ফ্রান্স ও বৃটেনের মাঝে ইংলিশ চ্যানেল; এই চ্যানেল পাড়ি দেন বাংগালী সাতাড়ু ব্রজেন দাস। ইংলিশ চ্যানেলের পাড়ে ছোট্ট একটা গ্রাম, নাম ‘ফ্লামাভিল’। ফরাসিরা লিখে এক উচ্চারণ করে ভিন্ন। ফ্লামাভিল উচ্চারণ করলেও লিখে ফ্লামানভিলে, নরমান্ডির একটা গ্রাম। শহরটি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ক্ষত আজও বুকে বহন করছে। গ্রামটির বুকে ছোট দ্বীপের মত জেগে আছে
-‘‘ওয়ার সিমেট্রি’ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃতদের নামফলক, ক্রসচিহৃ, ফুল আর ফুল।’
পরমাণু শক্তি জগতের নবাগতদের জ্ঞান সমৃদ্ধ ক্রেতা বানানোর প্রয়াস নিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা প্যারিসে পাঁচ দিনের একটা সেমিনারের আয়োজন করেছে। তিন দিন প্যারিসের লা ডিফেন্স এ সাধারণ আলোচনা। লা ডিফেন্স প্যারিসের আধুনিক এলাকা, বড় বড় দালান কোঠা, অফিস আদালত শপিং মল। লা ডিফেন্স মূলত ফ্রান্সের শক্তি হাব। বড় বড় শক্তি যোগানদাতা কোম্পানীর হেড অফিস এখানে আকাশ ছুয়ে আছে।
প্রথম তিন দিন মোনালিসা লিও নারডো দা ভিঞ্চি, মিখাইলো আঞ্চলো, ভান দে গগ, শপেন, এর অমর কৃর্তি; নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এর মরদেহের সংগেই ছিলাম। ক্যাসেল নটরডাম, সভ্যতার প্রতিভু লা-লুভার, সিন নদীর মায়াবী ডাক, ফরাসী ললনাদের কলতানে মুখরিত প্যারিস ছাড়তে হলো।
প্যারিস রেলওয়ে ষ্টেশন হয়ে ফ্লামাভিল যাবো। সেমিনারে আমরা চার জন একই হোটেলে ছিলাম। বাংলাদেশী আমরা দু’জন; একজন লাটভিয়ার, অন্যজন মেসেডোনিয়ার। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পাতাল রেল ধরতে এক কিলোমিটার হাঁটা পথ, তার পর পাতাল রেলে তিন ষ্টেশন। আবারো এক কিলোমিটার হাঁটা পথ। অবশ্য ট্যাক্সি নিয়েও যাওয়া যায়। প্রায় একশ ইউরো এর ব্যাপার, তাই হাঁটা দিলাম।
ষ্টেশনে পৌঁছলাম; মাথাটা ভিজে গেছে। মাথার চুলগুলো ইতোমধ্যে বিদেয় নিয়েছে। তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঠান্ডা লাগার ভয়ে পকেট থেকে রুমাল নিয়ে টাক থেকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরালাম। আমাদের সমন্বয়ক মহিলা তাঁর বিশাল দেহটাকে দুলাতে দুলাতে সামনে এসে, সবকটা দাঁত বাহির করে বললেন;
-“ যাক একটা দল অন্তত আগেই এসে পড়েছে ।”
আমাদের নির্দেশনা দিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করছি। ১০টা, ট্রেন ছাড়বে ১০টা বিশ মিনিটে। আমরা আমাদের নির্ধারিত বগি ২২ নম্বরে উঠলাম। ঠিক ঘড়ির কাটা ধরে ট্রেনটি রওনা দিলো।
লোহার চাকা, লোহার রেল, ট্রেন চলছে, কোন শব্দ নাই, কোন ঝাকুনি নাই। মনে হলো আকাশে উড়ছি। টয়েলেটগুলো তকককে ঝকঝকে, পানির ব্যবস্থাও আছে। পুরো বগিটা চক্ চক্ করছে; ময়লার চিহৃ নাই।
