কনসালটেন্ট

Category: Governmental Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 12587

কনসালটেন্ট বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি নাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করেন, 'কি করেন'? এরমধ্যে অন্ততঃ একজন জবাবে বলবেন, 'কনসালটেন্সি করি।' বাংলাদেশ পরামর্শকদের ভালো চারণভূমি। বাংলাদেশে পরামর্শক সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এমন কোন খাত বা কাজ নাই যেখানে পরামর্শক নেই। সর্বপ্রথম এদেশে কে, কতজন পরামর্শক এনেছিলেন, এ সংক্রান্ত কোন তথ্য আমার জানা নাই। শিল্প গার্মেন্টস, তথ্য প্রযুক্তি, হিসাব এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইনারা কাজ করছেন না।

শিল্প মন্ত্রণালয়ে শাখা প্রধান পদে আমার ১ম চাকুরী। সহকারী সচিব পদবীটির নাম আগে শাখা প্রধান ছিল। ৮০-এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগে কিছু কল-কারখানা গড়ে উঠলেও বেসরকারী খাত বলতে তেমন কোন কিছু ছিল না। সরকারী খাতের কল-কারখানাগুলো স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতীয়করণকৃত। কোন কোনটি পরিচালনার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে।

এ অঞ্চলের বাংগালীরা সনাতনীকৃত কৃষি নিয়েই ছিল। প্রকৃতি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার জন্য কোন পরামর্শক প্রয়োজন পড়েনি। কৃষক নিজেই নিজেদের পরামর্শক। আগাখানের আদমজী, ইস্পাহানী, কোহিনুর গড়ে তোলার সময় এগুলো চালানোর জন্য তারা উচ্চ বেতনে বিভিন্ন দেশ থেকে জনবল নিয়োগ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মালিক চাকুরে সবাই দেশত্যাগ করছে। পরিত্যাক্ত কলকারখানাগুলোর দায়িত্ব বর্তায় সরকারের উপর। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর বর্তায় কারখানাগুলোকে সচল রাখার দায়িত্ব। বাংলাদেশী সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ছিলেন মূলতঃ কেরানী।

কারখানাগুলো কিভাবে চলে, কোথা থেকে স্পেয়ার পার্টস আসে, কিভাবে আনতে হয়, কিভাবে রিপিয়ার করতে হবে বাংলাদেশী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছুই জানা নাই। স্বাধীনতার মূল প্রতিশ্রুতি সমাজতন্ত্র, সাম্য। সমাজতন্ত্রের মধ্যে অন্য দেশের মালিকানা এনে সাম্য নষ্ট করা যায় না। সরকার আগের প্রভুদের ডেকে আনতে পারে না। তৈরী করা হলো একদল নতুন মুখ। নাম দেয়া হলে এমআইএস ক্যাডার। যার অর্থ শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ সরকারী কর্মচারী। জার্মানী, রাশিয়াতে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। তাঁরা ম্যানেজমেন্টে পারদর্শী হয়ে আসলেন। ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান তৈরী হলো না। এদের অভাব রয়ে গেল সব কারখানায়। মেশিন নষ্ট হয়। মেরামত করতে যন্ত্রাংশ, মেকানিক, ইঞ্জিনিয়ার লাগবে। বাংলাদেশে এদের পাওয়া যায় না। খোঁজা শুরু হলো। কোন ক্ষেত্রে পাওয়া গেল। কোন ক্ষেত্রে কোন কিছুই জুটলো না। কল-কারখানাগুলো পড়ে রইল। এমআইএস কারখানাগুলোর মালিক বটে তবে কোন ক্ষমতা নাই। আগের মালিক ভালো টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ারকে বেশী বেতন দিতেন। যাতে চলে না যায়। যন্ত্র নষ্ট হলে সংগে সংগে পাল্টানোর টাকা দিতেন। এমআইএস মালিক তবে এ ক্ষমতা তাদের নাই।

সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরী করবেন। তিনি কি ২২ হাজার শ্রমিক ছাড়া পারতেন? এমআইএস-এর ক্ষেত্রেও একই দশা হলো। গোদের উপর খাড়ার ঘা। প্রতিটি কাজে তাদের বাজেট দরকার হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ করে। চাতক পাখির মত বাজেটের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ হতে সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণা টুকুও বিদায় নিয়েছে। কলকারখানা আছে, শ্রমিক কর্মচারী আছে। তাই মাসে মাসে তাঁদের বেতন-ভাতা বোনাস গুনতে হয়। কিন্তু কোন উৎপাদন নেই। সরকার কারখানাগুলোর পক্ষে সরকার গ্যারান্টি দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দিচ্ছে। কর্মচারী-কর্মকর্তারা যে যার মত ধান্দা করছেন। মাস শেষে বেতন নিচ্ছেন। উৎপাদন নেই তবুও বেতন-ভাতা আছে। মুদ্রাস্ফীতি প্রতিদিন বাড়ছে। কৃষক সনাতনী কৃষি দিয়ে উৎপাদন করে যা পকেটে আনছে তাও মুদ্রাস্ফীতির অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে চুরি হয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি আসছে না। কৃষির উদ্বৃত্ত দিয়ে শিল্প বিনিয়োগ হচ্ছে না। বাংলাদেশ দুষ্ট চক্রের শৃংখলে আবদ্ধ। এ শৃংখল ভাংগতে এসেছেন কনসালটেন্ট।

সত্তর দশকের শেষের দিকে সরকার ভালোভাবে টের পেলো, অচল কারখানাগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে। নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগ, বেসরকারী খাত, সবকিছুকে কাজে লাগাতে হবে। যেখানে বেসরকারী খাত পাওয়া যাবে না সেখানেই শুধু সরকারী খাত কাজ করবে। বর্তমান অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।

এমআইএস ক্যাডারের প্রয়োজন ফুরালো। বিলুপ্ত করে প্রশাসন ক্যাডারের সংগে একীভূতকরণ করা হলো। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'ডিসইনভেষ্টমেন্ট সেল তৈরী করা হলো। অন্যদিকে সৃষ্টি হলো বিনিয়োগ অনুবিভাগ। বিনিয়োগ অধিশাখার শাখার প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছি। আমার ঘাড়ে পড়লো নতুন বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরীর দায়িত্ব।

রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেব তাঁর দায়িত্ব সেনাবাহিনী প্রধানের কাজে হস্তান্তর করেছেন। দেশে সামরিক শাসন চলছে। এ অবস্থায় তৈরী করা বিনিয়োগ নীতিমালায় গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও বিনিয়োগ আসবে না জেনেও নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হলো। নীতিমালা চূড়ান্ত করার জন্য সরকারী বেসরকারী, দেশী-বিদেশী অনেকের সংগে কথা বলতে হলো। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ দাবী তুললেন,
- "বিদেশী কনসালটেন্ট, টেকনিশিয়ানদের আসার ও কাজ করার সংস্থান শিল্পনীতিতে থাকতে হবে। তাদের ও তাদের পোষ্যদের বিশেষ ধরণের ভিসা দিতে হবে। তাদের ওয়ার্ক পারমিট দিতে হবে।' সরকার এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন।

কারণ এ ধরণের কাজ করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসহ কোন জনবল বাংলাদেশে নাই। তাঁদের অকাট্য যুক্তি সরকার মেনে নিয়ে বেসরকারী ও বিদেশীদের বিনিয়োগকৃত শিল্পের জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞ আনার সংস্থান রাখা হলো। এই সংস্থানের আওতায় তাদের, তাদের পোষ্যদের বিশেষ ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট যা কিছূ দরকার দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো।

সিতাংশু, জগলু, মাহবুব, শফিক আমরা একসংগে শিল্প মন্ত্রণালয়ে শাখা প্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলাম। মাহবুব আজ আর আমাদের মাঝে নেই। সিতাংশু আর জগলুর পোষ্টিং বেসরকারীকরণ সেলে। প্রতিদিন পত্রিকায় খবর উঠে,
"সরকারের বেসরকারীকরণ উদ্যোগ লাল ফিতায় বন্দী।"
"একটি শিল্পও বেসরকারী করা যায়নি।"
সিতাংশুর ওখানে চা থেকে গিয়ে জানতে চাইলাম,
-"পত্রিকাগুলো এসব লিখছে আসলে ব্যাপারটা কি?"
"ঠিকই লিখছে" সিতাংশু জবাব দিলো।

"কিন্তু কেন এমন হচ্ছে" জানতে চাইলাম।

"জানি না কোনটা কি? কি দাম? দাম ঠিক না হলে সিডিউল তৈরী হবে কেমন করে? বিক্রির টেন্ডার দিবো কি করে?" সিতাংশু জবাব দিলো।

