শূন্যতা

Category: Education Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 5673

হঠাৎ করেই শূন্যতা আমাকে পেয়ে বসেছে। কেন এই শূন্যতা জানি না। জানি আমি শূন্যতায় ভুগছি। কোথায় যেন ভীষন একটা নাই নাই।এ নাই নাই ভীষণ ভয়ংকর। দমবন্ধ হয়ে আসা একটি গুমোটের মধ্যে বাস করছি। এ অবস্থায় লিখা যায় না। লিখা লিখি বন্ধ সে অনেক দিন।

রর্নবী ফেসবুকে জানতে চাইলো,

'স্যার! অনেক দিন আপনার কোন লিখা পাইনা। লিখা লিখি ছেড়ে দিলেন কেন?

কি জবাব দিবো জানি না। জবাব জানা ছিলনা, তবু বললাম;

-‘‘ নতুন মন্ত্রণালয়ে এসে কাজ কাম বুঝতে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ব্যস্ততা কমলেই আবার শুরু করবো । ‘‘রর্নবী বললো;

-‘‘এবার তো ঈদের লম্বা ছুটি। আশা করি ঈদের পর আমরা কিছু পাবো।’’

কথার ফাকে আটকা পড়তে চাইছিলাম না। তাই অতি সংক্ষেপে চ্যাট শেষ করলাম।

-‘‘অবশ্যই।’’

শূন্যতা নিয়ে কোন কিছু করা যায় না । লেখা লেখি তো নাই। অস্থিরতা নিয়ে দিন কাটছে।

নির্বাচন কমিশনে শুক্র শনি ছিলনা। ঈদের দিনেও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের চালান বুঝে নেয়ার জন্য কমলাপুর ডিপোতে থেকেছি। ব্যালট পেপার ছাপানো, ট্রেনিং এ নিয়ে সাড়ে চারটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে বুঝতেও পারিনি।

ভারপ্রাপ্ত সচিব হয়ে নতুন একটি বিভাগ গড়ার দায়িত্ব পেলাম। আমি সচিব, আমি পিওন, আমি টাইপিষ্ট। আমার কেউ ছিলো না। আমি জানতাম আমাকে বিভাগটা কার্যকর করতে হবে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আমি একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। বাবুল প্রকল্প সহকারী। সে সুবাদে আমার সংগে ছিলো। প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। নুতন একটি প্রকল্প এলেও তার চাকুরী রক্ষা হয়নি।

কেন তার চাকুরীটা হলো না জানি না। বাবুল কাজের লোক। দুধ কফি বানানো বুক বাইন্ডিং, টাইপিং, ফটোকপি এমন কি ইন্টারনেটে আপলোড ডাউন লোড এসবে তাকে আমি ওস্তাদ বানিয়েছি। সে বেকার শুনে তাঁকে টেলিফোনে বললাম;

-‘‘ বাবুল তুমি আমার সাথে থাকো। আমি নিজের পকেট থেকে যা পারি তোমাকে দিবো। হাইটেক পার্ক অথরিটিতে আউট সোসিং এ লোক নিয়োগ করবে। তখন তোমাকে সেখানে নিবো

বাবুল এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ২ মাস নিজের পকেট থেকে যা পারলাম দিলাম। রেজিস্টার তৈরি বিল বানানো। এহেন কোন কাজ নাই বাবুল করেনি। বাবুলকে হাই-টেক পার্ক অথরিটিতে নিয়োগ দেয়া হলো। বাবুল আমার সাথেই ছিলো। সেই ওয়েবে আমার লিখা গুলো টাইপ আপলোডের কাজ গুলো করেছে।

তাদের ছেড়ে নুতন মন্ত্রণালয়ে যোগদান দেড় মাস হয়ে গেল। ছেলেটা কেমন আছে জানার জন্য সেলে কল করলাম।

-‘‘স্যার আমি হাই-টেক পার্কে চলে এসেছি।’’

জানতে চাইলাম;

