এলোমেলো ভাবনা

Category: Education Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 7945

উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাষ্ট শহরে আলষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট এর উপর মাষ্টার্স ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করছি। সময় আগষ্ট ২০০০ইং। ফুল আর সবুজে ভরা আলষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়। অতলন্ডিক এর বুক চিরে আসা বাতাস শরীর মনে এনে দিত এক অদ্ভুত প্রশান্তি । ক’দিনের জন্য এই প্রশান্তি ছাড়তে হলো। কোর্সের অংশ হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য আমরা বেলজিয়াম এর রাজধানীতে আসলাম। কোন কাজকর্ম নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটাহাটি করছি। রাস্তার পাশে একটা আকর্ষণীয় বিল বোর্ড। ইংরেজীতে লিখা, বিলবোর্ডটি আমার নজর কাড়লো। বিলবোর্ডটি ইংরেজী হতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়ঃ
“আপনি কি নারী অথবা শিশু? আপনি কি নির্যাতনের শিকার? আমাদের জানান। আমরা ব্যবস্থ্যা নিব।’’

নীচে পুলিশ কর্তৃপক্ষের নাম, ঠিকানা আর বেশক'টি টেলিফোন নম্বর। বিলবোর্ড হতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছি। বিলবোর্ডের ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শিশু অভিযোগ করলে মা অথবা বাবার জেল জরিমানা হবে। তখন শিশুটি কার কাছে থাকবে? কে তাকে লালন পালন করবে? হয়তো বা কোন শিশুসদনে অথবা কোন দত্তক পরিবারের কছে যাবে শিশুটি। আমার মাথায় আসে না, নিজের মা-বাবার চেয়ে শিশুটির অধিকার কে বেশী রক্ষা করতে পারবে? ছেঁড়া ছেঁড়া সবকথা আর ভাবনাগুলোকে জোড়া লাগাবার চেষ্টা করতে করতে হোটেলে ফিরে এলাম।

শহর থেকে বেশ কিছু দূরে কোন এক সময় একটা মানাষ্টির ছিল। অনেকটা আবাসিক মাদ্রাসার মত। সেখানে ছেলেরা এসে বসবাস করতো। উদ্দেশ্য ধর্মকর্ম করা, ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশুনা ও জ্ঞান লাভ করা। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ইউরোপে অনেক দিন আগেই ফুরিয়েছে। কিছু উদ্যোক্তা মানাষ্টিরটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে হোটেল করেছেন। আমরা সেখানেই থাকি। আধুনিকতার ছোঁয়া আছে, তবে মানাষ্টিরের ঐতিহ্যকে একেবারে ফেলে দেয়নি।

হান্সপিটার ইউরোপীয় ইউনিয়ন সচিবালয়ের মাঝারী মাপের একজন কর্মকর্তা। আলষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় হতে আসা শিক্ষক-ছাত্রের সঙ্গে সমন্বয়কারীর কাজ করেছেন। অমায়িক ভদ্রলোক। মানাষ্টির কাম হোটেলে এসেছেন। উদ্দেশ্য আমাদেরকে তাঁর বাসায় দাওয়াত দেয়া। খুশি হলাম। এমন দাওয়াত ইউরোপে মিলে না। কফির দাওয়াত। ছোট্ট একটা বাসা। বেশ গোছানো ছিমছাম। সবখানে রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। মিসেস পিটার একটা কিন্ডার গার্টেনে চাকুরী করেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি ব্যস্ত, এ-ঘর ও-ঘর ছুটাছুটি করছেন। এর ফাঁকেও ‘আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুশি হয়েছেন’, কথাগুলো বলতে ভুলেননি। বাসাটার সবকিছুই একটু আলাদা, তাই এটা ওটা দেখতে দেখতে সময় চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কানে এলো, পিটার কাকে ডাকছেন-
-‘‘কাম অন ইয়াং লেডি। লেট ইনট্রোডিউস উইথ মাই ফ্রেন্ডস ফ্রম বাংলাদেশ।’’

