আমি অবসরপ্রাপ্ত সচিব। ৩১.১২.২০১৩ তারিখে আমার স্কুলের কেরানী সাহেবের দেয়া নির্ধারিত বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। মাস খানেক আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আমার পিআরএল মঞ্জুর করে রেখেছিল। জোর গুজব চলছিল চাকুরীর বয়স আরও এক বছর বাড়বে। অনেকে বললেন;
- “চাকুরীর বয়স না বাড়লেও সরকার কিছু সচিবকে রেখে দিবেন। স্যার আপনার যাওয়া হচ্ছে না।’’
জবাবে বললাম,
- “ভাইরে আমার পিআরএল আদেশ জারী হয়ে গেছে।”
আমার পিএস কিবরিয়া, তাঁর কাছে আমার পারসনাল নথিটি আছে। সে নেড়ে চেড়ে দেখেছে। সে বললো;
- “স্যার এমন আদেশ ২০১১ সালেও ইস্যু হয়েছিল।”
কথা না বাড়িয়ে আলোচনার ইতি টানলাম। গুজবে কান না দিয়ে পিআরএল এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কোন সংস্থা থেকে কোন বিদায় নিবো না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কয়েকটা সংস্থার গভর্নিং বডির সভার নথি অনেক দিন ধরে এসে পড়ে আছে। সভাগুলো করা দরকার। কোন চিন্তাভাবনা না করে সভার তারিখ দিয়ে ফেললাম।
এনআইবি এর বোর্ড সভা শুরুর আগেই আমার বিদায়ের সুর বেজে উঠলো। প্রথমে ভেবে ছিলাম এটা তা হলে বিদায়ী বোর্ড সভা। পরে তাও থাকলো না। বোর্ড সভা শেষে তারা একটা বিদায় আয়োজন করলো। আমাকেও থাকতে হলো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে আমার বিদায় অনুষ্ঠান। আমি প্রধান অতিথি। বিদায়ী অতিথিকে ফুলের তোড়া, কর্মকর্তা, মহাপরিচালকের বক্তব্য, টোকেন উপহার কোনটাই বাদ গেল না।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথায় বার বার ফুটে উঠছিল, আমি এটা করেছি, আমি ওটা করেছি। একজনতো বলেই বসলেন আমি না কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে সফল সচিব। তাঁদের কথাবার্তা শুনে অবাক হচ্ছি।
চাকুরী করেছি মাত্র। সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিছু ল্যাব তৈরী হয়েছে। ল্যাবগুলো উঁচুমানের। টাকা সরকারের, প্রকল্প পরিচালক কাজ গুলো সমন্বয় করেছেন। আমি কি করেছি জানি না। তবুও তারা বলছে। হয়তো এভাবেই বলতে হয়।
দেড়বছর আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে যোগদানের সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করার পর এখনকার ম্যান্টেট আইন-কানুনগুলো জানার চেষ্টা করছি। ম্যান্ডেট টা মোটামুটি এরকম;
- “দেশকে বিজ্ঞান মনষ্ক করে গড়ে তোলা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তর করা।”
আমি এজন্য কি করেছি? ক’দিন আগে ভারতীয় সিআরএস এর মহাপরিচালক, সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ব্রহ্মচারিয়া ঢাকায় এসে গর্বভরে বলেছিলেন,
-“আমরা স্পেস সাটেল পাঠাচ্ছি।”
