আমতলা

Category: Bangladesh Written by Md. Rafiqul Islam Hits: 9062

জৈষ্ঠ্য মাস, ভর দুপুর। বাহিরে গনগনে রোদ। স্কুল থেকে ফিরে কুয়ার পাশে গোসল সেরে আসলাম। ভাত খেয়ে পড়তে বসার মায়ের নির্দেশ অনেক দিনের পুরানো। বেশীর ভাগ সময় মেনে চলি না। মা মন খারাপ করতেন। আজও মানতে পারলাম না। এদিক ওদিক একটু দেখে বাহির হবো এমন সময়-
-‘ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?’ মা কর্কশ ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন।
-‘আমতলা’ জবাব দিলাম।

আমতলা আমার আত্মার আত্মীয়। আমতলার সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক রয়েছে। অন্য দিনের চেয়ে গরমটা একটু বেশী ছিল। ঘরে টেকা দায়। তাই মা নিজেও বাড়ীর বাহিরে ভিটের আমতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই বাড়ী থেকে বেরুনোর আগে এদিক ওদিক করেও মায়ের  দেখা মেলেনি। কেন জানি মা আজ আর বারন করলেন না।

বাড়ী থেকে ১০০ গজ দূরে হরি কাকার আম বাগান। বেশ ক’টা ফজলি আমের গাছ, কয়েকটা ল্যাংড়া, মোহনভোগ, গোপালভোগ ছাড়াও ক’টা গুটি আম গাছও আছে হরিকাকার বাগানে। গুটি আম সব বাগানেই থাকে। গুটি আম আগে পাকে, এছাড়াও ভালো আচার হয়।

ফজলি আমের গাছের নীচটায় কোন গাছপালা এমন কি ঘাসও ছিলনা। আমতলাটা সিমেন্ট বালু দিয়ে তৈরী ইউনিয়ন পরিষদের লম্বা বারান্দার মত মনে হতো।

হরি কাকার বাড়ী আম বাগান হতে ১ কিলো দূর, পদ্মার পাড়ে। তার বয়স হয়েছে। আম বাগানে খুব একটা আসেন না। হরি কাকার শরীর স্বাস্থ্য আগে ভালো ছিল। কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। হরিকাকা গাঁজার দোকান চালাতেন। তাঁর আম বাগান আমাদের দখলেই থাকতো।

বৈশাখের প্রথম দিক থেকে শুরু করতাম ঝিনুক খোঁজা। তখন পদ্মায় বড় বড় ঝিনুক পাওয়া যেত। ঝিনুক আর পিতলের বদনায় পানি নিয়ে গিয়ে বসতাম ইউনিয়ন পরিষদের লম্বা বারন্দায়। সিমেন্টের উপর ঝিনুকের উঁচু পিঠ ঘষে ছিদ্র করতাম। ঝিনুক ছিদ্রটা ছুরির মতো ধারালো হতো। এ ছিল আমের খোসা ছিলার একমাত্র অস্ত্র। তখন ছুরি বা কাঁচি সহজে পাওয়া যেত না। ঝিনুক দিয়ে খোসা ছিলা গেলেও কেটে ভাগাভাগীর কাজটা দাঁত দিয়েই করতে হতো। এঁটো খাবার খেতে আপত্তি থাকলেও এঁটো আম সবাই খেতাম কোনদিন কেউ আপত্তি করছে শুনিনি।

তখনও গোদাগাড়ীতে রেলগাড়ী আসতো। পদ্মায় জাহাজ ঘাটও ছিল। রাজশাহী হতে আমনুরা হয়ে রেলে গোদাগাড়ী এসে জাহাজে করে লালগোলা গিয়ে ট্রেনে উঠলেই কলকাতা যাওয়া যেত। তখনও আমার রেল লাইন দেখা হয়নি। ছুটির দিন। সকাল থেকেই আমতলায় আছি। মা ডাক দিলেন। অনিচ্ছা নিয়ে আমতলা ছড়তে হলো। মা কাশিমপুরে তাঁর গ্রাম্য অসুস্থ্ ভাইকে দেখতে যাবেন। আমাকে সাথে যেতে হবে। তখন বাহন বলতে ছিল একমাত্র ছইসহ গরুর গাড়ী। কাশিমপুর আমাদের বাড়ী থেকে প্রায় ৪ মাইল দুরে। ভেবে ছিলাম গরুর গাড়ীতে যাবো। মা বললেন- ‘দরকার নাই। হেঁটেই যাব।’ মা হাঁটতে পারেন। হাঁটা পছন্দও করেন। পাড়ার অনেক মুরব্বীরা রসিকতা করে মাকে ‘সাঁওতাল’ এর বেটি বলে ডাকতেন।