দূপুরে প্যাকেট খাবার দেয়া হলো। বুঝলাম এটা উড়োজাহাজ নয়। উড়োজাহাজ হলে খাবারগুলো গরম হতো। ঠান্ডা বরফের মত খাবার খাই না, তাই চেষ্টা করলাম না। সাথের দু’টো কলার একটা খেয়ে পেটকে শান্তনা দিলাম। ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর ট্রেন থেকে নামলাম। একটা বিশাল আকারের বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাসে উঠলাম, এখানেও স্বর্গীয় বিলাসিতার আয়োজন।
ফ্লামাভিলে দুটো পারমানবিক বিদ্যুr কেন্দ্র রয়েছে। এ দুটো চালু। এগুলো ১৯৮৫ সালে তৈরী হয়েছে। তৃতীয়টি নির্মাণাধীন। প্রথম দু’টো হল ‘প্রেসারাইড ওয়াটার রিক্র্যাকটর’ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। নির্মাণাধীন তৃতীয়টিতে ব্যবহার করা হবে ‘ইপিআর’ প্রযুক্তি। তৃতীয় কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে; বিদ্যুr উrপাদন শুরু হবে ২০১৬ সালে।
ফ্লামাভিল সেন্টারে কফি খেয়ে হলে বসলাম। দু’জন উপস্থাপক এলাকার জনগনকে সম্পৃক্ত করার জন্য কি কি করেছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। তাঁরা বললেন,
-“ পারমানবিক বিদ্যুr সমন্ধে জনগনকে জানানো হয়েছে ।”
-“ কেন্দ্র থেকে কি লাভ, সুবিধা তারা পাবেন তা জানানো হয়েছে।”
-“ যে সমস্ত বিষয় ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরী করতে পারে বলে স্থানীয় জনসাধারণ মনে করেন; তা দূর করার আশ্বাস তাঁদের দেয়া হয়েছে ।”
এ সব করার পরে ৯০ শতাংশ জনগণ তাঁদের সম্মতি দিয়েছে। বাকি ১০% আপত্তি করলেও তাঁদের আপত্তি আমলে আনা হয়নি। তবে তাদের জানানো হয়েছে; ৯০ শতাংশ লোক পরমাণু বিদ্যুr কেন্দ্র চায়, তাই সরকার এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য আপত্তিটি আমলে আনা হলো না।ব্রিফিং শেষে আমরা পরমানবিক শক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিমুলেটর দেখতে গেলাম। নির্দেশ দেয়া হলো;
-“ ছবি তোলা যাবে না। কোন কিছু স্পর্শ করা যাবে না ।” বুঝলাম না, এত বাড়াবাড়ি কেন ? এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম। জবাবে তিনি জানালেন;
-“ এই সিমুলেটরটি কনট্রোল রুমের কনসল প্যানেলের রেপলিকা। এটির ডাটা ইনপুট বাহির থেকে আলাদা ভাবে দেয়া হয়। নতুন নতুন ডাটা দিলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কি কি হবে, কোন পরিস্থিতিতে অপারেটরগণ কি করবেন তা শেখানো হয়।”
কোন কিছু না বুঝেই জিজ্ঞাস করলাম,
-“ তাতে কি ?” জবাবে জানালো;
“ কনসল প্যানেলটি কাজ করে রিক্র্যাটর, পাইপ এবং জেনারেটরের বিভিন্ন আসল ডাটার উপর ভিত্তি করে। টেকনোলজিটি প্রাচার হলে এটা তৈরী করা তেমন জটিল ব্যাপার নয়। ফলে এদের ৩০ কোটি টাকার ব্যবসা নষ্ট হবে।”
জানতে চাইলাম;
-“ সিমুলেটরটির দাম ৩০ কোটি টাকা ?”
