১৯৭০ সাল, মুসলিম লীগের একছাত্র আধিপত্য ভেংগে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে, অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভূট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনে জয় লাভ করলো। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদের আসন বন্টন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বাংগালী জনসংখ্যা বেশী; তাই আসন সংখ্যাও বেশী। বেশী আসন পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা রাজি নয়। টালবাহানা শুরু হলো। কোন কারণ ছাড়াই পাকিস্তান পিপলস পাটির ভুট্টোর সংগে আলাপ-আলোচনা শুরু করলো। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপি ভুট্টোর নাম মুখে মুখে জুবছে। বাংগালীরা ঘৃণা ভরে উচ্চারণ করছে শব্দ দু’টো। তখনও পিপিপি-র অন্য কোন মানে বাংলার মানুষের জানা নাই।
১৯৬৮ সালের দিকে বাটা বাংলাদেশের গ্রামে স্পঞ্চ স্যান্ডেল আনলো। দাম ৬ টাকা। এক মন ধান বেঁচলে ৮ টাকা পায়। স্পঞ্চের এক জোড়া স্যান্ডেলেই টাকা শেষ। ১৯৭৫ সালে অর্থনীতি শাস্ত্রে বুলগেরিয়ায় পড়াশুনা করছি। এক কেজি চাল ৬০ স্ততিনিজ; বুলগেরিয়ার পয়সার নাম; টাকার নাম লেভা। এক লেভা সমান ১০০ স্ততিংকি। সরকারী ভাবে এক লেভা এক ডলার দশ সেন্ট। কালো বাজারে ৩-৪ লেভা দিয়েও এক ডলার মেলা ভার। ৬০ স্ততিংকি চালের কেজি, অন্য দিকে ২০-২৫ স্ততিংকিতে ভালো এক জোড়া স্পঞ্চ মেলে সহজেই। কারণ বুঝিনা।
ইভানভ আমাদের ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পড়ান। লাইব্রেরীতে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম;
‘‘- ইভানভ একটা বিষয় আমার মাথায় ঢুকছে না। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো?’’
বুলগেরিয়াতে ছাত্র শিক্ষক সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে। তুমি বলে। কেউ কিছু মনে করে না। সাহায্য চাইছি দেখে খুব খুশি হয়ে আমার কাছে জানতে চাইলো;
‘‘- বলো কি? আমি তোমাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?’’ জবাবে বললাম;
‘‘- তোমাকে একটু বেশি সময় দিতে হবে। তোমার সময় হবে তো? শুনে ইভানভ খুশিই হোল! বললো;
‘‘- অবশ্যই-অবশ্যই এটা হবে আমার জন্য আনন্দের।’’ তাঁর আগ্রহ দেখে আমি ধন্য হলাম। শুরু করলাম,
‘‘- আমি দেশে ২৫ কেজি চাল কিনতাম এক ডলার দিয়ে। এক জোড়া স্পঞ্চের স্যান্ডেল কিনতেই এক ডলার দিতে হতো।’’
আমার বলা শেষ হয়নি। ইভানভ নিজেকে চেপে রাখতে পারলেন না। বললেন;
‘‘- তোমাদের ওখানে পিপিপি এত বেশী।’’
বুঝতে পারিনি আমি বললাম;
‘‘- আমার বলা শেষ হয়নি। তোমাদের এখানে দেখি এক কেজি চালে দুই জোড়া স্পঞ্চের স্যান্ডেল জোটে। একা কেন? এই অবাধ আমদানীর রফতানীর যুগে এটা হবে কেন?’’
