শ্রীপুর থেকে রূপপুর

Category: Bangladesh Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 6625

 

শ্রীপুর আর রূপপুর; দু’টোই বাংলাদেশের দু’টি গ্রাম। একটা গাজীপুর জেলায়, অন্যটা পাবনা জেলায়। নামে কি অদ্ভুত মিল! শ্রী, রূপ দু’টোই সৌন্দর্যের অপর নাম। আসলেই সুন্দর দু’টো গ্রাম। গাছ, লতা-পাতা দিয়ে ঢাকা নয়নাভিরাম দুটো জায়গার নাম শ্রীপুর, রূপর। শ্রীপুর-রূপপুরকে ঘিরে জড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের দু’টো ইতিহাস। ঘটনাচক্রে আমিও জড়িয়ে পড়েছি নয়নাভিরাম এই দু’টো গ্রামের সাথে।

২০০৭ সাল, যুগ্মসচিব হিসাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যোগদান করলাম। আন্দোলনের মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ সাহেব তার সকল নির্বাচন কমিশনার নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে ড.এ.বি.এম শামসুল হুদা যোগদান করেছেন। সংগে একজন সাবেক বিচারপতি এবং একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার নির্বাচন কমিশনার। বিচারপতি আজিজ সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার তৈরী ভোটার তালিকায় কোটির উপরে ভুয়া ভোটার। কেয়ারটেকার সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দিবে। গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত। গোদের উপর বিশ ফোড়া, ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি ভোটার এলাকায় শতাধিক ভুয়া ভোটার চিহিৃত করা হয়েছে। একজন স্কুল শিক্ষক আদালতে মামলা করেছেন। আদালতের রায় ভোটার তালিকা ত্রূটিমুক্ত করে নতুন ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন করতে হবে।

 

নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়ে সচিবালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক, সাধারণ জনগণের সাথে আলোচনা করলো। আলোচনা থেকে বাহির হলো গোড়ায় গলদ। ভোটার তালিকা আইন এবং ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়াটাই ক্রটিপূর্ণ। তখনকার ভোটার তালিকা আইনে যেকোন ব্যক্তি একাধিক জায়গায় ভোটার হতে কোন বাধা নাই। খোজ নিয়ে জানলাম, আমি নিজেই ঢাকা ও গোদাগাড়ীতে ভোটার। আমি ভুয়া ভোটার নই। দুই জায়গায় ভোটার ইনমেনারেটরগণ বাড়ী বাড়ী যায় না। তারা একজনের কাছ থেকে শুনে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করেছেন। নাম ঠিক নাই, বাবার নামে গন্ডগোল, তারা সবাই ভুয়া ভোটার।  ঠিক হলো, ভোটার তালিকা আইন ত্রূটিমুক্ত করে, ভোটার নিবন্ধন পদ্ধতিতে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে ভোটারের তথ্য নির্ভুল হয়। একজন ভোটার দুই জায়গায় ভোটার হলে তাঁকে যেন চিহিৃত করা যায়। উচ্চ পর্যায়ের কারিগরি কমিটি ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরী করার পরামর্শ দিলো। ইলেকট্রনিক তালিকায় আংগুলের ছাপ থাকবে যা ব্যবহার করে দ্বৈত ভোটারকে চিহিৃত করা যায়। আরও সমস্যা দেখা দিলো, কোথায় ছবি তোলা হবে, কোথায় কিভাবে আংগুলের ছাপ নেয়া হবে? কিছু লোক মন্তব্য করলো, গ্রামের ধর্মভীরু মানুষ বিশেষ করে মহিলারা ছবি তুলতে চাইবে না, আংগুলের ছাপ দিবে না। এ সকল যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে ঠিকমত চালানোর জনবল পাওয়া যাবে না। কথাগুলো সত্যি কি না জানা দরকার। এসব না জেনে সারা বাংলাদেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরীর কাজ শুরু করা ঠিক হবেনা । ঠিক হলো পাইট করা হবে। কিন্তু কোথায়? এমন এক জায়গায় পাইলট প্রকল্প করা হবে, যেখানে কারখানা আছে। শহরের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, আবার রয়েছে বাংলার গ্রাম। পাইলট প্রকল্পের জন্য ঠিক হলো শ্রীপুর।