তিনি বাঙ্গালী। ভারত সরকারের বিধান অনুযায়ী ইংরেজীতেই কথাবার্তা বলেন। শব্দ চারটি তিনি বাংলায় বললেন।
আকাশে ভারতীয় স্পেস সাটেল যাত্রা শুরু করেছে। দেশ জুড়ে হইচই। চাঁদে একজন মানুষের ছবি দেখা গেছে। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে আমরা সত্য মিথ্যা অনেক কিছু বলি। কেউ শুনে, কেউ প্রতিবাদ করে, কেউ মুচকি হেসে চলে যায়।
অবাক হলাম, ঘটনাটা অনেক মানুষ বিশ্বাস করছে। কেউ মুচকি হাসার সাহস পাচ্ছে না। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা।
বিদায় সভায় এরা কেউ আমার ব্যর্থতার দায়ভারের কথা ভুল করেও উচ্চারন করলো না। গ্লানি নিয়ে আমার মাথা হেঁট হয়ে আছে। ঠিক তখন আমার বিদায় সম্বর্ধনায় আমার সাফল্যের কথা বলা হচ্ছে। বিচিত্র এই দেশ।
মিরপুর রোডে রাসেল স্কয়ার এর পাশে রাখা ডাস্টবিনে সকালে মানুষের মত কিছু জন্তু, কুকুর আর কাকের যুদ্ধ দেখতে দেখতে হাটতে যাই। আজও এ দৃশ্য চোখের আড়াল হয়নি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাথাটা হেঁট হয়ে থাকে। ওদিকে তাকাই না। সরকারের সবচেয়ে বড় আসনে থেকেও কিছু করতে পারিনি।
সবার বলা শেষ। এবার আমার পালা। উপরের ঘটনা দু’টো তুলে ধরে আমি আমার ব্যর্থতার কথা বললাম, গ্লানির কথা বললাম। নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ করলাম।
- আমি যা পারিনি, আপনারা পারবেন। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী ৫ কোটি মানুষের মুখে আপনারা হাসি ফুটাবেন। আমি জাহান্নামে বসে জানলেও আপনাদের অভিবাদন জানাবো। সাবাস বাংলাদেশ।
বোর্ড সভার নাম করে আরও একটা প্রতিষ্ঠান বিদায় আয়োজন করলো। বোর্ড সভার একজন সম্মানিত সদস্য বললেন,
- ওয়াই-ফাই জোন করে কানেকটিভিটি সৃষ্টি করে যুগান্তকারী অবদান রেখে গেলেন। আমরা আজীবন স্মরণ করবো।
ডিজি সাহেব তার বক্তব্যে বললেন,
- “টাচ স্ক্রীন টিভি চালু হয়েছে। ছবিতে হাত দিলেই বিজ্ঞান সম্বন্ধে মজার মজার কাহিনী দেখতে পাচ্ছে। অনক বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্প মামলা মোকদ্দমায় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ প্রকল্পটি সফল ভাবে শেষ হতে যাচ্ছে।”
কথাগুলো ঠিক। আমি বুঝি না, কেন প্রকল্প গুলো বন্ধ হয় ? কেন বন্ধ ছিল ? আমি শুধু আমার কাজগুলো করেছি। তাতেই প্রকল্প শুরু ও সমাপ্ত দু’টোই হলো। তা হলে আগে হয়নি কেন? বুঝিনা। শুধু বলেছিলাম;
- “মামলা শেষ করেন। প্রকল্প শেষ করতে চাই। বর্তমান ঠিকাদারকে কাজ দিবেন না নতুন করে দরপত্র করবেন। আদালত ঠিক করবেন। দয়া করে আদালতের সাথে যোগাযোগ করে কাজগুলো শেষ করবেন।”
এ কথাগুলো না বললে কি বলতাম। আমার করার কি ছিল? এটা যদি আমার অর্জন হয় তা হলে কাজ কোনটা ?