একটা ৯-১০ বছরের ফুটফটে শিশু। পিটার লেডি পেলেন কোথায়? বাড়িতে এক দাঙ্গোল কালো চামড়ার মানুষ দেখে শিশুটি খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। হাত উচু করে ‘হাই’ বলে বিদায় নিলো।
পিটার জানালেন, ‘‘আমাদের একমাত্র কন্যা।’’
পিটার মেয়ের মার স্বীকৃতি দিতে ভুলেনি। আমার নয়, আমাদের কন্যা। ভাল লাগলো পিটারের কন্ঠে মায়ের স্বীকৃতি শুনে।

আমার বিক্ষিপ্ত কিছু ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো। পিটার কেন তাঁর মেয়েকে ইয়াং লেডি বলেছেন। কেন মা নয়। আমি কি আমার ১৮ বছরের দেবযানীকে ইয়াং লেডি বলতে পারি? সেতো ছোট মা। তাঁর মায়া-মমতা মাখা হাতে সে তাঁর বৃদ্ধ ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

কফির দাওয়াত। তাইবলে খাবারেরও কমতি নেই। ভাজাপোড়া, ফলমূল, পানীয় কোন কিছুরই কমতি ছিল না। বাংলাদেশের মঙ্গা পীড়িত মানুষের উদর পূরণের একটা বড় সুযোগ। আমি জন্ম থেকেই তৃণভোজী। তাছাড়া বিলবোর্ড, পিটারের ইয়াং লেডি, কথাগুলো আমাকে ভাবনার অন্ধকারে টেনে নিচ্ছিল। পিটারের ডাকে হঠাৎ নিজেকে ফিরে পেলাম।

-‘‘আর ইউ ফিলিং ব্যাড?’’ পিটার জিজ্ঞাসা করলো। আদৌ না - বললাম আমি।
-‘‘তবে ক’টা বিষয় নিয়ে ভাবছি। কোন উত্তর পাচ্ছি না।’’ জানালাম আমি।
-‘‘কি এমন ভাবনা?’’ জানতে চাইল পিটার। কথাগুলো পাড়তেই প্রথমে একটা বিরাট হাসি। মিসেস পিটারও বাদ গেলেন না।

-‘‘এশিয়ার মানুষগুলোকে নিয়ে এই এক বিপদ। তাঁদের নারী-পুরুষ নাই, আছে শুধু আত্মীয়তা।’’ বললো পিটার।
 
-‘‘তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু শিশুকে মা-বাবার বিরুদ্ধে নালিশ করতে উৎসাহিত করছো কেন? মা-বাবা ছাড়া আর কে তাঁর মানবধিকার নিশ্চিত করতে পারে।’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

পিটার কোন জবাব দিলনা। জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ ঘেরা মেঘের দিকে তাকিয়ে রইল। মিসেস পিটার এর যুক্তি হলো ইউরোপ ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। অর্থনৈতিক আর সামাজিক স্বাধীনতার ফসল হিসেবে মা-বাবা প্রায়ই সঙ্গী বদল করেন। সৎ বাবা-মার দ্বারা শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। তাই পুলিশী ব্যবস্থা। তারপরও ভাবনাগুলো আমাকে ছেড়ে যায়নি। বার বার প্রশ্ন জাগে-
-‘‘শিশুটির আশ্রমের জীবন কি সুখের হবে? সে কি তার শিশু অধিকার ভোগ করবে?’’

হয়তো বা হ্যাঁ, হয়তো বা না। জানে শুধু ভবিষ্যত। পিটার ও মিসেস পিটারের আতিথিয়তা ভুলবার নয়। রাত অনেক হয়েছে। এবার বিদায় দেবার পালা। পিটার তখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুজঁছে।

এত প্রাচুর্য্য, তবু কোথায় যেন লুকিয়ে আছে হাঁহাকার, বেদনা আর যন্ত্রনা। পিটার কি কোন দিন পাবে এশিয়ার কেয়ারিং, শেয়ারিং? ভোগ বাদে এ সবের ঠাঁই কোথায়?