হুদা ভাই মারা গেছেন। শুক্রবার ১৬ মাচ©, ২০১২ বাদ আসর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে কুলখানির মিলাদ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটা প্রকল্পে নিয়োগ পরিÿv ছিলো। আমার নিজের কোন দায়িত্ব ছিল না। সচিব হিসাবে সব দায়িত্বই আমার, তাই আসতে হলো। পরীÿv শেষ করে অফিসার্স K¬v‡e গেলাম। হুদা ভাই এর বউ নার্গিস, মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর। কাঁদছেন, তাঁদের মেয়ে বুড়ি, আসল নাম জানার প্রয়োজন হয় নি।
জিজ্ঞাসা করলো;
-‘‘ আংকেল এসেছেন ?’’
ঠোট দু’টো কাঁপছিল। কোন জবাব আসছিলো না। বললাম;
-‘‘ তোর বাবার মিলাদে আসতে হবে কোন দিন ভাবতে পারিনি। এটাই সত্য হলো। আসতেই হলো।’’
নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য বুড়ি প্রসংগ পাল্টালো;
-‘‘ আংকেল ভিতরে যান। মিলাদ শুiæ হবে। আমি অন্য দিকগুলো সামাল দিয়ে আসি।’’
কোন জবাব দেয়ার আগেই বুড়ি কোথায় হারিয়ে গেল।
হুদা ভাই এর বড় ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। গায়ে গতরে বড় হলেও কোন কিছু বোঝে না। সাদা কাপড়ে ঢাকা মেঝের উপর, অনেক মানুষ। সামনে দু’জন মৌলভী দোয়া দiæদ পড়ছেন। হুদা ভাই এর বড় ছেলেটা একটা চেয়ারে বসে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। এ সবের কোন অর্থ তাঁর হয়তো তাঁর জানা নাই।
নার্গিসের সব ছোট ছেলে অষ্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে। ৬ মার্চ, বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দেশে এসেছিল। তিনদিন থেকে অষ্ট্রেলিয়া চলে গেছে। মিলাদে সে নাই। তাই সব দায়িত্ব বুড়ির ঘাড়ে। পাশেই মিনু দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করলো;
-‘‘ ওকে চিনতে পেরেছো ?’’
আমি জবাব দিলাম;
-‘‘ দেখা তেমন একটা হয়নি অনেক দিন। তাই বলে এই আপনজনকে চিনতে অসুবিধা হবে ?’’
জবাবটা মিনুকে সšÍষ্ট করতে পারেনি। তাঁর সন্দেহটা রয়ে গেছে। আবারো প্রশ্ন করলো;
-‘‘ বলতো ও কে ?’’
রাগ হচ্ছিল। মরা উপল‡ÿ মিলাদ, তা না হলে অন্যভাবে জবাব দিতাম;
-‘‘ ও হুদা ভাই এর কে হয় জানি না। ও আমাদের বুড়ি।’’
জবাবটা শুনে মিনু কথা বাড়ালো না। দেখলাম, নার্গিস চোখ মুছতে মুছতে আসছে। সামনে এসেই বুক ফেঁটে কান্না, বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
-‘‘ আপনাদের হুদা ভাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেল, আমাদের কি হবে ?’’
