অবসরের দিনগুলো

Category: Entertainment Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 4242

৩১শে জানুয়ারী, আমি আজ থেকে পূর্ণ অবসরেসচিব হিসাবে পিআরএল এ সরকারী গাড়ি ছিল। গাড়িটা সরকারী পুলে জমা দিলাম।পেনশন পেপার জমা দেয়ার জন্য পরিবহন পুল থেকে একটা অনাপত্তি পত্র লাগবে। পরিবহন পুলের কমিশনারের সাথে দেখা করলাম। তিনি সদয় হয়ে একদিনেই অনাপত্তি পত্রটি দিলেন। পেনশন পেপার তৈরি করা ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় থেকে সরকারি আদেশ জারির জন্য পাঠানো হয়েছে।১৫ দিন পার হয়ে গেছে। কোন খবর নাই। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব এর সঙ্গে দেখা করলাম। পেনশন পেপারটা তার দপ্তরেই আছে। তিনি খুব ভাল ব্যবহার করলেন। কথা দিলেন;

“স্যার এ জন্য আপনার আসা লাগবেনা। ১৫ দিনের মধ্যে হয়ে যাবেআপনার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যান। আমি আপনাকে জানাবো”।

তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। পিআরএল এ থাকা অবস্থা থেকেই ঘরে বসে বসে সময় কাটেমাঝে মধ্যে সচিবালয়ে পরিচিত জনের কাছে যাই। সবাই ব্যস্ত। তার মাঝে কথা বার্তা বলে সময় কাটাচ্ছিলাম। বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আওলাদ হোসেন এর রুমে গিয়ে বসি। শান্তি একটাই এখনও এখানকার সবাই ইজ্জত করে। তারা সবাই কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাজা উজির মারি। ভালোই লাগে। তাই বলেতো প্রতিদিন যাওয়া যায় না। একদিন না একদিন তারাও বিরক্ত হবে। তাদের বিরক্তির কারন হয়ে কি লাভ। আর চাইলেও প্রতিদিন সিএনজি করে কলাবাগান থেকে সচিবালয় যেতে মন চায় না। জীবনের বিশাল একটা সময় সরকারী সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করেছি। শরীরটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যাওয়া আসার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিএনজি এর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না।তার উপরে সিএনজিতে উঠলে জানুয়ারির শীতের বাতাস ধুলাবালি সহ্য করতে পারি না। ঠাণ্ডা,সর্দি কাশি লেগে যায়। সরকারের সর্বোচ্চ পদে থেকে ঢাকায় বাড়ি গাড়ী না থাকা অভিশাপ। অবসর জীবন আমার অভিশপ্ত সময়।

পরিচিত লোকজন কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করে;

-“স্যার অবসরে সবাইতো কিছু করে। আপনি কেন কিছু করেন না। কিছু করেন স্যার। না করলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন”।

কোন জবাব দিতে পারি না। কোন জবাব আমার জানা নাই। মনে মনে নিজেকে বলি;

‘আমি অপদার্থ, তাই কোন কিছু জোটাতে পারি না’

কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকি। তাদের কথা গুলো তো ঠিক। বাসায় বসে থাকি। পিআরএল এর প্রথম দিকে রাস্তায় বাহির হতাম। রাস্তা দিয়ে ছোট বড় নানান জাতের গাড়ি ঘোড়া চলছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলোতে মানুষ বাঁদুর ঝোলা ঝুলছে। রাস্তা পার হচ্ছে। আমার সাহসে কুলায় না। ঠাই দাড়িয়ে থাকি। এ ভাবে কতক্ষন, এক সময় ঘরে ফিরে আসি। টিভিটা অন করে একটার পর একটা চ্যানেল বদলাতে থাকি।

মাঝে মাঝে ছেলে বউ জিজ্ঞাসা করে,

-“ কি করছো ?”

