দানিউব এর পাড়ে

Category: Entertainment Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6218

 

 

‘‘দানিউব এর পাড়ে’’

৩৮ বছর পরে আবার দানিউব পাড়ে। দানিউব বইছে ঠিক আগের মত, কোন পরিবর্তন হয়নি। পানি আগের মত, আজও মাতাল করে, মাটির সেঁদো গন্ধ পাড়ের মানুষগুলোকে পাগল করছে। চির যৌবনা দানিউব এর হাতছানি যুবা, যুবতি, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এমন কি পালতোলা নৌকাও উপেক্ষা করতে পারে না। সব হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, দানিউব বুকে। দানিউবের বুকে মানুষ, নৌকাগুলোর আদিম দাপাদাপি। মন্থণ দানিউব কে ফেনিল সৌন্দর্যে সাজিয়েছে।

 

শরীরে বাসা বেধেছে প্রৌঢ়ত্ব, চুলে পাক ধরেছে; যৌবন অনেক আগেই বিদায় । দানিউবকে দেখে হিংসে হচ্ছে। ৩৮ বছর আগে পাশে ভিয়েরা ছিল, স্বপ্ন ছিলো; মনে রং ছিল। আজ পাশে কেউ নেই; স্বপ্নগুলো ভেংগে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে; রং ফিকে হয়ে গেছে। শরীরের সে উদ্যম নেই; হাঁড়ে ক্ষয় ধরেছে। হঠাৎ বুকের মাঝে চিনচিন করে উঠলো। নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

 

 

‘‘কেন এলাম? না এলেই বোধ হয় ভালো করতাম।’’

আমাকে এলোমেলো করে দিল।

জার্মানী, অষ্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বেলোরুশিয়া হয়ে কৃষ্ণ সাগরে মিলন উৎসবে মত্ত দানিউব। আমি অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার দানিউব পাড়ে; পরমাণু রাজধানী ভিয়েনায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক উল্টোপাড়ে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিশ্লাভা। দানিউবের উপর স্থায়ী রংগধনুর মত রশি টানা দেয়া সাঁকো দুটো দেশের রাজধানীকে একত্র করেছে। রাতের আলোয় গাড়ীর হেডলাইটে মায়াবী এক জগৎ

রিসৃপের মত গাড়ীগুলো অবিরাম যাচ্ছে, আসছে। সীমান্ত রেখা, কাঁটা তারের বেড়া, সীমান্ত উত্তেজনা, লাশের মিছিল এখানে অলিক কল্পনা। এখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা উজিরে খামাখা। কাজ নাই, তাই এশিয়া আফ্রিকা নিয়ে মাথা ব্যথা।

দানিউবের বুক তিরে সাদা সাদা ইয়োট নেচেেড়াচ্ছে, যেন চাইকোবস্কির ‘লেবেদে। কে জানে এসব দেখতে দেখতেই হয়তো দানিউব তীরে বসে ‘স্ট্রাউস’ কমপোজ করেছিলেন বিখ্যাত ভালস্। আমেরিকাকেও জয় করেছিল স্ট্রাউসের এই অমর কৃত্তি।

এখন ইউরোপে পড়ন্ত গ্রীষ্মের বিকাল । বাতাসে শীতের মূর্ছনা টের পাওয়া যাচ্ছে। খেয়াল ছিলো না। তবুও হঠাৎ করেই শরীরে যৌবনের ফুটন্ত লাভা রক্তে আগুন ধরালো। ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, গেঞ্জিগায়ে হাঁটছি। এক এক করে মনে পড়ছে। ৩৮ বছর আগে বুলগেরিয়া পৌছলাম। বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় বুলগেরিয়ান ভাষা শিখছি। বুলেভার্ড লেলিন-এর পাশে চেৎভার্তি কিলোমিটারে, বিদেশী ছাত্রাবাসে থাকিআমরা এক সংগে ১২ জন ছেলে বুলগেরিয়া আসলাম। ১২ই অক্টোবর এয়ারপোর্টে কামরুল ভাই আমাদের রিসিভ করলেন। তিনি সংগে করে নিয়ে এসে হোস্টেলে তুলে দিয়ে সব কিছ বুঝিয়ে দিলেন। আসার পর থেকে এখানেই আছি। বুলগেরিয়ান ভাষা শিখছি। তিনটি জিনিস নিয়ে তাদের অনেক গর্ব, তাদের অক্ষর; দানিউব আর ভিতশা পাহাড়। ভাষা শিক্ষিকা দিমিত্রভা ঘোষণা দিলেন:

-‘‘আগামী সপ্তাহে তোমাদের দানিউবের তীরে নিয়ে যাওয়া হবে।’’

বাঁ-ভাংগা উৎচ্ছাস, আরাবগুলো চিৎকার করছে,

-‘‘মার হাবা, মার হাবা।’’

বাংগালীরা কিচমিচ করছে,

-‘‘ কি মজা, দারুন মজা হবে ।’’

পেরু , কিউবানরা কি বলছে বুঝলাম না। দেখলাম, নাঁচা নাঁচি করছে। আমরা দানিউব তীরে যাবো। শংকা, আনান্দ, ভীতি সব কিছু এক সংগে, আমরা বাংগালীরা চুপসে আছি। ওরা অনেক আগেই দানিউবে নেমে পড়েছে। নাচতে নাচতে ঘামে গোসল করে ফেলেছে। পরের বার দানিউব এর জলে ধুয়ে নিবে।

পরে আরও জানলাম, সোফিয়া থেকে আমরা দানিউব তীরের শহর রুসে যাবো। রুসে রাত্রি যাপন, পর দিন ইউরেপের রাণী দানিউব দর্শন শেষে সোফিয়া প্রর্ত্যাবর্তন।

পদ্মা তীরে বাড়ী পদ্মা, মহানন্দা, মরা গংগার সংগম স্থল। যাঁ রা কোনদিন সমুদ্র দেখেনি তাদের এই তিন নদীর সংগমস্থলে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের স্বাদ নিতে দেখেছি। যুবা, বৃদ্ধরাও বাদ যায়নি। চারিদিকে শুধু জলরাশি, উত্তাল ফেনিল, তীব্র স্রোতে কখনও বিশাল বটগাছ টেনে নিয়ে ছুটে চলেছে। এই জল সমুদ্রে ছিল আমার নিত্ত অবগাহন; দানিউব তীরে এসে হাসি পেল। দানিউবকে দেখলে মহানন্দারও হাঁসি পাবে। বুঝলাম না এ নিয়ে ইউরোপের এত গর্ব কেন। সহপাঠী হারুন বললো;

-‘‘হবে না কেন? এর চেয়ে বড় নদী কি ইউরোপে আছে।’’ তাই তো, এটাইতো ইউরোপের সব চেয়ে বড় নদী।

৩৮ বছর পরে দানিউব তীরে আসার আগে তিন নদীর সংগমস্থলে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। অভ্যাস আমাকে তীরে নিয়ে আসলো। কোথায় সংগমস্থল! এ শব্দটা আজ বড় বেমানান। পাড় দখল হয়ে গেছে। বুকে কচুরীপানা মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে। উঠেছে নতুন-নতুন দালান কোঠা। মাঝে নর্দমার মত স্রোতহীন, দেখে মনে হয় জীর্ণ শীর্ণ তিন বৃদ্ধ বৃদ্ধা শীতে জড়াজড়ি করে আছে, রাত পহানোর আশায়। মহানন্দা ৩৮ বছর আগে হেসেছে, দানিউব দেখে, আজ দানিউব হাসবে পদ্মা, মহানন্দা, মরা গংগা দেখে

দানিউব সেই আগের মতই; পাড় দখল হয়নি; পানিতে গন্ধ নাই; স্রোত আগের মতই। পাড়ের মানুষ, দানিউব বুকের ইয়োটগুলো ঠিক আগের মত দাপাদাপি করছে। কোন পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে আমার, আমাদের পদ্মা, মরাগংগা, মহানন্দার তীরে মানুষ নাই, দাড়িয়ে আছে দালান কোঠা। হারিয়ে গেছে পদ্মার বুকের হাজারমনী পাল তোলা নৌকা। নৌকার জায়গায় ছোট ছোট কচুরীপানা দাম। স্রোতের উজানে গুনটানা মাল্লার দেখা মেলে না । তবুও কানটা সজাগ করি, এই বুঝি শোনা যাবে;

-‘‘মার টান, টান মার, হেইও।’’