- 'দাম ঠিক কর!' আমি কোন কিছু না ভেবেই বললাম।
আমাদের সংগে জগলু যোগ দিলো।
- 'বললেই তো হবে না, কনসালটেন্ট লাগবে' - বিজ্ঞের মত জগলু জবাব দিলো। কনসালটেন্ট নিয়োগ করার জন্য বিদেশী সাহায্য, ঋণ খোজা হচ্ছে। তাদের নিয়োগের জন্য ট্রার্মস অব রেফারেন্স টিওআর তৈরী এসব হলেও দাতা সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য প্রাপ্তির লক্ষে টেকনিক্যাল প্রজেক্ট প্রপোজাল মানে টিপিপি তৈরী করা হবে। তার পূর্বো বক্তৃতায় আমার মুখে হতাশা এসে গেল। ভাগ্যিস সামনে চা সিংগাড়া ছিল। তা না হলে হয়তো তাঁর বক্তৃতার মাঝখানেই বিদায় নিতাম। জগলু হতো বুঝতে পেরেছিলো তাই বললো, 'এ নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। পত্রিকাগুলো এসব বলবেই"।

'এটা কোন জবাব হলো না' - আমি বললাম।

- 'কাজ চলছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে। টেন্ডার দিতে পারবো।' জগলু আশাবাদ ব্যক্ত করলো। হয়তো ও আমাকে শান্তনা দিতে চেয়েছিল।

শিল্পনীতি তৈরী হলেও তেমন কোন বিনিয়োগ আসছে না। বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি ছোট ছোট বিনিয়োগের আশায় প্রতিটি জেলা শহরে বিসিক শিল্প নগরী তৈরী করা হলো। পত্রিকাগুলো অবিরাম লিখে যাচ্ছে,
'দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ শূণ্যের কোঠায়।'
'বিনিয়োগের কোন পরিবেশ নাই।'
'শিল্প নগরীর প্লট কেউ নিচ্ছে না। যারা নিয়েছে তারাও খালি ফেলে রেখেছে।'

একটি পত্রিকা বিসিকের একটি প্লটে বাধা কপি চাষের ছবি ছেপেছে। মনে মনে বললাম বিদেশীরা মার্শাল ল' চিনে না। চেনে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র না থাকলে তারা তাদের টাকা বিনিয়োগ করতে আসে না। একদিকে মার্শাল ল' অন্যদিকে নাই অবকাঠামো। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, লাইন পেতে উপরি গুনতে হয়। তারপরও সংযোগ মেলে না। কে আসবে? বিনিয়োগ করতে নিজের গ্যাটের টাকা

প্রতিটি জেলায় আমরা শিল্প নগরী করলাম। গ্যাস নাই, বিদ্যুৎ নাই। কি দিয়ে শিল্প চলবে। তৈরী মাল কেনার মত ক্রেতা থাকলেও তাদের ক্রয় ক্ষমতা নাই। কে কিনবে এই শিল্প নগরীর মালামাল? দয়া করে কেউ শিল্প স্থাপন করলে কে চালাবে এগুলো? কেউ কি থাকবে এ ধরণের প্রত্যন্ত জেলা শহরে? প্রশ্নগুলো নিজের কাছে। কোন জবাব পেলাম না। বিসিক প্লটে বাধা কপি চাষী শিল্প উদ্যোক্তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। তার নেয়া জায়গাটা অন্ততঃ সে ব্যবহার করছে তার মত করে। সে তাই করেছে যা সে করতে জানে। আমি যা করতে জানি না তা কি করা সম্ভব। কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠলো, হ্যাঁ করি। কারণ আমরা প্রায় ভন্ডামি করি। ভন্ডামি করতে গিয়ে কত কিছু যে করি। এর হিসাব করা ভার।