জবাবে তিনি আক্রমনাত্তক হয়ে বললেন;
-“ দেখুন আমি আপনাকে কোন কিছু বলিনি। আপনি কোন কিছু শোনেন নি। আপনাকেও আমি চিনি না।”
ব্রিফিং শেষে আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম;
আমরা ৩০ জন, উঠেছি ৬টি হোটেলে। তখন বাজে সন্ধ্যা ৭.০০টা। রাত ৮.০০ টায় আয়োজকরা একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করেছে।
-“ আপনারা কয়জন হোটেল ডি, ক্যাপএ আছেন।” সমন্বয়ক জানতে চাইলেন। আমরা তিনজন হাত তুললাম।
বুঝলাম আমরাই শেষে নামবো। তিনি আরও জানালেন;
-“ আপনাদের হোটেলে নেমে চেক ইন করেই বাসে ফিরতে হবে। কোন সময় দেয়া হবে না।”
গলার স্বর ও বিষয় বস্তু কোনটাই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। বাধ্য হয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করলাম;
-“ আমরা সকল ৭.০০ টায় রওনা দিয়েছি। এখন বাজে রাত ৮.০০টা অর্থাr ১৩ ঘন্টা এ ভাবে আছি। দু:খিত আমি আপনাদের ডিনারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারলাম না।”
আয়োজকদের কাছে আমার কথাগুলো পরমাণু বোমার মত মনে হলো। একজন দোড়ে আমার সিটের কাছে এসে বললেন;
-“ দু:খিত, আমরা দেরী করে ফেলেছি। পনের মিনিট সময়ের মধ্যে আপনারা কি ফিরতে পারবেন।”
জবাবে বললাম;
-“ এভাবে আগেও বলতে পারতেন্ যাই হোক কথা দিচ্ছি দশ মিনিটের বেশী নিবো না।”
আমরা ২ জন দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলাম। অন্য জনের ১৫ মিনিট লেগে গেল।
ডিনার টেবিলে দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব আর ইন্দোনেশিয়াদের সংগে বসলাম। রাজা উজির মারা হলো। খাওয়া শেষে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন পরমাণু বিদ্যু কেন্দ্রে ঢুকবো।
বাসে চড়ে ফ্লামাভিল পরমাণু বিদ্যুr কেন্দ্রে গেলাম। আমাদের পাশপোর্ট নিয়ে নিলো। একটি হলে ফ্লামাভিল পরিচিতির পর আমাদেরকে দু’ভাগে ভাগ করা হলো। একভাগ যাবে চালু রিক্র্যাটর ফ্লামাভিল-২ পরিদর্শনে, অপর ভাগটি যাবে নির্মাণাধীন ফ্লামাভিল-৩ পরিদর্শনে। আমাদের সবাইকে পাশপোর্টের ফটোকপি একটি কার্ড এবং ৪ অংকের পাশ ওয়ার্ড দেয়া হলো।
প্রতিটি কেন্দ্রের তিনটি অংশ। কার্ডটা একটি মেশিনে ঠেকিয়ে একটি রুমে ঢুকলাম। সেখানে আমাদের একটা ‘ভিজিটর’ লিখা হলুদ সিনথেটিক এ্যাপ্রোন, একটা হেলমেট, একটা চশমা দেয়া হলো। বলা হলো ঘটি, পয়সা, চাবি, একটা জায়গায় রেখে যেতে। নির্দেশমত সব কিছু রেখে রওনা দিলাম। অন্য গেইটে পৌঁছলাম, হাতে একটি কোড নম্বর দেয়া হলো। গাইড বললেন,
