাইলাম;
‘- কিন্তু কেন ভাই। ভাবী দেশে নাই। গালি দেবে কে?’’
জবাবে সে জানালো;
‘‘- ওটাই তো হয়েছে আমার কাল। পিএইচডি করতে আমেরিকা গেছে। ভালো, পড়াশোনা কর না।’’ জানত চাইলাম;
‘‘- মেজাজ খারাপ কেন ডাক্তার।’’ বিরক্তি ভরাকন্ঠে জবাব দিলো;
‘‘- তোঁর ভাবী চায় আমি যেন আমেরিকায় তাঁর কাছে যাই।’’ সবাই এক সংগে বললাম;
‘‘- এতো উত্তম প্রসত্মাব। তবে রাগ কেন।’’ জবাবে বললো;
‘‘- আমি তাঁকে বলেছিলাম, টিকিটের কথা। টাকার কথা। আমাকে কোন সুযোগ দেয়নি। বললো সেই দিবে।’’ আমরা বললাম;
‘‘- ডাক্তার সাহেব। রাগ করছেন কেন? এতো বড়ই খুশিকা বাত হাই।’’ জববে তিনি বললেন;
‘‘- হ্যাঁ খুশি হতাম। যদি ভিসার জন্য আমেরিকান এমব্যাসিতে লাইনে দাঁড়াতে না হতো।’’
‘‘- লাইনে দাঁড়াতে হবে কেন?’ জানতে চাইলে জবাব দিলো;
‘‘- ইন্টারভিউ নিবে। বুঝলে ওসত্মাদ। ইন্টারভিউ নিয়ে দেখবে আমি ওদের দেশে থেকে যাবো কি না? ক্ষ্যাতা পড়েছে আমার ওদের দেশে থেকে যাওয়ার।’’ ইন্টারভিউ শব্দটা শুনেই আমি নড়াচড়া দিয়ে বসলাম। হঠাৎ কোন প্রসংগ ছাড়াই জিজ্ঞাসা করে বসলাম;
‘‘- আচ্ছা ইন্টারভিউ এর বাংলা শব্দ কি?’’ প্রশ্ন শুনে রেগে;
‘‘- ফ্যাজলামো করা হচ্ছে না। ’’ জবাবে আমি বললাম;
‘‘- রাগ করিস না দোসত্ম। আমি সত্য সত্যই জানতে চাচ্ছি।’’ জবাবে আরো রেগে গিয়ে বললো;
-‘ কিসের মধ্যে কি, পামত্মা ভাতে ঘি।’ আজ বকবক করার সময় নাই। আগামী কাল ভিসা ইন্টারভিউ। থাকতে পারলাম না। চললাম।’’
আমরা নাসিমকে বাদ দিয়ে আড্ডাটা জমাতে পারছিলাম না। সবাই একে একে কেটে পড়লাম। অভ্যাস অনুযায়ী রমনা পার্ক হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আজকের রূপসীবাংলা-এর সামনে দিয়ে শুক্রাবাদে বাসায় ফিরছি, আর ভাবছি। ইন্টারভিউ মানে কি? সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়ে আমেরিকান এ্যামব্যাসির লোকজন বুঝবে কি করে যে, নাসিম আমেরিকা থেকে যাবে কি না? কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না যে ইন্টারবিউ মানে শুধুই সাক্ষাৎকার। এটা নিছক দেখা নয়। আরো বেশী কিছু। ভালো করে আরো ভিতরে, আরো গভীরে অনুসন্ধান করা। আমেরিকান এ্যামব্যাসি নাসিমের ভিতরে অনুসন্ধান চালাবে, দেখবে নাসিম আমেরিকায় থেকে যাবে কি না? অনুসন্ধানে যদি তাঁরা দেখতে পায়, নাসিম সেখানে থেকে যেতে পারে, তাহলে তাঁরা ভিসা দিবে না। অন্যদিকে ভিসা দিলে নাসিম ভাবীর কাছে আমেরিকা যাবে। ভাবী খুশি হবেন।
আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমেরিকানরা কি ভাবে বোঝে, কে আমেরিকায় থেকে যাবে; আর কে থাকবে না। তারা কোন ধরনের মেথোডলজি ব্যবহার করে? মনে মনে জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল। বাসার কাছে এসে গেছি। সব চিমত্মা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বাসায় গিয়ে মুখ, হাত ধুয়ে জামাকাপড় পালটিয়ে টেবিলে খেতে বসলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে অভ্যাস মত পড়ার টেবিল। টেবিল থেকে বিছানা, তারপর ঘুম। এভাবে ভালোই কেঁটে যাচ্ছিল।
অফিসে ব্যাচমেট কলিগ মাহবুবকে খুব চিমিত্মত দেখাচ্ছিল। ও আমার খুব ঘনিষ্ঠ কলিগ বন্ধুও। নিজেকে চেপে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম;
‘‘-তোকে খুব চিমিত্মত মনে হচেছ। ব্যাপারটা কি? ’’ জবাবে বললো;
‘‘- হ্যাঁ। কিছুটা চিমত্মা তো করছি। ’’ জানতে চাইলাম;
‘‘- কেন?’’