মাহবুব-এর সংগে সখ্যতা একটু বেশী ছিল। তাই তার রূমে যাওয়া আসা ছিল একটু বেশী। অফিস সময়ের পরও মাঝে মধ্যে একসংগে বায়তুল মোকাররম মসজিদ-এর সামনে 'ফ্লোরা' নামের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সদ্য ইউনিভারসিটি পাশ করা চাকুরী প্রত্যাশীদের আড্ডাখানা। এখান থেকে ছিটকে গিয়ে চাকুরী জীবনে প্রবেশ ঘটলেও বেশ কিছুদিন মায়া কাটাতে পারিনি। মাঝে মাঝে ফ্লোরায় আড্ডা দিতে যেতাম। ফ্লোরা ছাড়াও এক নং পুরানা পল্টন, আনসার টেইলার্স-এর দোকানেও বেকার বন্ধুদের নিয়মিত আড্ডা ছিল। পূর্ব পরিচিতদের টানে সেখানেও যেতাম। মাহবুব ছিল নিত্য সংগী। এছাড়াও নিয়মিত আড্ডাবাজ হিসেবে কামাল, নান্নু, ফজলু নিয়মিত আড্ডা দিতে যেত। সেখানে খেতো। গ্রামের বাড়ী রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীতে বেড়াতে গেছি। হঠাৎ কয়েকজন সাদা চামড়ার লোক ঘোরাঘুরি করতে দেখে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এরা কারা?'
- 'ররেন্দ্র প্রকল্পের কনসালটেন্ট।' জবাবে মঞ্জুর চাচা জানালো। অবাক হলাম। আমাদের সনাতনী কৃষিতেও কনসালটেন্ট ঢুকে গেছে।

বরেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে জায়গায় জায়গায় ডিপ টিউবওয়েল বসছে। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে স্যালো দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। কৃষক সারা বছর ধরে জমিতে ধান চাষ করছে। মাটির উর্বরতা ধরে রাখার জন্য সার দরকার। ইউরিয়া সারের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে গেলো। বিদেশ হতে আমদানী করে সময়মত যোগান দেয়া যাচ্ছে না। আমদানীর নানা ঝক্কি-ঝামেলাও বন্ধ করা যায় না। সরকার সিদ্ধান্ত নিলো নতুন ইউরিয়া সারকারখানা স্থাপন করা হবে। সারকারখানা স্থাপন করার অভিজ্ঞতা সুপারভিশন করার ক্ষমতা আমাদের নাই। তাই সিদ্ধান্ত হলো প্রকল্প হবে, 'ট্রানকি'। মানে কারখানা তৈরী করে কারখানার চাবিটা হাতে তুলে দিবেন। আশুগঞ্জ ও চট্টগ্রামে সার কারখানা স্থাপন  করা হবে। সরকারকে তেমন ভাবতে হলো না। জাইকা, বিশ্বব্যাংক, ইয়েন, ডলারের বস্তা নিয়ে বসেই ছিল। বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ প্রাক সমীক্ষা শেষ করলেন। বিনিয়োগ প্রকল্প প্রস্তাব ডিপিপি তৈরী হলো। গাদাগাদা কনসালটেন্ট, টেকনিশিয়ান, ম্যানেজার এমনকি রাধুনী পর্যন্ত হাজির হলো। আশুগঞ্জ গেলে মনে হতো ইউরোপ বা কোরিয়ায় আছি। নতুন ঝামেলা দেখা দিলো।

বিদেশী বিশেষজ্ঞদের অতিরিক্ত চর্বিসহ শুয়োরের মাংসের কাবাব ছাড়া চলে না। অভিজাত এলাকার কয়েকটি দোকান শুয়োরের মাংস আমদানী শুরু করলো। ওয়ার হাউজগুলো বিশেষজ্ঞদের বিয়ার হুইস্কি সরবরাহ করছে। তাঁদের পাশাপাশি আমরাও দু'এক প্যাগের স্বাদ পেতে লাগলাম। কোরিয়ান কনসালটেন্টরা তাদের প্রিয় খাবার কুকুরের মাংস খাওয়ার জন্য আমদানীর পথে গেলেন না। রাস্তাঘাটের কুকুর মেরে সাবাড় করলেন। এখন কুকুরগুলো কোরিয়ান দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে দৌড় মারে।

'ট্রানকি' হিসেবে সরকারী-বেসরকারী খাতে অনেক কারখানা হলো। এক্সপার্ট প্রসেসিং জোন ইপিজেডে সম্পূর্ণ বিদেশী বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন হচ্ছে।
"এরা তো আজীবন বাংলাদেশে থাকবে না। এরা চলে গেলে কি হবে?" এ ভাবনটা সরকার বুঝতে পেরে টেকনোলজি ট্রান্সফার-এর ব্যবস্থা নেয়া হলো।