-‘‘তুমি কেমন আছো? জবাবে জানালো,

-‘‘ভালো লাগে না স্যার। কাজ কাম নাই।’’ বুঝলাম বাবুল এর মাঝেও শূন্যতা। হঠাৎ বাবুল অনুযোগ করলো,

-‘‘স্যার লেখা লেখি বন্ধ করলেন কেন? স্যার বন্ধ, করবেন না। দরকার হলে আমি টাইপ করে দিবো। কৈফিয়ৎ দিলাম;

-‘‘না বাবুল বন্ধ করিনি। লিখবো তবে কেন জানি বসা হয়ে উঠছে না। আমার ভালো লাগছে না। আমার জীবন হঠাৎ করেই ছন্দ পতন ঘটেছে। ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত , সময়টা কি ভাবে কেটেছে জানি না।

অফুরান্ত সময়। ধাক্কা দিয়েও পার করতে পারছি না। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বুঝলাম কেন আংরেজিতে;

-‘‘সময় পার করে না;

-‘‘সময় খরচ করে না,

-‘‘সময়কে হত্যা করে -Kill time’’

সময়কে কিল করা বড় কঠিন কাজ। সময় কিল করতে না পারলে শূন্যতার মাঝে হাবু ড়ুবু খেতে হয়।

শূন্যতা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। নাক মুখ বন্ধ হয়ে আসে। যন্ত্রণায় ছটপট করি। এক অদ্ভুত অনুভুতি। গোছল খানায় ঢুকলেই দমবন্ধ হয়ে আসে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করলেই দমবন্ধ হয়ে আসে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। বউ জানতে চায়,

-‘‘কি হলো তোমার? ঘুমাচ্ছো না কেন? আগে কাজের চাপ ছিল, ব্যস্ত থাকতা,কিন্তু ঘুমে তো কোন ব্যাঘাৎ হতে দেখি নি। এখন এমন হচ্ছে কেন?’’

আমিও জানি না। জানি না কি জবাব দিবো। একটা ছন্দপতন হয়েছে। একটি দীর্ঘশ্বাস মনের অজান্তে বুকের পাশ থেকে নিংড়ে বাহির হয়। বলি;

-‘‘জানি না কি হয়েছে, ঘুম আসছে না।’’

সন্ধা বেলা জামাটা গায়ে ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। বউ জানতে চায়;

-‘‘কোথায় যাও?’’

জানি না কোথায় যাচ্ছি শুধু জানি বাহিরে যাচ্ছি। আমার কোন গন্তব্য নাই। কি জবাব দিবো। তবে গন্তব্য না থাকলেও একটা উদ্দেশ্য আছে। তা হলো,

-‘‘সময় কিল করা।’’ বউএর কাছ থেকে আবারও প্রশ্ন;

-‘‘কি জবাব দিচ্ছো না যে; কোথায় যাচ্ছো।’’ বুঝলাম জবাব একটা দিতে হবে, বললাম,‘‘না কোথাও না। এমনি একটু রাস্তায় হাটা হাটি করবো।’’

দরজা খুলে বেরিয়ে গাড়ি। পাশেই মিরপুর রোড। রোডে অসংখ্য গাড়ি। ফুটপাতটাও গাড়ীগুলো দখল করে রেখেছে। ফাঁক ফোকর দিয়ে দুই তিনশো গজ গিয়ে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ একা একা ইয়াকুব পস্নাজার এম, কে ইলেকট্রনিক্ম এর দোকানের সামনে দাড়িয়ে এনিম্যাল পস্ন্যানেটে ছবি দেখি।

চিতা হরিণকে তাড়া করছে। হরিণ টা এদিক ওদিক বেঁকে সময় কিল করছে। হরিণ বেঁচে গেল। চিতাটা বসে পড়ে হাঁপাচ্ছে। হরিণটাও দৌড়াচ্ছে না। পাশেই ঘাস খাচ্ছে। তেমন কোন ভয় ভীতি নাই।