‘‘- ছোট বোনটাকে দেখতে আসবে। ’’ জবাব দিলো;
বুঝতে পারলাম। ছোট বোনটার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। পাত্র পক্ষ তাঁর বোনকে দেখতে আসবে। বললাম;
‘‘- খুব ভালো সংবাদ। এতে চিমত্মা কিসের? তোঁর বোন তো ফর্সা, লম্বা, পড়ছে, ভালো ছাত্রী। তাহলে চিমত্মা, কেন?
‘‘- তুই বিদেশে পড়ালেখা করেছিস, থেকেছিস। তোকে আমি বোঝাতে পারবো না। চিমত্মা করছি কেন? আমার মত একজন হলে তাঁকে কোন কিছু বোঝাতে হতো না। এমনিতেই বুঝে নিতো।’’
নিজের প্রতি ঘেন্না হলো। নিজের দূর্বলতাকে স্বীকার করে নিয়ে জানতে চাইলাম;
‘‘- ভাই আমি জানি, বিদেশে থাকার কারনে আমি অনেক কিছু বুঝিনা। দয়া করে আমাকে বুঝতে দে। বল চিমত্মা   কেন?’’
‘‘- ছেলেটা ভালোলেখা পড়া জানা। ভালো চাকুরী করে; ব্যাংকের অফিসার। তাঁর নিতুকে পছন্দ। তাতে কি? দেখতে আসবে গ্রাম থেকে ছেলের মা, বড় বোন। ’’ পরিস্থিতি তুলে ধরলো। আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম;
‘‘- তো কি হয়েছে? অসুবিধা কোথায়?’’
‘‘- এজন্যই তো বলেছিলাম তুই বুঝবি না। ভাই তাঁরাতো দেখবে না; ইন্টারভিউ নিবে।’’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে ব্যাখ্যা দিলো;
‘‘- আরে বুদ্ধু গ্রামের মানুষ কি জিজ্ঞাসা করবে তুই জানিস? ’’ জবাব দিলাম;
‘‘- না।’’
‘‘- জানতে চাইবে কলার মোঁচা রান্না করতে কি কি মসলস্না লাগে।’’ নিতু তো কোনদিন কলার মোঁচাই দেখে নি।’’
‘‘- নিতু বলবে, জানে না। ব্যাস হয়ে গেল।’’ আমি মমত্মব্য করলাম।
‘‘- ব্যাস হয়ে গেল। এর পর তাঁরা নিতুকে বউ হিসাবে পছন্দ করবে?’’
‘‘- কেন করবে না? ’’ জানতে চাইলাম;
‘‘- আমি তোঁকে এটা বোঝাতে পারবো না। এটাই শেষ নয়। তারা বলতে পারে,
‘‘- একটু হাঁটোতো মা। পা দেখি, ইত্যাদি ইত্যাদি।’’
আমি বললাম;
‘‘- এতে অসুবিধা কি?’’