সরকার, বেসরকারী খাত টেকনোলজী ট্রান্সফার-এর দেশী কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠালেন। দুর্ভাগ্য তাদের বেশীর ভাগ দেশে ফিরলেন না। বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে কনসালটেন্ট-এর চাহিদা মিটানোর ব্যবস্থাটা তেমন একটা কাজে লাগলো না। কারখানায় কোন ক্রুটি দেখা দিলে বন্ধ থাকে। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনার আগে কারখানা চালু করা যায় না। কিছু একটা করা দরকার। তাই বিদেশী কনসালটেন্ট এনে দেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। লাভ হলো, তারা দেশেই রয়েছেন। তবে যে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করলো সে সেখানে রইলো না। সে এখন লোকাল কনসালটেন্ট। আগের চাকুরীতে থেকে গেলে সরকারী স্কেলে বেতন ভাতায় পোষায় না। পদোন্নতি তার সম্ভাবনাও একেবারেই নাই।

৯০ শতকের শেষের দিকে অর্থ বিভাগে যোগ দিলাম। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের একগাদা কনসালটেন্ট কাজ করছে। আরস্ত-এর কাছ থেকে জানতে চাইলাম 'এদের কাজ কি? এরা কি করছে'। জবাবে আরস্ত যা জানালো, তার সারমর্ম হলো, আমাদের বাজেটিং, একাউন্টিং, অডিটিং কোনটাই ঠিক নাই। ইনক্রিমেন্টোল বাজেটিং শেষ করে অন্য সব দেশ জিরো প্রোগ্রাম, রির্সোসিং বাজেট নিয়ে ব্যস্ত। আমরা আজও আছি ইনক্রিমেন্টাল বাজেটিং নিয়ে। একাউন্টিং-রও একই দশা। ভাউচিং অডিট-এর জালায় সব দপ্তর অতীষ্ঠ তারপরও করার কিছু নাই। আমাদের ভ্যালু ফর মানি অডিটে যেতে হবে। এভাবে পড়ে থাকলে চলবে না। তাই ডিএফআইডির একটি প্রকল্পের অধীনে রজার এরা এসেছে। তাঁরা আমাদের রির্সোস বাজেটিং, ভ্যালু ফর মানি অডিটিং কিভাবে করতে হবে তা শিখাচ্ছে। এজন্য তারা ম্যাব চালু করেছে। ম্যাব কোর্স-এর সেরা কর্মকর্তাদের আইয়ার‌ল্যান্ডের অলস্টার ইউনিভারসিটি থেকে ফাইন্যান্সশিয়াল ম্যানেজমেন্ট মাস্টার্স ডিগ্রি করিয়ে আনা হবে। আমিও ডিগ্রীটা নিয়ে এসেছি।

স্থানীয় প্রযু্ক্তি আর ধারণাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ভালো কাজ করা যায়। সরকারী কর্মকর্তারা একাজটি করতে পারে না। তাই এনজিও সেক্টর বিস্তার করেছে বলে জানতাম। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে যোগ দিয়ে জানালাম এনজিও গুলোর কাজ কাম ঠিকমত করতে কনসালটেন্ট দরকার। এনজিওদের সবকাজেই বিশেষজ্ঞ লাগে। সমীক্ষা, রিসার্চ, টেকনোলজি এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে পরামর্শক কাজ করছে না। বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলোকে দাতার কাছে গাদাগাদা রিপোর্ট দিতে হয়। রিপোর্ট ইংরেজিতে লিখিতে হবে। ইংরেজিতে রিপোর্ট লিখার জন্য প্রায় সব এনজিওতে রয়েছে বিদেশী পরামর্শক। বিদেশী পরামর্শকগণ রিপোর্ট লিখছেন। দাতারা অর্থায়ন করছেন। লোকজনের মনে আশা বেঁধেছিল সরকারকে দিয়ে কিছু হবে না। এবার এনজিওরা যদি কিছু করতে পারে। সে আশাও গুড়েবালি। আগে কষ্ট করে হলেও ইংরেজিতে রিপোর্ট লিখতাম। এখন কনসালটেন্ট-এর জন্য অপেক্ষা করি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা প্রকল্পে কাজ করার সময় দেখলাম বিশ্বব্যাংক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। উপ-প্রকল্প পরিচালকের কাছে জানতে চাইলাম,
- 'এরা কেন? এদের কি কাজ?'
- 'স্যার! আমাদের ম্যানেজম্যান্ট ক্যাপাসিটি কম। তাই বিশ্বব্যাংক ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করার জন্য এদের নিয়োগ দিয়ে রেখেছে।' উপ-প্রকল্প পরিচালক জবাব দিলেন। এরা কারা জানার ইচ্ছা নিয়ে তাদের ডেকে পাঠালাম।
একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ২ জন মহিলা এনজিও থেকে এসেছেন। তারা আমাকে প্রকল্পের ম্যানেজম্যান্ট তেমন কোন সহায়তা করেছেন তা আমি বলতে পারবো না। আশা করি তারাও এ দাবী করবেন না। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিকে তারা সন্তুষ্ট রেখেছেন এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। তাদের সহায়তায় প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২ বছর বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কনসালটেন্ট-এর বাহার দেখলাম নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এসে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাজকর্মে সহায়তার জন্য ইউএনডিপি সাপোর্ট টু দ্যা ইলেক্টোরাল প্রসেস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। কমিশন ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরী করতে চায়। ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরীর জন্য দরকার ডাটাবেইস। ডাটাবেইস তৈরীর জন্য মেথোডোলজী, ডাটা স্ট্রাকচার ঠিক করা, ডাটার মান ঠিক রাখা ডাটা শেয়ার করার জন্য ডাটা ম্যানেজম্যান্ট কনসালটেন্ট হিসেবে স্টিভ ক্যানহাম কাজ করছেন। তার কাউন্টার পার্ট আজিমুল হক রায়হান। কমিশনের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য সবকিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ করছে আরেকজন কনসালটেন্ট পিটার লিংকুয়েষ্ট। তার সংগে আছেন বুয়েটের জনাব আশরাফুল আনাম।

নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেইসটি বাংলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ডাটাবেইস। এ ধরণের ডাটাবেইস ইউনিকোড ভিত্তিক একটি ফন্ট দিয়ে তৈরী না হলে পরে সমস্যা দেখা দিবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আগ্রহ এবং প্রচেষ্টায় একটি বাংলা ফন্ট তৈরীর জন্য কাজী জাওয়াদকে ফন্ট বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো। তাঁকে আনুসংগীক বিষয়ে সহায়তা করার জন্য আরও ২ জন বিশেযজ্ঞ নিয়োগ পেলেন।

সিভিল সোসাইটি দাতা সংস্থার ধারনা নির্বাচন কমিশন যেসব কাজ করছেন সেগুলো ঠিকমত তুলে ধরা হচ্ছে না। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানেন না কি বলা উচিৎ, কি বলা উচিৎ নয়। এছাড়াও তাদের দাবী নির্বাচন কমিশনের একটি কমিউনিকেশন স্ট্রাটেজি থাকবে।একজন কমিউনিকেশন কনসালটেন্ট নিয়োগ পেলেন। দিন কয়েক কাজ করে তিনি ৩ পৃষ্ঠার একটা রিপোট দিয়ে বিদায় নিলেন।

নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ত্রুটিমুক্ত করার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে একজন স্থানীয় ও একজন বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ করা হলো। ডিলিমেটেশন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করার জন্য আমেরিকা থেকে লিসা হ্যাডলিকে আনা হলো। তাঁর সংগে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে সিজিআইএস নিয়োগ পেলেন।

কাজী জাওয়াদ নিকস ফন্ট তৈরী করে দিয়েছেন। লিসা ও সিজিআইএস ডিলিমেটেশন করে জিআইএসভিত্তিক একটি ম্যাপ ও ভবিষ্যতের জন্য একটি সফ্‌টওয়ার তৈরী দিয়েছেন। জনাব আশরাফুল আনাম নিকস কন্‌ভাটার রেখে গেছেন। যা দিয়ে পূর্বের যে কোন ফন্টে লিখা বাংলা ইলেকট্রনিক ডকুমেন্টকে ইউনিকোড ভিত্তিক নিকস ফন্টে রুপান্তর করা যায়। নির্বাচনকে ত্রুটিমুক্ত করার লক্ষে স্টেপ টু স্টেপ গাইড নামে নির্বাচন দিনের একটি পদ্ধতি কনসালটেন্ট গন রেখে গেছেন। কতটুকু কাজে লাগবে জানিনা। অন্য কনসালটেন্টদের কাজ আমার কাছে পরিস্কার নয়। পূর্ণাংগ ডাটা বেইস আজও পাওয়া যায়নি, ওয়েভ সাইটে নানান সমস্যা, এত কিছুর পরও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা আগের মততই রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ৪ জন কনসালটেন্ট এর একটি টিম নিয়োগ করা হয়। টিম নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট, বর্তমান কাজ, ভবিষ্যতের কাজের পরিমাণ, ধরণ বিচার বিশ্লেষন করে একটি অর্গানোগ্রাম প্রস্তাব করেছেন। রিপোর্টটির একজন প্রণেতা সাবেক সচিব আনিসুল হক। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই।