-“ এই কোড নম্বরটি মেশিনে চাপ দিয়ে ঢুকান, নিজ নিজ নাম স্ক্রিনে দেখতে পাবেন। তখন কার্ডটি মেশিনে ধরবেন। হলুদ আলো জ্বললে পাশপোর্টের কাগজে লিখা কোডের প্রথম দুটো অংক চাপ দিলে সবুজ বাতি জ্বলবে। ভিতরে ঢুকুন।”
বিপদে পড়লাম। চশমা রেখে আসতে হয়েছে। এমনিতেই চোখে কিছু দেখি না। কোডগুলো এমন ছোট করে টাইপ করা পড়ার কোন উপায় নাই।
তাrক্ষণিক একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেললাম। অল্প বয়সের একজনকে ডেকে নামের কোড, পাশ ওয়ার্ড পড়তে বললাম এবং সংগে সংগে মাথায় নিয়ে এ যাত্রা পার হলাম।
পরের দরজায় কার্ড এবং পাশওয়ার্ড চাপ দিয়ে অন্য একটা রুমে ঢুকলাম। গাইডের নির্দেশ;
-“ শরীরের সকল কাপড় চোপড় খুলে ফেলুন। পাশে প্লাষ্টিকের স্যান্ডেল আছে; পড়ে পাশের রুমে ঢুকুন।” পাশের রুমে আমাদের একটি গেঞ্জি ন্যাপ্রোন, মোজা, মাথার জন্য একটি পলিথিনের টুপি, একটি হাত মোজা দেয়া হলো। সংগে একটি চার কোনা মেশিনও দেয়া হলো। নির্দেশ মোতাবেক কাজগুলো করে করিডোর দিয়ে গোল একটা ঘরে গেলাম। গাইড নতুন নির্দেশ দিলেন;
-“ খাঁচা থেকে প্লাস্টিকের মোড়ক নিয়ে তা জুতার উপর পড়ে নিন। পাশের খাঁচা থেকে হেলমেট নিয়ে পড়ে নিয়ে গেটে আসুন।”
নির্দেশ মত আমরা দরজায় গেলাম। গাইড জানালেন;
-“ মেশিনটি দরজার গর্তে সেট করুন। কার্ডটা দরজার উপর ধরে আপনার ৪টি পাশওয়ার্ডে চাপ দিন, সবুজ বাতি জ্বলবে, ভিতরে প্রবেশ করুন।”
ভিতরে ঢুকলাম। একটা বিশাল চৌবাচ্চা। নীলাভ টলটলে পানি। তলা পর্যন্ত দেখা যায়। নীচে বর্গাকার পাত্রের মত কিছু দেখা যাচ্ছে। কোনটি খালি কোনগুলো ভরাট। ভরাটগুলোর রং এক রকম নয়।
গাইড জানালেন;
-“ এখানে ৩৪ মিটার পানির নীচে নতুন এবং ব্যবহৃত পারমাণবিক শক্তি ফুয়েল ইউরেনিয়াম রাখা আছে।”
জানতে চাইলাম;
-“ চৌবাচ্চার সাইজ কত ? গভীরতা কত ?” জবাবে বিশেষজ্ঞ জানালেন;
-“ চৌবাচ্চার সাইজ রিক্র্যাক্টর ভেসেলের তিনগুন; গভীরতা ৩৪ মিটার।”
আর একজন প্রশ্ন করলেন;
-“ পানির পিএইচ কত ? তাপ মাত্রা কত ? ” বিশেষজ্ঞ জানালেন;
-“ এখন পিএইচ শূণ্য। তবে সাত এর বেশী উঠতে দেয়া হয় না। তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। ঠান্ডা পানি বাহির হতে পাম্প দিয়ে সর্বক্ষণিক ঢুকানো হয়। যাতে কোন অবস্থাতেই তাপমাত্রা এবং পিএইচ যেন না বাড়ে।”
কে যেন বললো;
-“ তার পরও যদি বাড়ে, কি হবে ?” সহজ জবাব;
-“ রিএ্যাক্টর স্যাট ডাউন করে দিতে হবে।”
দু’হাত দুরে ৩৪ মিটার পানির নিচে জ্যান্ত এবং পোড়া ফুয়েল ইউরেনিয়াম। চৌবাচ্চার দু’পাশে দুটো দরজার মত কৌতুহল সামাল দিতে পারলাম না। জিজ্ঞাসার জবাবে বিশেষজ্ঞ বললেন;