‘‘- তুই তো নিতুকে চিনিস। বেঁকে বসতে পারে। তা হলে ভালো পাত্রটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সে তার কষ্ট জানালো।’’
বুঝলাম অসুবিধাটা কোথায়। পাত্রের মা তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশ্ন করবেন। পাত্রীর যোগ্যতা পরখ করবেন। যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে না পারলে সে পাত্রস্থ হবে না। পাত্রের মা পাত্রের চাহিদা জানে না, বা জানতে বা বুঝতে চায়না। ফলে পাত্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্ন হবে না। প্রশ্নগুলো সব পাত্রের মা এর চাহিদা অনুযায়ী। পাত্রের মা এর চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নের জবাব নিতুর জানা নাই। পাত্রী পাত্রের যোগ্য হলেও প্রশ্নগুলোর কারণে পাত্রী যোগ্য হবে না। পাত্রের মা এমন একজন পাত্রী খুঁজছেন যে তাঁর যোগ্য। তিনি ছেলের যোগ্য প্রার্থীর ইন্টারভিউ নেয়ার যোগ্য নন। এ পরিস্থিতিতে সামত্মনা দেয়া ছাড়া কিছুই করার নাই। বললাম;
‘‘- দেখ এসব কিছুই হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ’’
‘‘- তাই যেন হয়। ’’
কয়েক দিন পর জানতে পারলাম। পাত্রের মা, বড় বোন নিতুকে দেখে গেছেন। সে দিন তাঁরা ভালো মন্দ কিছু জানাননি। পরে তাঁদের অপছন্দের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
নান্নু বয়সে ছোট হলেও বন্ধু প্রতিম। আড্ডার নিয়মিত অংশীদার। আড্ডার ফাঁকে একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো;
‘‘- বড় ভাই, আপনি তো জানেন আমি একটা বাইং হাউজ দিয়েছি। আমাকে কয়েকজন লোক নিয়োগ করতে হবে। বলেন তো কি করতে হবে।’’
জবাবে বললাম;
‘‘- কোন পদে লোক নিবেন। কি যোগ্যতা হলে আপনার চলবে ঠিক করে আবেদন চান। আবেদন পাওয়ার পর লিখিত আর মৌাখিক পরীক্ষা নিয়ে লোক ঠিক করে ফেলেন।
জবাবে নাঁন্নু জানালো;
‘‘- বড় ভাই, আমার বড় বড় মাথাওয়ালা লোক দরকার নাই। আমার দরকার যে কাজ করে, করিয়ে আনতে পারবে। ’’
নানঁণুর কাছে হাঁসির ছলে জানতে চাইলাম;
‘‘- কেমন লোক চান। ’’ নান্নু জবাব দিলো;
‘‘- উপস্থিত বুদ্ধি আছে। কাজ করতে পারবে। ’’
‘‘- আর কোন যোগ্যতার দরকার নাই।’’ জিজ্ঞাসার জবাবে নান্নু বললো;
‘‘- বাইং হাউজে অনেক জিনিষ নয়ছয় করতে হয়। তা না হলে আমাদের চলে না। বিশেষ করে একাউন্টস্ অফিসার যদি নয়, ছয় করতে না জানে তা হলে আমার একদম চলবে না। ’’
সরকারী চাকুরী করার সুবাদে আমাকে প্রায় ইন্টারভিউ বোর্ডে বসতে হয়। পরীক্ষাপত্র তৈরী মডারেশনের দায়িত্বও পড়ে। যে পদেই লোক দরকার হোক প্রশ্ন পত্র এক ও অভিন্ন। বাংলা, ইংরেজী, অংক, সাধারণ জ্ঞান। টিকা, প্যারাগ্রাফ: কারেকশন, সঠিক প্রিপজিশন বসানো, এক কথায় প্রকাশ, সুদকষা, উৎপাদকে বিশেস্নষণ, সমাধান ইত্যাদি ইত্যাদি; লিখতে করতে বলা হয়। সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন তো আরও হাঁসির।
-‘ পানিপথের যুদ্ধ হয়েছিল কবে?’