জবাবে ইভানভ বুলগেরিয়ান ভাষায় যা বললো তা জটিল। অনেক শব্দ তখনও আমার জানা হয়নি। মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। শুনেও কিছু বুঝলাম না।’’ ইভানভ জানালো;
‘‘- প্রশ্নগুলো জটিল। ইংরেজিতে তোমাকে বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নাই। বাংলা আমি এক বিন্দুও জানি না।’’ তাঁকে শান্তনা দিতে ইভানভকে বললাম;
‘‘- যাক ও নিয়ে আর ভেবো না। আমি জেনে নিবো’’। সে নিজের অক্ষমতাকে মেনে নিতে পারছিলো না। বললো;
‘‘- অর্থনীতিবীদরা ইংরেজি বলে, পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি-পিপিপি। বাদ বাকিটা তুমি নিজে জেনে নিও। লাইব্রেরীতে বিষয়টির উপর ইংরেজীতে বেশ কিছু বই আছে।’’ তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। সে আরো জানালো;
দেশে দেশে রয়েছে পিপিপি-এর গ্যাপ। গ্যাপের কারণেই আজকের সমাজতন্ত্র। তোমাদের দেশে ২৫ কেজি চালের বদলে কিনতে হয় এক জোড়া স্পঞ্চের স্যান্ডেল’’। এসব জটিল বিষয় মাথায় ঢুকছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল;
এক পিপিপি-এর কারণে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ নিরীহ জনগণ শহীদ; এক কোটি লোক ঘরবাড়ী ছাড়া হয়েছিল। পিপিপি-এর কারণে আমাদের ২৫ কেজি চালের বদলে কিনতে হয় এক জোড়া স্পঞ্চ। ভাবনার ঘোরপাকে ডুবে গেছি।’’
‘‘- কি ভাবছো।’’ ইভানভের ডাকে নিজেকে ফিরে পেলাম। জবাবে বললাম;
‘‘- ও কিছু না। বিষয়টা জটিল। মাথায় ঢুকছে না।’’ জবাবে সে জানালো;
‘‘- যাক, আজকে আর না। অন্যদিন আলাপ করবো।’’ তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। রূমে ফিরার আগে পর্যন্ত পিপিপি কি? কেন পিপিপি? পিপিপি কেন থাকবে? তাহলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিও কেন আছে? তাঁরা কি কাজ করছে? এ সব নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে হলো,
‘‘- এ সব ভেবে কি লাভ। আমি কি কিছু করতে পারবো?’’ ভিতর থেকে একজন চিৎকার করে বললো;
‘‘- তুমি কিছুই করতে পারবে না রফিক। কিছুই করতে পারবে না।’’
বিছানায় গিয়ে ঘুম দিলাম। পিপিপি তিনটা অক্ষরের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। নতুন পিপিপির শব্দ তিনটার প্রতিও ঘৃণা সৃষ্টি হলো। দেশে ফিরে এসেছি। শিল্প মন্ত্রণালয়ে চাকুরী করি। সরকার ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী তৈরী করছে। ‘জায়কার’ একজন কনসালটেন্ট এর সাথে ভালো খাতির হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে তেমন কিছু জানে না। তবে জানে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথা পিছু আয় ২৫০-৩০০ ডলার। একদিন কথায় কথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলো;
‘‘- এত কম আয় দিয়ে তোমরা বেছে আছো কেমন করে?’’ জবাবে তাঁকে বললাম;
‘‘- পিপিপি। তুমি দেখছো আমাদের মাথা পিছুগড় আয় ৩০০ ডলার। তুমি ৩০০ ডলারের জাপানে ক্রয় ক্ষমতার কথা ভাবছো। ৩০০ ডলার দিয়ে বাংলাদেশে কত কি কেনা যায় ভাবতে পারো? এসব তুমি জানলে কিনতে ১৫০০ ডলার গুনতে হবে। তোমার ৩০০ ডলার শুধুমাত্র ৩০০ ডলার। আমার ৩০০ ডলার মানে ১৫০০ ডলার। তাই আমরা বেঁচে আছি। বেঁচে থাকবো।’’ জবাবে সে বললো;