আজকে অখন্ড অবসরে বসে বসে ভাবি, আমরা নষ্টামি, ভন্ডামি সবকিছু করি। কাজ করি না। এটা দেখতে দেখতে মানুষ ধরে নিয়েছে, এরা কোন কিছু করে না। হঠাৎ হঠাৎ নড়ে চড়ে বসে, কিছু করার চেষ্টা করলে মানুষ ধন্য হয়। একে মানুষ তার বেতনের বিনিময়ে কাজ মনে করে না। বরং এটা মহত্ব। আমাদের অবদান। না করলেও বেতন পাওয়া যায়। করেছি তাই এরা ধন্য।
অবসরে যাওয়ার আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখে ছিলাম। সরকারী কোন সুবিধা ভোগ করবো না। গাড়ী থেকে নেমে ড্রাইভার, গানম্যান-আপেল ও আলমগীরকে বিদায় দিলাম। তারা দু’জনেই অঝোরে কাঁদছিল। বুঝতে পারছিলাম না। তাঁরা কাঁদছে কেন? তারা দু’জনই সরকারী চাকুরী করে। আমার সাথে শুধু থাকবে না। আমি তাদের কোন আলাদা বেনিফিট দেইনি। তারপরও এই অনুভুতি।
অবসরের প্রথম দিন। বাসায় বসে ছিলাম। যথারীতি সকালে হেঁটে এসে গোসল শেষে কাপড় পরে নাস্তার টেবিলে আসলাম। টেবিল ফাঁকা। বউ জিজ্ঞাসা করলো,
- “এত সকালে কাপড় পরে রেডি হয়েছো। কোথাও যাবা ?”
ভুলে গেছিলাম আমাকে অফিসে যেতে হবে না। আমি অবসরপ্রাপ্ত। সোফায় বসে সকালের কাগজগুলো পড়ছিলাম। নাস্তা খেয়ে আবারও সোফায় বসলাম। কাপড় চোপড় বদলাতে ইচ্ছে করছিল না। অবসর জীবনের অনুভূতিগুলো লিখবো। কাগজ কলম বাহির করলাম। লিখতে পারলাম না। এক সময় বাহির হলাম। মিরপুর রোড দিয়ে হাঁটছি। একবার ভাবলাম, নিকেতন গিয়ে মেয়ে নাতিকে দেখে আসি। কোন বাস ধরে যেতে, জানি না। ঠিক করলাম, একটা সিএনজি চালিত অটোরিক্সা নিয়ে যাবো। একটা অটোরিক্সার পাশে এসে থমকে দাঁড়ালাম। গাড়ীতে গেছি, জায়গা চিনি না। রোড নম্বর এলাকা কিছুই জানি না। অটো রিক্সাকে কি বলবো? কোথায় যাবো? ভাবনাটা বাদ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
নির্বাচন কমিশনে ৪ বছর কাজ করেছি। হাটতে হাটতে তাদের সাথে দেখা করতে গেলাম। তাঁদের আচরণে মনে হলো আমি এখনও নির্বাচন কমিশনে আছি। বাতেন চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে ডেপুটেশনে নির্বাচন কমিশনে সংযুক্তিতে এসেছে। একজন টেলিফোনে পরামর্শ চাচ্ছে,
- একজন ইউনয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মিলাদ এর আয়োজন করেছে। এটা বন্ধ করবে কিনা।”
বাতেন তাঁকে আচরণ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বললেন। ভুলে গেছিলাম আমি তিন বছর আগে নির্বাচন কমিশন ছেড়ে এসেছি। বাতেনকে বললাম;
- “মিলাদ বন্ধ করলে কথা উঠবে। এটা নির্বাচনী আচরণ বিধির সংগে সম্পৃক্ত নয়। অভিযোগ না আসলে মিলাদ বন্ধ না করাই ভালো।”
শুনে মুচকি হেসে উপ-সচিব কাশেম বললো,
- “এজন্যই স্যার আপনাদের প্রতি মূহুর্তে ফিল করি।”
বুঝলাম মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। পরে বললাম,
- ‘‘সরি, আমার মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।”
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবাই নেমে এসেছে, বিদায় জানাতে। সবার জিজ্ঞাসা;
- স্যার গাড়ী কোথায়?”