নির্বাচন কমিশনের বর্তমান অর্গানোগ্রামে ৩ জন যুগ্ম-সচিব, একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন সচিব রয়েছেন। তিনি যখন আমার সাথে কথা বলছেন তখন ১ জন যুগ্ম-সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের পদ শূন্য।

কমিটি প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রামে ৫ জন যুগ্ম-সচিব এবং ১ জন অতিরিক্ত সচিব ও সচিব, তার সংগে আনুপাতিক হারে উপ সচিব, সহকারী সচিব, স্টাফ লাগবে বলা হয়েছে। আমি কথায় কথায় আনিসুল হক স্যারকে বললাম,
‘- এক জন দিয়েই তো চলে যাচ্ছে ।’’

'একজন দিয়ে নির্বাচন চালিয়ে নেয়া, কোন সুপারম্যানের পক্ষে ও সম্ভব নয়।' জবাবে তিনি জানালেন।

একটা জাতীয় ও ৩য় উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেলো। কোন অতিরিক্ত লোকবল ছাড়াই। কমিশনের নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের বিষয়টি চলমান। হয়তো অচিরেই অনুমোদন হবে। এ কাজ গুলো ৫ জন যুগ্ম-সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিব করবেন। সে দিন যদি তাদের কেউ বলেন এ কাজগুলো একজন অতিরিক্ত সচিব করেছেন। তাঁরা হয়তো অবাক হবেন। হয়তো আমাকে গাধা অথবা সুপারম্যান ভাববেন। আমি সুপারম্যান নই। আমি সত্যিই একটা গাধা।

কেন কনসালটেন্ট প্রয়োজন হয়? কনসালটেন্ট কেন লাগে? আমরা কেন কাজগুলো কেন করতে পারিনা? এ সব নিয়ে অনেক ভেবেছি। কোন জবাব পাইনি। সাবেক সচিব জনাব আনিসুল হকের কথায় খুঁজি। ৫ জনের কাজ একজনকে দিয়ে করানো হলে এটা কি ভালো হবে।

কনসালটেন্ট নিয়ে লিখতে বসে ছিলাম। কনসালটেন্টদের নিয়ে অনেক ভালো ভালো গল্প আছে। কনসালটেন্টদেরকে অনেক কটাক্ষও করা হয়েছে। একজন সচিবের কাছ থেকে কনসালটেন্টদের কটাক্ষ করা একটা গল্প বলি, একটা মিটিং চলছে। সচিব মহোদয় তাঁর একজন কর্মকর্তাকে খুঁজছেন। না পেয়ে যুগ্ম-সচিব প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কর্মকর্তাটি কোথায়। জবাবে যুগ্ম-সচিব জানালেন, 'তিনি ট্রেনিং এ।'
- 'আগামীকাল তাঁকে আমার সংগে দেখা করতে বলবেন' সচিব নির্দেশ দিলেন।
- 'উনার ট্রেনিং তো স্যার ১৫ দিনের। শেষ হতে দেরী আছে।' যুগ্ম-সচিব জবাব দিলেন।
- 'ওর কি আর ট্রেনিং-এর দরকার আছে।' সচিব মহোদয় বললেন।

যুগ্ম-সচিব জানতে চাইলেন,
‘- স্যার ওকে কি ডেকে পাঠাবো ?
‘‘না ’’। সচিবের সংক্ষিপ্ত জবাব। তারপর নিজেকে নিজেই বলতে থাকলেন,
‘‘ যে জানে সে ট্রেনিং নেয়। যে কিছু জানে সে ট্রেনিং দেয়। যে কিছুই জানে না সে কনসালটেন্ট হয়।

কনসালটেন্টগন আমার উপর রাগ করবেন না। এটা শুধুই গল্প। পাঠক এবারে আপনাদের কনসালটেন্ট নিয়ে একটা সত্য ঘটনা বলি। আপনারা মজা পাবেন। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের প্রচলন করলো। ব্যালট বাক্স ইলেকশনের একটা সাদা মাঠা উপকরণ। এটা ব্যবহার করতে প্রশিক্ষণ লাগবে কেন ? এই প্রশ্ন ছিল অনেকের। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান 'কোড ইন্টারন্যাশনাল' তাঁদের অভিজ্ঞতা ইউএনডিপির কাছে তুলে ধরে জানালো, প্রশিক্ষন ছাড়া স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা সম্ভব নয়। প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাই স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রকল্পের প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী প্রশিক্ষণের সংস্থান করা হলো।