জবাব দিতে কষ্ট হচিছল, তারপরও শাšÍনা দিলাম;
-‘‘ সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে নার্গিস। কেউ আগে, কেউ পরে।’’
নার্গিস অঝোরে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো;
-‘‘ হুদা ভাই নাই। তাই বলে আমাদের ভুলবেন না। অšÍত খোজ খবর নিবেন। বাসায় আসবেন।’’
আমি হুদা ভাইকে চিনতাম না। মিনু, নার্গিস, ফেরদৌস আপা, শর্মী এক সংগে শিÿvভবনে চাকুরী করতো। চাকুরীর সুবাদে সখ্যতা। সেখান থেকে একে অপরের বাসায় যাওয়া আসা, পরিচয়। হুদা ভাইয়ের সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল না। তিনি গণপূর্ত বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার, শেওড়াপাড়ায় বাড়ি বানিয়েছেন। মোটামোটি বড়। বড়সড় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাইলে শেওড়াপাড়া বেশ ভালো জায়গা। নার্গিস তাঁর বাড়ীতে আমার জন্মদিন উপল‡ÿ একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এই অনুষ্ঠানে গিয়ে হুদা ভাই এর সাথে পরিচয়। প্রথম পর্যায়ে পরিচয়টা মুলত নার্গিসের স্বামী হিসাবে। পরে অনেক উপল‡ÿ শেওড়াপাড়া গেছি।
নার্গিসের অনভুতির জবাব দিতে গিয়ে মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল;
-‘‘ নার্গিসকে দিয়েই হুদা ভাই এর সংগে পরিচয়। যে ক’বার শেওড়াপাড়ায় গেছি নার্গিসের জন্যই গেছি। ভবিষ্যতেও যদি যাই, নার্গিসের জন্যই যাবো।’’
নার্গিস কাঁদছে। মিনু তাঁকে বুঁকে জড়িয়ে ধরে শাšÍনা দিচ্ছে। মিলাদ শুiæ হয়ে গেছে। মৌলভী সাহেবের গলা শোনা যাচ্ছে,
-‘বালাগাল ওলামায়ে বে কামালেহি, কাসাফাদ্দো যাবে জামালেহি.......................’
ভিতরে গিয়ে বসার জন্য স্যান্ডেল সুগুলো খুলছি। পরিবেশ বিনষ্টকারী পলিথিনের একটি ব্যাগ একজন বাড়িয়ে ধরলো। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। ভাবছি এটা কেন ? এটা দিয়ে আমি কি করবো? এর মাঝে অন্য একজন ছেলেটার হাত থেকে একটা পলিথিন টেনে নিয়ে পায়ের স্যান্ডেলগুলোকে ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে কাপড় বিছানো মেঝের সামনে রেখে মিলাদে যোগদিলেন। মিলাদ চলছে।
-‘‘ আjøvûম্মা সv‡jø আলা সাইয়াদেনা মাওলানা মোহাম্মদ,.................’’
নিজেকে ফিরে পেলাম। বুঝলাম পলিথিনটা কেন ? ছেলেটা আর একটা ব্যাগ সামনে ধরে আছে। বললাম;
-‘‘ লাগবে না।’’ ছেলেটা অবাক হলো। পরে সতর্ক করলো;
-‘‘ স্যান্ডেল পায়ে মিলাদে যেতে পারবেন না।’’ নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিলাম;
-‘‘ যাবো না।’’ জবাব শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলো;
-‘‘ মিলাদে এসেছেন কি ?’’ বললাম;
-‘‘ হ্যাঁ।’’
অবাক হয়ে ছেলেটার অজা‡šÍই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো।
-‘‘ তা হলে ?’’