কি বলবো, হেঁসে জবাব দিলাম,
- আমি অবসরপ্রাপ্ত। এখন আম জনতা।”
দাড়ানো অনেক সাংবাদিক। কুশলাদি শেষে জানতে চাইলো,
- “কি করবেন?” হাসতে হাসতে জবাব দিলাম;
- “জানি না।”
কোন রুটে কোন বাস চলে জানি না। বলতে পারি না ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুরের রিক্সা বা অটো-রিক্সার ভাড়া কত, যা চায় তাতেই যেতে হবে। সরকারী গাড়ী, ড্রাইভার, গানম্যান, পিএস, পিও, পিয়ন নিয়ে কেটেছে প্রায় এক যুগ। টিকিট কাটা থেকে ব্যাংকের টাকা তোলা কোনটাই করা লাগেনি কোন দিন। এভাবেই হারিয়ে ফেলেছি জীবনের সব ধরনের দক্ষতা ও সক্ষমতা। ৩২ বছর পর আজ হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন অকর্মন্য মানুষ হিসেবে। সেদিন কামাল সাহেব এসেছিল। চাকুরী জীবনে আমার প্রথম শাখা সহকারী। বেশ ভালো আছেন।
তার গাড়ী ছিল না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এসেছেন, গেছেন। গাড়ী নম্বর, রুট, ভাড়া মুখস্থ। বড় দাবী নিয়ে বললেন,
-“এখন তো অনেক সময় পাবেন। একদিন বাসায় আসেন।”
জবাবে জানালাম,
-“পুলের গাড়ীর ভরসা নাই। কেমন করে আসবো?”
“এখান থেকে এই বাস ধরে ওখানে নেমে সামনে গেলেই ……………………..”
গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ঢাকা শহরের অলিগলির রুট। আমি জানি না ব্যাংক থেকে পাবলিক হিসাবে কিভাবে টাকা তুলবো। তাঁর ঢাকা শহর মুখস্ত। মুগ্ধ হলাম।
সব কিছু দেখে শুনে নিজের উপর রাগ, ঘেন্না হলো। এখন হয় আমাকে আগের লোকজনের দ্বারস্ত হতে হবে, না হয় আমাকে নতুন লোক নিয়োগ করতে হবে। আমার নিজের করার সামর্থ নাই। নতুন সচিব আসবেন, তাঁর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। আগের লোক কাজ করে দেয়ার সময় কোথা থেকে পাবে। নিজে লোক নিয়োগ করবো, টাকা পাবো কোথায়। ভাবনাটা আমাকে আছন্ন করে রেখে ছিল। রাস্তা পার হচ্ছিলাম, একটা রিক্সা ধাক্কা দিল। চালকের কাছে মাফ চেয়ে নিলাম। ভাগ্যিস ও গাড়ী ছিল না।
সরকারী চাকুরী করেছি, প্রতিদিন নিজের দক্ষতা সক্ষমতা হারিয়ে অচল অপদার্থ হয়েছি। যাদের মনে ছিল যারা মেনে নিতে পেরেছিল তারা এ অক্ষমতাগুলো পূরণ করার জন্য অর্থের সংস্থান করেছে। তাদের একটা বদনাম আছে ঘুষখোর। তবে অক্ষমতাগুলো নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নাই।
