একটা কুয়া, লেবু গাছ ও সেনিটারি ল্যাট্রিন এর গল্প

Category: Bangladesh Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 9588

কোমড় পর্যন্ত উঁচু ইট, সিমেন্ট ঘেরা কুয়া। পাশে ইটের সুরকি ফেলা হয়েছে। লম্বা মোটা পাটের রশিবাঁধা বালতি কুয়া থেকে পানি তোলার কাজে ব্যবহার করা হয়। কুয়ার পাড়ে পাড়ার ছেলে-বুড়ো, বউ-ঝিরা কলসিতে পানি ভরা, গোসল এবং হাত-মুখ ধুয়ে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই এটা দেখি। আমি যে ঘরটায় থাকি তা থেকে কুয়াটা বড় জোর দশ হাত দূরে। পাশে একটা পেয়ারা গাছ এবং পরপর কয়েকটি লেবু গাছ। বাড়ীর দক্ষিণ দিকে বেশ দূরে শেষ সীমানায় বাঁশের বেড়া, টাটির দরজা, উপরটা পুরোপুরি ফাঁকা একটা সেনিটারি ল্যাট্রিন ছিল। এটাই আমাদের বাড়ী।

সব বাড়িতে পেয়ারা, আম, জাম, লিচুর গাছ আছে। আমাদের বাড়ীটা কুয়া, লেবু গাছ আর সেনিটারি ল্যাট্রিনটার জন্য একটু আলাদা ছিল। আশে-পাশে বাড়ীতে এগুলো ছিল না। বাড়িটাকে আরও একটু আলাদা করেছিল বাড়ীর আঙ্গিনা, কুয়ার দু'পাশে তিনটা নারিকেল গাছ। নারিকেল গাছগুলো আজও আমাদের বাড়ীর পরিচিতি হয়ে আছে। ছোট বেলায় লোকজনকে বলেছি কুয়ার পাড়ে নারিকেল গাছওয়ালা বাড়ীটা সরকার বাড়ী। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে আমার জন্ম। স্থানীয় লোকজন আমার বাবাকে সরকার ডাকতেন। তাই আমাদের বাড়ীটা সরকার বাড়ী হিসাবে পরিচিত ছিল। গোদাগাড়ী বরেন্দ্র মাটি লাল এলাকা। লাল মাটিতে নারিকেল গাছ খুব একটা জন্মে না। তাই নারিকেল গাছ ঐ এলাকায় আর ছিল না বললেই চলে। লেবুগুলো ছিল মাঝারি গোলগোল। লোকে কাগজি লেবু বলতো। প্রচুর লেবু হতো। লেবুর আচার, লেবু, মরিচ ও লবন দিয়ে ভাত ভর্তা, ভাতের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন লেবুর রস চিপে খেতাম। শখ ছাড়াও অনেক সময় তরকারির অভাবে বাধ্য হয়েও খেয়েছি। লেবু খেতে খেতে একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিল। লেবু গাছগুলোতে বছরে ৩ বার ফুল আসতো। ফুলগুলোর গন্ধ ছিল মিষ্টি মাদকতা ভরা। ছেলে বেলায় বেশ উপভোগ করতাম। আরও ভালো লাগতো বোলতা গুলো যখন ভোঁ ভোঁ করে ফুলের উপর ঘুরে বেড়াতো।

ডাবগুলো ছিল বেশ বড়। প্রত্যেক মৌচায় একসাথে অনেক ডাব ধরতো। একটা ডাবে আধ লিটার পানি হতো। ডায়রিয়া, কলেরা বা পেটের অসুখ হলে পাশের বাড়ীর ইউনুস চাচার ডাক পড়তো ডাব পাড়ার জন্য। পেটের অসুখে আমরা তিনবেলা ডাবের পানি খেতাম। ডাব খাওয়ার জন্য ইচ্ছে করে অনেক সময় পেটের অসুখের ভান করেছি। ভান করতে গিয়ে ধরাও পড়েছি। মাঝে মাঝে ডাব পেড়ে একসাথে বিক্রি করতাম। বাদ বাকি গাছে রেখে দেয়া হতো ঝুনা নারিকেল করার জন্য। নারিকেলরে আঁশ ছিল বেশ পুরু। ডালের ঘুটনির জন্য নারিকেলের খোল ছিল ঐ এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। আশে পাশের বাড়ী থেকে খোলের আবদার আসতো মায়ের কাছে। মুড়ি দিয়ে নারিকেল, নারিকেলের নাড়ু প্রায়ই খেতাম। তাই বাড়ীতে নারিকেল-এর খোলের কোন অভাব ছিল না। মা প্রায় সবার আবদার মেটাতেন।