-‘‘ আমি জানি বাবা, জুতা পায়ে দিয়ে গেলে চাদরগুলো নষ্ট হবে। তাই পলিথিনের ব্যবস্থা করেছো। এজন্য তোমাদের ধন্যবাদ। চাদরের দাগ বাঁচাতে গিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢাকা শহরের যে সর্বনাশ তোমরা করছো আমি এটা পারবো না। আমি স্যান্ডেল খুলে এ গুলো এখানে রেখে যাবো।’’ আমার কথা শুনে সে হতবাক হয়ে বললো;
-‘‘ সর্বনাশ। কি বলছেন আংকেল ? বিদেশী দামি স্যান্ডেল। চুরি হয়ে যাবে ?’’ নিজে নিজে বললাম;
-‘‘ হ্যাঁ দামি। হাসপাপিজ।’’
তারপরও পলিথিন নিয়ে ছেলেটা তাকিয়ে আছে। আমি স্যান্ডেলগুলো খুলে দরজার কোনায় রেখে মিলাদে যোগদিলাম। হুজুর নির্দেশ দিলেন।
-‘‘ আপনারা সাতবার দiæদ শরীফ; সাতবার কুল আjøvহু আহাদ..... সুরা পড়ুন।’’
সমাবেত সুধী বিড়বিড় করে দiæ` শরীফ ও কুলআjøvহু সুরা পড়ছেন।
আমাকে নষ্টালজিয়া পেয়ে বসলো। বড় মজার মানুষ ছিল হুদা ভাই। দু’টো কাজ খুব বেশী পছন্দ করতেন; খেতে আর রসিকতা করতে। মাঝে মধ্যে বোমা ফাটানোর মত কথা বলে ফেলতেন। নার্গিসের সম্পর্কের ছোট বোন শেওড়াপাড়ায় নার্গিসের সাথে থাকে। বিয়ে ঠিক হয়েছে একজন বিসিএস কলেজ শিÿকের সাথে। বোনটা নার্গিসের মতই সুন্দর। একদিন আড্ডায় মেয়েটার সামনেই হুদা ভাই বলে ফেললেন;
-‘‘ রফিক ভাই দেখেন না। আমার শালীটা কি আহম্মক।’’
বুঝেছি হুদা ভাই কোন বোমা ফাটাবেন। বললাম বলেন শুনছি।
-‘‘ আমি ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ী গাড়ী সব কিছু আছে। বিয়ে যদি করতে হয় তা হলে পাত্র খোঁজার দরকার কি ? আমি তো আছি।’’
শর্মীর স্বামী ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার; হুদা ভাইকে তাল দিলেন;
-‘‘ হ্যাঁ ঠিক। এটাই তো হওয়া উচিৎ।’’ হুদা ভাই উৎসাহিত হলেন;
-‘‘ দেখেন না। উনি বিয়ে করার জন্য একটা কলেজের মাস্টার ঠিক করেছেন। আমার এই সুন্দর শালিকাটিকে কি কলেজের মাস্টারের বউ হিসাবে মানায় ?’’
মি: ফেরদৌস মানে বাদশা ভাই, মিচকা টাইপের। হুদা ভাইকে উস্কে দিলো;
-‘‘ ইঞ্জিনিয়ার আমলা ছাড়া ওর পাশে আর কোন কিছু মানায় না। হুদা ভাই ঘরের মুরগী, ডাল বরাবর, ভালো লাগবে না। রফিক ভাইকে ধরতে পারতো ? দ্বিতীয় তাকে কি; আমলার বউ বলে কথা।’’
হুদা ভাই এর শালিকাটি মুখ লাল করে হলেও এতোÿন আড্ডায় ছিল। আর পারছিল না। মুখ খুললো;
-‘‘ বুঝেছি আপনাদের মুখে কিছু না দিলে মুখ বন্ধ হবে না। আমি উঠি, আপনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করি।’’
হুদা ভাই হাঁক ছাড়লেন;
-‘‘ নার্গিস, রফিক ভাই আছেন। গাইটার লাইগ্যা কিছু ঘাস ভুঁসি আনা আছে। ওখান থ্যাইকা কিছু টেবিলে দাও। তা না হলে জাত সম্মান যাবে।’’
হুদা ভাই এর কথা শুনে পুরো আড্ডা হাঁসিতে লুটিয়ে পড়েলো। খাওয়াদাওয়া শেষ। হুদা ভাই আবারও শুiæ করলেন;