অক্ষমতাগুলো কাটাতে চাই। শরীরে কুলায় না। গতি বাড়ে না। অক্ষমতাগুলো পীড়া দিতে থাকে।
অবসরে যাওয়ার আগে অফিস কলিগকে প্রায় বলতে শুনেছি;
-“আপনাকে একদিনও বসে থাকতে হবে না স্যার। আপনি না চাইলেও ধরে নিয়ে যাবে।”
শুনে নিজে নিজে হাসতাম। আমি জানতাম সময় কাটানো আর স্বাধীনতা ভোগ করা, দুটাই আমার জন্য কষ্টকর হবে। লিখা লিখি করি, তাই সাহস ছিল সময় কাটানো কোন সমস্যা হবে না। লিখা লিখি করে সময় কাটিয়ে দিব। অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকেও সময় পেলেই লিখতাম। বারো বছর ধরে সাথে পিও, স্টেনোটাইপিস্ট, পিয়নের কোন অভাব বোধ করিনি। লিখা শেষ টাইপও শেষ। পিএস প্রুফ দেখে এনে দিয়েছে। আমার কাছে দ্বিতীয় প্রুফ। কষ্ট কম হয়েছে। সামান্য সংশোধন করে নেটে তুলে দিয়েছি। বিদেশে লেখাপড়া করার সুবাদে ইংরেজী কম্পোজ করার অভ্যাস, টাইপ স্পিড ভালোই ছিল। সরকারী চাকুরীতে এসে তাও হারিয়েছি। বাংলা কম্পোজ টাইপ কোনটাই শিখা হয়নি। অতি গোপনীয় কিছু কাজ করার জন্য বাংলা টাইপ শিখার উদ্যোগ নিয়ে ছিলাম। পিএ সাহেব বললেন,
-“ছোট খাটো টাইপ করবেন। এজন্য টাইপ শিখার কি দরকার। অভ্র ব্যবহার করে চালিয়ে নিতে পারবেন।”
ভাবলাম যুক্তিটা মন্দ না। টাইপের মত সামান্য কাজে এতো বেশী সময় দিলে পলিসি এর কাজে সময় দিতে পারবো না। রাজি হয়ে পিএ সাহেবকে বললাম ল্যাপটপে অভ্র ফনেটিক্স ইনস্টল করে দিতে। অভ্র ফনেটিক্স ইনস্টল হয়ে গেল।
ফেসবুক, ছোট খাটো চিঠি পত্র লিখছি। লোকে ভাবছে সাবাস বাংলাদেশের সচিব পর্যন্ত বাংলা ইংরেজী সব কিছুতে আইসিটিতে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
এই লেখার তিন পৃষ্ঠা শেষ করেছি। ভাবলাম টাইপ শুরু করা দরকার। ল্যাপটপটা খুলে অভ্র দিয়ে শুরু করলাম। তিন ঘণ্টা পার করেছি। দেখলাম আধা পাতা শেষ করতে পারিনি। বুঝলাম আমার দ্বারা হবে না। কাকে দিয়ে টাইপ করাবো। শনিবার নভোথিয়েটার খোলা। মহাপরিচালক আরশাদ হোসেন এনডিসি, ব্যাচমেট বন্ধু মানুষ, একসাথে কাজ করেছি। তার দপ্তর থেকে টাইপ করানো যায়। কোন কথা চিন্তা ভাবনা না করে কাপড় চোপড় পরে বাহির হলাম। গাড়ী ঘোড়া নাই। হাটছি, ভালো লাগছিল না। একটা সিএনজি চালিত অটো রিক্সাকে বললাম,
-“নভোথিয়েটার যাবেন?”
চালক আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“ওটা আবার কোথায়?”