‘‘- বুঝলাম না।’’ উত্তরে বললাম;
‘‘- জানি তুমি বুঝবে না। আমিও বুলগেরিয়াতে বুঝিনি।’’
‘‘- আমি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। এসবে কাজ নাই। হেয়ালি করে জবাব দিলাম।
‘‘- ঠিক’’। জাপানি একমত পোষন করলো।
‘‘শুভ বুদ্ধির জন্য ধন্যবাদ।’’ জাপানি কথা বাড়ালো না মুচকি হাঁসি দিয়ে কথাবার্তা শেষ করলো। আমার কিছু না থাকলে, অন্যের কাছ থেকে নিয়ে আসি। তার এখন ওটার প্রয়োজন নাই। তাই সে দিচ্ছেও। আমরা নিচ্ছি। এভাবে ভালোই আছি। সমাজ জীবনে রাষ্ট্রসেবা তৈরীতে এটার প্রতিফলন ঘটানো যায় না। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্য গিয়ে দেখলাম, যা তারা এটা করছে। এটার নাম দিয়েছে, পিএফআই।
প্রাইভেট ফাইন্যান্সেয়াল ইনিসিয়েটিভ (পিএফআই) রজার আমাদের শিক্ষক। ফাইন্যানসিয়াল ম্যানেজমেন্ট পড়ান। সে জানালো, ‘‘ব্রিটেনের অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা দরকার। বেশী বেশী পাবলিক সেবা পণ্য তৈরী করে জনগণকে দিতে অনেক টাকা দরকার। তাহলেই জনগণ খুশি হবে।’’ জানতে চাইলাম;
‘‘- প্রাইভেট পার্টি টাকা দিবে কেন?’’ জবাবে জানালো;
‘‘- দিবে কারণ তাঁদের কাছে টাকা আছে। ব্যাংক তাঁদের তেমন কোন রিটার্ণ দিচ্ছে না। তারা বেশী রিটার্ণ পেতে রিক্স নিতে দ্বিধা করে না।’’
‘‘- প্রাইভেট সেক্টর রিক্স নিলে সরকার নিতে পারে না কেন?’’ জানতে চাইলাম। জবাবে রজার বললো;
‘‘- সব জায়গার বুরোক্র্যাসি সেলফ ইন্টারেস্টড।’’ রিক্স নিয়ে ফেল করলে তার উপরে ওঠার সিঁড়ি ভেঁঙ্গে পড়েবে। সে রিক্স নিবে কেন?’’ ও আরো জানালো;
‘‘- এ ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর অনেক বেশী মূল্য-সাশ্রয়ী ও কার্যকর। তাই তারা কম খরচ করে যা করতে পারে, পাবলিক সেক্টর পারে না।’’ তাঁর কথার জবাবে জানালাম;
‘‘- তাহলে প্রাইভেট সেক্টর একাই করে না কেন? পাবলিক সেক্টর দরকার হচ্ছে কেন?’’ জবাবে হেয়ালির ছলে জানালো;
‘‘- দরকার আছে বন্ধু, দরকার আছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) না হলে পাবলিক সেবা, পন্য কোনটাই হবে না।’’ শুনেই চমকে উঠলাম। বললাম;
‘‘- আবার পিপিপি। এটা কোন সর্বনাশ ডেকে আনবে কে জানে।’’ তাঁর দৃঢ় জবাব;
‘‘- কোন সর্বনাশ নয়। বরং সর্বনাশের হাত হতে রক্ষা করবে। বিনিয়গের জন্য অর্থ, প্রযুক্তি দরকার। সরকারের কাছে এসব নাই। আছে প্রাইভেট পার্টির কাছে। সরকার যানজট কমাতে একটা ফ্লাইওভার করতে চায়। টাকা নাই তাই করতে পারছে না। প্রাইভেট পার্টির টাকা, প্রযুক্তি দু'টোই আছে। নাই জমি ও অনুমোদন। তাই তাঁরাও করতে পারছে না। সরকার চুক্তি করে জমি, অনুমতি দিলে ফ্লাইওভারটি তৈরী করা সম্ভব। ফ্লাইওভারটি তাঁদের ১০-১৫ বছরের জন্য দেখাশুনার ও টোল আদায় করতে দিলে সরকারের কোন ঝুঁকি থাকলো না। সরকারের টাকার উপর কোন চাপ পড়লো না। জনগণ পাবলিক সেবা পণ্য পেল। প্রতিযোগিতা ভালো হলে ফ্লাইওভারের মান ভালো হবে, মূল্যাটাও কম পড়বে। নিদৃষ্ট সময়ের পর তাঁদের কাছ থেকে সরকার বুঝে নিতে পারবে। প্রাইভেট পার্টিও ব্যবসা হলো। সরকার একটি ফ্লাইওভার পেল।’’