এ প্রশ্ন দিয়ে আমি তাঁর ভিতরের কি দেখতে চাই। এটা জানা না জানায় তাঁর গুণাবলী, দক্ষতার কোন আভাস পাওয়া যায়, আমি বিশ্বাস করি না। তাই এ ধরনের কোন প্রশ্ন এলেই বাদ দিতে চাই। বোর্ডের অন্য সদস্যগন এগুলো রাখতে আগ্রহী। এর বাহিরে তাঁরা যেতে চান না। বলেন;
‘‘- এ গুলো বাদ দিলে কি প্রশ্ন করবেন? ’’এ ছাড়া এ গুলো প্রশ্ন পরীক্ষিত। না এর বাহিরে যাওয়া যাবে না।’
আমার সহধর্মীনি কলেজ শিক্ষক। একবার তাঁর কলেজের ভর্তি পরীক্ষার একটা খাতা দেখার সুযোগ হয়েছিল। প্রশ্নটা খুবই চমৎকার কিন্তু উত্তরটা আমার আজও জানা নাই। পাঠক প্রশ্নটা ছিল;
‘‘- জীবনানন্দ দাস কেন তাঁর কবিতায় শংখচিল, শালিকের বেশে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন? সংক্ষেপে বর্ননা দিন।’’ একটা ছেলে লিখেছিল আমার মনের কথা।
ছেলেটি জবাব;
‘প্রশ্নটা জীবনানন্দ দাসকে করাই যথাযথ ছিল। যাই হোক যেহেতু আমাদেরকে প্রশ্নটা করা হয়েছে, তাই আমাদের ধারণা করেই জবাব দিতে হবে। আমার ধারণা জীবনানন্দ দাস মানুষ হিসাবে বাংলায় জন্মের যন্ত্রণাভোগ করেছেন। অন্য দিকে ফল, মূল শস্যের মাঠে পাখিদের আনন্দ ও গান শুনে তাঁর মনে হয়েছে শংখচিল,শালিকদের জন্যই বাংলা। তাই তিনি পাখি হয়ে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।’'
সুন্দর জবাব। মোট ৫ নম্বর ৩ পেলেই ছেলেটা অনার্সে ভর্তির সুযোগ পেতেন। আমার সহধর্মীনি নির্মম হাতে শূন্য বসিয়ে দিলেন। ছেলেটা ভর্তি পরীক্ষার ইন্টারভিউ এ ফেল করলেন।
সরকারী চাকুরী করি, বিল্ডিং এর সবাই জানে। মেয়ের বন্ধুরা ইউনিভারসিটি পাশ করে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিচ্ছে। ওরা এসে জিজ্ঞাসা করে;
‘‘- আংকেল, বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষা দিতে যাবো। বলুন না কি পরে যাবো।’’ উপদেশ দিয়ে থাকি;
‘‘- কোট, টাই পরতে হবে এমন কোন কথা নাই। যে সময় যে ধরণের কাপড় পরা যায় ওটা পড়াই উত্তম। তবে, স্যান্ডেল, জিন্স, গেঞ্জি, জ্যাকেট এসব না পরাই ভালো।’’
আমার বড় ভাই এর ছোট মেয়ে কামত্ম, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস এর ভাইভা দিতে যাওয়ার আগের দিন জিজ্ঞাসা করলো;
‘‘- কাকু, শাড়ী পরে যাবো? ’’ জবাবে বললাম;
‘‘- কেন? সালোয়ার কামিজ যা পরে তুই অফিস আদালতে যাস, তাই পরে যাবি। ’’
সময়টা ছিল শীতকাল। সে সালোয়ার কামিজের উপর জিন্সের একটা জ্যাকেট পরে। ভাইভা বোর্ডের লোকজন একালের নয়। জিন্সের জ্যাকেট পরা পরীক্ষার্থী দেখলে বিরক্ত হবেন, মনে পড়ায় ওকে সাবধান করে দিলাম;
‘‘- ও হ্যাঁ , সালোয়ার কামিজের উপর জ্যাকেট পরিস না। এটা ভালো চাঁদর পরে নিস।’’
পরে ও কাপড় চোপড়ের প্রসংগ বাদ দিয়ে অভিমান করে বললো;
‘‘- আমি ভাইভা দিতে যাবো না।’’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম;
‘‘- কেন রে, কি হলো? ’’ জবাবে কাঁদো কাঁদো ভাবে বললো;
‘‘- কিছু পড়া শুনা করিনি। জানি না কি জিজ্ঞাসা করবে? আমি কি জবাব দিবো। ’’ মেয়ের অভিমান ভাংগাতে বললাম;