-‘‘ একটু বেশী হয়ে গেল। বুঝছেন রফিক ভাই ভালো ভালো রান্না করে আমাকে নার্গিস হাতি বানাচ্ছে।’’
নার্গিস wÿপ্ত হয়ে জবাব দিলো;
-‘‘ খাওয়ার সময় হুশ থাকে না। যত দোষ আমার।’’ আড্ডা শেষ হলো।
মিলাদ চলছে আমি আমার স্মৃতির পর্দায় ভেসে বেড়াচ্ছি। আমি ও হুদা ভাই উপ-সচিব হলাম। হুদা ভাই এর নামটা দেখে অবাক হলাম। দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলাম;
-‘‘ ভাই কি মনে করে আমাদের খাতায় নাম লিখালেন।’’
হুদা ভাই এর সেই স্বভাব সুলভ জবাব;
-‘‘ কি করবো ভাই, পরিচয় দেয়া যায় না। ইঞ্জিনিয়ার বললেই সবাই ভাবে চোর। ইঞ্জিনিয়ারিং করে তো দেখলাম, এবার নি¤œ¯^vÿরকারী আদিষ্ট হয়ে কাজ করে দেখি। একটা মাত্র চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পদ। পেলেই এক্সটেনশন, তারপর চুক্তিভিত্তিক। কোন ফাঁক নাই। আপনাদের সাথে সচিব হওয়া যায় কি না, দেখি।’’ বললাম;
-‘‘ নি¤œ¯^vÿরকারীকে স্বাগতম।’’
নার্গিস, মিনু, শর্মী, ফেরদৌস আপা সবাই শিÿvভবন ছেড়েছে। তবে তাদের গাঁটছড়া অটুট আছে। সবাই নিজেকে, ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্য¯Í। আগের মত আড্ডা বসে না। জমেও না। একদিন কি কাজে ফেরদৌস আপা কলাবাগানে আমাদের বাসায় আসলেন। মুখে একরাস বিরক্তির ছাপ। জিজ্ঞাসা করলাম;
-‘‘ আপা এতো বিরক্ত কেন ?’’ জবাবে তিনি জানালেন;
-‘‘ আর বলেন না ভাই। দু’আমলার বউকে নিয়ে আর পারছি না।’’
বুঝলাম মিনু, নার্গিসের নতুন পদবী জুটেছে, আমলার বউ।
শেওড়াপাড়ার চিপাগলি, মোহাম্মদপুরের বাদশা ভাই এর বাসা, শর্মীর মহাখালির কলোনীর রা¯Ív¸লো আপন হয়েছিলো। কফি হাউজের সেই আড্ডার মত আজ আর নেই। ফোরদৌস আপা, শর্মীরা কোথায়; আজ জানাও নাই। মাঝে মধ্যে মিনুর সেলটা বেজে উঠে। সে ব্য¯Í থাকলে বলে;
-‘‘ মোবাইলটা ধরো না।’’ ধরার সাথে সাথে,
-‘‘ মিনু।’’ জবাবে বলি;
-‘‘ আমি মিনু না, রফিক।’’ আপনি কে বলছেন;
-‘‘ রফিক ভাই, আমি ফেরদৌস আপা। মিনু কি ব্য¯Í। না হলে ওকে একটু দেন। আর ব্য¯Í হলে ওকে বলবেন, আমি ফোন করেছিলাম। ও যেন সময় মতো ফোন করে। কথা আছে।’’ সংwÿপ্ত জবাব;
-‘‘ আচ্ছা! বলবো।’’
মিলাদ চলছে। ইমাম সাহেব আjøvহ্ তালার কাছে আকুতি মিনতি করছেন;
-‘‘ হে আjøvহ্, হে রহমানের রহিম, আjøvহ্ তুমি সব পারো। হে আjøvহ্ তোমার বান্দারা দiæদ পড়ে, পবিত্র কোরান খতম করেছেন আjøvn& আjøvহ্ এই দোয়া দiæ`দের অছিলায় তুমি জনাব হুদা সাহেবের সব গুণা মাফ করে দিয়ো আjøvহ্।’’