সব শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। মনে হলো এতো আলাদিনের চেরাগ। ‘‘তাহলে, আমরা করছি না কেন?’’ জানতে চাইলাম। জবাবে রজার জানালো;
‘‘- করতে পারছি না। কারণ আমরা প্রকল্প চিহ্নিত করতে পারছি না। আমরা জানি না কোন প্রকল্প প্রাইভেট পার্টির জন্য বিনিয়োগ বান্ধব। প্রাইভেট পার্টির জন্য একটা প্রকল্পকে বিনিয়োগ বান্ধব করতে কি করতে হবে? সরকারী লোকজন এটা শিখলে, মাইন্ডসেটটার একটু পরিবর্তন ঘটলে সম্ভব হবে।’’
সে আরো জানালো;
‘‘- প্রাক-যাচাই এর ভিত্তিতে সরকার প্রাইভেট পার্টিকে জমি, অনুমতি, টোল তোলার অনুমতি দিলাম। তাঁরা প্রাক-যাচাই করে দেখাবে তাঁদের খরচ কত হবে? খরচ তুলতে কত হারে কত দিন টোল তুলতে হবে। লাভ কেমন হবে? এসব জেনে প্রসত্মাব দিলে প্রাইভেট সেক্টও অবশ্যই লাভ করবে।’’ জবাবে বললাম;
‘‘- অবশ্যই হবে। তবে কাজগুলো করবে কে? সরকারী লোকজনকেও জানতে হবে কোন ছলচাতুরী হচ্ছে কি না।’’ রজার হাঁসতে হাঁসতে জানালো;
‘‘- সমস্যা এখানেই। এ ধরনের লোকের অভাব। কাজগুলো করার জন্য কোন বেঞ্চমার্ক নাই। নাই কোন আইনী কাঠামো; প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব। এছাড়া পিপিপি হবে না? এগুলো তৈরী করতে হবে।’’ জবাব দিলাম।
রজার জবাব দিল,
‘‘- ঠিক তাই। তবে এ জন্য সময় দরকার।’’ জবাবে বললাম;
‘‘- তোমরা আগে যাঁরা করেছে তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবো।’’ সে জবাব দিলো;
‘‘- প্রযুক্তি অংশে সম্ভব। মানুষের ক্ষেত্রে নয়। লাফ দিয়ে মানুষকে চাঙ্গে তোলা যাবে না। তাদের ধাপে ধাপে এ কাজের উপযোগী করে তুলতে হবে।’’ হতাশ হয়ে বললাম; হতাশ হয়ে বললাম;
‘‘- এটা কোন কথা হলো। আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলাম। কাজে লাগাতে পারবো না।’’ জবাবে জানালো;
‘‘- পারবো। আমাদের কাজ করতে করতে শিখতে হবে। এভাবে আমাদের মানুষ সম্পদ তৈরী করতে হবে। তা হলে পিপিপিকে কাজে লাগানো যাবে।’’
আহমেদ মোর্শেদ আইসিটি বিভাগের উপ-সচিব। প্রাইভেট সেক্টরের লোকজনের উপর তাঁর আস্থা কম। তার বক্তব্য;
‘‘- এরাও ফাঁকি দিবে। আয় কম, ব্যয় বেশী দেখাবে।’’ জবাবে বললাম;
‘‘- আমি দ্বিমত প্রকাশ করছি না। হিসাব প্রাইভেট সেক্টর একা করলে তাই হবে। প্রাইভেট পাবলিক একসাথে হিসাব করতে হবে। এছাড়াও তাঁদের উপর আস্থা রাখতে হবে।’’ মোর্শেদ হতাশাবাদী লোক। জবাব দিল;
‘‘- নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি, স্যার। অন্যের উপর আস্থা রাখতে পারছি না।’’ জবাবে বললাম;
‘‘- আস্থা না থাকলে পিপিপি নিয়ে আগানো যায় না। পিপিপি-এর ভিত্তিই পার্টনারশীপ। উভয় পক্ষ উভয় পক্ষকে ছাড় দিবে। তৈরী হবে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি। তখনই হবে চুক্তি।
অবাক হয়ে বললো, ’সমঝোতা’।
‘‘- কার মধ্যে কি, পান্না ভাতে ঘি? বাঙ্গালী করবে সমঝোতা?’’