‘‘- পড়াশুনা করিসনি এ জন্য তুই নিজে দায়ী। পড়াশুনা করা দরকার। তা না হলে জ্ঞানের গভীরতা বাড়ে না।
‘‘- একবারে যে, পরিনি তা তো না। কি জিজ্ঞাসা করে কে জানে? ওটা তো না জানতে পারি।’’ অনুযোগ করলো;
বুঝলাম মেয়ের ভয়ের কারণ। আমরা যারা ভাইভা বোর্ডে থাকি। আমাদের প্রশ্ন পরীক্ষার্থীরা কি জানে না তা জানার জন্য নয়। বরং আমরা জানতে চেষ্টা করি ওরা কি জানে না। প্রশ্ন করি টেন্ডুলকার কোন মাঠে তাঁর শততম সেঞ্চুরী করেছিলেন? এটা কোন বনেগা ক্রোড়পতি অনুষ্ঠানে ভারতের টিভি চ্যানেলের জন্য একটা ভালো প্রশ্ন। বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে আদৌ প্রশ্ন কি না ভাবনার বিষয়। এটা আমার ভাবনার সময় নয়, মেয়েকে শামত্মনা দিতে হবে। অনুযোগের জবাবে বললাম;
‘‘- কি জিজ্ঞাসা করবে তা তুই কেন, কেউ জানে না। তা হলে তোর অসুবিধা কোথায়?’’ কথার মাঝে মেয়ে ডুকে জিজ্ঞাসা করলো;
‘‘- না পারলে যদি বোর্ড মনে করে মেয়েটা কিছু জানে না। ’’ তাকে শামত্মনা দেয়ার জন্য আবারও শুরু করলাম,
‘‘- না জানলে বিনয়ের সাথে সোজা জবাব দিবি,
-‘ সরি স্যার, উত্তরটা আমার জানা নাই’।
ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে এটা ওটা জবাব দেয়ার দরকার নাই। এতে বোর্ড বিরক্ত হতে পারে।’’
‘‘- সোজা সাপটা জানি না বললে বোর্ড অন্য কিছু মনে করবে না।’’ সে জানতে চাইলো। হাঁসতে হাঁসতে জবাব দিলাম;
‘‘- তুই ভয় পাচ্ছিস কারণ তুই মনে করছিস তোর চাকুরী হবে না। ওদেরও কোন দরকার নাই। ওরা তোদের দয়া করছে। না, ওদেরও লোক দরকার। তাই এত পয়সা কড়ি সময় খরচ করে পরীক্ষা নিচ্ছে।’’
‘‘- আপনি হাঁসছেন। আপনার মজা লাগছে। ’’ মেয়ে মমত্মব্য করলো।
‘‘- নারে মা, আমার মজা লাগছে না। তোর ভয় কাঁটানোর চেষ্টা করছি। ইন্টারভিউকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নাই। ভয় পেয়েছিল কি ব্যাস। সব জবাব আওলা ঝাওলা হয়ে যাবে।’’ মেয়েকে আমার অবস্থান বললাম। সবকিছু শুনে জানতে চাইলো;
‘‘- ওসব বাদ দাও। বল আমি কি করবো? ’’ বললাম;
‘‘- শুন। একদম ভয় পাবি না। যা জানিস না তা জানার ভান করে প্যাঁচাবি না। সোজা বলবি জানি না। ’’
মেয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে বললো;
‘‘- আচ্ছা।’’
কি কি করবে বলে যাচ্ছিলাম। মেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
‘‘- প্রশ্ন যদি ইংরেজিতে করে ইংরেজিতে জবাব দিবি। ’’
‘‘- ইংরেজিতে জবাব দিতে অসুবিধা হলে কি করবো?’’ মেয়ে কথার মাঝে ডুকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলো।
‘‘- আমাকে শেষ করতে দে। ইংরেজিতে জবাব দিতে অসুবিধা হলে বোর্ডকে বলবি;
‘‘- স্যার জবাবটা বাংলায় দিই।’’ দেখবি বোর্ড সম্মতি জানাবে। তুই বাংলায় জবাব দিবি। একটা কথা মনে রাখবি জবাব গুলো গুছানো, টু দ্যা পয়েন্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট হতে হবে।’’
‘‘- ওটা আবার কেমন?’’ মেয়ে কথার ফাঁকে ঢুকে আবারও জানতে চাইলো;
‘‘- ধর তোর কাছ থেকে জানতে চাইলো; বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সমন্ধে যা জানেন বলেন। জবাবে তুই বলবি, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না’।----------