ইমাম সাহেবের দোয়ার ফাঁক দিয়ে আমি ঘুরে বেড়াছি আমার স্মৃতির পাতায় পাতায়। হুদা ভাই আমি এক সংগে যুগ্ম-সচিবও হলাম। দু’জনকেই সিনিয়র স্টাফকোর্সে পাঠানো হলো। এসাইনমেন্ট, রিপোর্ট লিখা, এ সব তো আছেই; তারপর সকাল বিকাল পিটি প্যারেড। নিজের এ্যাসাইনমেন্ট না লিখলেও অন্যেরটা লিখে দিতে হয়। ব্য¯Í থাকি। পিটি প্যারেডে আমি সিরিয়াস। হুদা ভাই নির্বিকার। এ সব দিয়ে কি হবে ? পরীÿv আর এ্যাসাইনমেন্ট এর চাপে নড়তে পারি না। খাওয়ার টেবিলে হুদা ভাই নাই। অসুখ বিসুখ হলো কি না জানার জন্য iæমে উকি দিলাম, নাই। সকালে পিটিতেও ফাঁকি। ক্লাশে দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম;
-‘‘ কোথায় কাঁট মেরে ছিলেন ?’’ জবাব;
-‘‘ আরে রফিক ভাই জানেন তো নার্গিস একা থাকতে পারে না। আর আপনারা যা খাওয়ান, কি করবো ? তাই একটু ঢু মেরে আসলাম।’’
মনে মনে ভাবতাম, ‘এমন সুখি মানুষ ক’জন আছে পৃথিবীতে।’
বিপিএটিসি এর ওয়াক ওয়েটা প্রতিদিন তিন পাক দিতাম। হুদা ভাই টেনিস গ্রাউন্ডে এসে খাতায় দ¯Íখত করে বিদায় নিতেন। মাঝে মধ্যে ঝাড়ি দিতাম;
-‘‘ হাঁটেন না কেন ? এই বিশাল ভুড়িটা তো কিছুটা হলেও কমতো।’’ তাঁর স্বভাব সুলভ জবাব;
-‘‘ বহু কষ্ট করে ভাই এটা বানিয়েছি। আপনি কমাতে চান, কমান। আমি পারবো না। নার্গিস কষ্ট পাবে।’’
কোন দিন তাঁকে হাঁটাতে পারিনি। একদিন তাঁকে জিমনেশিয়ান হলে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম;
-‘‘ সূর্য কোন দিকে উঠেছে।’’ জবাব;
-‘‘ রাজিয়া আপাকে কেউ সংগ দেয়ার ছিল না, তাই।’’
-‘‘ রাজিয়া আপনাকে খেলায় নামাতে পেরেছে, রাজিয়াকে ধন্যবাদ।’’
হুদা ভাই, রাজিয়া দু’জনই আজ স্মৃতি।
সিনিয়র ষ্টাফকোর্স শেষ হলো। আমরা একাডেমিতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম। আমাদের বউ/কর্তা ছেলে মেয়েরা উপw¯’Z থাকবে। আমরা নাচবো, গাইবো, খাবো পরে একাডেমিকে বিদায় জানাবো।
অনুষ্ঠান ঘোষক ফাiæক, ডাক নাম কহিনুর হঠাৎ করেই ঘোষনা করলেন;
-‘‘ এবার রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করবেন মিসেস হুদা, নার্গিস।’’
আমি অবাক হলাম। বহু আড্ডায় এক সাথে ছিলাম। কোন দিন নার্গিসকে গান গাইতে শুনিনি। আরও অবাক হলাম নার্গিস মিনুকে নিয়ে মাইক্রোফোনের দিকে যাচ্ছে। কোন দিন সে গান গেয়েছে এটা আমার জানা ছিল না। গোছলখানাতেও তাঁকে গুনগুন করতে শুনিনি। অবাক হলাম। গান শেষ হলো। বুঝতে পারলাম নার্গিস কোন এক সময় গান গাইতো। এক এক করে সব শেষ হলো। শেষ আইটেম;
-‘‘ কপি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই ................................. ’’
মিউজিকের তালে তালে গানটা বাজছে। কহিনুরসহ আমরা কয়েকজন নাচতে শুiæ করলাম। এক এক করে সবাই যোগ দিচ্ছে। রেক্টার স্যার, রেক্টার ভাবীকেও নাচে নামালাম। অবাক হয়ে দেখি হুদা ভাই নাচছে। একটানা পয়তাwjøশ মিনিট নেচে জামা চুপচুপে ভিজা।