আমাদের বাড়ী থেকে ২ মাইল পর আমনুরা-গোদাগাড়ী রেল লাইন পার হয়ে কাশিমপুর। মায়ের গ্রাম্য ভাইয়ের বাড়ী। যাবার পাথে দেখলাম ক’টা আমার বয়সী ছেলে রেলের উপর কাদা দিয়ে কিছু একটা ঢেঁকে রাখছে। দেখা বা জানার সুযোগ হলো না।

মামার বাড়ি এসেছি। মা মামিকে সান্তনা দিলেন। বাচ্চা দু'টোকে আদর করে বাড়ী থেকে নিয়ে আসা খাবার দিলেন। বেশীক্ষণ অপেক্ষা না করে আমরা বাড়ী ফিরলাম।

আমার ভাগ্য ভালো যে ঐ সময় একটা রেলগাড়ী সাপের মত এঁকে বেঁকে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে পার হলো। সাথে সাথে ছেলে গুলো লাইনের কাঁদার নীচ থেকে কি যেন খুঁজে বাহির করলো। দেখা হলো না। মনে মনে কৌতুহল নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।

‘‘মামা কেমন আছে দেখে আসি’’ এই অজুহাত দিয়ে আবারও একদিন রেল লাইনের ধারে আসলাম। কিছু ছেলে আগের মতই ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে ভাব জমালাম। একটু মোটা একটা তার কাঁদা দিয়ে রেলের উপর আটকানো হচ্ছে। রেল গাড়ীর চাপে তারটা চ্যাপ্টা হবে। তারপর ঘষে ধারালো করলে ছুরি হবে। আম ছিল ও কাটার একটা সুন্দর ব্যবস্থা। লোভ হলো একটা ছুরি পাওয়ার। কিন্তু মোটা তার পাবো কোথায়? আমার দুঃখ একজন বুঝতে পেরেছিল। সে নিজের একটা মোটা তার আমাকে দিল। রেল লাইনে তারটা চ্যাপ্টা করে নিয়ে বাড়ী ফিরলাম। পরে ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় ঘষে একটা চাকু তৈরী করেছিলাম। এই চাকুর জন্য আমতালায় আমার আলাদা একটা কদর ছিল। আম থেকে একটা ভাগ চাকুর জন্য পেতাম। এ অমূল্য সম্পদ রক্ষা করতে আমার অনেক কষ্ট হতো। কখনো বই এর ভিতর, কখনও বিছানার নীচে লুকিয়ে রাখতাম। আমের মৌসুম শেষই হলে বারান্দার টিনের চালার নীচে চাকুটা লুকিয়ে রাখতাম। তিন বছর চাকুটা আমার সঙ্গে ছিল। একদিন তা আমার অজান্তেই ছুরিটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল। খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন হয়নি।

হরি কাকার বাগানের পাশেই আইয়ুব বিশ্বাসের বাড়ী। তিনি কবিরাজ, ঝাড়-ফুঁ দিতেন। মাঝে মধ্যে আমতলায় তাকে পুঁথি পড়তেও দেখেছি। অনেক মানুষ বিশ্বাসকে ঘিরে বসতেন। তিনি সুর করে সোনাভানের কিচ্ছা পড়তেন। সোনাভানের কিচ্ছার একটা লাইন আজও মনে আছে- ‘‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার। গুনিয়া দেখা গেল কয়েক হাজার।"

আমতলার মাটিতে গর্ত করে পোকা বাস করে। ছোটবেলায় প্যান্টের ফাঁক দিয়ে নুনুটা বাহির করে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গর্তে পেশাব করতাম। ঝিঁ ঝিঁ পোকা গর্ত থেকে বের হয়ে লাফ দিলেই তাকে মারার উৎসবে মেতে উঠতাম। পেশাব করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা গর্ত হতে বাহির করে মারার কাজটা বেশী দিন চালানো যায়নি। কারন লজ্জা। বড় বিপদে পড়লাম। পেশাব করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা বাহির করার জন্য আমরা বয়স বেশী হলেও ‘গাদি’, ‘বর্দন’ বা গোল্লাছুটের উপযোগী আমি তখনও ছিলাম না।