‘‘- কেন নয়? আমরা আগেও করেছি। এটা নতুন নয়। অবাক হয়ে বললো,-‘‘তাই নাকি? এমন উদাহরণ আছে কি, স্যার? জবাবে বললাম;
‘‘- হ্যাঁ আছে। বেশী দেখতে গিয়ে সহযোগিতা, সাহায্য, পার্টনারশীপ সব চুক্তিকে এক করে ফেলেছি। এগুলোকে আলাদা করতে হবে।’’
আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে রূপামত্মর করার পরিকল্পনা নিয়েছে। বেশী বিনিয়োগ নতুন প্রযুক্তি দরকার। বিশাল বিনিয়োগ ক্ষমতা রাজস্ব বাজেট থেকে সম্ভব নয়। দাতা সংস্থা থেকেও এ ধরনের বিনিয়োগে অর্থায়ন আসবে না। অর্থ মন্ত্রী মহোদয় গত দু'টো বাজেটে পিপিপি-এর মাধ্যমে প্রাইভেট বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। সরকারের পিপিপি বাসত্মবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইন্সটিটিউট ফর পলিসি, এ্যাডভোকেসি, এবং গভর্ণেন্স (আইপিএজি) যৌথভাবে পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। পিপিপি প্রকল্প চিহ্নিতকরণ একটি জটিল কাজ। এছাড়াও বিষয়টা বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের কাছে নতুন। কাজটি সহজ করার জন্য সচিব ও পিপিপি বাসত্মবায়নকারী সকল দপ্তর সংস্থার প্রধানদের নিয়ে রূপসীবাংলা হোটেলে ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে সকল সচিবদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ছুটির দিন তবুও গেলাম। মাননীয় অর্থ মন্ত্রী প্রধান অতিথি, মুখ্য সচিব মহোদয় বিশেষ অতিথি; এছাড়াও অনেক লোকজন বিশাল মঞ্চে উপবিষ্ঠ। উদ্বোধনী ভাষনে অর্থ মন্ত্রী মহোদয় অভিযোগ করলেন;
‘‘- আমি পিপিপি এর জন্য বাজেট বরাদ্দ রেখেছি। সাংবাদিকরা সমালোচনা করছে; কারণ এক পয়সাও খরচ হয়নি। খরচ না হোক কাজতো হচ্ছে। গত সপ্তাহেই তো আমরা আইসিটি বিভাগের হাই-টেক পার্ক স্থাপনের একটা পিপিপি প্রসত্মাব অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে পাশ করেছি।’’
উদ্বোধনী অংশ শেষ হলো। কাজের সেশন শুরু। ওয়ার্কশপের বিষয়বস্ত্ত পিপিপি প্রকল্প চিহ্নিতকরণ। ‘রাকেশ বাংগেড়া’ কিভাবে পিপিপি মডেল বাসত্মবায়ন করা যায় তা বোঝাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ইন্ডিয়ান ‘বিল্ড, অপারেট এন্ড ট্রান্সফার’ মডেলের সফলতার গুণগান করছেন। সমাজকল্যাণ সচিব মহোদয় মমত্মব্য করলেন;
‘‘- এখানে উপস্থিত সবাই উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক। কোন মডেল ভালো বা খারাপ এটার চেয়ে কোন ধরণের পিপিপি কোন পরিস্থিতিতে ফলপ্রসু হবে এটা নিয়ে আলোচনা দরকার। ফেল করেছে এমন পিপিপি; কেন ফেল করেছে? এসব নিয়ে আলোচনা করলে আমরা লাভবান হবো।’’
মন্তব্য শুনে বক্তা হাংগেরীর হাইওয়ে পিপিপি ফেলের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। শিক্ষা সচিব, শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন ধরণের পিপিপি নেয়া যায় এ বিষয়ে জানতে চাইলেন। জবাবে বক্তা প্রসংগটি এড়িয়ে গেলেন। পরবর্তী বক্তা ‘দিকবিজয় ভৌমিক’ পিপিপি প্রকল্পের হিসাবরক্ষণ নিয়ে কথা শুরু করলেন। মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা হিসাবে সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য পিপিপি হিসাব সঠিকভাবে প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এত বিস্তারিত তথ্য বাহুল্য, বললেই চলে। কিভাবে হিসাব করতে হবে, এটা সচিবদের কোন কাজে লাগবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সচিব