ভেটেরনারী সার্জেন রাজ্জাক সাহেব। তার কাছে জেনে ছিলাম চিতাটা হঠাৎ থেমে গলে কেন? কিছুক্ষণ আগে হরিণটাকে খামচানোর জন্য এমন দৌড় ঝাপ করলো। এখন তা তার হাতের নাগালে, কিছুই করছে না। শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছে।’’

জবাবে রাজ্জাক সাহেব জানালেন,

-‘‘কি আর করবে স্যার। চিতা মাংশাসী প্রাণী,ক্ষি প্রও বটে। তবে তাদের ক্ষি প্রতা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। অন্যদিকে হরিণ তৃণভোজী; চিতার মত ক্ষি প্র নয়, তবে অনেকক্ষ ণ গতি ধরে রাখতে পারে।’’

কথার মাঝখানে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম,

-‘‘চিতা কতক্ষণ এবাবে ক্ষি প্রগতিতে ছুটতে পারে?’’

জবাবে তিনি বলে ছিলেন,

-‘‘বড় জোর ৪-৫ মিনিট। বেশী দোড়ালে মাথায় রক্ত জমে চিতা নিজেই পটল তুলবে। হরিণ চিতার এ সময় টুকু কিল করতে পারলেই বাজিমাত।’’

হরিণটা বাজিমাত করেছে। আনন্দে ঘাস চিবাচ্ছে। চিতার মাঝে শূন্যতা হাপাচ্ছে। কে যেন বললো, একে বলে বিউটি অব ন্যাচার। এটা না হলে বাঘ হরিণ কোনটাই থাকতো না।’’

একজন ভিক্ষক এসে আমার চিন্তা ছেদ টানলো;

-‘‘ দশটা টাকা দিন না স্যার। ইফতার করে কিছুই খাইনি স্যার। এখনও রোজা মুখে আছি স্যার।’’

বিরক্ত হলাম মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে ভাবছি;

এখানে বিউটি অব ন্যাচারটা কোথায়? থাকলে ভাল হতো। মনূষ্য ইন্টারভেনশনের জন্য বসে থাকতে হতো না। নিজেকে ফিরে পেলাম। ভিক্ষকটা হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমার আর ভালো লাগছিলো না। ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। লিফটের দরজা বন্ধা হলো। দমবন্ধ হয়ে আসছে। বুকে জমাট বাধা শূন্যতা। লিফটের ফ্যানটা অন করলাম। চার তলায় এসে গেছি। দরজা খুলেছে; বাঁচলাম।

শূন্য থেকে শূন্যতা; দুটোর মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় তা। একটা মানুষের মসিত্মষ্কের আর অন্যটা হৃদয়ের। আমার বন্ধু হামিদ, এক সংগে স্কুলে পড়েছি, এসএসসিও পাশ করেছিলাম। তারপর লেখা পড়ার পাঠ চুকিয়েছিল। উপার্জনের আশায় ঢাকায় আসে। সে থেকে ঢাকায় আছে। একটা বেসরকারী কোম্পানীতে ছোট খাটো কাজ করে। মধ্যে ক’দিন অসুখে ভুগেছে। সেল ফোনের সুবাদে আমার খবর তারা জানে। একদিন আমার অফিসে এসে হাজির।

-‘‘দোস্ত তোর কাছে চলে এলাম।’’ জবাবে বললাম’ ‘‘ভালো করেছিস। বল, কি খেদমত করতে হবে। জবাবে সে জানালো’’

-‘‘তোরা বড় বড় পদে আছিস। হ্যামরা বিপদে না পড়লে কি তোরঘে কাছে আসি।’’

বললাম;

-‘‘ ভনিতা না করে বল আমাকে কি করতে হবে।’’

-‘‘দোস্ত, অনেকদিন ভুগলাম, টাকা কড়ি নাই, ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্য, রোজা ঈদ, ছেলেমেয়ের কিছু কিনে দিতে হবে কিছু টাকা দিতে হবে।’’