খেয়ে দেয়ে বিদায় নিলাম। কথা ছিল আমরা প্রতিমাসে এ আড্ডাটা চালিয়ে যাবো। কয়েকটা হয়েছিল, পরে আর চললো না। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। যোগাযোগটাও হারিয়ে গেল। শুনেছিলাম হুদা ভাইএর স্পারসোতে পোষ্টিং হয়েছে। দেখা হয়নি। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে একই সংগে আতিরিক্ত সচিব হলাম। আমি নির্বাচন কমিশনেই থেকে গেলাম। হুদা ভাই কোথায় জানি না।
মিনু জানালো, হুদা ভাই এর হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। তিনি ল্যাব এইডে আছেন। তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। তখন বিডিয়ার বিদ্রোহ চলছে। থমথমে অবস্থা। দেখা হলো না, তিনি আইসিইউতে। নার্গিস, বুড়ির সাথে কথা হলো। বুড়িকে জিগাতলায় তাঁর আত্মীয়ের বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে কলাবাগান বাসায় ফিরলাম। আর দেখা হয়নি। শুনলাম, হুদা ভাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
আমার অভ্যাস মতো আমি আজো প্রতিদিন হাঁটি। ধানমন্ডি লেকে হাঁটছি। দেখি হুদা ভাই, হাঁটছেন। থামলাম, জিজ্ঞাসা করলাম;
-‘‘ যZœ করে বানানো জিনিষ কমাচ্ছেন কেন ?’’
হুদা ভাই জবাব দিলেন;
-‘‘ আমি তো চাই না ভাই। কি করবো ডাক্তারদের নির্দেশ। তাঁরা বাসায় থাকতে দেয় না। আমি বাঁচতে না চাইলে কি হবে। তাঁরা মরতে দিবে না।’’
আমার শরীরটা ভিজে ছিলো। হুদা ভাই এর সংগে হাঁটা মানে দাঁড়িয়ে থাকা। তাঁকে বললাম;
-‘‘ আমি ভিজে আছি। দাঁড়ালে ঠান্ডা লেগে যাবে।’’ হাঁসতে হাঁসতে জবাব দিলেন;
-‘‘ চালিয়ে যান।’’
শিÿvভবনে মইনুলহক বার ভুইয়া কাজ করতেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিনু, নার্গিস, শর্মী, ফেরদৌস আপারা সবাই মন্টু ভাই বলে ডাকতো। উচ্চতায় হুদা ভাই এর চাইতে কিছুটা খাটো। তবে খাওয়া, আড্ডা, রসিকতায় কোনটাতেই কম ছিল না। শুiæ থেকেই সব খানে তার ছিল সরব উপস্থিতি। হুদা ভাই এর সংগে তাঁর ছিল আত্মার আত্মীয়তা। মন্টু নাই ক্যান্সার তাঁকেও নিয়ে গেছে।
হুদা ভাই এর ছোট ছেলের সংগে আমার ছেলে ইন্টারনেটে গেমস্ খেলে। সামাজিক ওয়েব সাইটেও তাদের যোগাযোগ ছিল। সে জানালো, হুদা আংকেল মারা গেছেন। দেশের বাড়ী নেত্রকোনা বেড়াতে গিয়ে গোছলখানায় পড়ে মারা গেছে।
লাশ ছেলের জন্য বারডেম হাসপাতালে রাখা ছিলো। কখন দাফন হয়েছে জানা ছিল না। যেতে পারিনি।
ইমাম সাহেব ঘোষনা দিলেন এখন মোনাজাত হবে। হাত তুলেন। হাত তুললাম। ইমাম সাহেব আjøvহ্ তালার কাছে আকুতি মিনতি করলেন।
আমার কোন কিছুই কানে ঢুকলো না। হুদা ভাই এর গাড়ী, বাড়ী, সব কিছু ছিল। ছিল নার্গিস। তারপরও কেন ‘‘মরিবার হলো mva’’ ?