কোকিলের কুহু কুহু দিয়ে শ্রীপুর আমাদের স্বাগত জানালো। পাখির কিচির-মিচির, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁ শব্দ আবেগ আপ্লুত করে রেখে ছিল। উঠেছি শ্রীপুর ডাকবাংলোয়। পুরাতন একটা বিল্ডিং। রাতে মশা আর পোকার উৎপাত। ঘুটটে অন্ধকারে জোনাকী পোকার আলো। হৃদয় কাড়ছে। মশা আর পোকার জ্বালায় ঘুমাতে পারলাম না। জোনাকীর আলো দেখে রাত কাটলো।  ব্যবস্থাপনার বিশালত্ব, কারিগরি জটিলতা, সবকিছু মাথায় রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভোটার তালিকা প্রণয়নের সাথে সম্পৃক্ত করা হলো। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কারিগরি কমিটি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই সুযোগে ভোটারদের একটা ন্যাশনাল ডাটাবেস তৈরীর কথা বললো । সাথে সামান্য কিছু খরচ করে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরীর কথাও তুলে ধরলো। চমৎকার আইডিয়া; নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুরু করলো ভোটার তালিকার কাজ। 

তথ্য সংগ্রহের জন্য ফরম তৈরী, তথ্য সংগ্রহকারী, ডাটাএন্টি অপারেটর নির্বাচন, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান। আরেক দল মাঠে নামলো সচেতনতা সৃষ্টির কাজে। একটা মহেন্দ্রক্ষণে আমরা শুরু করলাম মূলকাজ। তার আগে ডাটাএন্ট্রি অপারেটরগণ নিজেদের তথ্য ল্যাপটপে এন্ট্রি, হাতের আংগুলের ছাপ নিয়ে ছবি তুলে হাত পাকালেন। মাত্র ৩ দিনের ট্রেনিং নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারীরা নির্ধারিত ফরমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করলো; ডাটাএন্ট্রি অপারেটরগণ তথ্যগুলোকে ডিজিটাইজ করলো। সব আশংকা দূর করে শ্রীপুরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছবি তুললো, আংগুলের ছাপ দিল। তৈরী হলো শ্রীপুরবাসীর নাগরিক তথ্যভান্ডার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাপানো হলো শ্রীপুরের ভোটার তালিকা, পরিচয়পত্র। বিতরণ করা হলো সবার কাছে। রঙ্গিন ছবিসহ পরিচয়পত্র হাতে পেয়ে শ্রীপুরবাসীর কি যে আনন্দ! আনন্দের চোটে কেউ কেউ একাধিকবার ছবি তুলেছে। ফিংগার প্রিন্ট ব্যবহার করে একটা সফটওয়ার দিয়ে চিহিৃত করা হলো দ্বৈত ভোটারদের; একটা রেখে অন্যগুলো বাদ দেয়া হলো। 

শ্রীপুর এর অভিজ্ঞতাকে পুজি করে নামলাম পর্যায়ক্রমে সারাদেশের ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরীর কাজে; তৈরী হলো ন্যাশনাল ডাটাবেস, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ পেলো একটি পরিচয়পত্র। পরিচয় পত্রের নম্বরটি ইউনিক। এই নম্বর দিয়ে সব মানুষকে চিহিৃত করা যায়।  শ্রীপুর পাইলট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে এক অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজে হাত দিয়েছিলাম। সারা বিশ্বের নজর ছিল শ্রীপুরের দিকে শতশত দেশ থেকে প্রতিনিধি আসছেন, দেখছেন, কথা বলছেন। শ্রীপুর বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত এক নাম। শ্রীপুরের শ্রী আরও বেড়ে গেল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাংলা ডাটাবেইস এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে শ্রীপুরের নাম।

