ওএসডি

Category: Governmental Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 8842

১৯৮৪ সালে বিসিএস (সচিবালয়) ক্যাডারে সহকারী সচিব হিসাবে শিল্প মন্ত্রণালয়ে কাজ করছি। আমাদের সিনিয়র একজন বড় ভাই আজিজুর রহমান এক বছরের অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স কোর্সে স্কলারশীপ পেলেন। যাওয়ার আগে তাঁকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি হতে হলো। ওএসডি হিসাবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হতে বেতন ভাতাদি গ্রহণ করবেন, বিদেশে স্কলারশীপও পাবেন। বিদেশ যেতে ওএসডি হতে হয়। ওএসডি মানে জ্ঞানী গুনি, বিদেশে লেখাপড়া করছেন এটাই ছিল আমার বদ্ধমূল ধারণা।

কাজের চাপ কম ছিল। নিয়মিত গেজেট পড়তাম। গেজেটে দেখলাম রাজশাহীতে আমাদের এক বড় ভাই ওএসডি হয়েছেন। তিনি মানবিক বিভাগের শিক্ষক হন। আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না। পুরাতন রীতি নীতি অনুযায়ী শিক্ষা গুরু হিসাবেই তাঁকে স্যাঁর সম্বোধন করতাম। ১৯৭৯ সালে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে স্যার বাংলাদেশ সচিবালয়ে সহকারী সচিব। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় স্যারের সাথে দেখা। বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তাঁর চেহারা দেখে স্যারকে কনগ্রাচুলেশন জানাতে দ্বিধা হলো। কুশল বিনিময় করার পর জিজ্ঞাসা করলাম -

-'অনেক দিনের জন্য বাহিরে যাচ্ছেন বুঝি, তাই মন খারাপ?'
-'আপনি কি বলছেন?' স্যার জিজ্ঞাসা করলেন।
-'পত্রিকায় দেখলাম আপনি ওএসডি হয়েছেন?' আমি বললাম।
-'আপনি ঠিকই দেখেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার কি দেখলেন?' স্যার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
-'ওএসডি করা হলো কেন স্যার?' জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে রেগে গিয়ে বললেন-
-'আমাকে জিজ্ঞাসা না করে সংস্থাপন সচিবকে জিজ্ঞাসা করলেই সঠিক জবাব পাবেন।'
নিজেকে বোকা এবং অপরাধী মনে হলো। স্যার কোন কথা না বাড়িয়ে উধাও হয়ে গেলেন। আমি এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

স্যার একটু ভাবুক-খেয়ালী। কথাবার্তায় মাঝে মধ্যে গোলমাল করে ফেলতেন। এক ঘেয়েমী নথি নিয়ে কাজকর্ম তাঁর ভালো লাগতো না। তাই গাঁ লাগাতেন না। ফাঁকিবাজ কর্মকর্তা হিসাবে তিনি একটা নাম ইতোমধ্যে অর্জন করেছেন। তথ্য সচিব তাঁকে বদলী করার জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করায় তাঁকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে অর্থ বিভাগে বদলী করা হয়েছে। অর্থ সচিব তাঁকে যোগদান করতে দেবেন না। অর্থ সচিব মহোদয়ের ধারণা, তাঁকে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ-কর্ম চলবে না। ক’দিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, দেন-দরবার, তদবীর করে কাজ হলো না। যোগদান করতে পারছেন না, বেতন-ভাতাও জুটছে না। তাই নিজেই চেষ্টা তদবির করে ওএসডি হয়েছেন। কোন কাজ কর্ম নাই। মাসে একবার এসে বেতন বিল করে যান। মাসের ১ম সপ্তহে এসে চেক নিয়ে যান। মজার চাকুরী কাজ নাই বেতন আছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের রাইট অব রিফিউজাল (আরওআর) শাখার সহকারী সচিব। সরকারী হোক আর বেসরকারী হোক একটা সূচ আমদানী করতে হলেও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মতি লাগে। অনুমোদন প্রদান প্রক্রিয়া করার কাজটা আমার। কাজের চাপে আমার দমবন্ধ অবস্থা। বদলী হলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, কলেজ শাখার সহকারী সচিব। খুশিই হলাম। হয়তো কাজ কিছুটা হলেও কম হবে। গুড়েবালি কাকে বলে জানা থাকলেও কোন দিন তা নিজে অনুভব করিনি। শিল্প হতে শিক্ষায় এসে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। ওএসডিরা মুখ কালো গোমড়া করে রাখে কেন বুঝলাম না। ওএসডিদের হিংসে করতাম। ওএসডি হওয়ার জন্য দু’একজনকে অনুরোধও করেছি। তাঁদের এক জবাব, “তুই ওএসডি হতে পারবি না। যা করছিস কর।“

রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব একের পর এক স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দিচ্ছেন। প্রজ্ঞাপণ জারী করা হতে শিক্ষক জাতীয়করণ করা কলেজ শাখাকে করতে হয়। ভোলা ডিগ্রী কলেজের একজন শিক্ষিকাকে জাতীয়করণ করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলো। উপ-সচিব (কলেজ) নথি তলব করে ঐ শিক্ষিকাকে আত্মীয়করণ সিদ্ধান্ত হাতে হাতে শিক্ষা সচিব কে দিয়ে চূড়ান্ত করলেন। আত্মীয়করণ আদেশটি তিনি সংশোধন, টাইপ করে চূড়ান্ত করলেন। দস্তখত করা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। ক'দিন পর বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আরও বাড়লো। নথিটি নিয়ে সচিব মহোদয় ডাকলেন। উপ-সচিব (কলেজ) বললেন, “আমার অনুমোদন করা খসড়া অনুযায়ী আদেশ জারী হয়নি”। আমি অবাক হয়ে বললাম, “কি বলছেন স্যার? আপনি চূড়ান্ত আদেশ তৈরী করে দিয়েছেন আমি দস্তখত করেছি মাত্র”। খসড়াটি নথিতে রাখেননি। তাই সব দোষ নন্দ ঘোষ।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে বদলী হলাম। রেল (ক্রয়) শাখার দায়িত্ব দেয়া হলো। কাজটা আমার ভালো লাগছিল না। ওখান থেকে চলে আসার চেষ্টা করছি। এর মাঝে একদিন মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত সচিব জুলফিকার ভাইয়ের সাথে দেখা। কুশল বিনিময়ের পর তিনি জানতে চাইলেন,
-'পোষ্টিং কোথায়?'
-'রেলওয়ে (ক্রয়) শাখা।' আমি জানালাম। তিনি খুশি হয়ে বললেন 'খুব ভালো জায়গা'। আমি ওখানে থাকতে চাই না শুনে তিনি অবাক হলেন। পরে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আসবো কি না জানতে চাইলেন। আমি কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করে বললাম, 'হ্যাঁ'।

ক'দিন পর আদেশ হাতে পেয়ে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হলাম। মৎস্য ও পশু মন্ত্রণালয় হতে যুক্তরাজ্যের নরিচ ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ৯৫ দিনের একটা সার্টিফিকেট কোর্সে মনোনয়নও পেলাম। কোর্সটি ১০০ দিনের। ৯০ দিনের বেশী সময়ের যে কোন কোর্সে বিদেশ যেতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ওএসডি হতে হবে। অন্যরা না চাইলেও খুশি হলাম 'এবার ওএসডি হওয়া যাবে।' আবারও আশায় গুড়োবালি। মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় আমাদের একে বারে ছেড়ে দিতে রাজী নয়। আমার সাথীরাও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এড়াতে চান। ১০০ দিনের কোর্সকে ৯০ দিন দেখানো হলো। মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় জিও জারী করলো। ওএসডি হওয়া হলো না। মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকার সচিব হিসাবে বদলী হলাম। সচিবালয় ও প্রশাসন ক্যাডার বিলুপ্ত করে নতুন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার করা হয়েছে। সচিবালয় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে ও মাঠ সংযুক্তি দেয়া হলো। ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে সিনিয়র সহকার সচিব হিসাবে বদলী হয়েছি। আইন বিষয়ক কোর্সে মনোনয়ন ও বদলী আদেশ একসংগে পেলাম। আইন কোর্সে যোগদান বাধ্যতামূলক। যোগদান না করলে তাৎক্ষণিক বিমুক্ত করা হবে। আগেই তথ্য মন্ত্রণালয় হতে বিমুক্ত হয়ে গেছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে হবে। তা না হলে বেতন ভাতা পাবো না। বাণিজ্য সচিব মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে জনালাম। তাঁর সাফ জবাব প্রশিক্ষণে গেলে তিনি যোগদান পত্র গ্রহন করবেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করা হলো না। তদবীর করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হতে প্রশিক্ষনের জন্য ওএসডি হলাম। অবশেষে ওএসডি হলাম। এ ওএসডিতে আসল ওএসডির কোন মজা নাই। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ক্লাশ। নিয়মিত পরীক্ষা। ৩ মাস বিসিএস একাডেমী, শাহাবাগে আইন প্রশিক্ষণের পর তিনমাস সিলেট জেলায় সংযুক্তি। কাজ ছাড়া বসে বসে বেতন, ওএসডি এর এই সুখ পেলাম না।