-“ টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছি”।

জবাব দিয়ে পুনরায় চ্যানেল বদলাতে থাকি। এ কাজ করতে করতে চ্যানেল বদলানোর একটা নব নষ্ট করে ফেলেছি। এখন চ্যানেল গুলোতে কখনো উপরে কখনো নিচে করতে পারি না। শুধু কমাতে পারি। তাই করতে থাকি। বিরক্তি ধরে যায়। টিভি বন্ধ করে আইপ্যাডটা নিয়ে বসিনেটে ব্রাউজ করি। কখনো ফেসবুক, কখনো অনলাইন পত্রিকা, নেটের আর্টিকেল একটাও ভাল লাগে না।

অবসর জীবনের প্রতিদিনের গুমোট, আস্তে আস্তে একটা বিরাট পাথর হয়ে বুকে চেপে বসলো। এলপিআর এর মাঝ পথে, শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। বউ বলছে,

-ডাক্তারের কাছে যাও। দেখাও, চেক আপ কর। তা না হলে কবে একেবারে বিছানায় পড়ে যাবে। যাবো যাচ্ছি করেও যাওয়া হয় না। একদিন কলাবাগানের ভাড়া বাসার সামনের মুদি দোকানের মালিক বললেন;

-“স্যার আপনার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে,ডাক্তার দেখান”।

আর অবহেলা করতে পারলাম না। স্কয়ার হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে শুয়ে পড়তে হলো। সাবেক সচিব ওয়ার্ড এ থাকি কি করে। কেবিনে উঠলাম দু’দিন থেকে বিলের পরিমান শুনে স্বেচ্ছায় বিদায় নিলাম। ও কথা আপনাদের বলেছি ‘জীবন’ প্রসঙ্গে। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিবের দেয়া কথা, ১৫ দিন অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা সিরাজকে টেলিফোন করলাম। সিরাজ জানালেন;

-“অনেক দিন তো হয়ে গেল স্যার। আজও কিছু পাইনি। আপনি নিজে একটু খবর নিবেন স্যার”।

২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি থেকে বিরোধী দলের ডাকে অবরোধ চলছে। এর মাঝে হরতাল।এখানে সেখানে ককটেল ফুটছে,পেট্রোল বোমায় গাড়ী জ্বলছে, পুড়ে মরছে মানুষ। রাস্তায় বাহির হতে সাহস হয় না। তারপরও বাহির হলাম। ঢাকার রাস্তায় গাড়ী ঘোড়ার অভাব নাই। এর মাঝে সব কিছুই চলছে। একটা সিএনজি নিয়ে জনপ্রশাশনে হুমায়ুনের দপ্তরে হাজির হলাম। সে জানালো;

-“ স্যার আপনার পেনশন পেপারের সাথে আবাসন পরিদপ্তরের অনাপত্তি পত্র নাই। ওটা ছাড়া পেনশন পেপার প্রসেস করতে পারছি না”।

 

 

 

 

জবাবে জানালাম;

-“ভাই আমি কোন দিন সরকারী বাসায় ছিলাম না। আবাসন পরিদপ্তরের অনাপত্তি পত্র লাগবে কেন ?”

-“স্যার লাগবে”। হুমায়ুনের নির্লিপ্ত জবাব।

কথা বাড়ালাম না। আবাসন পরিদপ্তরে এসে পরিচালক সাহেবের সাথে দেখা করতে চাইলাম। পরিচালক সাহেব ব্যস্ত, মিটিং এ আছেন। পিও সাহেব প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে এনে ধরিয়ে দিলেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবুল আক্তার আমাকে একটা ফরম ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

-“স্যার এটা পূরণ করে এটাতে আপনার আর আপনার কন্ট্রোলিং অফিসারের সই লাগবে। সাথে ছাড়পত্রের জন্য একটা আবেদন”।

চাকুরীকালীন সময়ে আমার কন্ট্রোলিং অফিসার ছিলেন মন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মনে মনে ভাবছি,

-“এখন কে আমার কন্ট্রোলিং অফিসার?”