শ্রীপুরকে নিয়ে আমার, আমার সহকর্মীদের, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেটেছে অনেক বিনিদ্র রজনী। দু:খ, কষ্ট, উৎকন্ঠা, আনন্দ মেখে আছে শ্রীপুরকে ঘিরে। হয়তো আজ সবাই ভুলে গেছে পিছনের এই মানুষগুলোকে । আজো বেঁচে আছে বিশ্ববাসীর কাছে শ্রীপুরের নাম।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, ইউনিয়ন নির্বাচন নিয়ে সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে অতিরিক্ত সচিব হয়ে নির্বাচন কমেশনেই ছিলাম। ২০১১ সালের জুন মাস, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসাবে পোস্টিং হলো। বসার জায়গা নাই, অফিসার ও পিয়ন কেউ নাই। জানলাম কালিয়াকৈর, গাজীপুর এ হাইটেক পার্ক হবে। দেখতে গেলাম। বিশাল জায়গা, একটা প্রশাসনিক ভবন তৈরী হয়েছে। কোন কাজ-কর্ম নাই। তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পরিত্যক্ত জায়গাই হবে হাইটেক পার্ক। ভেবেছিলাম এটাও বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনার শিপে পার্ক ডেভেলপার নিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে এক বছর এক মাস পার হয়ে গেল। বিভাগ আলাদা মন্ত্রণালয় হলো। আমি সচিব হয়েছি। কালিয়াকৈর আগের জায়গায় রয়ে গেল। বদলী হয়ে আসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রলায়ের সচিব হিসাবে।

বাংলাদেশ পরামাণু শক্তি কমিশন রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যাদি সম্পাদনের জন্য একটা প্রকল্প চলমান আছে। কমিশনের একজন পরিচালক শৌকত আকবর প্রকল্পের পরিচালক।  ১৯৬২ সালে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরমাণু বর্হিভুত ভৌত আবাসিক অবকাঠামো সৃষ্টি করা হয়। পরে পাকিস্থান সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে প্রকল্পটি নিয়ে যায় করাচিতে। অর্ধসমাপ্ত অবকাঠামো আজ ধ্বংসস্তুপ।

পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে ইন্টার গর্ভানমেন্টাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়েছে। রাশিয়ান সরকার পরমাণু শক্তি টেকনোলজি, ফুয়েল দিবে, অর্থায়ন করবে, ব্যবহৃত ফুয়েল ফেরৎ নিবে। অর্থায়ন চুক্তি হলেই রাশিয়ান ফেডারেশনের ঠিকাদার এটমস্টয়এক্সপোর্ট কাজ শুরু করবে। নিগোশিয়েশনের জন্য অর্থ উপদেষ্টাকে আহবায়ক করে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বেশ কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। রূপপুর যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়ে উঠেনি। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। স্কুলে পড়ার সময় রূপপুর আমাকে আছন্ন করে রেখেছিলো। আমি চাইলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম। চাইনি, চেয়েছিলাম পরমাণু বিজ্ঞানী হতে। আবেগতাড়িত হয়ে, ভর্তি হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিভাগের ছাত্র হিসাবে। দেড় মাসের মাথায় পেট্রোকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বুলগেরিয়া পাড়ি জমালাম। পরমাণু বিজ্ঞানী হওয়া হলো না। পেট্রোকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারও হওয়া হলো না, বুলগেরিয়া থেকে অর্থনীতি শাষ্ত্রে ডিগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে আসলাম। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সহকারী সচিব হিসাবে যাত্রা শুরু করে আজ সচিব। কৈশোরের স্মৃতি স্মরণ করে স্বস্তি পেলাম। পরমাণু বিজ্ঞানী হতে না পারলেও পরমাণু ব্যবস্থাপক, প্রশাসক হতে পেরেছি । নিজের মধ্যে একটা গর্ব অনুভব করলাম।