পেয়ারা গাছটার পেয়ারা খুব বড় ছিল না। কিন্তু ধরতো অনেক। বেশ মিষ্টি আর ভিতরটা গোলাপী রংয়ের ছিল। কেমন একটা মাদকীয় গন্ধ ছিল পেয়ারাগুলোতে অন্য কোন গাছের পেয়ারা খেয়ে এমন মজা পেতাম না। পেয়ারা পাকলেই ইদুঁর-বাদুঁড় এর মেলা বসতো। সারারাত কিচমিচ করতো বাদুড়গুলো। ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না, তাদের কিচমিচ আর দাপাদাপিতে। অনেকবার গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছি। বাদুড়গুলোর উপর রাগ হলেও গাছটা কাটা হয়নি।

আমার ঘরটায় দুটো জানালা ছিল। একটা জানালা দিয়ে কুয়ার দু'পাড় দেখা যেত। কুয়াটা ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। সকাল, দুপুর বা বিকালে সুযোগ পেলেই দড়ি বাধা বালতি দিয়ে পানি তুলে বিরামহীন গায়ে ঢালতাম। এভাবে পানি ঢালার জন্য মায়ের বকা খেয়েছি অনেক। কিন্তু পানি ঢালা বন্ধ হয়নি।

একটু বড় হলে সবার সাথে পদ্মায় গোসল করতে যেতাম। গোসল করে এসে ভাত খেয়ে ঘরে ঢুকতেই পড়ন্ত বিকেলে বৌ-ঝিদের কুয়ার পাড়ে গোসল করার দৃশ্য দেখা যেত। অনন্ত সৌন্দর্যভরা এ দৃশ্য! যাদের এ দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি তারা মিস করেছেন অনেক কিছু। ভিজা শাড়ী বুকের সঙ্গে লেগে আছে। কালো লম্বা চুল থেকে পানি ঝরছে, মুখের উপর লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু জলে বিকেলের রোদের মন মাতানো খেলা, দারুন। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এমনি একটা স্বর্গীয় দৃশ্য দেখছিলাম। বিকাল বেলা। পাশের বাড়ির এক ভাবী গোসল করছেন। অন্য গ্রাম থেকে আমাদের পড়াতো এক ভাই সদ্য বিয়ে করে তাঁকে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা করেছেন। গায়ের রং গোলাপী লাল। ভাবী আর দশটা মানুষের চেয়ে একটু খোলামেলা হয়েই গোসল সারছিলেন। অপরূপ এ দৃশ্য। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মা এসে সব মাটি করে দিলেন। জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে।