কোন জবাব পেলাম না নিজের কাছে। শেষমেষ বাবুল আক্তারের কাছে জানতে চাইলাম,

-“ ভাই বুজছি না। এখন কে আমার কন্ট্রোলিং অফিসার?”

জবাবে সে জানালো;

-“স্যার জনপ্রশাসন অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের একজন যুগ্মসচিব দস্তখত করলেই চলবে”।

মনে মনে বললাম, আমি আসলেই একটা গাধা। আমি এখন আম জনতা। এখন সবাই আমার কন্ট্রোলিং অফিসার। বাবুল আক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব দিলিপ এর কাছে গেলাম। দিলিপ নাই,হাই প্রেসার, অসুস্থ। অফিসে আসেনি। গেলাম যুগ্মসচিব রবীন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীর কাছে। তাঁকে বললাম,

-“ভাই,আমার কন্ট্রোলিং অফিসার হিসাবে একটা দস্তখত করে দাও”।

সে হাসতে হাসতে বললো,

-“স্যার আমি আপনার কন্ট্রোলিং অফিসার হিসাবে সই করি কি ভাবে?।

জবাবে বললাম,

-“ভাই,আমি এখন আম জনতা। সবাই আমার কন্ট্রোলিং অফিসার। সই করে দাওতো”।

সে সই করে দিলো। আবেদন লিখে ফরমটা জমা দিতে পাঠালাম। বুঝেছি লেগে না থাকলে ওটা পাবো না। পরের সপ্তাহে বাবুল আক্তারের সাথে দেখা করলাম। জানলাম, আবেদনটা এখনও পরিচালক এর দপ্তরে।

স্বাক্ষর হয়নি। সে প্রস্তাব দিল,

-“স্যার,পরিচালক সাহেবের সাথে দেখা করবেন”। কোন কথা না বলে পরিচালক এর কাছে গেলাম। সাথে বাবুলও গেলেন। ডাক ফাইল থেকে চিঠিটা বাহির করে সই নিলেন।

বাবুল আক্তার বেশ সহযোগিতা করলেন। চিঠি তৈরি করে নথিতে দিয়ে হাতে হাতে সই করার উদ্যোগ নিলেন। পারলেন না। পরিচালক জরুরী কাজে বাহিরে চলে গেছেন। বাবুল আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের সিরাজকে দায়িত্ব দিয়ে সচিবালয় ছাড়লাম। সিরাজকে পরদিন টেলিফোন করলাম। তিনি জানালেন, এখনও হয়নি। পরদিন আমি বাংলা মোটর কনকর্ড টাওয়ারের বারো তলায়। সিরাজ মোবাইল করে জানালেন;

-“ছাড়পত্রটা পাওয়া গেছে। জনপ্রশাসনে একটা কপি দিয়ে এসেছি। একটা কপি আমার কাছে আছে”।

তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে কাজটার পেছনে লেগে থাকতে অনুরোধ করলাম।

আজকাল অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেন;

-“স্যার অনেকের তো অনেক কিছু হলো। আপনার কিছু হলো না কেন?”

জবাবে ব্যঙ্গ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। বলি;

-“আমি কোন কাজের নই তাই”।

তারাও ছাড়বার পাত্র নন, বলেন;

-“আমরা তো স্যার আপনাকে একজন অভিজ্ঞ, দক্ষ ও সৎ আমলা হিসাবে জানি। ঢাকা শহরে আপনার বাড়ী নাই, গাড়ী নাই। কিছু না করলে পেনশনের এই কটা টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে টিকে থাকবেন কি করে?”