নিগোশিয়েশন কমিটি প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ করে ফিরে এসেছে। আবারো যাবেন। নিগোশিয়েশন কমিটিতে সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাখা হয়নি । যুগ্মসচিব (উন্নয়ন), রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর উদ্যোগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিবকে টিমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরেরবার আমাকেও টিমের সাথে যেতে হবে। ভাবলাম একবার রূপপুর ঘুরে আসা দরকার। হলো না, তার আগেই নিগোশিয়েশন টিমের সাথে চুক্তি চুড়ান্ত করতে রাশিয়া যেতে হলো। রাত ১১.০০ টায় মস্কো বিমানবন্দরে নামলাম। বাহিরে হিমাংকের নিচে ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। চারিদিকে সাদা তুলার মত বরফ দিয়ে ঢাকা। টিমের সদস্যদের জমে যাওয়ার অবস্থা। আমার শীত এমনিতেই কম লাগে। কোর্ট গায়ে খোলা আকাশের নীচে হেটে বেড়িয়েছি। প্রতিমন্ত্রী মহোদয় শংকিত। কয়েকবার সাবধান করেছেন। পরে সচিবের ব্যাটাগিরি নামে একটা কবিতা লিখে বসলেন। মজার একটা ছড়া। নিগোশিয়েশন হলো, প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শেষ করার জন্য রাশিয়ান ফেডারেশন ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার দিবে। মূল প্রকল্পের জন্য টাকার অংক নির্ধারিত হলে অন্য একটি চুক্তির অধীনে তাঁরা মোট ব্যয়ের ৯০% অর্থায়ন করবে। চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকের খসড়া চূড়ান্ত করে দেশে ফিরলাম।

রূপপুর থেকে ঘুরে আসা দরকার। একটা প্রোগ্রাম দিয়ে বৃহস্পতিবার রূপপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়লাম। যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে হাটিকুমরুল হয়ে বনপাড়া, সেখান থেকে পাবনার পথ ধরে ঈশ্বরদীর একটা ইউনিয়ন রূপপুর।

রাত বারোটা। আমার গাড়ীটা হাটিকুমরুল পার হয়ে রাস্তার মাঝখানে নষ্ট হয়ে গেল। আমার সাথে অর্থ বিভাগের এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্মসচিব, প্রকল্প পরিচালক আর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ফিরোজ। অতিরিক্ত সচিব দু’জন গাড়ী ধাক্কা দিচ্ছেন। স্টার্ট নিচ্ছে না। পরে পুলিশ ডেকে গাড়ী তাঁদের জিম্মায় রেখে প্রকল্প পরিচালকের মাইক্রোবাসে রাত ১-৩০ মিনিটে রূপপুর পৌঁছলাম। পাশে লালন শাহ সেতু, চাইনিজ ঠিকাদার সেতু নির্মাণ করার সময় থাকার জন্য বাংলো তৈরী করেছে। নাম চায়না কটেজ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজের জন্য কটেজগুলো পরমাণু শক্তি কমিশনের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এখনও পাওয়া যায়নি। তবে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। একটা কটেজে উঠলাম। সকালে উঠে নাস্তা সেরে হাটছি। অবিকল আর একটা শ্রীপুর। গাছ, লতাপাতা ঢাকা একটা গ্রাম।

সন্ধ্যায় কেডস পায়ে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাইটে গেলাম। শেয়ালের হুক্কা-হুয়া কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। রাস্তায় বড় সাইজের একটি শেয়াল পথ রোধ করে দাড়ালো। তাঁকে বিরক্ত করলাম না। পাশ দিয়ে চলে আসলাম। সাইটে হাটছি। রশির মত একটা কিছু পায়ে জড়িয়ে আছে। ছাড়ানোর জন্য হাত দিলাম। ঠান্ডা নরম মনে হলো। বুঝলাম সাপ। পা ঝাড়া দিয়ে ছুড়ে ফেললাম। পরের দিন সকালে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, প্রকল্পের সাইট অফিসারের সাথে কথা হলো। রূপপুর সাইট অফিস দেখতে গেলাম। পদ্মার পাড়ে উচু-নীচু বালুর চর। তেমন কিছু করার ছিল না। পরের দিন ঢাকা ফিরে আসলাম।