-“ রিএ্যাক্টরের পাশের দরজাটা দিয়ে নতুন ফুয়েল রড রিএ্যাক্টরে ঢুকানো হয়। রডগুলোকে খাড়াখাড়ি নিয়ে কাছে গিয়ে লম্বালম্বি করে তা রিক্র্যাক্টরে ঢুকানো হয়। একই সংগে একটি পোড়া ফুয়েল রড বাহির করে লম্বাভাবে এনে আড়াআড়ি ভাবে পাত্রে রাখা হয়।”
আবারো জানতে চাইলাম;
-“ পোড়া ফুয়েল বাহির করার সময় তাপমাত্রা কেমন থাকে ?” জবাব দেয়ার আগে হাসলেন; পরে জানালেন;
-“ রিএ্যাক্টরে ভিতরের তাপমাত্রা চার থেকে সাত হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। পোড়া ফুয়েল বাহির করার সময় প্রায় চার হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকে।”
অবাক হয়ে বললাম;
-“ কি ভাবে এটা ঠান্ডা হয়?” তিনি বললেন;
-“ এগুলো পানির নীচে ৪ বছর থাকে। পানি চলাচল করতে করতে তাপ ৪০০ ডিগ্রীতে নেমে আসে। তখন বিশেষ ব্যবস্থায় অন্য দরজা দিয়ে বাহির করে তা বিশেষ গাড়িতে করে পোড়া ফুয়েল ব্যবস্থাপনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।”
কৌতুহল থামাতে না পেরে আবারো জানতে চাইলাম,
-“ পোড়া ফুয়েল ব্যবস্থাপনাটি হয় কিভাবে?” খুশি হয়ে জানালেন;
-“ একই ভাবে ব্যবস্থাপনাগারে ১০ বছর থাকার পর তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে রডগুলো ছোট ছোট টুকরা করে যন্ত্রের সাহায্যে ইউরেনিয়াম থেকে প্লুটোনিয়াম আলাদা করা হয়। পোড়া ফুয়েলের ইউরেনিয়াম ২৩৮ নয়। তাই একে সমৃদ্ধ করে ২৩৮ বানিয়ে তা দিয়ে নতুন ফুয়েল বানানো হয়।”
তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তিনি তাড়া দিলেন। একই প্রক্রিয়ায় বাহির হয়ে জুতার কভার ও হেলমেট রেখে দিলাম। পরের রুমে জুতা, এপ্রোন, গেঞ্জি, হাত মোজা খুলে অন্য একটি রুমে গেলাম। রুমে ঢুকার আগে ছোট একটি বাক্স। পাশে দুটো গর্ত। গর্তে হাত রেখে দাড়িয়ে রইলাম। সবুজ বাতি জ্বললো। নিজেকে ধন্যবাদ জানালাম। কোন বিকিরণ প্রভাব পড়েনি। দরজার বিশেষ মেশিনটি তারা নিয়ে নিল।
যে রুমে কাপড় চোপড় খুলে একটি লকারে রেখে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কাপড় চোপড় পরে বাহির হলাম।শেষে ১ম রুম থেকে ঘড়ি, চশমা, কয়েন সংগ্রহ করলাম।
চশমা পড়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হেলমেটটি রেখে দিলাম। হলুদ এ্যাপ্রন ও হেডফোনটি রাখতে যাবো এমন সময় গাইড জানালেন;
-“ ফ্লামাভিল-৩ দেখতে যাবো দূপুরের খাওয়ার পরে। তখন এগুলো লাগবে। সংগে রেখে দিন।”
খেতে গেলাম। স্টাটার হিসাবে শবজি পোড়া আর রুটি দেয়া হয়েছে। মেইন মেনু মাছ সিদ্ধ। শবজি পোড়া আর রুটি দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করলাম।