আমি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারছি না। ভাবছি, তাঁর ব্যাংক ব্যালান্স শূন্য অর্থ কষ্টে আছে। শূন্যতা নাই আমার ব্যাংক শূন্য নয়; তবু কেন এ শূন্যতা। কোন জবাব না পেয়ে হামিদ আকুতি জানালো,

-‘‘বিপদে না পড়লে মানুষ কি হাত পাতেরে ভাই।’’

জবাব দিলাম,

-‘‘ও হ্যাঁ দাঁড়া দেখছি। চা খা।’’ বলে ঘন্টা বাজিয়ে চা দিতে বললাম। আমি জানি টাকাটা সে ধার চাচ্ছে না। ধার দিলেও ও ফেরৎ দিবে না আমি ফেরৎ নেয়ার জন্য ওর বাসা বা অফিসে যাবো না। সব কিছু ভেবে তাঁকে দুটো পাঁচশত টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম।

-‘‘এক হাজার টাকা, আর একটি বেশী হলে ভালো হতো।’’

হামিদের কথা শুনে কোন জবাব দেয়ার ইচ্ছে হলো না। একটা কষ্টের হাসি হাসলাম। টাকাটা নিয়ে বুক পকেটে রাখলো। চা খাওয়া শেষ হয়েছে।

-‘‘তোরা ব্যস্ত মানুষ। তোরঘে সময়ের ম্যালা দাম। আ্যাইজ উঠি।’’

বললাম,

-‘‘আচ্ছা;ভালো থাকিস।’’

হামিদ অনেকটা দৌড়ে বাহির হলো। মনে হলো এখানে তাঁকে তার শূন্যতা তাড়া করে মারবে। এখানে তাঁর আর কিছু করার নাই। সে জানে তার পূর্ণতা কোথায়। সেতাঁর পূর্ণতায় ফিরে গেছে।

রোজাতে অফিসের সময় সূচি নয়টা সাড়ে তিনটা। বাড়ি ফিরলেই শূন্যতা; ভয় কাজ করে। উঠতে ইচ্ছে করে না। চারিদিকে শুনসান নিরবতা। পিও সাহেব এসে কাচুমাচু হয়ে হাত মড়াতে মড়াতে আবদার করে;

-‘‘স্যার আমি যাই। গাড়ী ছেড়ে দিবে।’’ জবাবে যান্ত্রিক ভাবে বলি;

-‘‘ঠিক আছে; যান।’’ চোখে মুখে এক প্রশামিত্মর ছাপ বুঝা যায়, ফিরছে সে তার পূর্ণতায়।

সবার বাড়ি ফেরার এক অদ্ভুত তাড়া। ৩০ মিনিটের ব্যবধানে জনঅরন্য পরিনত হয় একটা ইটকংক্রিটের ডুবে। হিংসে হয়। এক দিন এক জনের কাছে জানতে চাইলাম,

-‘‘বাড়ি গিয়ে কি করেন?’’

-‘‘বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করি। টেলিভিশন দেখি। কখনও বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিই। গঞ্জ গুজব করি।’’

বুঝলাম তাঁদের ব্যস্ততা আছে। শূন্যতাকে দূরে সরিয়ে রাখে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন করেছি। ক্রিকেটে এ পর্যন্ত প্রাপ্তি প্রায় শুন্য। অর্জন অনেক, শূন্যতা নাই। লন্ডন অলিম্পিক শেষ হলো এখানেও বাংলাদেশের ক্রিকেটার প্রাপ্তি শূন্য। ক্রীড়া ফেডারেশন গুলোর কোন শূন্যতা নাই। অভিজ্ঞতার প্রাপ্তি অনেক। তা হলে কেন আমার এ শূন্যতা। আমি কেন মুক্ত হতে পারছি না।

কোন জবাব মিলছে না। ঝেড়ে ফেলতে চাই, আমাকে আরও বেশী করে আকড়ে ধরছে। আমি মুক্তি চাই।