কয়েকটি বিষয়ে বক্তার সংগে দ্বিমত পোষন করলেন। ‘আবেই কন্ঠক’ পিপিপি এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনীকাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব নিয়ে আলোচনা করলেন। বলাবাহুল্য বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট আলোচনার বাহিরে রয়ে গেলো। শেষ বক্তা হিসাবে এ, কে আব্দুল মবিন, সামনের দিকে আগানোর পরামর্শ দিলেন। তাঁর কথায় জিও-এনজিও সহযোগিতার বিষয়টিও পিপিপি হিসাবে দেখানো হলো। এখানে এনজিও সরকারের রিক্স কিভাবে কমাচ্ছে বুঝলাম না। শুনেছি রিক্স শেয়ারিং ছাড়া পিপিপি হয় না। বিতর্ক তুলে আনার ইচ্ছা হলো না। তাই চুপ করে রইলাম। রাত প্রায় ৯:৩০ মিনিট। অনেকে চলে গেছেন। যারা আছেন তাঁদের অনেকে ঘুমাচ্ছেন। ওয়ার্কশপ তাড়াতাড়ি শেষ হোক এটাই সবার প্রত্যাশা।
আর্থিক সহযোগীতা চুক্তির আওতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারী কিছু প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্যেও বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প মূল্যে জনগণকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। বক্তাদের কথাবার্তায় মনে হলো এটাও পিপিপি। সবকিছু গোলমাল হয়ে গেলো। এতদিন জানতাম পিপিপি মানে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ। প্রথমে পাবলিক, তারপর প্রাইভেট, দু’টোর একটা না থাকলে কোন পার্টনারশীপ হবে না। সরকারের কাজের মধ্যে কোন বিজনেস কেইস থাকলেই প্রাইভেট পার্টি আসবে, না থাকলে তাঁরা নাই। তাঁদের জানতে হলে কিছু সুযোগ সুবিধা সুষ্টি করতে হবে। যেমন, ঢাকা ফ্লাইওভার। জমি কিনে প্রাইভেট পার্টি প্রকল্প করবে না। জমির দাম বেশী তাই লাভজনক নয়। লাভজনক করতে সরকার প্রাইভেট পার্টিকে জমি দিয়েছে। ১৫ বছর প্রতিটি গাড়ী থেকে নিদৃষ্ট হারে টোল আদায়ের অনুমোদন দিয়েছে; যাতে লাভসহ বিনিয়োগ ফেরৎ পায়। প্রাইভেট পার্টি প্রকল্পটি নির্মাণ করছে। ১৫ বছর এটার মালিকানাও ভোগ করবে। টোল আদায় করবে; তারপর সরকারকে হস্তান্তর (বিওটি) করবে। বিনির্দেশ অনুযায়ী ফ্লাইওভার তৈরী হচ্ছে কি না; নির্ধারিত হারে টোল আদায় করছে; না বেশী আদায় করছে; ঠিকমত মেরামত হচ্ছে কি না, সরকারকে এ বিষয়গুলোর উপর নজর রাখতে হবে। তা না হলে হাটিকুমরুল-বোনপাড়া টোল রোডের মত শুধু টোল আদায় করে পকেট ভর্তি করবে। মেরামতের কোন কাজ করবে না। তা হলে এ পিপিপিও আগের দু'টো পিপিপি এর মত বাংগালির গলায় কাঁটা হবে। কথাগুলো আমার গানম্যান শুনছিল। নিজেকে চেপে রাখতে পারলো না। জানতে চাইলো;
‘‘- আমাদের কি করতে হবে, স্যার।’’
জবাবে বললাম;
‘‘- আমাদের মানুষ হতে হবে, মানুষের উপর আস্থা আনতে হবে।’’ জবাবে সে জানালো;
‘‘- নিজের উপর আস্থা রাখতে পারছি না, স্যার। পাবলিকের উপর আস্থা রাখবো কি করে।’’
জবাবে বললাম;
‘‘- আপনার কাছে একটি পিস্তল আছে। এটা দিয়ে আমাকে গুলি করতে পারেন। তারপরও আমাদের আস্থা আপনারা আমাদের রক্ষা করবেন। করি না।’’ জবাবে বললো;
‘‘- জ্বী স্যার। এটাই তো আমাদের কাজ।’’
বললাম, এটাই মাইন্ডসেট। পাবলিক, প্রাইভেট উভয়ের মাঝে এই মাইন্ডসেটটা তৈরী করতে হবে। তাহলেই পার্টনারশীপ হবে।’’ জবাবে ও বললো;
‘‘- হলেই হয় স্যার। বললাম;
‘‘- আমরা সবাই ও দিনের অপেক্ষায় রইলাম।’’ গাড়ী বাসার দিকে রওনা দিলো।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||