সকাল বেলার প্রাকৃতিক কাজটা সেরে নেয়ার জন্য আমাদের বাড়ীর মত অদ্ভুত ব্যবস্থা অন্যসব বাড়ীতে ছিল না। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারার ব্যাপারে তাদের মত আমাদের স্বাধীনতা তেমন ছিল না। লোকজন নদীর পাড়ে, বদনায় পানি হাতে বাঁশ ঝাড়েই কাজটা সেরে নিতেন। বেড়া দিয়ে ঘেরা সেনিটারি ল্যাট্রিনটাতে গন্ধ লেগেই থাকতো। প্রায়ই ব্লিচিং পাউডার দেয়া হতো। গন্ধ যেত না কিছু্তেই। সকাল বেলা ঐ গন্ধ ভালো লাগতো না। আর দশটা মানুষের মত নদীর ধারে বা বাঁশ ঝাড়ে কাজটা সেরে নিতে ইচ্ছে হতো। সবার অজান্তে এ কাজটা কয়েকবার করেছিও। অন্যদের করে স্বাধীনতা ভোগ করতে না পারার যন্ত্রণা আর গন্ধকে সাথে নিয়ে বড় হলাম। আমার গর্ব ছিল তেমন কোন অসুখ-বিসুখ আমার হয় না। একবার শীতকালে সন্ধ্যা অবধি মহানন্দায় ডুব দিয়ে চিংড়ি ধরতে গিয়ে নিউমোনিয়া বাঁধালাম। আরশাদ ভাইয়ের কয়েকটা সুঁচ নিতে হলো। কম্পাউন্ডার আরশাদ ভাই বললো-
‌-'এমন নিউমোনিয়ার পর এত অল্পতেই ছাড়া পেয়ে গেলি?‌'
বড় রাগ হলো আমার। বললাম- 'আপনার সুঁচগুলো কে খেয়েছে? আপনি না আমি।'
-'রাগ করছিস্ কেন? আরশাদ ভাইয়ের অনুযোগ।

অন্য কোন অসুখ-বিসুখ আমাকে তেমন পায়নি। আমরা ক'জন বর্ষা-শীত-গ্রীষ্ম সারা বছর স্কুলে উপস্থিত থাকতাম।

৫ম শ্রেণীতে পড়ি। থানার সব স্কুল থেকে বাছাই করা ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের স্কুলে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে আসতো। আশে-পাশের বাড়ীতে যাদের জায়গা হতো না তারা অস্থায়ী তাবু করে স্কুলের মাঠে থাকতেন। সেখানেই গোসল, রান্না-বাড়া খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো।

আমাদের স্কুলের নিয়মটা ছিল একটু আলাদা। স্কুলের ঘরে সব ছেলে মেয়েদের জন্য গণ বিছানা করা হতো। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত সবাই পরীক্ষা শুরুর ১৫ দিন আগে এসে স্কুলে গণবিছানায় উঠতো। খাওয়া-দাওয়া ঘুমানো আর পরীক্ষার প্রস্তুতি এক সংগে চলতো।

আমরা ১২ জন পরীক্ষা দিব। ১১ জন এসে গণবিছানায় ঠাঁই নিয়েছি। এনাম আসেনি। সেকেন্ড মাষ্টার সেতাফুর রহমান স্যারের মাথায় বাজ পড়লো। এনাম সবচেয়ে ভালো ছাত্র। বয়সে একটু বড়। বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁর সবচেয়ে বেশী। সে আসেনি। এখন কি হবে? কি হয়েছে জেনে আসার দায়িত্ব পড়লো আমার ঘাড়ে। এনামের বাড়ী নদীর ধারে মাদারীপুর। স্কুল থেকে ৩ মাইল দূর। প্রতিদিন সে ৬ মাইল পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করে বিদ্যাদেবীর দর্শন লাভ করতো। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছি। উদ্দেশ্য এনামের বাড়ী যাবে।

সকালবেলা অনেক মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তার চিহ্ন স্বগৌরবে অস্থিত্ব জাহির করছে। কোথাও লং জাম্প, কখনও নাক চেপে ধরে শেষে এনামের বাড়ী এসে পৌঁছালাম। এনাম বিছানায় আসাড় হয়ে শুয়ে পড়ে আছে। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে এনামের মা জানালো-'উলা উঠায় ধরছে'। গ্রাম্য কবিরাজ পানি দিতে বারণ করেছেন। আমি পানি দিতে চাইলাম। এনামের মা বললেন,
- 'পানি দিও না বাবা। কবিরাজ মশাই মানা করেছেন।'
- 'এ অবস্থায় ও পানি সবচেয়ে বেশী দরকার।' বললাম আমি।
-'কি জানি বাবা! তোমরা লেখাপড়া শিখে কিছু মানতে চাও না।
মা বিরক্ত প্রকাশ করলেন। শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধে তিনি পানি দিতে রাজি হলেন। এনাম পানি পানি করছে। এনামের মা কাঁশার চামচে করে এক চামচ পানি আনলেন মাটির কলসি থেকে।