ভাগ্যিস জানা ছিল। জবাব দিলাম;
-“বিজয় স্মরণীতে, সামরিক জাদুঘরের পাশে”। যেতে রাজি হলো। জানতে চাইলাম;
-“ভাড়া কত দিতে হবে?” জবাবে জানালো,
-“১৫০/- টাকা।”
ভাড়া কত জানি না। বেশী কম বলে ফেললে সে রাগ করে না বলে ফেলতে পারে। এ শংকায় কোন কথা না বলে উঠে পড়লাম। গেটের কাছে সিএনজি চালিত অটো রিক্সাটাকে থামতে বললাম। দারোয়ান এসে আমাকে দেখে অবাক হলো। তারপর নিজেই বললো,
-“স্যার ভিতরে চলে যান।”
তাঁকে বিনয়ের সাথে না করে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মহাপরিচালক সাহেব এর রুমে গেলাম। কথাবার্তা শেষে তাকে আসার কারণ জানালাম। সে লিখাগুলো নিয়ে একজন টাইপিস্টকে দিলো। টাইপ শেষে প্রিন্ট আউট আমাকে দিয়ে গেছে। আমি বিদায় নিতে চাইলাম। আরশাদ আমাকে নামিয়ে দিবে। তাকে বললাম, সরকারী চাকুরী করতে এসে সবকিছু হারিয়েছি। অন্যরা অনেক কিছু অর্জন করেছে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাকে টিকে থাকতে হবে। আমাকে ওগুলো অর্জন করতে দে। অগত্যা সে রাজি হলো। আমি হাঁটতে হাঁটতে নভোথিয়েটার থেকে কলাবাগান পৌঁছালাম।
২ তারিখ, বাড়ি ভাড়া, পেপার, ডিস বিল দিতে হবে। টাকা তুলতে হবে। চাকুরী জীবনে কখন ব্যাংকে নিজে গেছি আজ আর মনে পড়ে না। টাকা জমা আর তোলার জন্য কি করতে হয় তাও মনে নাই। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একজন অফিসারকে বললাম, আমি একজন অবসর প্রাপ্ত সচিব। টাকা তুলবো জানি না কি করতে হবে। ভদ্রলোক হেঁসে বললেন,
-“খুব স্বাভাবিক কোন দিনতো ব্যাংকে আসতে হয়নি। হয় আপনার লোকজন এসেছেন, না হলে আমরা গেছি। চেকটা দিন আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”।
কর্মকর্তাকে চেকটা দিলাম। তিনি তার একজন কর্মচারীকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কাজ করছেন। আমি অসহায়ের মত বসে আছি। কিছুক্ষণ পর কর্মচারী টাকাটা এনে কর্মকর্তাকে দিলেন। তিনি গুণে আমার হাতে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম।
সিএনজি অটো রিক্সায় উঠে নিজেকে ধিক্কার দিলাম। ব্যাংক ডিলিং তার সক্ষমতাও আজ আর আমার নাই।
গুছিয়ে ভালোভাবে লিখতাম তাই বিসিএস এ প্রথম বারেই চাকুরী হয়ে গেল। গণি, আমার বন্ধু সেও পরীক্ষা দিয়েছিল। তার হলো না। পরে কয়েকবার সরকারী চাকুরীর জন্য চেষ্টা করলো। তাও হলো না। শেষে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে যোগ দিল। আমি প্রতিদিন শাখা সহকারীকে বকা দিতাম,
-“এটা কি করেছেন? যান ঠিক করে নিয়ে আসেন?”
কেরানী সাহেব তার মত করে ঠিক করে নিয়ে আসে। মনে ধরে না। সময় নাই দস্তখত করি। অন্য দিকে গণি প্রতিদিন বসের ঝাড়ি খায়। সন্ধ্যায় ফ্লোরাতে বসি, আলাপ হয়। গণি তার কষ্টের কথা বলে। মাঝে মাঝে শান্ত্বনা দেই,
-“চেষ্টা কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
গণি চুপচাপ থাকে। গণি চেষ্টা করতে করতে অর্জন করেছে অনেক। আজ সে চীফ এক্সিকিউটিভ। আমি ঝাড়ি মারতে মারতে সব ধরনের সক্ষমতা হারিয়ে একজন অথর্ব।