বিকালে ফ্লামাভিল-৩ যাওয়ার আগে আমাদের নতুন পাশওয়ার্ড ও নতুন একটি কার্ড দেয়া হলো। ভিতরে ঢুকার আগে গামবুট ও হেলমেট দেয়া হলো। তেমন কোন কড়াকড়ি নাই। চশমা, মোবাইল সংগেই ছিল। তবে ছবি তোলা মানা।
প্রথমে পাহাড়ের উপর থেকে ওভারভিউ দেয়া হলো। পরে সাইটে ঢুকলাম। মোটা মোটা রড কংক্রিট দিয়ে গোলাকার ৩টি বৃত্ত তৈরী করা হচ্ছে। পাশে চৌবাচ্চা, দরজা, কত কিছু । এটা রিএ্যাক্টর কোর। এর মাঝখানে রিএ্যাক্টর ভেসেল বসানো হবে। অবাক হলাম। দেয়ালগুলো ১.৭ মিটার পুরু।
পাশেই একটা লোহার ডোম পড়ে আছে। রিএ্যাক্টর বসানো হলে ডোমটি বিশেষ ক্রেন দিয়ে উপরে বসানো হবে। পরে ডোমের উপর সিমেন্ট লাগানো হবে।
পাশেই একটি মেশিনে ক্লিংকার থেকে সিমেন্ট তৈরী করা হচ্ছে। বুঝলাম না কেন এখানেই সিমেন্ট তৈরী করতে হবে। সাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে জানতে চাইলাম। সহজ জবাব;
-“কোয়ালিটি নিশ্চিত করার জন্য।”
জেনারেটর রুম দেখে পাম্প হাউজের উপর উঠবো। গাইড জানালেন প্রতি সিড়িতে এক জনের বেশী উঠা যাবে না।নির্দেশমত উপরে উঠলাম। বিশাল দক্ষযজ্ঞ। নিচে নেমে গাড়ীতে উঠলাম। কার্ড দিয়ে বাহিরে বাহির হয়ে কার্ডটা ফেরr দিলাম। আমাদের পাশপোর্টও ফেরr দেয়া হলো।
পাশ দিয়ে একটি সাদা নজরকারা গাড়ী যাচ্ছে। পাশের একজন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞাস করলাম;
-“ এটা কি ?” জবাবে জানালেন;
-“ ফুয়েল ইনজেক্ট ও আউট করা হয় আঠারো মাস পর পর। বেশ কিছু একত্রে হলেই নতুন ফুয়েল আনা হয়। পোড়া ফুয়েল বাহির করা হয়। পোড়া ফুয়েল বিদেয় হচ্ছে।”
নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। শরীরের এক মিটার দূর দিয়ে পোড়া ফুয়েল এর গাড়ী গেল। আমি দেখলাম। আগের রুমে এসে ভিজিটরস এ্যাপ্রন, টামবুট, হেড ফোন, হেলমেট ফেরr দিয়ে নিজের জুতা মোজা পড়ে ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকলাম।এক কাপ কফি বিস্কুট খেয়ে বিদায় নিলাম। ফ্লামাভিল কর্তৃপক্ষ আমাদের ছবি তুলতে দেন নি। তাই তাঁদের তোলা ছবির একটা বই আমাদের উপহার দিলেন। প্যারিস ফিরতে অনেক রাত হবে, খাবার জুটবে না। তাই একটা খাবার প্যাকেটও হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো।
পরমাণু চুল্লির সময়গুলো শেষ হলো। কোন ভয় লাগে নি। আমরা উপভোগ করেছি। বাসে উঠলাম। প্যারিস রাত কাটিয়ে দেশের জন্য চালর্স দ্য-গল বিমানবন্দর দুবাই হয়ে ঢাকায় পৌঁছাবো।
বিদায় ফ্লামাভিল, পরমাণু চুল্লি, ওয়ার সিমেট্রি বুকে নিয়ে তুমি ভালো থাকে। ইউরোপের রাতে আলো জ্বালাও। ফ্লামাভিল তোমাকে বিদায়।
------------x------------