পরবর্তীতে বাড়ী থেকে ‘বদনা’ তে করে পানি এনে এই পানি গর্তে দিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা মারতাম। এটাও বেশী দিন করতে হয়নি। ‘গাদ্দি’ খেলতে দুপক্ষে অনেক লোক লাগে। বিকালের শুরুতে বা পড়ন্ত বিকালে এত লোক পাওয়া যেত না। তাই বয়সে ছোট হলেও ডাক পেতাম বড়দের দলে। এভাবে কখন বড়দের দলে ঢুকে পড়লাম খেয়াল করতে পারিনি। এর পর ঝিঁ ঝিঁ পোকা মারার আর প্রয়োজন হয়নি।

গদ্দি একটা মজার খেলা। ১৮ হাত প্রস্থের মাঠ। মাঝে ২ হাতপ্রস্ত পাহারাদারদের জন্য রাস্তা। লম্বার দিকে আট হাত অন্তর অন্তর পাহারাদারের রাস্তাসহ ছোট ছোট খোপ। প্রথমে সকলের জন্য একটা খোপ প্রতিপক্ষ পাহারা দিবে। পাহারা হতে বাহির হয়ে পূর্বের ঘরে আসতে পারলেই সে বিজয়ী। আর বাহির হওয়ার সময় পাহারাদার ছুঁয়ে নিলে এ খেলোয়ার মৃত বলে গণ্য হবে। পাহারাদার তাঁর ২ হাতপ্রস্ত পাহারা রাস্তার বাহিরে আসতে পারবে না। এ খেলা দিয়েই আমার আমতলার জীবনের সমাপ্তি।

হরি কাকার বাগানের পাশে একটা বাড়ী। বাড়ী পার হলেই পন্ডিত এর বাগান। পন্ডিত বাড়ীর কিছু ছেলে আমতলায় টেবিল এনে ক্যারাম খেলতো। এ জায়গায় সবার প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে সেখানে ঢুকতে আমার কোন অসুবিধা ছিল না। পন্ডিতের আমতলা ছিল প্রাণহীন। হরিকাকার আমতলার প্রাণ তারা পাবে কেথায়? তাই যাওয়া হতো না পন্ডিতের আমতালা। আমতলায় কোন খেলাই মূখ্য ছিল না। একটা আম পড়লে সবাই খেলা বাদ দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। আমে যে আগে হাত দিতে পারবে সেই হবে আমের মালিক। এ আম কেউ বাড়ী নিয়ে যেতো না। নিজেও একা কোনদিন কেউ খায়নি। তবুও অধিকারের লড়াই থেমে ছিল না।

মাধ্যমিক স্কুলে উঠেছি। পড়ার চাপ বাড়লো। আমার সাথে আমতলার দূরত্বও বাড়লো। মাঝে মধ্যে যাই। পড়ন্ত বিকাল। আমতলায় পাড়ার একটা মেয়ে নাম আলাতনও আগে যেত। আলাতন আমার সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছে। অভাবে তাঁকে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছে।

হরিকাকার ফজলি আমের গাছ থেকে একটা আম পড়লো। দৌড় দিয়ে আমটা ধরেছি। আলাতন গিয়ে পড়লো আমার উপর। পিঠে একটা নরম কিছু অনুভব করলাম। তার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমরা বড় হয়ে গেছি। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলাতন বললো- ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস যে?’
-‘কিছু না। আম নিবি? এই নে।’ বলে আমটা তাকে দিয়ে দিলাম।
আমটা নিয়ে আলাতন বাড়ী চলে গেল। এরপর আর কোন দিন এভাবে আমতলা যাওয়া হয়নি।

বড় হয়ে ভোররাতে পাঁকা আম কুড়াবার জন্য আমতলা গেছি। আমতলায় বাদুড়, চামচিকা, কাঠবিড়ালী, শেয়াল কত কিছুর সাথেই না দেখা হয়েছে। আজকের মত ওগুলোকে সেদিন আলাদা কিছু মনে হয়নি।

হরি কাকার আম বাগান, আমতলা কিছুই আজ আর নাই। আম গাছগুলো কেটে ইট ভাটার লাকড়ি হয়েছে। বাগানটায় ভারত থেকে এসে অনেকে বাড়ী তুলেছে। হরিকাকা আমবাগান বিক্রি করে ভারত চলে গেছেন।

আমতলার পাশ দিয়ে আমাকে বাড়ি যেতে হয়। চোখ পড়লেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়।