রাজনীতিবিদরা বেশীর ভাগই প্রাইভেট সেক্টরের মানুষ। তাঁরা মাঝারি মানের লোকজন নিয়ে কাজ করলেও ঘষে মেজে ধারালো করে নিয়েছেন। সরকারে এসে আমরা যারা পুরানো ইতোমধ্যে সবকিছু হারিয়ে বসেছি, তাদের পছন্দ করতে পারেন না। তারা বাহির থেকে লোক আনতে চান। যাদের আনতে চান তারাও আমাদের সাথে বিসিএস দিয়েছিল। কলিফাই করেনি। আজ তাদেরকেই দরকার।
আমরা মানতে চাই না, আজ তারা আমাদের চেয়ে যোগ্য। এক সময় তারা আমাদের চেয়ে যোগ্য ছিলেন না। প্রতিবাদী হয়ে উঠি। প্রতিরোধ গড়ে তুলি। রাজনীতিবীদগণ বাহির থেকে লোক আনার চিন্তা বাদ দেন।
সদ্য যোগদান করা নবীন কর্মকর্তারা তখনও তাদের যোগ্যতার ছাপ রাখছেন। রাজনীতিবিদগণ তাদের উপর ভর করে বসেন। এক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা চলে আসে তাঁদের হাতে। আমরা বড়রা মেনে নিতে পারি না। আক্ষেপের সাথে বলি;
-“দেশ আজ কচি কাঁচাদের হাতে।”
কোন দিন প্রশ্ন করিনি,
-“কেন রাজনীতিবিদরা বাহির থেকে লোক আনতে চান।”
-“কেন তারা কচি কাঁচাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।”
-“কেন কচি কাঁচারা দেশ চালায়?”
আমরা বোধ হয় ব্যর্থ হয়েছি। অক্ষমতার দায়ভার নেয়া সবচেয়ে কঠিন। আমরা কেউ নিতে চাই না তাই একে অপরকে দোষারোপ করি। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই অবসর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সরকার থেকে বিদায় নেয়ার পর আমাকে কিছু করতে হবে। ভালো ভাবেই জানতাম। প্রথম কারণ আর্থিক। ঢাকায় ছেলেটার পড়াশুনার তাগিদেই থাকতে হবে। পেনশন হিসাবে যা পাবো তা দিয়ে বাড়ীভাড়া, খাওয়া দাওয়া, পড়া, ঔষধ পত্রের খরচ চলবে না। দ্বিতীয় কারণ, সময় কাটানো। ৩২ বছর এক ভাবে জীবন কেটেছে। হঠাৎ করে বাড়ীতে বসে বসে সময় কাটানো যাবে না। লিখা লিখি করি বটে তবে বন্ধ মনের কল্পনা দিয়ে লিখা হয় না। মানুষ, সমাজ, আইন নীতি জানা দরকার। তাই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একমাত্র লিখা লিখিকে পেশা হিসাবে বেছে নেয়ার সাহস করতে পারছি না।
৭০ এর দশকের পশ্চিম বংগের লেখক নিয়ে বেশ মজার একটা জোকস মনে পড়ে গেল। লোভ সামলাতে পারছি না। হয়তো জোকসটা জীবনে অনেকবার শুনেছেন। যারা শুনেছেন তাদের বিরক্তি ঘটানোর জন্য ক্ষমা প্রার্থী। তবুও বলছি।
এক লেখকের বেশ কয়েক দিন থেকে পায়খানা হয় না। ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার যথারীতি জোলাপ দিলেন। কোন কাজ হলো না। অবস্থা ভালো না। ছেলেকে পাঠালেন। ডাক্তার সব শুনে সর্বোচ্চ ডোজের জোলাপ দিলেন। তাতেও কোন কাজ হলো না দেখে লেখক আবার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে পাঠালেন। সব শুনে ডাক্তার চিন্তায় পড়ে গেলেন। জোলাপের যে ডোজ দেয়া হয়েছে তাতে পেটে কিছু থাকলে কাজ হওয়ার কথা। তা হলে কি লেখক ঠিকমত জোলাপ খাননি। ডাক্তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“তোমার বাবা ঠিকমত ঔষধগুলো খেয়েছেন?”