পিপি অনুযায়ী 'কোড ইন্টারন্যাশনাল' একজন বিশেষজ্ঞ পাঠাবেন। তিনি ৩০ জন বাংলাদেশী কোর ট্রেনারকে ট্রেনিং দিবেন। তাঁরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৬০০ জন মাস্টার ট্রেনারকে প্রশিক্ষণ দিবেন। নির্বাচনের আগে মাস্টার ট্রেনারগণ ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণ দিবেন।

আমরা অপেক্ষা করছি, কোড ইন্টারন্যাশনাল প্রশিক্ষণের জন্য কনসালটেন্ট পাঠাবেন। অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর কনসালটেন্ট আসার দিনক্ষণ ঠিক হলো। কমিশনের সভা কক্ষে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলছে। কনসালটেন্ট তার কেতাদুরস্ত ইংরেজীতে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সমন্ধে বললেন। বলা শেষে একটি বাক্সে সিলগুলো লাগিয়ে টান দিয়ে দেখার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা চুপচাপ বসে আছি। প্রকল্পের কনসালটেন্ট ডেভিড ক্যানহাম বাক্সটার কাছে গিয়ে সিল ধরে টান দিলেন। আলতো টানেই সিলটা খুলে গেল। কনসালটেন্ট কিছু একটা বলতে চাইছেন। তার কথা জড়িয়ে আসছে। তিনি ঘামছেন।

আমার বিদেশের অবস্থানের কারণে সিল ও বাক্স গুলো আগে থেকেই পরিচিত। কনসালটেন্টকে সাহায্য করতে গেলাম। বাক্সে সিল লাগালাম। ডেভিডকে ডেকে আবার টান দিতে বললাম। সিলগুলো যেমন ছিল তেমনি রইল। প্রশিক্ষণ দিতে আসা কনসালটেন্ট জানালেন তাঁর অন্য কাজ আছে। আজকেই চলে যেতে হবে। তাঁকে বিদায় জানালাম। একই সংগে প্রকল্পের একটি বিরাট অংকও তাঁকে দিতে হলো। কনসালটেন্ট আমাকেও প্রশিক্ষন দিলেন।

গোদাগাড়ীতে মা থাকেন। তাঁকে বাড়ী, গাছ, মাটি থেকে সরিয়ে ঢাকায় আনতে পারিনি। তাই প্রায় আমাকে গোদাগাড়ী যেতে হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঢাকা রাস্তার দুপাশে অনেক বাবলা গাছ ছিল। বাবলা কাঁটাওয়ালা একটা দেশী জাতের গাছ। ডাল দিয়ে ভালো দাঁতন হয়। পেস্ট ব্রাশের প্রচলন গ্রামে তখন তেমন একটা হয়নি। আমরা বাবলা, নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করতাম।

বাড়ী যাওয়ার পথে লক্ষ্য করলাম। বাবলা গাছগুলো নাই। সে জায়গায় লাগানো হয়েছে, ইউক্যালিপটাস আর নাম জানি না কি একটা গাছ। বাড়ী এসে ছোট ভাই আমিনুলের কাছে জানতে চাইলাম,
- 'বরেন্দ্র অঞ্চলে ইউকালিপটাস আর ঐ গাছগুলো লাগাচ্ছে কেন?'
- 'তাড়াতাড়ি বড় হয়, তাই।' জবাবে ছোটভাই বললো।
- 'এসব গাছে আছে অনেক বেশী পানি লাগে। পরে মরে যাবে তো।' আমি বললাম।
- 'সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় কনসালটেন্টদের পরামর্শে এ গাছগুলো লাগনো হয়েছে। তুমি কনসালটেন্টদের চেয়ে বেশী জানো।' ছোট ভাই প্রতিক্রিয়া জানালো।

কনসালটেন্টদের চেয়ে বেশী জানি না। তাই চুপ করে রইলাম। ভাবছি আমাদের বনায়নও আমরা করতে পারি না। এখানেও কনসালটেন্ট লাগে।

কয়েক বছর পর বাড়ি যাচ্ছি। গাছগুলোর আগা মরে গেছে। কোনটাই আর জীবন্ত নেই। আশপাশের মহিলারা মরা ডাল ভেংগে নিয়ে যাচ্ছেন। কনসালটেন্টরা আসেন। তাদের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। কনসালটেন্ট চলে যান। বাবলা গাছ হারিয়ে যায়। আমরা ইউক্যালিপটাস-এর শুকনো ডাল বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।