১৫ জানুয়ারী, ২০১৩ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসংগী হয়ে রাশিয়া গেলাম। ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি পুতিনকে বললেন, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমি আমার জনগণের ক্ষতিকর কোন কাজ করতে পারবো না। জবাবে পুতিন জানালেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রযুক্তি বাংলাদেশকে সরবরাহ করা হবে। মূল নির্মাণ কাজের জন্য সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। দেশে ফিরলাম।

এটমস্ট্রয়একপোর্ট এর সাথে চুক্তি করতে হবে। তার আগে জমি সংক্রান্ত সব কাজ শেষ করা দরকার। আবারও রূপপুর যেতে হলো। জেলা প্রশাসক, এসিল্যান্ডকে এক মাসের মধ্যে জমি সংক্রান্ত সব কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়ে এক রাত কাটিয়ে ঢাকা ফিরলাম।

ঢাকা বিমানবন্দরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে বসে আছি। ভিয়েনা যাবো, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার জেনারেল কনফারেন্সে। প্রথম আলো প্রতিবেদন ছেপেছে, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব; আমরা প্রস্তুত নই, প্রয়োজনীয় লোকবল নাই, সাইট উপযোগী নয়, আমরা হেলিকপ্টারে শুধু রূপপুর যাচ্ছি আর আসছি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরীর সময় একই কথা শুনেছি। সেদিনও বলা হয়েছিল আমরা তৈরী নই। জনবল নাই। আমরা সেদিন বিজ্ঞজনদের মতামত শুনলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারতাম না। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বাংলা ডাটাবেইস নিয়ে গর্ব করতে পারতো না। জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরী হতো না। রাধা নাচবে, বারো মন ঘি জোগাড় করতে হবে। আমরা কি বসে থাকবো? সচিব ডিসেম্বরের ঠান্ডায় চলন বিলের মাঝখানে বসে আছে। দুইজন অতিরিক্ত সচিব গাড়ী ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাস্তায় জ্যামে ১৪ ঘন্টা আটকা পড়ে থাকছেন। পত্রিকায় লিখা হচ্ছে, আমরা হলিকপ্টারে যাচ্ছি আর আসছি। এ কষ্ট রাখবো কোথায়?

এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট এর সাথে ২য় চুক্তি নিগোশিয়েশন চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রথম পর্যায়ের কাজের শুভ উদ্বোধন করবেন। রাশিয়ান ফেডারেশন, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার প্রতিনিধিরা আসবেন। ধুধু বালু চরে প্যান্ডেল, হেলিপ্যাড, রাস্তা তৈরী করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, ফিরোজ ওখানে পড়ে আছে। আবারো গেলাম রূপপুরে। রোলার দিয়ে মাটি সমান করা হয়েছে। প্যান্ডেলের মাটিতে ইটসোলিং করা হচ্ছে, রাস্তার কাজ চলছে। ভয় হলো কাজ শেষ হবে তো? সবাইকে সাহস জাগিয়ে ঢাকা ফিরলাম।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ তারিখ রূপপুর গেলাম। রবীন্দ্রনাথ বালুচরে একটা মরুদ্যান তৈরী করেছে। রংবেরং এর পতাকা। পাশের গ্রামগুলো হতে হাজার হাজার মানুষ দেখতে এসেছেন। মনে হলো মেলা বসেছে। সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি উপেক্ষা করে দূরদূর বুকে গ্রামের মানুষগুলো উকি-ঝুকি দিচ্ছে। একটা অভাবনীয় দৃশ্য। রাস্তা, হেলিপ্যাডের কাজ শেষ হয়েছে। প্যান্ডেল তৈরীর কাজ চলছে। ১লা অক্টোবর রাত, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। শ্রীপুরেও উদ্বোধনের আগের রাতে এমনই বৃষ্টি ঝরছিল। কি অদ্ভুত মিল। ২রা অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নামলেন। সবকিছু সাজানো গোছানো। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হলো। রূপপুর ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে নাম লিখালো।