এটা কিছু হলো? তোকে শিক্ষা ব্যবস্থা সমন্ধে কিছু বলতে বলেছে। তুই বলা শুরু করেছিস শিক্ষা সমন্ধে। তাও আবার গতানুগতিক বিরক্তি কর ভাবে।’’
‘‘- এটা ছাড়া আর কি বলবো।’’ মেয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো। জবাবে বললাম;
‘‘- বলা যেত, ‘ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিন সত্মরবিশিষ্ট - প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বীকৃত বেশ কয়েকটি ধারা, উপধারা রয়েছে, সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা। এ গুলোর অনেক উপধারা রয়েছে’। এভাবে বললে দেখবি তোকে মাঝ পথে থামিয়ে দিবে।’’ শুনে মেয়ের মমত্মব্য ,
‘‘- এ ভাবে বলা কি এতই সহজ। ’’ জবাবে বললাম;
‘‘- হ্যাঁ সহজ। চেষ্টা করলেই হয়। প্রশ্নটা আগে ভালো করে শুনে নিতে হবে। তারপর জবাবটা মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিবি। এ জন্য একটু সময় লাগবে। চুপচাপ থাকবি না, উল্টো বোর্ডকে প্রশ্ন করবি; ‘স্যার শিক্ষাব্যবস্থা সমন্ধে বলতে বলেছেন’ ‘ মানে কয় সত্মর বিশিষ্ট----------------।’

সময় পেয়ে গেছিস। গুছানো হয়ে গেছে। এবার বলা শুরম্ন কর।’’ শুনে বললো;
‘‘- অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে উঠতে হবে। ঘুমাতে যায়।’’ জবাবে বললাম;
‘‘- বোর্ডের কাছে যাওয়ার সময় বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে ঢুকার অনুমতি চাইবি, ‘আসতে পারি স্যার। আসার পর বসার অনুমতি নিবি, ‘বসতে পারি স্যার’। ইন্টারভিউ শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বিদায় নিবি। আমার যা বলার ছিলো বলেছি। তুই তোর মত করবি। যা ঘুমা গিয়ে।’’
যে পদে লোক নিবো, এ পদের কি দক্ষতা দরকার মাথায় নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। কমিটির বেশীর ভাগ ট্রাডিশনের বাহিরে যায় না। ফলে একই দক্ষতা নিয়ে সরকারে প্রশাসক, হিসাব নিয়ন্ত্রক, সবকিছুই হওয়া যায়। আমি হতাশ নই। ইন্টারভিউ এর মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর উপস্থিত বুদ্ধি, তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, যাচাই করার জন্য জিজ্ঞাসা করি;
‘‘- কাপের কোন দিকে হাতল থাকে?’’
বেশীর ভাগ পরীক্ষার্থী জানে না। কেউ বলে ডান, কেউ বা বাম দিকে। নিজের ডান বা বামের, বাহিরে কাপের কথা কেউ চিমত্মা করে না। একবার বোর্ডের এক মেম্বার ধমক দিয়ে বললেন;
‘‘- আপনি কি শুরম্ন করেছেন। এটা কোন প্রশ্ন হলো। কাপের হাতল সব দিকেই তো থাকে? ঘুরিয়ে নিলেই হলো।’’
‘‘- জবাব না থাকলে প্রশ্ন করতাম না। আপনি শুধু আপনার কথা ভাবছেন। কাপটির কথা ভাবুন। ওটার তিনটা দিক আছে;
-    ভিতর;
-    বাহির;
-    তলা।
আপনার কথা শুধু ভাবলে আপনি ঠিক। কিন্তু যদি কাপের কথাটাও একবার ভাবেন তা হলে উত্তরটা বাহিরের দিকে।’’। ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। ইন্টারভিউতে পরীক্ষার্থীদরে জিজ্ঞাসা করছি,
‘‘ ২ ও ২ এ কখন চার হয়?’’