না কোন কোরাস শোনা গেল না। বুকের মাঝে মোচড় দিলো। হঠাৎ কচুরীপানার মাঝ থেকে একটা ঝি ঝি পোকা ঝি ঝি করে উড়াল দিলো। আৎকে উঠলাম।

মাল্লার জারি শোনার আশা ভংগ হলো। সহকর্মীর ডাকে আবারও দানিউব তীরে ফিরলাম। সে বললো;

-‘‘রাত হয়েছে স্যার, শীত লাগছে। চলেন যাই। কাল না হয় আবার আসা যাবে।’’

তাঁর কথায় সায় দিয়ে আস্তে আস্তে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। দানিউব তীর ছেড়ে আসলেও আমার বুকের ভিতরের যন্ত্রনা আমাকে ছাড়লো না। যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ভিয়েনার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশের তারাগুলো আজও আগের মত। আকাশটা এখনও আগের মতই নীল। বাংলাদেশে এখন নীল আকাশ দেখা যায় না। দীলিপ আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ওভাবেই সে বললো;

-‘‘স্যার, দেখেন আকাশটা কি সুন্দর নীল। অনেক দিন আমি এমন নীল আকাশ দেখি না।’’

কষ্টের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। ম্লান মুখে জবাব দিলাম;

-‘‘হ্যাঁ দিলীপ, আমরা আমাদের নীল আকাশটাও হারিয়েছি। ঠিক পদ্মা, গংগা, মহানন্দার মত। এদের বুকে কচুরী পানা, আকাশের বুক জুড়ে শুধুই কালো ধোঁয়া।’’

ড. মজিবুর জানতে চাইলো,

-‘‘তা হলে আমরা কি উন্নতি করলাম স্যার?’’ জবাব দেখার ইচ্ছে হলো না। জবাব কি দিবো। এর কোন জবাব আমার জানা নাই। চুপ করে রইলাম।

দানিউব পাড়ি দিয়ে ব্রাতিস্লাভা যাচ্ছি। আলো ঝলমলে সাঁকো। গাড়ীটা শহরের একটা আন্ডার গ্রাউন্ডে পার্ক করলো। লিফট দিয়ে একটা হোটেলে আসলাম। অবাক হলাম। হোটেলটা ঠিক আগের মতই আছে। শুধু নামটা পালটে গেছে।

-‘‘রেডিশন।’’

নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম;

-‘‘এ হোটেল ৩২ বছর আগে একজন মহিলা কাজ করতেন, নাম, ভিয়েরা লেলভসকা। সে বুলগেরিয়া থেকে ম্যানেজমেন্ট অব ট্যুরিজমে এমএসসি করেছিল। ওর বাড়ি পালারিকোভো। সে কোথায় বলতে পারেন?’’

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলাম। হোটেল রিসেপশনিষ্ট ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। জবাবে জানালো,

-‘‘অনেক দিন আগের কথা, তখন দেশটার নাম চেকোস্লোভাকিয়া ছিল; ছিল সমাজতন্ত্র; আজ সব উলোট পালট হয়ে গেছে। সবাই যে যার মত চলে গেছে।’’

রিসেপশনিষ্ট ঠিক জবাব দিয়েছে। ওটা তো আমি জানি। ওটা আমার দরকার নাই। আমার দরকার ভিয়েরার খোঁজ। আমি চেয়েছিলাম, রিসেপশনিষ্ট বলুক,

-‘‘ভিয়েরা এখন এই ঠিকানায় থাকে। তার টেলিফোন নম্বর -----------------------।’’

সব চাওয়া পূরণ হয় না। ও তাঁর জবাব দিয়েছে। আমি যা শুনতে চাই, সে তা জানে না। তবুও দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাড়ীচালক টুর গাইড এর কাজ করছিলেন। তিনি তাগাদা দিলেন,

-‘‘লেট গাইজ মোভ।’’

কোন কথা না বলে তাঁর পিছনে হাঁটা দিলাম। সে কি যেন বলছে। আমি দেখছি পাশেই ব্রাতিশ্লাভা অপেরা। হাটতে হাটতে পুরানো শহরটা এক চক্কর দিলাম।