জবাবে ছেলেটি বললো;
-“হ্যাঁ ডাক্তার কাকু। আমি নিজ হাতে বাবাকে ঔষধগুলো খাইয়েছি।”
ডাক্তার সাহেব নিশ্চিত হলেন, পেটে কিছু নাই। জোলাপ নয় পেটে কিছু দরকার। পকেট থেকে পঁচিশ পয়সা বের করে দিয়ে ছেলেকে বললেন,
-“এই নাও। ঔষধ লাগবে না। মুড়ি কিনে দিবে। কাজ হবে।”
লিখা লিখিকে পেশা হিসাবে নিলে কাগজ কলম জোগাড় করাসহ টাইপের কাজটাও করে দিতে হবে।
চাকুরীর ধান্ধায় ঘুরতে হবে। এতাগিদ থেকেই আমি প্রফেশনাল সিভি তৈরী করছিলাম। ৩১.১২.২০১৩ তারিখে অবসরে যাবো। ২৭.১২.২০১৩ তারিখে সিভি এর খসড়া তৈরী করেছি। নামের পাশে লিখা, সাবেক সচিব। একটা কপি হাতে করে বাসায় আনলাম। আমার ছেলে নেড়েচেড়ে দেখে বললো;
-“বাবা এ সিভি কারো কাছে দিলে বলবে, আমার দরকার নাই আপনি চালান।”
আমি হাসলাম। কোন জবাব দিলাম না। সরকারের সচিব পদের জন্য পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত যোগ্যতা ব্যাচেলর্স ডিগ্রী। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হতে মাস্টার্স লাগে। তারা জীবনে কোন দিন সচিব হবেন না। কিন্তু ব্যাচেলর্স ডিগ্রী দিয়ে সহকারী কমিশনার হওয়া যায়। তারা সবাই প্রথম দিন থেকে স্বপ্ন দেখেন সচিব হওয়ার।
সিভি-টা দেখে আমারও মনে হয়েছে সচিব হওয়ার জন্য ডিগ্রী, ট্রেনিং এর পরিমাণ বড্ড বেশী হয়ে গেছে। এত না হলেও চলতো। তাই অনেক ছোট খাটো ডিগ্রী, ট্রেনিং, পাবলিকেশন বাদ দিয়েছি। তারপরও সিভি এর এই দশা। আর কমাতে পারলাম না। কি করা। কষ্ট করে ডিগ্রীগুলো অর্জন করেছি বাদ দেই কেমন করে?
প্রফেশনাল সিভি দেখে ছেলে বললো;
-“এত ভালো ভালো না।”
বিদায় অনুষ্ঠানেও উপসচিব মোস্তাফিজ বলেছিলো;
-“এত ভালো ভালো না।”
আমার সিভি রিজ। আমি প্রফেসনাল। এ সবের সাথে ভালো খারাপ কোথা থেকে যোগ হলো বুঝলাম না।
সচিবের ভারগুলো আজো কাঁধে, হারিয়ে ফেলেছি ভারগুলো সরানোর দক্ষতা সক্ষমতা। ভালো মানুষের তকমা ঘাড়ে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। তাকিয়ে দেখে, আর বলে,
-“ওতো ভালো, ভালো না।”
-----------xx-----------
শ্রীপুর আর রূপপুর; দু’টোই বাংলাদেশের দু’টি গ্রাম। একটা গাজীপুর জেলায়, অন্যটা পাবনা জেলায়। নামে কি অদ্ভুত মিল! শ্রী, রূপ দু’টোই সৌন্দর্যের অপর নাম। আসলেই সুন্দর দু’টো গ্রাম। গাছ, লতা-পাতা দিয়ে ঢাকা নয়নাভিরাম দুটো জায়গার নাম শ্রীপুর, রূপপুর। শ্রীপুর-রূপপুরকে ঘিরে জড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের দু’টো ইতিহাস। ঘটনাচক্রে আমিও জড়িয়ে পড়েছি নয়নাভিরাম এই দু’টো গ্রামের সাথে।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||
We have 59 guests and no members online