সংযুক্তি শেষ হলো। ১৯৯৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে খাঁটি ওএসডি হিসেবে যোগদান করলাম। কোন কাজ নাই। আমি, মুক্ত স্বাধীন। ফুরফুরে মেজাজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে বের হচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে আমার ঘাড়ে একজনের হাত। বিরক্তিভরে পেছনে তাকিয়ে দেখি পানি সম্পদ সচিব। শিল্প ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাঁর অধীনে কাজ করেছি। তিনি কি কারণে জানি না, আমাকে পছন্দ করেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় আছি।
-'ওএসডি। ' উত্তরে বললাম।
-'আমি অফিসার পাইনা, তুমি ওএসডি।' তিনি ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন,
‘চলো, আমার সংগে’। আমার করার কিছুই ছিল না। যন্ত্রের মত তাঁকে অনুসরণ করছি।
আমাকে নিয়ে গেলেন সংস্থাপন সচিব মহোদয়ের কাছে। তিনি বসে থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে আমার আদেশ করালেন। আমি ১লা জানুয়ারী ১৯৯৪ সাল হতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব। ওএসডি এর স্বাদ তখনও পাইনি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় হতে ঘিওর, মানিকগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওখান থেকে উপ-পরিচালক, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, তারপর অর্থ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব। ২০০০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী পদোন্নতি পেয়ে উপ-সচিব হলাম। একই সংগে পদোন্নতি ও সত্যিকারের ওএসডি, ভীষণ উপভোগ করছিলাম।
বেতন সমতাকরণ, শেষ বেতনের প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করতে করতেই দশ/বার দিন চলে গেল। ১৮ই ডিসেম্বর ২০০০ হতে আমাকে এসিএডি কোর্সে পাঠানো হলো বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, সাভারে। ৩০ এপ্রিল ২০০০ এসিএডি কোর্স শেষ করলাম। আমি ওএসডি। কোন কাজ নাই। পদোন্নতি প্রাপ্ত প্রায় সবার পোষ্টিং হয়ে গেছে। আলাদা রুম, পিএ, অধীনস্থ বেশ কয়েকজন সিনিয়র সহকারী সচিব, বাসায় একটা সরকারী টেলিফোন ইত্যাদি নিয়ে আমার বন্ধুরা উপ-সচিব হিসাবে বেশ উপভোগ করছেন। আমার অফুরন্ত অবসর। যেখানে যাই সেখানেই শুনি-
-'দোস্ত বসো। চা খা'। 'আমাকে বস ডেকেছে'। 'একটা জরুরী মিটিং আছে'।

বিরক্তি ধরে গেল। বুঝতে শুরু করলাম ওএসডি মুখগুলো গোমড়া কালো থাকে কেন!

ভাগ্য ভালো ওএসডি হিসেবে বিরক্তি ধরার আগেই বিশদিন পর অর্থ বিভাগের উপ-সচিব হিসাবে পোষ্টিং হলো। ১লা জানুয়ারী ২০০২ এনজিও এ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এর পরিচালক হিসাবে যোগদান করলাম। ৫ মার্চ ২০০৫ তারিখে যুগ্ম সচিব হিসাবে পদোন্নতি। একই সঙ্গে পদোন্নতি প্রাপ্ত সবার পোষ্টিং হলেও আমার হয়নি। আমি ওএসডি ভালো লাগলো। ক’দিন আরাম করে ঘোরাঘুরি করা যাবে। হলো না। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক পদেই ইনসিটো। ১৯ মার্চ ২০০৫ থেকে সিনিয়র স্টাফ কোর্সে পাঠানো হলো। কোর্স চলাকালীন সময়েই আমাকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটা প্রকল্পে নিয়োগ দেয়া হলো। কোর্স চলাকালেই জানলাম প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণকারী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো মহাপরিচালক হিসাবে আমার একজন কণিষ্ঠ সহকর্মীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যোগদান করতে চাইনি। কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে যোগদান করলাম। আরও একটা কারণ ওএসডি হতে চাইনি।