নিজেকে বড় একা মনে হলো। ভালো লাগছে না। সিদ্ধান্ত হলো গাড়ীতে করে প্রাসাদে ঢুকবো, পরে পাশে পালামেন্ট ভবন দেখে ভিয়েনা ফিরবো। পাহাড়ের উপরের প্রাসাদে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছি। বাংলাদেশ থেকে আবার এসেছি, ভিয়েরা নাই। কষ্ট হচ্ছিল। দলের সবাই ভিতরে গেল। পেশাব লেগে ছিল। রহিম সাহেব ও দিকেই যাচ্ছেন। আমিও টয়েলেটের দিকে রওনা দিলাম।

গাড়ী ভিয়েনার পথে চলছে। কখন ঘুমিয়ে গেছি। ভিয়েরা আমি দানিউবের পাড় দিয়ে হাঁটছি। কয়েকটা বাচ্চা দানিউবের জলে দাপাদাপি করছে। একটা সুন্দর সাদা পাল তোলা ইয়োট দানিউবের ঢেউ ভেংগে ছলাৎ ছলাৎ করে রাজ হংসের মতো নাচছে, যেন চায়কোবস্কির লেবেদেভ।

একটা নৌকায় দু’জন যুবক যুবতি গভীর আলিংগনে, পাশে একটা গাংগচিল একটা মাছ নিয়ে ভোজনে মত্ত। কয়েকটা পাখি ঝাঁক মেলে যুগলদের উপর দিয়ে উড়ে গেল। ভিয়েরা বললো,

-‘‘এই দ্যাখো, পাখিগুলো কি সুন্দর আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ড্রাইভার সাহেবের কড়া ব্রেকে তন্দ্রা ভেংগে গেল। কোথায় দানিউব, কোথায় ভিয়েরা, আমি গাড়ীতে; ভিয়েনা শহরে পৌঁছে গেছি। ’’

দানিউব আগের মতই আছে। নীল আকাশটারও কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু ভিয়েরাকে ব্রাতিস্লাভা মনে রাখেনি।

হেমন্ত এর সেই গানটা গুণ গুণ করে কানে বাজতে লাগলো;

-‘‘-------------- কত তারা ঝরে পড়ে আকাশ কি তা মনে রাখে।’

ভিয়েরা হারিয়ে গেলেও দানিউব এখনও কেমনি আছে। ঘুম আসছে না, টিভি প্রোগ্রামগুলোও ভালো লাগছে না। ভাবলাম,

-‘দানিউব এর পাড় থেকে ঘুরে আসি।’’

হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত পনে চারটা। মনে মনে বললাম,

-‘‘রাত অনেক হয়েছে। যাওয়া ঠিক হবে না থাক।’’

দোটানায় ভুগছি। মনের অজান্তে কখন কেটস গেঞ্জি পরেছি জানিনা।

দানিউব এর টানে পথে নামলাম। মিনিট বিশেক হেঁটে দানিউব পাড়ে পৌছলাম। আমি হাটছি, মাঝে মাঝে দূরন্ত গতিতে সাইকেল উড়ে হচ্ছে।

পাড়ে ক্লাব, রেস্টুরেন্ট, গ্রিল জোন, সারফেসিং করার ব্যবস্থা; আগে এগুলো দেখিনি।

দানিউব ছিল, দানিউব নিয়ে ইউরোপের গর্ব ছিল। দানিউব কে ঘিরে ব্যবসা করছে। পাশ দিয়ে একটা কুকুর হেঁটে গেল। কুকুরটা অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। কুকুরটাকে দেখে মুচকি হাসলাম।

দানিউকে বললাম,

-‘‘ আমিও তোমার মত হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণ সাগরে নামবো।’’ দানিউব মুচকি হেঁসে বললো,

-‘‘পারলে এসো।’’

পারলাম না। ক্লান্তি পেয়ে বসলো। হোটেলে ফিরে আসলাম।

আমি বিছানায়, দানিউব বইছে।

পদ্মাকে গায়ক প্রশ্ন করেছিল।

-‘‘--------------------ও পদ্মা ------- তুমি বইছো কেন ? ’’

তাই পদ্মা অভিমান করে থেমে গেছে। জরা আমাকে থামিয়ে দিয়েছে। ভিয়েরা হারিয়ে গেছে। তবুও দানিউব আজো বহমান।