কোন জবাব দেই না। নিজে বলি চেষ্টা তো কম করিনি। আবেদনও অনেক করলাম, কোথাও কিছু হলো না। একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে জীবনের বেশীর ভাগ সময় পার করেছি। কোন বাঁকা অন্ধকার পথ আমার চেনা নয়। ও পথে যেতেও চাই না। তাই মনে মনে ঢাকা ছাড়ার একটা পরিকল্পনাও নিচ্ছিলাম।

চাকুরীর সুবাদে সহকর্মী পিউস কস্তার মাধ্যমে আরএমএম গ্রুপের সাথে পরিচয়। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিঃ অনিরুদ্ধ রয়, চেক প্রজাতন্ত্র হতে লেদার টেকনোলজি এর ওপর লেখাপড়া করেছেন। তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায়। সরকারী অফিসের বাহিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রনে তাদের এখানে বেশ কয়েকবার এসেছি।

রাজশাহীর বর্ডার অঞ্চলে বাড়ী। জন্মের পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে বড় হয়েছি। ছোট বেলায় প্রাইমারী স্কুলের প্রায় সব বন্ধু বান্ধব ছিল হিন্দু। বাড়ীর বাহির হলেই কীর্তনের সুর কানে আসতো। আমবাগান, ধাপের সবুজ মাঠ, কীর্তন বাউল গানের সাথে আত্মার আত্মীয়তা হয়ে গেছে। হঠাৎ মোবাইলে অনিরুদ্ধ দাদার একটা এসএমএস পেলাম।

বাংলাদেশের একদল ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কীর্তনের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি দাওয়াত করেছেন। কীর্তন শুনতে এসে হঠাৎ বলে ফেললাম;

-“ আর দেখা হবে কিনা জানি না। হয়তো ঢাকা ছেড়ে দিবো”।

ছোট ছোট বাচ্চাদের আসরে মুগ্ধ হলাম। বিদায় নিলাম। কয়েকদিন পর দাদার টেলিফোন;

-“আমার এখানে আসেন তো। এখানে একসাথে বসবো। কিছু একটা করার চেষ্টা করবো”।

সমাজতান্তিক দেশে লেখাপড়া করার সুবাদে এ সব দেশে লেখাপড়া করা লোকজনকে আত্মার আত্মীয় মনে করি। উপেক্ষা করতে পারলাম না। বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে। কোন সুযোগ হয়নি তাই জানুয়ারী’১৫ থেকে এখানে আমি বসি।

আমবাগান ধানক্ষেত হতে উঠে সমাজতান্তিক দেশে লেখাপড়া করেছি। ফিরে এসে কিছুদিন শিক্ষকতা তার পর প্রশাশনে চাকুরী করেছি। ভালো আমলা হিসাবে সরকারী কাজকর্ম ভালই বুঝতাম। ব্যবসা আমি বুঝি না। এখানে আমি দাদার কি উপকারে লাগবে জানি না। নতুন করে দেখছি, শিখছি।এ এক ভিন্ন জগৎ।

প্রতিদিন আসি। এখানে তেমন কেউ বসে না। রাজন অফিস পাহারা দেন। চা নাস্তা খাওয়ান। দাদার পিও টিটো টাইপ করে। একটা দিনে কয়েকটা বিষয়ে রাইট আপ তৈরি করেছি। না জেনে না বুঝে। এ গুলো দাদার কোন কাজে লেগেছে কিনা জানি না।

আরএমএম এর আইটি কর্মকর্তা সোহেল সাহেব একটা পিসি, ইন্টারনেট লাগিয়ে দিয়েছেন। বসে বসে নেটে পত্রিকা পড়ি,মেইল করি- সময় কেটে যায়।

মাঝে মাঝে রাজন,টিটো,সোহেলদের সাথে কথা বলি। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করি। নিজেকে এই নতুন জগতে বড় অসহায় মনে হয়।

মাঝে ১লা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস পার হয়ে গেছে,১লা ফাল্গুন, হাটতে হাটতে কনকর্ড টাওয়ারের ১২তলায় এসেছিলাম। রাস্তা, রিকশায় শুধু লাল আর লাল। মাথায় গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলী।

ভালোবাসা হীণ ভাবে ভালোবাসা দিবস পার হয়ে গেল। কোন ক্ষুদে বার্তা আসেনি, নিজেও লিখিনি। কি লিখবো।