জবাবগুলো প্রায় এ রকম;
-‘ কখনই নয়।’
-‘ এটা কোন প্রশ্ন হলো।’
-‘ আপনারা চাকুরীদাতা আমরা প্রার্থী তাই উপহাস করবেন’।
আমি প্রশ্ন করেছি। ‘কখন হয়’। যদি না হতো তাহলে জিজ্ঞাসা করতাম না। ‘কখনই নয়’ জবাব দিয়ে সে অন্যের মতামতকে উপেক্ষা করতে চায়। এটা কোন প্রশ্ন হলো’ জবাব পরীক্ষার্থীর তার দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। শেষ জবাবটা দিয়ে পরীক্ষার্থী তাঁর অজ্ঞতা আর অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। কেউ সব কিছু বিবেচনা করে বলছে না;
-‘ ভুল হলে হয়।’
-‘ নয়-ছয় করলে হয়।’
কেউ‘ ১ম জবাবটা দিলে আমি ধরে নি, প্রার্থী হলিস্টিক, কারও মত উপেক্ষা করে না। দ্বিতীয় জবাবটা শুনলে বলি; ‘সে জানে, নয়-ছয় করা যায়। নয়-ছয় করতে হয়।’ নান্নুকে এই কৌশলগুলো ব্যবহার করতে উপদেশ দিলাম। নান্নু ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলো। আলোচনা শেষে আমার ইউরেকা, ইউরেকা বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। আমি জেনে গেছি আমেরিকান এ্যমব্যাসি কি ভাবে জানে, কে আমেরিকায় থেকে যাবে। কাঁকে ভিসা দেয়া ঠিক হবে অথবা হবে না। ভিসা দিলে আমেরিকায় থেকে গেলেও আমেরিকারই লাভ হবে।
এ্যমব্যাসি আমাদের ভিতরে গভীরে গিয়ে এ সব অনুসন্ধান করে ভিসা দেয়। আমরা মনে করি আমাদের দয়া করেছে।’ শুধু আমাদের দিকটাই দেখি। তাঁরা আমাদের দয়া করে না। তাঁরা তাঁদের কাজ করে। আমরা ভিসা পাই অথবা ভিসা বঞ্চিত হই।
কয়েক দিন ধরে নান্নু আড্ডায় আসছে না। তখন হাতে হাতে সেল পৌছেনি। খবর নিতে পারলাম না। হঠাৎ নান্নুর আড্ডায় পুনরায় আবির্ভাব। আমাকে দেখেই ;
‘‘- বড় ভাই, কাজ হয়ে গেছে। একটা ভালো মাল পেয়ে গেছি।’’
জানতে চাইলাম;
‘‘- কি ভালো মাল পেয়ে গেছেন? ’’ জবাবে জানালো;
এ তিন দিন ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যাসত্ম ছিলেন। তাই আড্ডায় আসা হয়নি। তিনি একজন ভালো একাউন্টস্ অফিসার পেয়ে গেছেন। জানতে চাইলাম;
‘‘- কিভাবে সম্ভব হলো। ’’ জবাবে বললো;
‘‘- বড় ভাই, আপনার ফরমূলা। জিজ্ঞাসা করলাম‘২ এ ২ পাঁচ কখন হয়?’’ একজন জবাব দিলো;
‘‘- স্যার ! কত হলে আপনার চলবে।’’ অবাক হয়ে কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম;
‘‘- চমৎকার ব্রিলিয়ান্ট।’’ নান্নু জানালো,
‘‘- নিয়োগ দিয়ে দিয়েছি। কাজ করছে। ’’ আমি বললাম,
‘‘- খুব সিয়ানা মাল। দেখে শুনে রাখতে হবে; তা না হলে ‘চোরের উপর বাটপারি’ করতে পারে। ’’
সে সস্মতি জ্ঞাপন করে বললো;
‘‘- তা আর বলতে।’’
অনেক দিন পর হয়ে গেছে। আমিও আমার চাকুরী জীবনের শেষ প্রামেত্ম এসে পেঁŠছেছি। নান্নুর বিজনেস ফুলে ফেঁপে একাকার। সে প্রাডো গাড়ী চড়ে বেড়ায়। পত্রিকায় দেখলাম, সরকার বেসরকারী খাতের দক্ষতা সরকারী খাতে আনতে চায়। বেসরকারী খাত হতে সরকারে কিছু লোক নিয়োগের প্রসত্মাব করেছেন একজন কলামিস্ট। কলামিস্টের মতে বেসরকারী খাত হতে সরকারে লোক নিয়োগ করা হলে সরকারের দক্ষতা বাড়বে।
কোন পদের জন্য কোন দক্ষতা, যোগ্যতা লাগবে ঠিক করে তা যাচাই করার জন্য পদ্ধতি বাহির তারপর ইন্টারভিউ নিয়ে দেখলে কেমন হয়। নজর রাখি না কেন, যেন বাটপারি করতে না পারে।