রাজনৈতিক পরিচয়ে কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হচ্ছে। এখন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি-র সংক্ষিপ্ত রূপ ওএসডি নিজ হারিয়ে পরিচিতি পেয়েছে "ও শালারে ধর"। তত্বাবধায়ক সরকার ওএসডি কর্মকর্তাদের পদায়নের চেষ্টা করছে। ওএসডি নতুন নাম পেল ‘অফিসার সার্চিং ফর ডিউটিজ’। যে নামেই ডাকা হউক না কেন, কেউ ওএসডি হতে চায় না। কর্মকর্তাদের চাপে কিংবা খুশি করতে সম্প্রতি পদের চেয়ে বেশী পদোন্নতি দেয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। ফলে শত শত কর্মকর্তা ওএসডি। ওএসডি এড়ানোর জন্য ইনসটো অর্থাৎ আগের পদে বহাল রাখার প্রচলন অনেক আগেই হয়েছে। ওএসডি এর সর্বশেষ সংস্করণ পদোন্নতির পর একই পদে সংযুক্তি।

আমার বস আমার কণিষ্ঠ সহকর্মী। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে আরও কয়েকটি প্রকল্প আছে। সেখানে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে কর্মকর্তা দু'জন উপ-সচিব। তাঁদের প্রকল্পগুলো আকারে বেশ বড়। একজন যুগ্ম-সচিব হয়েও ছোট একটা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একটা ভালো ট্রান্সপোর্ট, অফিস এবং কাজগুলো চ্যালেঞ্জিং। বিধি বাম। তিনিও হঠাৎ বদলী হয়ে গেলেন। তাঁর জায়গায় আমার পরের ব্যাচের একজন কণিষ্ঠতম কর্মকর্তাকে মহাপরিচালক করা হলো। সরকারী চাকুরী করতে এসে অনেক কিছু মেনে নিয়েছি। এটা মানতে পারলাম না। অন্য কোথাও একটা পোষ্টিং দিতে সংস্থাপনের এপিডিকে বললাম। সংস্থাপনের সাফ জবাব 'পোষ্টিং দেয়া যাবে না। জুনিয়রের অধীনে চাকুরী করতে না পারলে ওএসডি হন’। কোন ওজর আপত্তি না করে জবাব দিলাম, ‘তাই করেন। আমার কোন আপত্তি নাই’।

আমি এখন ওএসডি। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। আমার কোন গাড়ী-ঘোড়া নাই। শুধুমাত্র যোগদান অগ্রায়ন এবং বেতন-বিল করতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যায়। রাস্তায় সিএনজি চালিত ত্রি-চক্র যানের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি। ফেরার পথে কিছু পাই না। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফিরি। আমার স্ত্রী সরকারী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। প্রকল্পে থাকা কালীন সময়ে মাঝে মাঝে প্রয়োজনে আমার গাড়ীতে লিফ্‌ট নিতেন। এখন আর পান না বিধায় মুখ বেজার। বসার জায়গা নাই। সংস্থাপনের বারান্দায় দাড়িয়ে থাকি মলিন মুখে।

সরকারী পদে থাকার সময় লোকজন তাঁদের ওখানে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করতো। টেলিফেনের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে যেতাম। মোবাইলগুলো এখন আর বাজে না। মাঝে মাঝে চেক করি, মনে মনে ভাবি বোধ হয় চার্য নাই। খোলার সাথে সাথে সে জানান দেয় সবকিছু দেয় ঠিক আছে। মনে মনে ভাবি, গন্ডগোলটা অন্য কোথাও।

দেশে গেলে শুনতাম ধান চাষ করে কোন লাভ হয় না। তখন ধমক দিয়ে বলতাম-
-'তা হলে চাষ করিস কেন?'
-'না করলে কি করবো?' আক্ষেপের সংগে চাষী জবাব দিতো। মনে মনে বলি, ওএসডি দিয়ে দেশের কোন লাভ হয় না। তা হলে ওএসডি আছি কেন? মনের গভীর থেকে চাষীর মত একটাই জবাব বাহির হয়, ‘না থাকলে কি করবো’।

আমি ওএসডি এর যন্ত্রণা লিখছি। কিন্তু লিখে কি হবে? আবার না লিখেই কি করবো? হাতে অফুরন্ত সময়। বসে বসে তো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা যায় না। আমি জানি ও আসবে । আসুক, আমার অজান্তে। কাজের মাঝে, কর্মহীনতার অতলে ওএসডি হিসেবে নয়।