ইমাম সাহেবের গলা শুনতে পেলাম। তিনি আওড়াচ্ছেন।
-‘‘ রাবেবর হামহুমা কামা ............................। আমীন।’’
মোনাজাত শেষ হলো। পলিথিন হাতে ছেলেটা তখনও আমার স্যান্ডেলগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো, সে সারাÿণ পাহাড়া দিয়েছে। স্যান্ডেল পরে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আকাশের নীচে এসে দাড়ালাম।
মিনুর দুই বান্ধবী গাড়ী থেকে নামলেন। নেমেই জানতে চাইলেন;
-‘‘ মিলাদ শেষ।’’ জবাবে জানালাম;
-‘‘ হ্যঁv, মিলাদ শেষ। তোবারক এখনও বাকি আছে। যান ভিতরে গিয়ে দেখা করে আসেন।’’ কথা না বাড়িয়ে তাঁরা ভিতরের দিকে পা বাড়ালো।
মেয়ে দেবযানি, জামাই এসেছে। তাঁদের সাথে কথা বললাম। অনেক দিন পর নার্গিসের ছোট ভাই এর সাথে দেখা। তাঁকে শাইখু বলে ডাকতেই অবাক হয়ে জানতে চাইলো;
-‘‘ আমি কে ?’’
পরিচয় দেওয়ার পর অšÍহীন ওজু হাত মোটা হয়ে গেছি, আগের মত নাই, না না কথা। কোন ফাঁকে সে কেটে পড়েছে বুঝতে পারিনি। সামনে নার্গিসের মেয়ে বুড়ি। জানতে চাইলো;
-‘‘ আংকেল তোবারক পেয়েছেন?’’
বহু কষ্টে নিজেকে সামাল দিয়ে জবাব দিলাম;
-‘‘ মাগো, তোবারক খেতে তোর বাবার মিলাদে আসিনি। আর ওটা আমি খেতেও পারবো না।’’
মিলাদ শেষ। আ‡¯Í আ‡¯Í সবাই চলে গেছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিবো, দেখি হুদা ভাই এর সেই শালিকা একটা বাহনের জন্য অপেÿv করছে। রা¯Ívq কোথাও নামিয়ে দেওয়ার প্র¯Ívব করলাম। ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করলো।
ছেলেকে বাসায় রেখে গেছিলাম। তাঁর জন্য হাতিরপুলের শরমা হাউজ থেকে পিজা কিনবো। গাড়ীতে উঠলাম। মিনু বললো;
-‘‘ হুদা ভাই এর মিলাদের তোবারক খেতে হবে এটা চিšÍv করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।’’
কোন জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না। জবাব জানাও ছিল না।
শরমা হাউজে ঢুকে দু’টো পিজার অর্ডার দিলাম। পিজা নেবার জন্য একটা সোফায় বসে আছি। ভাবছি;
হুদা ভাই সবকিছু নিয়ে ছিলেন। তাঁর সবকিছু ছিল। দারিদ্র তাঁকে তাড়া করে নি। চাকুরীর পর কোথায় উঠবেন এ চিšÍvও তাঁর ছিল না। তবুও চলে গেলেন। ÿzধা, দারিদ্র, হতাশা, বঞ্ছনা, লাঞ্ছনা তাঁর কাছেধারে ছিল না তবুও চলে গেলেন। আমি এ সবের মাঝেই আছি; এসব নিয়েই আছি; তা হলে কেন বেঁচে আছি ? মারা গেলে সবকিছুর উদ্ধে উঠে যেতে পারবো। কি চমৎকার, হঠাৎ ‘মরিবার হলো সাধ’।
ওয়েটার এর ডাকে পৃথিবীতে ফিরে এলাম;
-‘‘ স্যার আপনার অর্ডার রেডি।’’
-‘‘ ধন্যবাদ।’’ গাড়ীতে উঠলাম, কলাবাগানের পথে গাড়ী চলছে।
-‘‘ আমি আজও বেঁচে আছি! কেন ?’’
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||