-'পানিটা ভালো তো?' এনামের মাকে জিজ্ঞাস করলাম।
-'হ্যাঁ বাবা। কিছুক্ষণ আগে নদী থেকে এনেছি।' মা বললেন। নাক ধরা, লং জাম্প এর কথা মনে পড়ে গেল। এ পানি খাওয়াতে নিষেধ করলাম।
-'বাবা এটা নতুন বসতি। কোন কুয়া নাই। কুয়ার পানি কোনঠে পাব?' মা করুণভাবে বললেন।
- 'তাহলে পানি দেয়ার দরকার নাই।' বললাম আমি।
- 'কি জানি বাবা, তোমাদেরকে বুঝি না। পানি তো পানি।' তিনি আরও রেগে গেলেন।
- 'আমার সংগে ডাব এনেছি। একটা দা দেন। ডাবের পানি দেব।' এবার তাঁর রাগটা একটু কমলো। তিনি একটা দা এনে দিলেন। একটা ডাব কেটে ডাবের পানি তার মুখে দিলাম।
যাওয়ার আগে ইউনুস চাচাকে দিয়ে ৪টা ডাব পড়ে আর কটা লেবু নিয়ে গিয়েছিলাম। আসার সময় এনামের মায়ের হাতে বাকি ডাব আর লেবুগুলো তুলে দিয়ে স্কুলে ফিরলাম।

এ যাত্রায় বেঁচে গেল এনাম। প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষাও দিল। বাংলা, বিজ্ঞান কোন রকম হলেও অংক একটাও মিললো না। প্রাথমিক বৃত্তির রেজাল্ট হলো। আমরা ছয় জন বৃত্তি পেয়েছি। এনাম এর নাম নাই। আমরা যে ছয়জন বৃত্তি পেয়েছিলাম তারা কেউ এনামের মত ভালো ছাত্র ছিলাম না। তবে এই ছয়জনের সবার একটা বিষয়ে মিল ছিল। আমাদের সবার বাড়ীতে কুয়া আর সেনিটারি ল্যাট্রিন ছিল।

হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। মেরিট গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে বেতন ভাতা দিতে হতো না। ৬ মাস অন্তর মাসে ৩৫ টাকা হারে বৃত্তি, বই এর জন্য আরও ২০০ টাকা পেতাম। খাতা, কলম, পেন্সিল কেনার জন্য টাকার দরকার হলে, মা বলতো- 'হাট বারে ক'টা লেবু বিক্রি করে কিনে নিস'।

জ্যামিতি বক্স বা তেমন কোন বড় জিনিষ কেনার দরকার হলে মা ইউনুস চাচাকে ডাক দিতেন। ডাব পেড়ে হাটে পাঠাতেন। ডাব, লেবু গাছ আমাদের জীবনের ছোট ছোট আর্থিক বাঁধা গুলোকে পার করে দিয়েছে। লেবু-পেয়ারার ভিটামিন, কুয়ার বিশুদ্ধ পানি, বেড়া ঘেরা ল্যাট্রিনের স্যানিটেশন আমাকে অন্য সবার চেয়ে কখন আলাদা করে দিয়েছিল, টের পাইনি।

এ ছেড়া কথাগুলো আজ আপনাদের গল্প মনে হবে। কারণ কুয়াটা আর নাই। পেয়ারা গাছ কেঁটে লাকড়ি বানানো হয়েছে। ভাগ্য ভালো, গাছটার বীজ থেকে একটা গাছ আঙ্গিনায় বেশ বড় হয়েছে। লেবু গাছগুলো অনেক আগেই মরে গেছে। বাড়ীতে টিউবওয়েল সংগে পাইপ দিয়ে স্যানিটারি ল্যাট্রিনে পানির সংযোগ দেয়া হয়েছে।